এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ৪

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ অক্টোবর ২০২২ | ৩২২ বার পঠিত
  • নিজের ঘরে বিছানার উপর বসতে না বসতেই, পুতুল হন্তদন্ত হয়ে মুখ ভার করে বলে, 'দিদিভাই, তুমি নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলে। বাড়িতে কাউকে কিছু বলে যাও নি। আমাকে তো সাথে নিতে পারতে।'

    কুসুম দু'হাতে জড়িয়ে ধরেন পুতুলকে, 'নারে বোনটি, আমার যাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। জানালা দিয়ে হঠাৎ দেখি মানুষের ঢল, সব চলেছে রমনা রেস কোর্সের দিকে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি ভিড়ের মধ্যে যাই নি। মৎস ভবনের কোনায় দাঁড়িয়ে শুনেছি।'

    মুহূর্তের মধ্যে পুতুলের মুখ হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে, 'ঠিক আছে, এখন থেকে যেখানেই যাবে আমাকে সঙ্গে নেবে। কাল থেকে তুমি তো ছুটি নিয়েছো। এখন কয়েকদিন আমার সেবা-যত্ন নাও।'

    'দূর পাগলী ! তুই আমাকে তো কিছু করতেই দিস না।'

    'চিন্তার কিছু নেই, দিদিভাই। সব সুদে আসলে তুলে নেবো। তোমার দেওর তো আমার পিছনে পড়ে আছে একটা বাচ্চার জন্য। বলেছি একটু সবুর সইতে। দিদিভাইয়েরটা আগে সামলে নিই।'

    এদিকে যতদিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি জটিল হয়ে আসছে। নানা খবর ভেসে আসছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এসেছেন ঢাকাতে। বঙ্গবন্ধুর সাথে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনো ফলপ্রসূ পরিণতি বেরোয় নি।

    হঠাৎ করে ২৩ শে মার্চ রাত দশটা নাগাদ মানিক আসেন বাড়িতে। বাবা এবং খুড়োকে ডেকে বলেন, 'পরিস্থিতি খুব সঙ্কটজনক। ঢাকা শহরে যেকোনো সময়ে সংঘাত হতে পারে। আজকে ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল করে দেওয়া হয়। আপনারা সবাই কেরানীগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। আর আমি কাল সকালে কুসুম আর পুতুলকে নিয়ে আমার চেনাজানা নাসিমা বেগমের ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করে দিই। পুতুল কয়েকদিন কুসুমের সাথে ক্লিনিকে থেকে যাবে। আমি পরে এসে ওদেরকে কেরানীগঞ্জে নিয়ে যাবো।' 
    মানিকের বাবা এবং খুড়ো দুজনেই রাজি হন না কেরানীগঞ্জে যেতে। বলেন, 'আমাগো গুলবাগে একটা টিনের চাল দেওয়া পাকাবাড়ি আছে। গুলবাগ রাজারবাগ পুলিশ লাইন থিকা বেশি দূর নয়। আমরা তোর খুড়িমা আর বিবেককে নিয়া গুলবাগ যাইয়া থাকি। সেটাই ঠিক হইবো।'

    পরেরদিন সকালবেলায় কুসুমের শ্বশুরমশাই, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়ি, দেওর বিবেক আর রানী চলে যান গুলবাগে। আর কুসুম ভর্তি হন নাসিমা আপার ক্লিনিকে। পুতুল কুসুমের সাথে একই ঘরে একটি আলাদা বিছানা নিয়ে থেকে যায়।

    ২৫ শে মার্চ রাতে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন কুসুম আর পুতুল। পুরো ক্লিনিকে আর একজন নার্স ছাড়া কেউ নেই। নাসিমা আপা থাকেন ক্লিনিক থেকে বেশ কিছুটা দূরে। হঠাৎ রাত বারোটা নাগাদ কামানের আওয়াজ, গোলাগুলি এবং মানুষের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় দু'জনেরই। নার্সটি বাইরের ঘরে শুয়েছিল। ভয়ার্ত মুখে দৌঁড়ে চলে আসে কুসুমদের ঘরে। কুসুম দু'জনকেই তখন ভরসা দিতে থাকেন। বাইরে কী চলছে ভিতর থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। জানালার কাছে গিয়ে কুসুম দেখতে পান - এদিক ওদিক জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা, রাস্তায় নেমে পড়েছে মিলিটারি ট্যাঙ্ক, একটানা গুলির আওয়াজ আর তার সাথে মানুষের দৌঁড়ে পালানোর আওয়াজ, কোলাহল আর আর্তচিৎকার। মনে হচ্ছে আজ রাতেই বোধহয় ঢাকা শহরটা পরিণত হবে মৃত্যুপুরীতে। কুসুম নার্সকে নিয়ে যান অফিসঘরে। নাসিমা আপার বাড়ির ফোন নম্বর নার্সের থেকে নিয়ে, ফোনের রিসিভার তুলে দেখেন ফোন কাজ করছে না। ভাবলেন যদি রেডিওতে কোনো খবর পাওয়া যায়, যদিও এত রাতে সেটা হয়ত সম্ভব নয়। রেডিও চালু করে শুনতে পেলেন একটানা কু কু আওয়াজ। যত রাত বাড়ছে গোলাগুলির আওয়াজ বেড়েই চলেছে। কুসুম খাতুন বুঝতে পারলেন, সকাল না হওয়া পর্যন্ত কিচ্ছু করার নেই - যদি অবশ্য বেঁচে থাকেন। এত অসহায় বোধ এই পর্যন্ত বোধহয় এর আগে কোনোদিন উপলব্ধি করেননি। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে কখন যে বাকি রাতটা কেটে যায় কুসুম খাতুন বুঝতে পারেন নি।

    জানালার কাঁচ ভেদ করে সূর্যের কিরণ চোখে এসে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসেন বিছানায়। শেষ রাতের দিকে ক্লান্তিতে বোধহয় চোখ জোড়া বুজে এসেছে। পাশের বিছানায় পুতুল আর নার্সটি শুয়ে আছে। জানালার পাশে এসে দেখেন নিঝুম রাস্তাঘাট, যেন একটা দমবন্ধ ভয়ার্ত আবহাওয়া। তখনও ভেসে আসছে দূর থেকে ক্ষীণ গুলির আওয়াজ। আকাশে চিল উড়ছে, কাক ডেকে চলেছে। কিছুক্ষণ পরেই শুনতে পান ভারী বুটের আওয়াজ, তার সাথে ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় কর্কশ আওয়াজ। 

    পুতুল আর নার্সটিকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে গেলেন নিজেকে পরিষ্কার করতে। এর মধ্যে নার্সটি বুদ্ধি করে চা বানিয়ে এনেছে কিচেন থেকে। চা খেতে খেতেই আবার টেলিফোন করার চেষ্টা করলেন নাসিমা আপাকে। কিন্তু টেলিফোন যন্ত্রটা কাজ করছে না। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। কিচেনে গিয়ে দেখেন শুধু চাল, ডাল, আটা, তেল আর মসলাপাতি আছে। বাজার রোজ ক্লিনিকের রান্নার লোক এসে করে। যাইহোক, খাওয়াটা চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু কারুর খবর পাবেন কী করে, সেটাই বুঝতে পারছেন না। রাস্তায় কোনো লোকের দেখা নেই। হঠাৎ করে দু'একজনকে দৌঁড়ে এদিক থেকে ওদিক যেতে দেখা যাচ্ছে। আর পাওয়া যাচ্ছে ভারী বুটের আওয়াজ পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর।    

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন