এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল 

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ অক্টোবর ২০২২ | ৪৩৯ বার পঠিত
  • (২) 
                                                 
    ঘুম হবে না জেনে বিছানায় গেলে, কোন রকম উদ্বিগ্নতা থাকে না। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি এই ব্যাপারটা অনেকটা বৃষ্টি হবে না ভেবে, ছাতা না নেওয়ার মতো। অবধারিত, সেদিন বৃষ্টি হবেই,  আর শুধু তাই নয়, সেই বৃষ্টিতে পড়ে ভিজতেও হবে। তেমন ভাবেই, ঘুম হবে না জেনেই, কখন ঘুম এসে গেল, বুঝতেই পারিনি। বেলা প্রায় ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙে। একবার চায়ের পাট হয়ে গেছে কিন্তু সকলেই দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করছিল- আর আমি সেই হিসেবে ঠিক সময়েই উঠে পড়েছি। চা নিয়ে এ কথা সে কথার পরে, বাড়ির কর্তা বাজারে গেলেন, আমি আর আমার হাফ গিন্নী ও তার মেয়ে কিছুটা আড্ডা দিলাম। এই বছরে কোলকাতার কয়েকটি পূজা সংখ্যায়   আমার কয়েকটি গল্প বেরিয়েছে- সেই ম্যাগাজিনগুলি হস্তান্তরিত হল। এইবারই প্রথম যে একসাথে  চারটে ম্যাগাজিনে আমার লেখা বেরিয়েছে। ২০০৮ সালে সিরিয়াসলি লেখা শুরু করি, আর আজকের স্থিতি এটাই। যদিও আমি সিরিয়াস জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখি না, প্রধানত গল্পই লিখি, তাও আবার থ্রিলার, কিন্তু প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনীও লেখার চেষ্টা করি। ইতিহাস নির্ভর বা চরিত্র এর পরিপ্রেক্ষিতে গল্প ফাঁদতে আমার নিজেরই কেমন একটা ভেতোরে ভেতোরে হয়। সব গল্পই যে খুব ভাল উৎরোয় তা নয়, কিন্তু কিছু কিছু বেশ ভাল হয়ে যায়। যাই হোক, সে কথা পাঠকের জবানীতেই শুণতে ভাল লাগবে। আমার শ্যালিকা কবিতা এবং ইদানীং গল্পও লিখছে। তার একটা সাহিত্যিক গোষ্ঠি আছে- তাদের নানা অনুষ্ঠান ইত্যাদি কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় হতেই থাকে।  সেখানে তার উপস্থিতি অনিবার্য্য। এই সময়েও একটা বড় অনুষ্ঠান ছিল, কিন্তু আমি ঠিক তার একদিন আগেই ফেরত যাচ্ছি। আজকাল তো আর ইচ্ছে হলেই টিকিট বদলানো যায় না, রেস্তোও  লাগে আবার প্রাপ্তিযোগও লাগে। আমার কাছে উপার্জন নেই, আগেই বলেছি- তাই প্রাপ্তিযোগের চানস নেবার মত অবস্থায় ছিলাম না।

    ইতিমধ্যে অনুজের ফোন- তারা পৌছে গেছে বাড়িতে। মানে দমদমে। ওদের সেখানেই নিজের  বাড়ি। আমাদের বরানগরের বাড়িটির একটি সম্ভাবিত সদগতির জন্য আমাদের দুই ভাইয়ের এই স্বল্প সময়ের র‍্যাঁদেভু কোলকাতায়। আজকালের নিয়ম মতো, জমিটা একজন ডেভেলাপার নিচ্ছেন, আমাদের কাছ থেকে- তিনি তার প্ল্যান মাফিক কিছু পায়রার ঘর তুলবেন- আর তার থেকে আমাদের দুজনকে দুটি খুপরি দেবেন। এই কথাটাই আইনের মারপ্যাঁচে কাগজবন্দী করার জন্যে আমাদের আসা। আজকাল আইনের কাজে আবার বায়োমেট্রিক বলে একটি বস্তু জুড়েছে। আঙুলের ছাপ (দশ আঙুলেরই), দুচোখের আইরিশের ছবি, আপনার চাঁদ বদনের ছবি ছাড়াও, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা উপহার প্রাপ্ত ‘আধার’ এর প্রতিলিপি (যা তিনি বিরোধি নেতা থাকার সময় দাঁত-নখ লাগিয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন- ঘোষণা করেছিলেন, সমস্ত রাজ্যে কেন্দ্রিয় সরকার যদি ‘আধার’ করেও ফেলেন, তার রাজ্যে তিনি করতে দেবেন না, যেন ওনার রাজ্য ভারতের  প্রজাতন্ত্রের বাইরে) সবই লাগবে। যাই হোক, আজকে বিকেলে এই কাজের সুবাদে আমায় ভাইয়ের ওখানে চলে যেতে হবে, মানে দমদমে। ৩১ তারিখের বিমানটি যদি দুপুর বেলা হত, তাহলে এই কাজকর্ম শেষ করে, ফিরে যাবার আগে সিনেমা পাড়ায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সে  সবই তো পাকে চক্রে বদলে গেল- সে কথা আগেই বলেছি। দুপুরে বিবিধ মৎস এবং পঞ্চ-ব্যাঞ্জনাদি দ্বারা আহারে পরিবৃত হইয়া তন্ডুল সহযোগে সে সকল খাদ্যবস্তু ভক্ষণ করিয়া দিবনিদ্রায় উপবেশন করিলাম। কলিকাতায় খাদ্যবস্তুর স্বাদই আলাদা। অবশ্য রান্নাটাও জানতে হবে। সে ব্যাপারে এরা দু-বোনই বেশ পারদর্শীনী। 

    বরানগরে উকিলের ঘরে আমাদের দুই ভ্রাতার সমস্ত কাগজপত্র লইয়া সন্ধ্যা সাড়ে ছয় ঘটিকায় পৌঁছাইবার কথা। টালিগঞ্জ থেকে বরানগর, মানে দখনে থেকে সেই উত্তুরে। তবে এখন সুবিধে  আছে- মাটির নীচে দিয়ে রেলগাড়ি, দুঘন্টার রাজপথ (সাথে জ্যাম+ধোঁয়া ফ্রি) মাত্র আঠাশ মিনিটে শুড়িপথ ধরে নিয়ে এল। নির্দিষ্ট সময়ের কিছুটা আগেই পৌঁছে যাই মোক্তারের দরজায়। ভাই  তখনও রাস্তায়, আসছে বলে খপর দিলে। আমাদের ডেভেলাপারও এসে উপস্থিত।  

    আজ ভোরেই এসে নেমেছি। আসা ইস্তক বরানগর যাই নি। এখন সন্ধ্যাবেলায় এলাম, কিন্তু বাড়িতে নয়, এলাম উকিলের চেম্বারে, সেই বাড়িটিকে অন্যের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা নিমিত্তে। এটা আমাদের দুজনের কারোরই জন্য সুখের বা গর্বের বিষয় নয়, আমাদের সফলতার(?) অপমান বলেই আমি মনে করি। আমার বাবা, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটা একটা করে ইট গেঁথে গেঁথে যে ঘর তুলেছিলেন, আমাদের মাথার ওপরে যে সুরক্ষার নির্ভরতা দিয়ে গেছিলেন, আমাদেরই  গাফিলতিতে, আজ তা বাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা এখানে থাকি না, তাই প্রয়োজনীয় দেখাশুনোও করা যাচ্ছে না। ঘরের দেওয়াল জুড়ে ঘূণপোকাদের বাসার স্থায়ী আলপনা। এক আলমারি বই তারা গ্রাস করেছে ইতিমধ্যে। একটি জীবন্ত বাড়িকে আমরা নিজেদের সময়ের দোহাই দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছি। আর আজ এখন সেই মৃত্যুপথ যাত্রীকে ভেন্টিলেশনে চড়াবার জন্যে সান্ধ্য বাসরে একত্রিত হয়েছি। বিশ্বাস করুন, এই ছিল আমার মানসিক অবস্থা। অনেকেই বলবেন, আরে বি প্র্যাকটিকাল। তুমি তো ভালোই করছ, আরো কিছু লোকের বসবাসের ব্যবস্থা হবে- কিন্তু তা কি বিনামূল্যে? এই আদান প্রদানের অঙ্কই তো আমাদের সভ্য (?) করেছে, তাই না? আমরা গিভ এন্ড টেকের বাইরে অন্য কোন সভ্য পদ্ধতি এখনও খুঁজে পাই নি। আমাদের হাত-পা বাঁধা। তাই নিজেকে যূপকাষ্ঠ হতে বাঁচাতে, বাড়িটিকে চাপিয়ে দিলাম-  যে আমাদের এত দিন আশ্রয় দিয়েছিল, যে আমার আর আমার স্ত্রীর জন্য তার ভেতোরে এক আপন কক্ষ সংরক্ষিত রেখেছিল, যে বাড়ির বারান্দায়, আমার কন্যা লক্ষীপূজার দিনে ছোট্ট শাড়ি পড়ে অপক্ক হাতে আলপনা আঁকতো তার ঠাকুমার সাথে, যে বাড়িতে আমার বাবা আমাদের অগোচরে নিজের অসুস্থতায় দিন শেষ করেছেন, যে বাড়িতে আমার ভাতৃবধু তার বড় জা-য়ের সাথে একসাথে রান্নাঘর আর আড্ডাস্থল মাতিয়েছে। আজ একবারও সেই বাড়ির দরজায় না গিয়ে, আমরা তাকে অন্যের হাতে তুলে দিলাম। এ কি পাপ নয়? এ কি অনীতি নয়? যুক্তি যতই খাড়া কর, আমি জানি এ শুধুই মানবের চিরাচরিত সুযোগসন্ধানী মনোভাবেরই প্রতিফলন। আর কিচ্ছু নয়। এ বাড়ি ভেঙে, নতুন খুপরি ঘর যতদিনে বাসযোগ্য হবে, আমি হয়তো থাকবো না। আমার মা-বাবা নিজেদের জমি জায়গা ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন দেশ ভাগের সময়। সেই মানুষ এখানে নিজের রক্তের বিনিময়ে যেটুকু জমি তার বংশজের জন্য নিতে পেরেছিল, আজ তাকেও আমরা হারালাম। আজ দেশ ভাগ নেই, কিন্তু আমরা ভাগ হয়ে গেছি। চিন্তায়, ব্যবহারে, প্রয়োজনে। দুজনে দুদিকে। দুজনে দু-প্রকারে। আমরা আমাদের কেজো মুখোশের ভেতোরে লুকিয়ে থাকা সেই ছোট্টবেলার দুই ভাইকে বের করে আনতে পারলাম না। প্রয়োজনের চাপে  তলিয়ে গেলাম। আমরা আবার বাস্তুহারা হলাম। আজ কি আকাশের থেকে দুটি তারা খসে গেল? ‘কোথায় কখন কবে কোন তারা খসে যাবে, আকাশ কি মনে রাখে? মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে....’।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন