এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ৫

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ৩১৯ বার পঠিত
  • হঠাৎ করে কুসুমের মনে আসে, গোপনে কিছু বাঙালি ছেলে চট্টগ্রাম কালুরঘাটে একটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুলেছিল। সেটা একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়। অনেক কসরৎ করে রেডিওর কাটা বারবার এদিক ওদিক করে একটি ক্ষীণ আওয়াজ পান। কানে রেডিওটা চেপে ধরে বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ।
    রেডিও থেকে শুনে যতটুকু বোধগম্য হোল, পুতুল এবং নার্সটিকে জানালেন। ওদের মুখ ভয়ে ত্রাসে শুকিয়ে প্রায় আমসির মতন। রান্নাঘরে যা আছে তাই ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। জানেন না, সামনের দিনগুলো কী দুরাবস্থায় কাটবে। আরেকটি দিন এবং রাত কাটে আতঙ্কের সাথে।

    (ছয়)
    পরদিন ২৭ শে মার্চ কয়েকঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পান লোকজনের পড়িমড়ি করে ঢাকা শহর ত্যাগ করার ধুম। কিছুক্ষণ পরেই নাসিমা আপা এসে উপস্থিত হন। বলেন, 'ঢাকা শহরে বাড়িঘর পোড়ানো হচ্ছে, বোম্বিং হচ্ছে। ক্লিনিকে থাকা নিরাপদ নয়। হাসপাতালে থাকা এখন অনেক শ্রেয়। ক্লিনিকের কর্মচারীরা এখন কেউ ভয়ে আসতে চাইবে না।'
    নাসিমা আপা মিটফোর্ড হাসপাতালের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরামর্শ দিলেন, ওখানে গিয়ে ভর্তি করে দেবেন কুসুমকে। কিন্তু পুতুলকে তো ওরা থাকতে দেবে না। পুতুল বলে, 'আমি বাইরে বসে থাকবো। নাসিমা আপা - আপনি সেটার ব্যবস্থা করে দিন। আমি দিদিভাইকে ছেড়ে এখন কোথাও যেতে পারবো না।'
    কথাবার্তা বলতে বলতেই মানিক ঘরে ঢোকেন হন্তদন্ত হয়ে। কুসুম লক্ষ্য করেন মানিকের চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে একটা যেন অজানা আতঙ্ক জোর করে ভিতরে চেপে রেখেছেন।
    সব শুনে উনি নাসিমা আপাকে বলেন কুসুমকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে। উনি দু'একদিনের মধ্যে আসবেন। পুতুলকে নিয়ে এখন কেরানীগঞ্জে গিয়ে রেখে আসবেন। তারপর যাবেন গুলবাগে।
    পুতুল তখন জেদাজেদি করতে থাকে, গুলবাগে মানিকদার সাথে যাবে। মানিক অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু পুতুল শুনতে চায় না।
    পুতুলের মনে সন্দেহ জাগে। জিজ্ঞেস করে, 'মানিকদা, গুলবাগের খবর সব ভালো তো ?'
    মানিক হঠাৎ পুতুলের এ প্রশ্নে থতমত খেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ - সব খবর ভালো। ভালো কেন হবে না ?'
    কুসুম বুঝতে পারেন মানিকের মুখ দেখে এবং কথাবার্তা শুনে, বোধহয় সব খবর ভালো নয়। পুতুলকে দু'জনের ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বলে, একটু বাথরুমে যাচ্ছেন বলে - চোখের ইশারায় মানিককে ডেকে নেন। মানিক জানান, 'পরশু রাতে রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনে হামলা হয়েছিল। অনেক পুলিশ মারা গিয়েছে, কিছু পালিয়েছে, কিছুকে বন্দি করেছে। জানতে পারলাম, পালানোর সময় অনেক পুলিশ গুলবাগের দিকে গিয়ে লুকোনোর চেষ্টা করেছে। গুলবাগ গ্রামে গিয়ে পাকিস্তান মিলিটারিরা প্রত্যেক বাড়ি গিয়ে হামলা করেছে। তাই বেশ চিন্তা হচ্ছে।'

    (সাত)
    মানিক পুতুলকে নিয়ে গুলবাগের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। পুতুল যাওয়ার সময় কুসুমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে, কান্না আর থামেই না। যতই কুসুম পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকেন, 'সব ঠিক আছে রে বোনটি, চিন্তার কিছু নেই।' দেখেন পুতুলের শরীর নিজের বুক আর বাহুর মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার, শাড়ির আঁচল অশ্রুজলে সিক্ত। কুসুমের মনটাও যে কেঁপে উঠছে একটা অজানা ভয়ে এবং ত্রাসে, বুঝতে পারছেন সেটা নিজেও। পুতুল একটু শান্ত হলে, ভেঁজা ভেঁজা গলায় বলে, 'দিদিভাই, তোমাকে একা রেখে যেতে মন চাইছে না। তুমি ভেবো না, আমি এক-দু'দিনের মধ্যে চলে আসবো তোমার কাছে। তুমি সাবধানে থেকো। সাবধানে বাথরুমের কাজ করবে কিন্তু।'
    নাসিমা আপার সহায়তায় কুসুম ভর্তি হন মিটফোর্ড হাসপাতালে। চারদিন কেটে গেছে। কোনো খবর নেই মানিকের অথবা পুতুলের এখন পর্যন্ত্য। এর মধ্যে জানতে পেরেছেন পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার খবর। আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, ভার্সিটি সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসিকস্থল। রাজারবাগ পুলিশ স্টেশন, পিলখানা ইপিআর। সংবাদপত্র অফিস বন্ধ। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বেতার কেন্দ্র করে দিয়েছে অকেজো। রক্ষা পায়নি সাধারণ মানুষ। অসংখ্য নারী হয়েছেন লাঞ্চিতা, যৌনতাহানির শিকার। কুসুম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন গুলবাগ এবং কেরানীগঞ্জের আপনজনদের কথা ভেবে। কিন্তু কিছুই করার নেই, অসহায়ের মতো বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন ফ্যালফ্যাল করে। 
    ১ লা এপ্রিলে সকালে নাসিমা আপা রাউন্ডে এসে কুসুমকে চেক-আপ করে লেবার ট্রায়ালে দেওয়ার পরামর্শ দেন। শুনতে পান ঐদিন সকাল থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাদ আর্মির দখলে। ছাত্রনেতা যারা ঢাকা শহর ত্যাগ করছে, তাদের তাক করে গুলিবর্ষণ করছে। আর্মিদের কাছে খবর ছিল, ছাত্রনেতারা ঢাকা শহর ছেড়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে জিঞ্জিরা, কালিন্দী এবং কেরানীগঞ্জের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেক হাসপাতালের কর্মচারীরাও ভয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। এরকম একটা যুদ্ধরত পরিস্থিতিতে কুসুমের কন্যা জন্মগ্রহণ করে ২ রা এপ্রিল ভোররাতে। (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন