এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিদ্রোহীঃ একটি বই আলোচনা

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২৩০ বার পঠিত
  • বই আলোচনা; বিদ্রোহী
    লেখকঃ অবিন সেন মহাশয়
    মুদ্রকঃ সৃষ্টিসুখ

    সৃষ্টিসুখের প্রয়াসে (ওরা এমনই বলেন), শ্রী অবিন সেন মহাশয়ের লেখা "বিদ্রোহী" নাম্নী বইটি দিন দুয়েক হল পড়ে শেষ করেছি। এই বইয়ের মূল চরিত্র যশোহরের রাজা, বাংলার অন্যতম ভূস্বামী এবং রাজা প্রতাপাদিত্য। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকের অবিভক্ত বাংলায়, প্রতাপাদিত্যের বিচরণ কাল এবং নানারূপ কার্য্যাদি খুবই গভীর অনুধাবনের ইতিহাস। আমি এই সময় কাল নিয়ে বেশি পড়ি নি, তাই সেন মহাশয়ের লেখা গল্প এবং ইতিহাস পাশাপাশি পড়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, খুবই ভাল লেগেছে। আমার কাছে এক রকম অজানা সময়কালেরই বাংলার কাহিনী বেশ প্রাঞ্জল ভাবে তিনি শুণিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার আন্তরিকতা এবং গবেষণা বেশ ভালোই বোঝা যায় লেখার মধ্য দিয়ে। 
    আজকের জেনারেশনের জন্যও এই বই খুব জরুরী প্রতিপাদ্য, যদি তারা পড়ে এবং পড়ে মনে রাখে। অবিভক্ত বাংলা যে মোগল শাসনের আগে, প্রায় দুশো বছর পাঠানদের দ্বারা চালিত ছিল, আজকের ছেলেপুলেরা নিশ্চিত ভাবে সে খবর রাখে না। বাংলার শেষ শাসক দাউদের মৃত্যুর পরেই, বাংলায় মোগল শাসনের গোড়াপত্তন হয়। প্রতাপের জন্ম যদিও তখনকার বাংলার রাজধানী গৌড়ে হয়েছিল, কিন্তু বাংলার শাসক সুলেমান দাউদ করনানীর বিশেষ অমাত্য পদে আসীন ছিলেন প্রতাপের পিতা এবং পিতৃব্য। যাদের আসল নাম যথাক্রমে শ্রীহরি এবং জানকী বল্লভ। আকমহলে,আকবরের সাথে যুদ্ধে, দাউদের মৃত্যু হবার পরে, বাংলায় মোগল আগ্রাসনের একটা সুযোগ গড়ে ওঠতে থাকে। শ্রী হরি এবং জানকী বল্লভ, দাউদের সমস্ত ধন সম্পত্তি নিয়ে তৎকালীন, অবিভক্ত  বাংলার দক্ষিণ ভাগে, চন্দনা নদীর কূলবর্ত্তী এলাকায় সাময়িক ভাবে পালিয়ে আসেন। এই স্থানই যশোহর নামে পরে বিখ্যাত হয়। 
    সেন সাহেবের বইটিতে এইসব কাহিনী অত্যন্ত মনোরম ভাবে বর্ণিত আছে। 
    বাঙালি যুদ্ধবাজ জাত নয়, ভীরু এইসব আপবাদে আজ আমরা প্রায় চারশো বছরের ওপর বদনামী। কিন্তু প্রতাপাদিত্য আর তার চার বন্ধুর কথা যখন পড়ি, তখন জানতে পারি, মাত্র ৪৫০-৫০০ বছর আগেও, বাঙালি কি অসম সাহসী আর যুদ্ধপটু ছিল। প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর সাথে সাথে বাঙলার সাহসিকতা এবং স্বাধীন মনস্কতা দিনে দিনে হীনবল হয়ে পড়ে। যদিও বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজ কিছুটা সাহসিকতা এবং যুদ্ধ কুশলতা দেখিয়েছিলেন, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয়ের সময়, কিন্তু ততদিনে বাংলার বিভিন্ন পদাধিকারী জন মানসের মধ্যে, সুযোগ সন্ধানী প্রবণতা, উৎকোচ এবং কথার মূল্য না রাখার এক ধারাবাহিকতা জায়গা করে ফেলেছিল। প্রতাপাদিত্যের সময়, বিশ্বাস ভঙ্গের উদাহরণ ততটা চোখে পড়ে না - যদিও তার পিতৃব্যের বংশধরেরা মোগলের হাত ধরেই, তা করার চেষ্টা করে গেছে। প্রতাপ অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং প্ল্যানিং এর মাস্টার ছিলেন - এ কাজে শংকর আর সূর্য্যকান্ত নামে তার দুই বাল্য বন্ধু আজীবন তার সঙ্গ দিয়েছে। 
    তার বিদ্রোহী মনোভাব, একদম ছোট্টবেলা থেকেই তার মনের মধ্যে ঘর করে নেয়। জন্মের মাত্র পাঁচ দিনের মাথায়, মায়ের সূতিকা গৃহে জীবন নাশ এবং গণতকারের গণনা অনুযায়ী ভবিষ্যত পিতৃহন্তা হিসাবে ঘোষণা, তার পিতা বিক্রমাদিত্য(শ্রী হরি)র মন, সন্তানের ওপরে বিরূপ করে দেয়। যার প্রভাব পিতা এবং পুত্র দুজনকেই ক্রমেই দূরে ঠেলে নিয়ে গেছে। এই বিদ্রোহী মনোভাব, তাকে স্বাধীনচেতা বানিয়ে তোলে, পরের জীবনে তাকে মোগলদের শত্রু করে তোলে। ষোড়শ শতকে অন্তত পূর্ব ভারতের জমি ভূমি থেকে ভিনদেশীয় মোগলদের তাড়িয়ে দেবার সংকল্প এই বাঙালিই করেন। এবং ১৮৫৩ সালে, শেষ যুদ্ধের আগে, তিনি বার বার মোগলদের হারিয়েছেন। 
    অবিন সেনের বই না পড়লে, এইসব ইতিহাস অধরাই থেকে যেত। বাঙালি হলে, এই বই অবশ্যই পড়তে হবে। সৃষ্টিসুখের সাথে, আমার একটা ছোট্ট অধ্যায় আছে, যদিও তা কোন ভাবেই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু ইতিহাস সবসময়ই আমার প্রিয় বিষয় (যদিও বিজ্ঞানের ছাত্রই আমি), তাই লেখককে সম্যক না চিনলেও, সৃষ্টিসুখের বই, এই যুক্তিতে, কিনতে দ্বিধা করি নি। আমার অনুমান সত্যই হয়েছে। 
    অবিন সেনকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই, উপেক্ষিত বাংলার ইতিহাসের এই দিকটি নিয়ে জমিয়ে লেখার জন্য। যদিও, আমার ধারনা, তিনি লেখাটি শেষের দিকে তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছেন। আমার ধারনা। উচিত মতে, প্রতাপের ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে মোগলের বিরুদ্ধে জয়ই তার আগ্রাসী বিদ্রোহী রূপের দ্যোতক। মনে হয়, ক্রনোলজি হিসাবে পর পর যুদ্ধের কথা বলে গেলে, লেখাটি উপন্যাসের বৃন্ত থেকে খসে পড়ত - সেটা কুসুমিত হয়ে উঠতো নিখাদ ইতিহাস হিসেবেই। তাই বোধহয় সেন বাবু, তা এড়িয়ে গেছেন। 
    তথাপি চন্দ্রলেখা চরিত্র, শরতকুমারী হরণ এবং প্রতাপের বিবাহ অত্যন্ত নিপুণ ভাবে প্রেমের আবেশে তিনি গড়ে তুলেছেন। আবার গুণময়ীর প্রতি প্রতাপের আচরণ লাম্পট্যই বলা যায়।
    পিতৃব্যকে এবং খুল্লভ্রাতাদের খুন করাটাও তার ক্রোধের নমুনা হিসাবেই দেখতে হয়, যা অবশ্যই হঠকারি। তবুও ভিন্ন ভিন্ন বিরোধী গুণের সমষ্টিগত রাজা প্রতাপাদিত্য, আমার কাছে রাজা হিসেবেই থাকবেন। 
    রাজা বসন্তরায়ের ভাইদের বংশ থেকে সাবর্ণ চৌধুরিদের বিকাশ, এটাও বাংলার প্রাচীনতম ইতিহাসের একটা ভুলে যাওয়া পৃষ্ঠা। 
    লেখক অবিন সেন তার বইটি যেখানে শেষ করেছেন, তাতে প্রতাপের পরাজয় আর বন্দীদশা আছে। ইচ্ছে করেই তিনি প্রতাপের মৃত্যুর কথা এড়িয়ে গেছেন মনে হয়। ধূমঘাট দূর্গ রক্ষার্থে, একটা সাম্রাজ্যের গোটা পরিবার শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা বড়ই বেদনার। একাকী শংকর মান সিংহের কাছে মুচালেকা দিয়ে মুক্ত হয়ে ফরিদার কাছে যখন ফিরে আসে তার নিজ গৃহে, তখন কেন যেন মনে হয়, প্রতাপের এই বিরাট আয়োজনের প্রয়োজন কি তাহলে নিতান্ত তুচ্ছই ছিল? হিংসা, বিদ্রোহ, যুদ্ধ আর রক্তপাতের পরিণামে যে জয়, তা কি মানুষকে সত্যিই জয়ী করে তোলে?  
    তবুও কালে কালে এমনই বিদ্রোহীরা ইতিহাসের সময় সারণী ধরে বার বার ফিরে এসেছেন - আর থেকে গেছেন ইতিহাসের জীর্ণ পাতায়। 
    অবিন সেনকে অনেক ধন্যবাদ, তেমনই এক বিদ্রোহী বীরের কথা লিখে রাখার জন্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন