এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শীতঘুম

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ অক্টোবর ২০২২ | ৪১২ বার পঠিত

  •  
       একসময় এ বাড়ি ছিল জমজমাট । কালীপুজোর রাতে মহা ধুমধাম করে পাঁঠাবলি, গ্রামের সবাইকে পাত পেড়ে খাওয়ানো, আতশবাজির রোশনাই । পাইক বরকন্দাজের দল ছিল, গুমঘর ছিল । একটা কালি ঝুলি মাখা দোনলা বন্দুক এখনো রয়ে গেছে দোতলার মাঝের বন্ধ ঘরে।
       এখন বাড়িটা বহুদিন ফাঁকাই বলা যায়, বেশীর ভাগ বংশধররা দূরে চলে গেছে, বিদেশেও থাকে । তবে মাঝে মাঝে আসে । বাড়িটা সারানোও হয়, ভেঙে পড়ার মত অবস্থা নয় । লাগোয়া কালী মন্দিরের জন্য গ্রামের লোকেরাও এ বাড়ির দিকে তেমন নজর দেয়নি কিন্তু পঞ্চায়েত বদলের পর একটা চেষ্টা হয়েছিল এ বাড়ির চাষের জমি দখলের।
       সেসব কান্ড যখন হয়েছিল তখনও বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে অগ্নিবেশ এ বাড়িতে থাকতেন না । তিরিশ বছর আগে তিনি উধাও হয়ে গেছিলেন । নিরুদ্দেশ ঠিক নয়, মাঝে মাঝেই তার চিঠি পাওয়া যেত। তাতে সবাই বেঁচে থাকা নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেও তাকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছিল । যাবার সময় যে বাড়ি ভাই বোন জ্ঞাতি গুষ্টিতে গমগম করতে দেখে গেছেন, এখন ফিরে দেখেন শুধু আরেক ভাই প্রণবেশ আর তার পরিবার । দোতলার কোণের নিজের পুরনো ঘরটাতেই তিনি থাকতে শুরু করলেন । নিজের বিড়ি, সাবান, তেলের খরচ ওঠাতে পৈতে বানান, কিছু এদিক ওদিক যজমানি করেন । এই কোণার ঘরের আলমারিতে বহুকালের মোটা মোটা সব বই রাখা আছে। সবই তাদের বাপ ঠাকুরদাদের সংগ্রহ। ভাতঘুম দিয়ে উঠে অগ্নিবেশ মাঝে মাঝে সেসব পুরনো ইতিহাস বই পড়েন ।
      ভাইপো প্রথমেশ ওরফে রঘু মাঝে মাঝে ওপরের ঘরে এসে উঁকি মারে । একদিন টেবিলে গাঁজার মশলা দেখে তার বাবাকে গিয়ে বলেছিল, "পৈতে বানাতে বানাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ছোটকা একটু টেনে নেয়, বুঝলে তো বাবা" । প্রণবেশ ধমক দিয়েছিলেন ছেলেকে - "ওকে শুধু শুধু খোঁচাতে যাস না"।
       রঘু গাছগাছালি ভালোবাসে, আধুনিক কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ে গ্রামে ফেরত এসে সে সেসব পদ্ধতি আনতে চাইছে এখানকার চাষে, কিন্তু প্রণবেশ নিজেই ছেলেকে বাধা দিচ্ছেন। আগের বছর গ্রামের সব আলু পোকায় ধসে যাচ্ছিল, রঘু বাঁচিয়েছে, কিন্তু প্রণবেশ আর গায়ের বাকিরা তাতে আমল দেন না । আগের আমলের পঞ্চায়েত প্রধান প্রণবেশের এসব নতুন কায়দা পছন্দ নয় । আর এসব ব্যাপারে গ্রামের বয়স্করা সবাই তারই পক্ষে। তবে অল্পবয়সী কিছু ছেলেকে জড়ো করে রঘু নতুন চাষের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । শুধু রঘুর মার জোরাজুরিতে বাগানটা বাধ্য হয়ে ছেলের পরীক্ষা নিরীক্ষার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন প্রণবেশ।
        মাঝে মাঝে সকালবেলা খাবার পর অগ্নিবেশকে বাগানের গাছগুলো চেনায় রঘু । তাদের পায়ে পায়ে রঘুর দুটো পোষা কুকুর ঘোরে যারা ইঁদুর মারার জন্য বাহবা পায় রঘুর থেকে ।
       এই বাড়ির একদম ওপরে তেতলার ছাদে উঠলে জমি পুকুর পেরিয়ে দূরে দেখা যায় একটা নদী । গরমকালে শুকিয়ে যায়, শিবেনের লোকেরা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বালি তোলে দিনে রাতে, সেই বালি যায় শহরে বড় বড় বাড়ি বানানোর কাজে ।নদীর ধারে কয়েকটা চালাঘরে সব শিবেনের ছেলেদের আড্ডা |
        কিছুদিন ধরেই গ্রামে একটা কানাঘুষো কথা চলছে, রঘুরও কানে উঠেছে কথাটা । সেই একদিন এসে অগ্নিবেশকে ধরলো, "ছোটকা, শিবেনের বৌয়ের সাথে তুমি কি শুরু করেছো?" অগ্নিবেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, খবরটা ছড়াচ্ছে, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন ভালো হচ্ছেনা কাজটা । কিন্তু শিবেন সারা দিন রাত বালির কাজে বাইরেই থাকে, শিবেনের বৌ নিজেই যদি তাকে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ডাকে তাহলে আর তিনি কি করতে পারেন।



      একদিন সন্ধের যজমানি সেরে নদীর ওপার থেকে ফেরত আসার সময়, শিবেন চালাঘর থেকে মুখ বার করে অগ্নিবেশকে ডাকল "ও জগুদা শোনো " ।
       অগ্নিবেশ কাছে যেতে শিবেন আরো পাঁচ ছজনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে চালাঘরের বাইরে । শিবেনের হাতে একটা পাটের থলি, হালকা গন্ধ আসছে ।কাঁধে হাত দিয়ে বললো, "জগুদা তোমার সাথে একটা কথা আছে, হাঁটু গেড়ে বসো"।
       হাঁটু গেড়ে বসতে শিবেন, থলিটা দোলাতে লাগলো অগ্নিবেশের মুখের সামনে ।
       অগ্নিবেশ বিরক্ত হবার ভাব দেখান - "কি বলবি বল, সন্ধেবেলা হাঁটু গেড়ে বসালি এভাবে!"
       শিবেন তার দলের একটা ছেলের দিকে ফিরে বললো "লেড়ো, তোর বাঁশিটা নিয়ে আয় "
       এটা শুনেই অগ্নিবেশ চোখ বন্ধ করে ফেললেন, বাঁশি মানে যন্তর? আজকেই তাহলে তার শেষ দিন ।
       সন্ধেবেলা হাঁটু গেড়ে বসালো কেন সেটা না বলে শিবেনের মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে । থলিটা ডানহাতে ধূপের মত দোলাতে দোলাতে শিবেন একবার জগুর নাকে ইচ্ছে করে ছুঁইয়ে দিল, ঝাঁজালো গন্ধে বাধ্য হয়ে মাথাটা সরিয়ে নিলেন অগ্নিবেশ । বিরক্তিতে কুঁচকে গেল তার চোখ মুখ।

      ছেলেটা যেটা নিয়ে ফিরে এলো, সেটা সত্যি একটা আড়বাঁশি, যন্তর না। অগ্নিবেশ অবাক হন, বালি তোলার ফাঁকে এরা আবার পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে বাঁশিও বাজায় নাকি নদীর চরে?

      তিনি মাথাটা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন - "বারবার ওটা নাকে ছোঁয়াচ্ছিস কেন?"

    "এ থলিতে কি আছে জানো জগুদা? হিরু সাপুড়ে বলেছে, সর্পগন্ধা গাছের শেকড় অব্যর্থ ওষুধ । এতে সব সাপ দূরে চলে যায় । এবার লেড়ো বাঁশি বাজাবে আর তোমাকে থলিটা শোঁকাব । লেড়ো, শুরু কর!"
    "সেসব খেলা তো সাপের জন্য, আমি কি সাপ নাকি? "
    "তুমি বাস্তুসাপ, এবার ভিটে চ্যুত করবো তোমাকে । গ্রামের বৌদের দিকে নজর দেওয়া? "
      
      সেরাতে বাড়ি ফিরে রোজকার মতই অগ্নিবেশ খোলা আকাশের নিচে দোতলার আধখানা ছাদে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসেন । ছিলিমে অল্প অল্প টান দিতে থাকেন । আজ আর রাতে খাবার খেতে নামবেন না । শীতকাল আসছে । ঘরে আলোর চারপাশে ভিড় করে উড়ছে শ্যামাপোকার দল। বাইরে অল্পস্বল্প হিম টুপটাপ ঝরে পড়ছে মাটিতে । অন্ধকারে সরীসৃপরা খুঁজে নিচ্ছে শীতঘুমে যাবার নিরাপদ আশ্রয়।
     
      পরেরদিন রঘু সকাল সকাল খাবার জন্য অগ্নিবেশকে ডেকে না পেয়ে দোতলায় এসে খুঁজলো । আধখানা ছাদে ফাঁকা পড়ে আছে মাদুর, অগ্নিবেশ নেই । ঘরে বিছানায় টান টান চাদর, টেবিল ফাঁকা । এখানে কেউ থাকছিল বলে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না রঘুর । অগ্নিবেশ যেন কর্পূরের মত উবে গেছেন হাওয়ায় ।
     
       কিন্তু সে তেমন চিন্তায় পড়ে না। "কাকা মনে হচ্ছে আগের মত আবার কোথাও ঘুরতে চলে গেছে"- ভেবে সে ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় দ্রুত, যদি খুচরো টাকা বা গাঁজার মশলা চোখে পড়ে । কিছুই নেই ।
      শুধু, বইয়ের আলমারিটা অন্যরকম লাগে তার কাছে ।
      বইয়ের আলমারির কাছে গিয়ে অবাক হয়ে প্রথমেশ ওরফে রঘু দেখে, পুরনো বইগুলো আর আস্ত নেই একটাও । এক রাতের মধ্যে সব যেন খেয়ে গেছে উইপোকা । আলমারির তাক গুলো জুড়ে শুধু তাদের গুঁড়ো করে ফেলা ধুলোর পাহাড় জমে আছে।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন