এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রিনিঝিনি তালে তালে, দোল দোল দোদুল দোলে

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ আগস্ট ২০২২ | ৩২৪ বার পঠিত
  • সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত বিবেক দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে নিতে ভাবে পঁয়ত্রিশ বছর প্রায় হয়ে গেল তার সংসার-ধর্ম শিখার সাথে, কিন্তু আজও সে ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারলো না তার স্ত্রীকে। তার কী যে মায়া এই সংসারের প্রতি ! একঘন্টার উপর হয়ে গেল সবার দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু শিখার পাত্তা নেই। এখনও সে রান্নাঘরে ব্যস্ত কাজের মাসির সাথে। বাসন ধুচ্ছে রাসমণি মাসি। যতক্ষণ না সে ধোয়া বাসন পরিপাটি করছে, দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করবে শিখা। এখন তাদের ছেলে কিশোরের বউ রনি জুড়েছে এই সংসারে প্রায় বছরখানেক হলো, দিতে পারে তাকে এই তদারকির দায়িত্ব। কিন্তু দেবে না। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সংসারের ঘানি টানলো দুজনে। এখন একটু আরাম করার, গল্প-গুজব করার সময়। তা নয়, নিজেই সব করবে।

    বিবেকের মনে পড়ে যায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে পুত্রবধূ হয়ে যখন শিখা প্রবেশ করলো এই সংসারে। তাদের  পুরী থেকে ঘুরে আসার পরপরই পুরো সংসার যেন হাতের মুঠোয় তুলে নিল। তখন হানিমুন বলতে ছিল পুরী অথবা দীঘা কিংবা মেরেকেটে দার্জিলিং। আর এখন তো বিদেশভ্রমণ না করলে নাকি হানিমুনটা কেমন যেন বিস্বাদ, ফিকে ফিকে লাগে। তারপর আবার স্টেটাস জানাতে কিসব ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম হয়েছে না - ফটো ঝোলাতে না পারলে ইজ্জত থাকে না বন্ধুদের কাছে। কিশোর আর রনিও ঘুরে এসেছে আমস্টারডাম, আরও কত কি সব জায়গায় - নামটাম ঠিক খেয়াল রাখতে পারে না !

    পুরী থেকে তথাকথিত হানিমুন সেরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বাবা বলেন, "বৌমা জানো আমার সরকারি পেনশনের কয়েক বছরের আটকানো গিঁট গতকাল খুলে গেছে। তুমি আমাদের জন্য সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী।" বাবাকে সময় করে ওষুধ এগিয়ে দেওয়া, ঘন ঘন  চা বানিয়ে বারান্দায় দিয়ে আসা, বাবার পছন্দের পোস্তবাটা-ধোকার ডালনা বানানো, আরও কতোকি সব যোগান দিয়ে যেত শিখা মুখের হাসিটি বজায় রেখে। শ্বশুরমশাইয়ের সাথে বাজার যাওয়া, গ্যাসের দোকানে গিয়ে সিলিন্ডার বুক করা, রেশন তোলা - সব কাজ একে একে শিখে নেয় শিখা। মাসখানেকের মধ্যেই শ্বশুরমশাই শিখা ছাড়া আর এক পাও চলতে পারেন না। শ্বশুরমশাই তখন শিখার আঁচলের গিঁটে বাঁধা। শুধু দরকার তখন শিখার সংসারের চাবির গোছাটা হাতানো শাশুড়িমায়ের আঁচল থেকে।

    সহজে কী শাশুড়িমা চাবির গোছা হাতছাড়া করেন ! প্রথম প্রথম মা কাজে হাত লাগাতে গেলেই হা হা করে ছুটে আসত শিখা। বলতো, "মা, আপনার বয়স হয়েছে। এখন আপনার আরাম করার সময়। সারা জীবন তো এই সংসারের ঘানি টানলেন, এবার একটু বিশ্রাম করুন। আশেপাশে সইদের বাড়িতে গিয়ে গল্প-গুজব করুন। আমি সব সামলে নেব।" কিন্তু শাশুড়িমা কি সহজে সংসারের কর্তৃত্ব ছাড়েন ! শ্বশুরমশাই খাওয়ার পাতে বসেই বলেন, "রান্নাটা বোধহয় আজ তুমি করোনি বৌমা ?" বৌমা পাশেই দাঁড়িয়ে, সব দেখেশুনে যত্ন সহকারে দিচ্ছে বাবাকে খেতে। বৌমার নরম সুরে বিগলিত গলায় চোখ মেঝের দিকে নামিয়ে উত্তর, "না বাবা, আজ মা নিজেই করেছেন সব।" শ্বশুরমশাইয়ের জবাব, "তাই ভাবি, মাছের ঝোলটা এরকম স্বাদহীন বিস্বাদ হয়েছে কেন ? এতো দাম দিয়ে সোনালী দেশি ট্যাংরা আনলাম। বৌমা, তুমি সেই যে কয়েকদিন আগে মাখামাখা ঝালঝাল করে  রেঁধেছিলে - এখনও তা জিভে লেগে আছে।" শাশুড়িমা তখন রান্নাঘরে বসে গজগজ করছেন, "বুঝলি বিবেক, তোর বাপের নোলা  বেড়ে গেছে। এখন আর নিজের বউয়ের হাতের ফিকা রান্না তার পছন্দ নয় - সারাজীবন যেটা আহা আহা করে খেয়ে অফিস করলো।"

    ফলস্বরূপ শাশুড়িমায়ের শুরু হলো পাড়া বেড়ানো, বৌমার পরামর্শ অনুযায়ী। কিন্তু চাবির গোছা আঁচলে বাঁধা। দেখতে দেখতে বছর দেড়েক কেটে গেল। শিখার কোল আলো করে এলো ফুটফুটে ছেলে। প্রায় কেড়েই নিলেন নাতিকে শাশুড়িমা শিখার কোল থেকে। অভিযোগ, "বৌমা কি কোনোদিন ছেলেপুলে মানুষ করেছে ?" যেন উনিও বিরাট বিশারদ ছিলেন ছেলেপুলে সামলানোর, নিজের জন্মের পরপরেই ! যাইহোক বুকের দুধটুকু খাওয়ানো ছাড়া শিখা ছেলের ব্যাপারে ঝাড়া হাত-পা, নাতি পুরোপুরি তার ঠাকুমার হেফাজতে। আর এই সুযোগে শিখা একদিন টুক করে চাবির গোছাটা তার শাশুড়িমায়ের আঁচল থেকে খুলে নিজের আঁচলে শক্ত করে গিঁট বেঁধে গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করলো, 'রিনিঝিনি তালে তালে, দোল দোল দোদুল দোলে।'

    বিবেক খেয়াল করেছে বৌমা রনির চকচকে দৃষ্টি তার শাশুড়িমায়ের আঁচলে বাঁধা চাবির গোছার দিকে। যেন ভাবছে কবে তার ওড়নার আঁচলে এসে দুলতে শুরু করবে সেটা ! কিন্তু বিবেক ভাবে, আজকালকার মেয়েদের কি শিখার মতো ধৈৰ্য্য আছে কিংবা কাজ করার ইচ্ছা ! যেই দুপুরের খাওয়া হয়েছে, নিজের ঘরে গিয়ে এসি চালিয়ে শুয়ে পড়েছে আর শাশুড়িমা লেগে রয়েছে রাসমণির সাথে।      
                       
    বিবেক এইসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই, শুনতে পায় সুমিষ্ট রিনঝিন আওয়াজ। শাড়ির আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটি দোলাতে দোলাতে প্রফুল্ল মুখে শিখার প্রবেশ ঘরে।
    "আজকে কী হয়েছো জানো ? তোমার মা তার নাতবৌকে পাশে বসিয়ে ফোকলা মুখে হাসি ছড়িয়ে শিখাকে বলেন - 'বৌমা তোমারও তো অনেক বয়স হলো সংসারের ঝক্কি সামলাতে সামলাতে। এখন নাতবৌ এসেছে, চাবির গোছাটা ওর ওড়নার আঁচলে বেঁধে দাও।' আমিও দিয়েছি সেরকম মোক্ষম জবাব মিষ্টি মিষ্টি গলায় - 'ওদের তো সবে বিয়ে হয়েছে মা। এখন আনন্দ করবে, ঘুরে বেড়াবে। এখন থেকেই যদি সংসারের জোয়াল জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় সেটা কি ঠিক হবে, বলুন ? ওটা তো জুলুমের মতো হবে - যেমনটা আমার উপর করা হয়েছিল। চাবির গোছা তো আমার আঁচলে বাঁধা থাকলই, ধীরে সুস্থে পরে সংসারের ভারটা চাপালেই হবে।‘  ঠিক বলেছি কিনা বলো তুমি। কষ্ট করে বাগানো চাবি এত সহজে ছেড়ে দেব ?"
    "তুমি কি কিছু বেঠিক বলতে পারো ? মাঝে মাঝে ভাবি, তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছিলেন। তোমাকে রাজনীতির সাথে জুড়ে দিতে হতো। নিদেনপক্ষে, মন্ত্রী না হতে পারলেও - মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান অবশ্যই হতে পারতে।"

    বিবেকের খোঁটাতেও কোনো বিরাগ নেই শিখার। অভিঞ্জ রাজনীতিবিদদের মতো এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে, "তা যা বলেছো !"                          
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন