এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • কালো রামধনু - ১০

    অভিজিত মজুমদার
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৫১৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • মূল ছবি - cottonbro

    পর্ব দশ



    আনন্দ মিশ্র ঘরে ঢোকার পর সৌম্য শৌভিককে জিজ্ঞাসা করল, “কী শৌভিক, একে চেনেন?”
    শৌভিক বেশ রাগত স্বরেই বলল, “যাকে তাকে ধরে এনে একে চেনেন তাকে চেনেন এইসব মনগড়া গল্প বানালে তো আর হল না। হ্যাঁ, সি. কে. পন্থ সম্পর্কে আমার জামাইবাবু হন। কিন্তু সেটা কোনো গোপন কথা নয়। এ বাড়ির সবাই সেটা জানেন। আপনাকে সেটা জানতে ঝুনঝুনু অবধি যেতে হল, সেটাই আশ্চর্যের। আপনি তো বেড়ে গোয়েন্দা মশাই!” শৌভিকের গলায় শ্লেষ ঝরে পড়ল।

    সৌম্য হেসে বলল, “আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিই? আপনি আপাতত একদম চুপ করে থাকুন। আপনার বক্তব্য বলার সুযোগ জেলে, আদালতে অনেক জায়গায় পাবেন। আমি বরং যেটা বলছিলাম, সেটা শেষ করি।"

    শৌভিককে এইটুকু উত্তর দিয়ে সৌম্য আবার বলা শুরু করল।
    “আমি তুহিনের দেওয়া ক্লু ধরে কী করে ঝুনঝুনুর সি. কে. পন্থ অবধি পৌঁছলাম, সেটা তো বললাম। গল্পের বাকিটা বলি। খানিক আমার অনুমান, খানিক ডিডাকশন। ভুলত্রুটি হলে আনন্দ আর শৌভিক শুধরে দেবে।
    আমার প্রথমেই যেটা খটকা লেগেছিল, সেটা হল – এর আগে প্রতিবার টাকা নিয়ে তুহিন দিল্লি গেলেও, এবারের লেনদেনটা কেন কলকাতায় হল। তুহিনের বাবা একজন প্রতাপশালী মন্ত্রী। অতএব কলকাতায় ডিল করাটা ব্ল্যাকমেলারের পক্ষে সুবিধার হবে না। দিল্লি সেদিক থেকে সেফ। ওখানকার পুলিশ বিরোধী দলের, অতএব দিল্লি পুলিশের সাহায্য নিতে হলে ব্ল্যাকমেইলিং-এর অস্ত্রটা বিরোধী দলের হাতে চলে যেতে পারে। তুহিন সেই রিস্ক নেবে না। সেই জন্যই তো দিল্লি বাছা, তাই না শৌভিক?”
    শৌভিক কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

    সৌম্য এক সেকেন্ড থেমে আবার বলতে থাকল, “সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যা হল আনন্দ অর্থাৎ তুহিন যাকে আমন বলে জানত, সে যখন তুহিনের প্রেমে পড়তে শুরু করল। অবশ্য প্রেম বলতে মানসিক না শারীরিক আকর্ষণ – তা আমি বলতে পারব না। তবে এরকম অনেক সময়ই হয়, যেখানে শিকার ও শিকারী পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। সেই দুর্বলতার জন্যই পরপর তিনবার তুহিনের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর এইবার আনন্দ বেঁকে বসে। শুধু তাই নয়, উল্টে তুহিনের সাথে দেখা করতে ও কলকাতা চলে আসে। সম্ভবত, তুহিনের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য। আমার এরকম অনুমানের কারণ তিনটে। এক, তুহিন এইবারও দিল্লি যাওয়ার টিকিট কেটেছিল, পরে সেটা ক্যানসেল করে। দুই, তুহিনের গলায় আনন্দের চুমুর দাগ। আর তিন – এবং এইটাই সবথেকে জোরালো – তুহিন আনন্দের লজে যাওয়ার ঠিক আগে পৃথাকে মেসেজ করে ক্লু-টা দিয়েছিল যাতে শৌভিকের যোগসাজসের উল্লেখ আছে। তুহিন কী করে জানল, যদি না ওকে সেটা আনন্দ জানায়? আমার ধারণা এর আগে টাকা পয়সার লেনদেন হত পাবলিক প্লেসে। এই প্রথম আনন্দ তুহিনকে হোটেলের ঘরে ডেকে পাঠায়। সম্ভবত ও কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বিনিময়ে ব্লাকমেলিংয়ের যাবতীয় নথি তুহিনের হাতে উঠিয়ে দিয়েছিল। তবে তুহিন কিন্তু তখনও আনন্দকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। তাই ওর হোটেলের ঘরে যাওয়ার আগে পৃথাকে মেসেজটা করে গেছিল। ঋককে করেনি, কারণ সম্ভবত আনন্দের প্রতি ওর নিজের মনেও একটা আকর্ষণ জন্মেছিল।”

    “কিন্তু আনন্দ যদি ব্ল্যাকমেলিং-এর টাকাটা না নেয়, তাহলে ওই ক্যাশ টাকাটা গেল কোথায়, যেটা তুহিন অফিস থেকে উঠিয়েছিল?” মহেশকুমার একক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এবার প্রশ্নটা করলেন।

    “সেটা ঋকের বাড়িতেই ছিল। পরের দিন সেটা ঋকের বাড়ি থেকে শৌভিক হস্তগত করেছে।” সৌম্য বলল।

    “সব মিথ্যে কথা। আমি এই আনন্দকে চিনিই না।” শৌভিক গর্জে উঠল।

    সৌম্য বলল, “সেটা না হয় কোর্টেই বলবেন। আপনাকে আপাতত জানিয়ে রাখি – ঋকের নখের কোণে আটকে থাকা চামড়ার সাথে আপনার ডিএনএ ম্যাচ করে গেছে। তাছাড়া আপনার বাড়িতে এর মধ্যেই সার্চ করে পুলিস বেশ কিছু ক্যাশ টাকা পেয়েছে। তার নম্বর আর তুহিনদের কোম্পানির ব্যাংক থেকে তোলা টাকার নম্বর মিলে গেছে। এর বাইরে আরো কিছু ছোটোখাটো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে আপনার বিরূদ্ধে। যেমন, আপনি সব সময় স্নিকার্স পরেন। তার তলাগুলো ফরেন্সিকে পাঠালে ঋকের বাড়ির ভাঙা জলের জগের ছোটো কাচের টুকরোও পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। এর বাইরে জীবন লজের লোকজন সাক্ষ্য দেবে, যে তারা আপনাকে ওখানে পরপর দু’দিন আনন্দ-এর সাথে দেখা করতে যেতে দেখেছে। প্রথমদিন তুহিন যাওয়ার পর, আর দ্বিতীয় দিন সকালে তুহিন মারা যাওয়ার পর। সুতরাং আপনার তো বাঁচা মুশকিল শৌভিক। দুর্ভাগ্য, যে আমাদের মত বাজে গোয়েন্দাদের হাতে আপনাকে ধরা পড়তে হল।”

    শৌভিক তার সমস্ত তর্জন গর্জন থামিয়ে মুখ নিচু করে বসে রইল। সেইদিকে একবার তাকিয়ে সৌম্য আবার বলা শুরু করল।
    “আসলে তুহিন মারা যাওয়ার পর আপনি প্যানিকড হয়ে পড়েন। সাত তাড়াতাড়ি জীবন লজে গিয়ে আনন্দকে বার করে ওকে ঝুনঝুনু পাঠিয়ে দিলেন। তারপর সোজা পৌঁছন ঋকের বাড়ি। আপনার ভয় ছিল, যে ঋক এই ব্ল্যাকমেইল এবং তাতে আপনার জড়িত থাকার ব্যাপারটা জানে। তাই ঋককে সরিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন আপনার যাবতীয় সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু যখন তুহিনের কাজের দিন আমাকে আর পৃথাকে কথা বলতে দেখলেন, তখন আবার আপনার মনে ভয় ঢুকল। আপনি দুটো কাজ করলেন। এক, আমাকে ফলো করা শুরু করলেন। সেটা নিজে করেছেন না লোক দিয়ে তা আমি জানি না। দুই, আমার মনে পৃথার ওপর একটা সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিলেন এই বলে, যে ওদের স্বামী স্ত্রী-র সম্পর্ক খুবই খারাপ। তবে এটা আপনি জেনেশুনে মিথ্যে বলেননি। অন্য সবার মত আপনিও সেটাই জানতেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও যখন আমরা জীবন লজ অবধি পৌঁছে গেলাম, তখন আপনি প্রমাদ গুনলেন। তৎক্ষণাৎ, আনন্দকে তার অন্য নম্বরে কল করে বলে দিলেন বাড়ির বাইরে না বের হতে, তাই না? তবে ওটা কিন্তু খুব কাঁচা কাজ হয়ে গেছিল শৌভিক। ওটা না করলে আমরা ঝুনঝুনু পৌঁছেও আনন্দ মিশ্র অবধি পৌঁছতে পারতাম না। হুট্ বলতে তো আর বিধায়কের বাড়ি সার্চ করা যায় না। কিন্তু যখন দেখলাম, যে আমাদের জীবন লজে পৌঁছনোর পরপরই আপনার নম্বর থেকে একটা নম্বরে কল গেছিল আর সেই নম্বরের টাওয়ার লোকেশন মিস্টার পন্থের বাড়ির লোকেশন, তখন দুই দুই চার করতে সময় লাগল না। যে বিধায়কের কাছে এই বারের নির্বাচন মরণবাঁচন সমস্যা, তাঁকে গিয়ে ব্যাপারটা বলতে তিনি নিজেই আনন্দ মিশ্রকে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। ঝুনঝুনুর মত রক্ষণশীল জায়গায় গে ব্ল্যাকমেইলেরকে উনি বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন – এটা ওঁর পক্ষে খুব একটা সুবিধেজনক হত না। আর কে না জানে, জন-জামাই-ভাগ্না তিন নয় আপনা। নিজের গদি বাঁচাতে সি. কে. পন্থ স্বচ্ছন্দে শালাবাবুকে বিট্রে করে দিলেন। অবশ্য বিট্রে বলাটা ঠিক হল না। আপনিও তো ওঁকে জানাননি যে এই অতিথিকে আপনি কেন ওনার বাড়িতে পাঠালেন, তাই না?”

    রজত মন দিয়ে শুনছিল। সৌম্য যখন এই ডিডাকশনগুলো করে, তখন ওকে যেন আরও সেক্সি, আরও ইরেজিস্টেবল লাগে।
    কিন্তু এইখানে একটা ফুট না কেটে ও থাকতে পারল না, “শৌভিক, আনন্দ কিন্তু আপনাকে ধোঁকা দেয়নি। ও তুহিনের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিল, যে তুহিন আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। সে অবশ্য তুহিন এমনিতেও করত না। আইন মেনে আপনাকে শাস্তি দিতে গেলে যে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনাটা প্রকাশ্যে চলে আসত। সেটা তুহিন করত না। কিন্তু তুহিন হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় আপনি সমস্যায় পড়ে গেলেন। খবরটা যদি কোনোভাবে তুষারবাবুর কানে পৌঁছয়, উনি কী কী করতে পারেন, সে আপনার থেকে ভালো আর কে জানে?”
    শৌভিক এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার ভেঙে পড়ল। আতঙ্ক ও কান্না চাপা গলায় বলল, “কিন্তু বিশ্বাস করুন, তুহিনকে খুন আমরা করিনি।”

    সৌম্য বলল, “আমি কি একবারও বলেছি, যে আপনি তুহিনকে খুন করেছেন? সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে কেটে ফেলবেন, এত বোকা আপনি নন। তাছাড়া সেই সময় আপনি পেলেনই বা কোথায়? আনন্দ সন্ধ্যেবেলা আপনাকে জানাল, যে ও তুহিনকে সব বলে দিয়েছে, রাত্রে তুহিন মারা গেল। ছুরি মেরে বা অন্য কোনো বিষে তুহিন মারা গেলে তবুও আপনার কথা ভাবতাম। কিন্তু রাইসিন দিয়ে এইভাবে খুন করাটা কোনো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কাজ নয়, রীতিমত প্ল্যান্‌ড্‌। মনে রাখতে হবে, রাইসিন কোনো ইঁদুর মারা বিষ নয়, যে দোকানে গিয়ে চাইলেই কিনে ফেলা যাবে। না, তুহিনকে আপনি খুন করেননি। ঋককেও আপনি খুন করতেন না, যদি সবকিছু আপনার প্ল্যানমাফিক চলত। তবে আপনি যদি একটু আনন্দ-এর আগের বয়ফ্রেন্ডদের হিস্ট্রি ঘাঁটতেন, তাহলে কখনোই এই কাজের জন্য আনন্দকে বাছতেন না। আনন্দের এক্স বয়ফ্রেন্ডদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে। তারা প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষিত, সুদর্শন, ও লাজুক। যেটাতে তুহিনও ফিট করে গেছিল। আর অবশ্যই তুহিনের এরকম দুম করে খুন হয়ে যাওয়াটা আপনার কোনো হিসেবের মধ্যেই ছিল না। সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাড লাক।”

    “শৌভিক যদি খুনি না হয়, তাহলে তুহিনকে মারল কে?” পৃথা জানতে চাইল।

    “বলছি। তার আগে মহেশবাবু আপনি আমাকে একটু দুটো জিনিস কনফার্ম করবেন?”

    “বলুন” মহেশ বলল।

    “আপনার সঙ্গে মাস ছয়েক আগে পৃথার এনগেজমেন্ট হয়, রাইট? মানালিতে?”

    “আপনি এটা কী করে জানলেন জানি না। এটা খুবই গোপনে হয়েছিল। শুধুমাত্র আমি, পৃথা, আর তুহিন জানতাম। ঠিক অফিসিয়াল এনগেজমেন্ট নয়। কেননা ওরা দু’জন তখনো স্বামী স্ত্রী। এটা অনেকটা নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া ছিল বলতে পারেন।”

    “গুড। লাস্ট কোয়েশ্চেন। আপনাদের ল্যাবে একটা রাইসিন বেসড অ্যান্টি-ক্যানসার ড্রাগের টেস্টিং চলছে, তাই না?”

    মহেশকুমার খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ চলছে।”

    সৌম্য এবার রজতের দিকে ফিরে বলল, "বাকিটা তো প্রায় তোর উদ্ধার। তুইই বল।”

    রজত এভাবে সবার সামনে কথা বলতে ঠিক স্বস্তি বোধ করে না। বরং পর্দার পেছনেই ও বেশি স্বচ্ছন্দ। তবু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৌম্য ওকে আগে ঠেলে দেয়।
    রজত পৃথার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুহিনের মৃত্যুটা যখন আমরা খুন বলে জানতে পারলাম, আমাদের প্রথম প্রশ্নটা ছিল, যে ওর শরীরে রাইসিন ঢুকল কী করে। ঐদিনের পার্টির ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। আউট অফ ফোকাস ছবিতে দেখতে পেলাম তুহিন ইনহেলার থেকে পাফ নিচ্ছে। তারপর তুহিনের কাজের দিন সেই একই ইনহেলার দেখলাম আপনার হাতে। সম্ভবত যজ্ঞের ধোঁয়ায় আপনার কষ্ট হচ্ছিল, তাই না?”

    পৃথা মাথা নাড়ল।

    রজত বলল, “তুহিনের মৃত্যুর দিন আমরা যখন এ বাড়িতে এসেছিলাম, তখন শৌভিক আমাদের বলেছিল, যে ও আপনার জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিল। সেদিন আর কী ওষুধ – সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাই কাজের দিন সুযোগ পেতেই সৌম্য সেটা জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, যে শৌভিক ওইদিন আপনার জন্য ইনহেলার নিয়ে এসেছিল। আরো জানা গেল, যে আপনার হার্ট ও লাংসের বিভিন্ন সমস্যা আছে এবং আপনাকে তার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ইনহেলার নেওয়া তারই একটা অংশ। দুয়ে দুয়ে চার করে আমাদের প্রথম সন্দেহ গিয়ে পরে আপনার ওপর। আপনি তুহিনকে রাইসিন মেশানো ইনহেলার দিয়ে নিজের জন্য আবার একটা নতুন ইনহেলার আনিয়ে নিয়েছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, মোটিভ এবং সুযোগ দুই-ই আপনার ছিল। কে আর গে হাসব্যান্ডের সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে চাইবে? এর সঙ্গে সঙ্গে নজরে পড়ল আপনার হাতের আংটি পাল্টে যাওয়ার দিকে। তবে কি আপনি ইতিমধ্যেই অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক শুরু করেছেন? এবং সেই জন্য পথের কাঁটা তুহিনকে সরিয়ে দেওয়া?”

    সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে রজত বলতে থাকল, “পৃথাদেবীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে আমি ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম। সেটা করতে গিয়েই ইনস্টাগ্রামে দেখতে পেলাম তুহিন আর পৃথার মানালি বেড়াতে যাওয়ার ছবি। খুব আনন্দে ভরা ছবি সব। আর সেই সব ছবির মধ্যেই আমার চোখে পড়ল আরেকটা জিনিস। চৌঠা নভেম্বরের ছবিতে পৃথার হাতে ছিল ওদের বিয়ের আংটি, যে আংটির ছবি এই ঘরে টাঙানো ছবিতে রয়েছে। পাঁচই নভেম্বর আঙুল খালি। ছয় নভেম্বর ওই আঙুলে আবার আংটি ফেরত এল। কিন্তু এবার অন্য আংটি। তবে দেখতে অনেকটা আগেরটার মতনই। ফলে খুঁটিয়ে না দেখলে সবার চোখে চট করে ধরা পড়বে না। কী মহেশবাবু, ওই দিনই তো আপনাদের ইনফর্ম্যাল এনগেজমেন্ট ছিল, তাই না?”

    মহেশকুমার একটু হেসে সম্মতি জানালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু ওই ব্যক্তিটি যে আমি সেটা বুঝলেন কী করে? আমরা তিনজনেই তো পুরো ব্যপারটা গোপন রেখেছিলাম। ঠিক করেছিলাম ওদের দু’জনের মিউচ্যুয়াল ডিভোর্সটা হয়ে গেলে তারপর আমরা অ্যানাউন্স করব।”

    রজত বলল, “সেটা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। ওদের ছবিতে হোটেলের চেক ইন করা ছিল। সেই হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানলাম তুহিন দুটো রুম বুক করেছিল। একটা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস তুহিন মিত্র, অন্যটা মিস্টার মহেশকুমার। আর আপনার ছবি তো নিয়মিত কাগজে –ম্যাগাজিনে ছাপাই হয়। ফলে আপনার আঙুলে কবে থেকে আংটির আবির্ভাব হল, তারও একটা কাছাকাছি দিন পাওয়া গেল এবং দেখা গেল সেটা ওই নভেম্বর মাসেরই প্রথম সপ্তাহ। তার পর যেদিন পৃথা সৌম্যকে তুহিনের মেসেজটা পাঠাল, সেইদিনই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সৌম্য আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। আপনি প্রথমে দেখা করতে না চাইলেও সৌম্যর পরিচয় দিতেই দেখা করতে রাজি হয়ে গেলেন। আপনার মত একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়ে গেলেন, তাও আবার যাকে কেউ অফিসিয়ালি রিক্রুট করেনি, এটা কি হয়? যদি না আমাদের যিনি আনঅফিশিয়ালি রিক্রুট করেছেন তিনি আপনাকে অলরেডি সেটা ইনফর্ম করে থাকেন? আমরা সেদিনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও কনফার্মেশনের জন্য পৃথাকে বলা হল, কোনও এক বিশ্বস্ত বন্ধুর বাড়ি গিয়ে আত্মগোপন করতে। যখন পৃথা এই ক্রিটিক্যাল সময়ে মেয়েকে নিয়ে আপনার বাড়ি গিয়ে উঠল, তখন আর সংশয়ের কোনও অবকাশ রইল না।”

    পৃথা একটু ঘাড় নেড়ে বলল, “কিন্তু তাই বলে আপনারা আমাকে তুহিনের খুনি বলে সন্দেহ করবেন?”

    রজত বলল, “কী করা যাবে বলুন? যদিও তুহিনের সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো হয়ে উঠেছিল এবং আপনার আর মহেশবাবুর বিয়ের ব্যাপারেও তুহিনের পুরো সমর্থন ছিল, কিন্তু তুহিনের মৃত্যুতে যদি কারোর সব থেকে বেশি লাভ হয়, তো সে আপনার এবং মহেশবাবুর। ডিভোর্স হয়ে গেলে তো কোম্পানিতে তুহিনের অংশটা আর আপনি পেতেন না। কিন্তু এখন তুহিনের অংশের মালিক আপনি আর অন্য অংশের মালিক মহেশবাবু। অর্থাৎ, দু’জনে মিলে আপনারাই পুরো কোম্পানির মালিক। প্লাস, রাইসিন আর ইনহেলার দুইই আপনাদের হাতের নাগালের মধ্যে ছিল। তাই না?”

    তুষারবাবু এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি। এই প্রথম উনি মুখ খুললেন। পৃথার দিকে একটা ঘৃণাভরা দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললেন, “তোমাকে আমি নিজের মেয়ের মত দেখতাম। তোমার আর তুহিনের ঝগড়া হলে আমি সব সময় তোমাকেই সাপোর্ট করেছি। তুমি যে এরকম করতে পারো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।”

    রজত তুষারবাবুকে কোমল স্বরে বলল, “তবে কাকু, আমাদেরও ভুল হতে পারে। হয়তো অন্য কেউ ইনহেলারে বিষ মিশিয়েছে পৃথার অগোচরে?”

    তুষারবাবু বললেন, “পৃথার অগোচরে কে ওর ঘরে ঢুকে বেডরুমের আলমারি খুলে ওষুধের বাক্সে হাত দেবে?”

    রজত বলল, “সেটাই তো প্রশ্ন। পৃথা যে বেডরুমের আলমারিতে ইনহেলার রাখে, সেটা কে জানবে? আর ইনহেলারের গায়ে পৃথা আর তুহিন ছাড়া যে তৃতীয় হাতের ছাপ আমরা পেয়েছি সেটাই বা কার?”

    সৌম্য এবার একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “আচ্ছা তুষারবাবু, আপনি কী করে জানলেন যে পৃথা বেডরুমের আলমারিতে ইনহেলার রাখে?”

    তুষারবাবু অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, “আমার নিজের বাড়ি আর আমি জানব না? আশ্চর্য।"

    সৌম্য বলল, “তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এটাও জানেন, যে ওরা ঘরের কোথায় দরকারি কাগজপত্র রাখে? কিংবা ধরুন মেয়ের খেলনাপত্র?”

    তুষারবাবু আরো বেশি বিরক্তির স্বরে বললেন, “আমি কি বিবাহিত ছেলের বেডরুম সার্চ করি নাকি, যে ওরা কোথায় কী রাখে সেটা জানব?”

    সৌম্য বলল, “ঠিক কথা। তুহিনের বিয়ের আগের থেকেই ওর দিকের অংশে আপনার বিশেষ যাতায়াত ছিল না। আর বিয়ের পর থেকে তো আপনি ওর অংশে কখনো যাননি। অন্তত বাড়ির কাজের লোকেরা তো তাই জানাল। সুতরাং ঘরের কোথায় ওষুধের বাক্স থাকে, সেটাও আপনার জানার কথা নয়, কিন্তু আপনি জানেন। সে যাক গে, আমি বরং অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মহেশবাবুদের ফার্মা কোম্পানিতে রাইসিন নিয়ে যে রিসার্চ চলছে, তার প্রিলিমিনারি সাকসেসের খবর জানিয়ে ওঁরা একটা সেমিনার আয়োজন করেছিলেন গত ডিসেম্বরে, যাতে আপনি প্রধান অতিথি ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানটার কথা কাগজে-টাগজেও বেরিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানটার কথা আপনার মনে আছে?”

    তুষারবাবু বললেন, “অনেক অনুষ্ঠানেই আমাকে যেতে হয়। সব কিছু ডিটেল্সে মনে রাখা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, ওই রকম একটা কিছুতে গিয়েছিলাম বটে।”

    সৌম্য বলল, “গুড গুড। মনে নাই থাকতে পারে। আচ্ছা, আরেকটা কথা দেখুন তো মনে পড়ে কিনা – রাস্তার কুকুরদের মারার জন্যে আপনি রাইসিন স্যাম্পল আনিয়েছিলেন। পরে সেটা কাগজে ফাঁস হয়ে যাওয়াতে অনেক অ্যানিম্যাল রাইট অ্যাক্টিভিস্টস হৈচৈ শুরু করে দিয়েছিল। তখন আপনারা সেই প্রজেক্ট বাতিল করে দেন। এটা বোধহয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির ঘটনা, তাই না?”

    তুষারবাবু শুধু মাথা নাড়লেন।

    - ওই রাইসিন স্যাম্পল নিশ্চয়ই আপনার অফিসেই আছে। আশা করি সেই ভায়ালের এখনো সিল ওপেন করা হয়নি। আর যদি ওপেন করা হয়েও থাকে, সেটার পরিমাণ নিশ্চয়ই বিন্দুমাত্র কমেনি, তাই না?

    এইবার তুষারবাবুর গলা কড়া হল। বেশ রাগত স্বরেই সৌম্যকে বললেন, “তুমি কী বলতে চাইছ হে ছোকরা?”

    সৌম্য খুব শান্ত স্বরে বলল, “বলতে চাইছি, যে আপনি জানতেন না যে তুহিনও ওই একই ইনহেলার নেওয়া শুরু করেছে। জানলে এত বড় ভুলটা করতেন না। অবশ্য জানবেনই বা কী করে? এটা তো খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। কী ডাক্তার সান্যাল, ঠিক বললাম তো?”

    ডাক্তার স্যান্যাল এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি। সৌম্যর প্রশ্নের উত্তরে এতক্ষণে এই প্রথমবার মুখ খুললেন। “হ্যাঁ, খুবই রিসেন্ট, ধরুন উনি মারা যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগের ঘটনা। পৃথা আমার বহুদিনের পেশেন্ট। রিসেন্টলি তুহিনবাবু ওঁর সাথে আসেন। আমাকে বললেন, যে ওঁর আজকাল প্রায়ই নিঃশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষত ধোঁয়া-ধুলোর জায়গা, যেমন কোনো পার্টি-টার্টিতে গেলে। আমি ওঁকে বলি, দরকার মত ওই ইনহেলারটা ব্যবহার করতে।”

    - ধন্যবাদ ডাক্তার সান্যাল। আমার মনে আছে, আমরা প্রথম যেদিন এই বাড়িতে আসি, সেদিন তুষারবাবু কথায় কথায় বলেছিলেন, যে তুহিন সুস্থ সবল ছেলে, শরীরে সামান্য কোনো রোগ-ব্যাধিও নেই। সত্যি কথা। এই রিসেন্ট এলার্জি ব্যাপারটা বাদ দিলে তুহিনের মত সুস্থ নীরোগ মানুষ পাওয়া মুশকিল। অতএব তুষারবাবু কল্পনাও করতে পারেননি, যে ওঁর বিষ মেশানো ইনহেলারটা পৃথার বদলে তুহিনের কাছে পৌঁছে যাবে। ওই যে শুরুতে বললাম – কে কী জানে আর না জানে তার ওপর এই কেসটা দাঁড়িয়ে আছে। ভেবে দেখুন, তুষারবাবুর জানা-মত তুহিন যাচ্ছে মুম্বাই। এই অবস্থায় যদি বাড়িতে হঠাৎ করে পৃথার হার্ট অ্যাটাক হয়, তাহলে কেউ কিছুমাত্র সন্দেহ করবে না, বিশেষত যেখানে পৃথা একজন ক্রনিক কার্ডিওভাসকুলার পেশেন্ট। ডাক্তার এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন, দেহ দাহ হয়ে যাবে, কোনোরকম পোস্টমর্টেম ছাড়াই। তুহিনও থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এর মধ্যে কোনো এক সময় আলমারিতে রাখা ইনহেলারটা পাল্টে দিলেই কেল্লা ফতেহ। এই জন্যই রাইসিন ব্যবহার করা, যাতে কোথাও কোনো সন্দেহ উদ্রেক না হয়। ভেবে দেখুন, যদি তুহিনের মৃতদেহ রাস্তায় পাওয়া না যেত, তাহলে হয়তো ওর বডিও পোস্টমর্টেম হত না। তুষারবাবু, আপনিও একটা পারফেক্ট ক্রাইম প্ল্যান করেছিলেন। কিন্তু কথায় বলে, রাখে হরি মারে কে, মারে হরি রাখে কে?”

    সৌম্যর কথা শুনে স্প্রিং-এর মত ছিটকে উঠলেন তুষারবাবু। দিব্যেন্দুবাবু হাত বাড়িয়ে ধরে না নিলে হয়তো চড়াও হয়ে যেতেন সৌম্যর ওপর। দিব্যেন্দুবাবুর ধরে থাকা অবস্থাতেই গর্জে উঠলেন, “চোপরাও ছোকরা। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? জানো তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছ?”
    তারপর দিব্যেন্দুবাবুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওঁকেই বললেন, “আর আপনার চাকরি কে বাঁচায় আমি দেখব। এতক্ষণ ধরে অনেক নাটক সহ্য করেছি। আমার ছেলেটাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা বলে চলেছে এই দু’পয়সার ডিটেক্টিভ। আপনার ছেলেকেও তো শুনেছি নাকি এর বাড়িতেই রেখেছেন। ছি ছি। তবে আপনার ছেলেকে কোথায় শোওয়াবেন, সে আপনার ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু ওদের ডিটেকটিভগিরির ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য আপনি যদি আমার পরিবারকে এই নোংরামিতে জড়ান আপনাকে আমি দেখে নেব। আপনি আমাকে চেনেন না।”

    রজত মুখ নীচু করে আড়চোখে দেখল বাবার মুখচোখ লাল হয়ে গেছে। তবুও পদমর্যাদা রক্ষা ক্ষেত্রে নিজেকে সংযত রেখেছেন।

    সৌম্য বরফশীতল গলায় বলল, “আপনাকে সত্যিই কেউ চেনে না। তবে এবার চিনবে।”

    সৌম্যর কথায় তুষারবাবু এবার একটু থমকালেন। তারপর বললেন, “তোমায় আমি জেলের ঘানি ঘোরাব ছোঁড়া। এ শুধু আজ বলে না, তুহিনের ওপর তোমার অনেকদিনের নজর। সে সব কি আমার জানতে বাকি আছে? তোমাদের ওই নরকে আমার ছেলেকে টানতে চেয়েছিলে। আমি সেটা হতে দিইনি বলে সেই রাগের শোধ এখন আমার ওপর তুলছ। কী হে, ঠিক বলছি তো?”

    সৌম্য আগের মতনই ঠান্ডা গলায় বলল, “অনেকটাই ঠিক বলেছেন। আপনিই তুহিনকে কখনও ওর জীবনটা বাঁচতে দেননি। আপনার ভয়ে ও কুঁকড়ে থাকত। আর নরকের কথা বলছেন? নিজের ছেলের জীবনটা যে নরক আপনি বানিয়েছিলেন, তার থেকে বেশি খারাপ আর কী হবে?”
    তারপর অন্যদের দিকে ফিরে বলা শুরু করল, “আমার থেকে ভালো আর কে জানে, এই ভদ্রলোক তুহিনকে সারা জীবন কীভাবে দমিয়ে রেখেছেন? উনি খুব ভালো করেই জানতেন, যে তুহিন গে। সেই জন্য উনি তুহিনকে উঠতে বসতে কম হেনস্থা করেননি। শেষমেশ শুধুমাত্র নিজের ইমেজ বাঁচিয়ে রাখতে উনি তুহিনের জোরজবরদস্তি বিয়ে দেন। ভেবেছিলেন, বিয়ের খোলস পরিয়ে তুহিনের সেক্সুয়ালিটিকে সমাজের থেকে লুকিয়ে রাখবেন। তুহিনেরও সাহস ছিল না বাবার সামনে মুখ খোলার। ফলে বিয়েটা হয়েই গেল। ওদের মেয়ে হল একটি। তুষারবাবুর মিশন কমপ্লিট। কিন্তু গোল বাধল এর পর। পৃথা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী মেয়ে। সহজেই ধরে ফেলল অল ইজ নট ওয়েল। শুরুতে ঝগড়াঝাঁটি হত আর সত্যিই তুষারবাবু তখন পৃথার সাইড নিতেন। কিন্তু পৃথা যখন বুঝতে পারল, যে আসল সমস্যাটা কোথায় – ও তখন বরং তুহিনের বন্ধু হয়ে উঠল।
    আমি একটু আগেই বলেছি, যে আমি ঋক আর তুহিনের সম্পর্কের কথাটা শোনার পর খুব অবাক হয়ে গেছিলাম। আরও অবাক হয়ে গেছিলাম এ’কথা শুনে যে তুহিন গে পার্টিতে গেছিল। যে তুহিন বাবার ভয়ে কখনও আমি বা অন্য কোনও গে বন্ধুর সাথে সিনেমা বা পার্কে যায়নি, সে যাচ্ছে পার্টিতে?
    রজত আমার মুখে এই কথা শুনে তুহিনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটা শুরু করল। ও-ই আমাকে দেখাল, যে গত বছরের মে মাসের পর থেকে ওর প্রোফাইলে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। আগে ওর প্রোফাইল জুড়ে থাকত হয় বিষণ্ণ কোটেশন আর নয়তো কাজের খবর। মে মাসের পর থেকে দেখলাম, অনেক হাসিখুশি খোলামেলা পোস্ট। সবথেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, ক্যুইয়ার ইস্যু সংক্রান্ত পোস্ট। যারা তুহিনকে চিনত, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে যে এটা পুরো যেন একটা মেটামরফসিস। ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল। আর এই ব্যাপারটাই তুষারবাবুর সহ্য হল না। এতদিন ধরে এত সাবধানে তিনি ইমেজ বাঁচিয়ে চলেছেন, এখন কি শেষে তীরে এসে তরী ডুববে? উনি বুদ্ধিমান মানুষ। সহজেই বুঝে গেলেন, এই সাহসের উৎস কোথায়। আমার ধারণা, পৃথা আর মহেশের সম্পর্কের খবরটাও কোনোভাবে ওঁর কানে এসেছিল। বুঝলেন, ওঁর তথাকথিত পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে পৃথাকে সরিয়ে দেওয়াই সবথেকে সহজ উপায়। পৃথা সরে গেলে উনি আবার তুহিনকে নিজের কবজায় আনতে পারবেন। অন্তত, এমনটাই উনি ভেবেছিলেন।”

    তুষারবাবু এবার তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “এত গল্প কোর্টে প্রমাণ করতে পারবে তো হে ছোকরা?”

    সৌম্য একটু হেসে বলল, “হয়তো পারব না। ইনহেলারে আপনার হাতের ছাপ, আপনার অফিসের সিল খোলা রাইসিন, আর কিছু পারিপার্শিক প্রমাণ ছাড়া আমার হাতে আর কিছু নেই। তাছাড়া সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেও, আইনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ম্যাজিক তো আপনাদের মত পলিটিশিয়ানদের হাতের মুঠোয়। তবে কী জানেন তো তুষারবাবু, যে ছেলেকে আপনি নিজের ঠুনকো সামাজিক প্রতিপত্তির জন্য ঠিকমত বাঁচতে দেননি, যার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী, সে কিন্তু আপনার সম্মান বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ব্ল্যাকমেলারের হোটেলে যেতে দু’বার ভাবেনি। আপনি একটু আগে বলছিলেন না, যে আমি পুরোনো রাগ থেকে এসব বলছি? রাগ তো দূরের কথা, আপনার কথা ভাবলে আমার ঘেন্নাও হচ্ছে না। যেটা হচ্ছে, সেটা করুণা। আপনাকে দেখে আমার করুণা হচ্ছে। নিজের জীবনটা নিজের মত করে বাঁচলেন না, এমন ছেলেকে হারালেন, যে আপনার মন জয় করার জন্য পৃথিবীর সবকিছু করতে পারত, আর যে ঠুনকো ইমেজ আর ভোট ব্যাঙ্ক-এর কথা ভেবে এই সব করলেন, সেই ইমেজও এখন নষ্ট হবে – যখন ব্ল্যাকমেইলিং আর ঋকের মৃত্যুর কেসটা কোর্টে উঠবে। তখন কিন্তু যে ভিডিওগুলো পাবলিক হওয়া থেকে তুহিন আপনাকে রক্ষা করছিল, সেই ভিডিওগুলোও সবার সামনে আসবেই। আর ছেলের বয়সী একজন জিগোলোর সাথে প্রবীণ মন্ত্রী তুষার মিত্রের সেম-সেক্স ভিডিও পাবলিক কেমন লুটেপুটে খাবে, সে তো আপনি বুঝতেই পারছেন। আপনার একূল ওকূল দুকূলই গেল, তুষারবাবু।”

    সৌম্যর কথা শেষ হতে রজত তাকিয়ে দেখল, যে লোকটা একটু আগে গর্জাচ্ছিল, সে কেমন একটা ভাঙাচোরা মূর্তির মত মাথা নীচু করে বসে আছে।


    (চলবে)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৫১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:০৪511603
  • মারাত্মক! এরকম মোড় নেবে ভাবাই যায়নি! 
  • Kausik Ghosh | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:২৪511620
  • শৌভিকের অপরাধ ধরা পড়া দিয়ে শেষ হবে ভেবেছিলাম। শেষে অনেকগুলো মোচড় রাখলেন লেখক।
    উপভোগ্য হচ্ছে।
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:6c5e:6191:5848:d82 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৩১511626
  • চমৎকার!  এই নখের কোণে আটকে থাকা স্কিনটিস্যু থেকে ডিএনএ ম্যাচ করানো জাতীয় ফরেন্সিক ডিটেলগুলো আনা হয়েছে এটা খুব ভালো লাগছে। ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে টেকনোলজি এত এগিয়ে গেছে যে সেগুলো অস্বীকার করে গোয়েন্দার পক্ষে এগোনো বেশ অবাস্তব ব্যাপার। আপনি এইদিকে খেয়াল রেখেছেন এটা খুব ভালো লাগছে। এখন আর শুধুমাত্র লিটল গ্রে সেলস দিয়ে কাজ চলেনা।
  • যোষিতা | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০২:১০511627
  • উরিত্তারা! কাহানি মেঁ সাংঘাতিক টুইস্ট তো!
  • :|: | 174.251.161.224 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৩:৩৬511630
  • কি ক্কান্ড! মন্ত্রী মশায়ের কেচ্ছা বলে কেচ্ছা! 
    দিল্লী পুলিশ আর কপু বা রাজ্য পুলুশ উল্টো পার্টির। ফুল দুটো বুঝে ফেলিচি। এইবার মন্তিরির আসল নাম বার করে ফেলাই হবে পরবর্তী গল্পের বিষয়। 
     
    সত্যিই ভালো প্লট হয়েছে। একেবারেই প্রেডিক্টেবল নয়। 
  • Biswaroop Chatterjee | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৩৭511633
  • গল্প তো নয়, গোলকধাঁধা!  কোথায় শুরু হ'লো আর কোথায় পৌঁছলো। এখন আবার এক সপ্তাহ বসে থাকতে হবে; কি হ'লো জানতে।  যত্তো ঝামেলা।  
     
    ​​​
  • Ranjan Roy | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৩১511636
  • টুইস্ট পে টুইস্ট ! টুইস্ট পে টুইস্ট !
     
    দারুণ! দারুণ!
    শেষ কিস্তির অপেক্ষায়। 
  • Biswaroop Chatterjee | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:১৮511643
  • আবার মন্তব্য করছি - পর্বটা সকালে পড়ার পর থেকে ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আর মনস্তাত্ত্বিক স্তরগুলো পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে খুলে আসছে। অসম্ভব ভালো লেখা।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন