এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নীলিমার নজরুল 

    Diponkar Chanda লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ মে ২০২২ | ৫৭৯ বার পঠিত
  • অনেক সকালে ঘুম ভাঙল নীলিমার। 
    শুভ সকাল। নিজেই নিজেকে মিষ্টি করে বলল সে, মনে মনে। 
    বিছানা থেকে নেমে হেঁটে গেল জানালার সামনে। পর্দা সরাল। 
    সুদীর্ঘকাল অপেক্ষমাণ প্রকৃতির প্রশান্ত মুখ যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে। 
    দূরে পিচঢালা পথ অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। 
    ধুলোবালিগুলো এখনো উড়ে বেড়ানোর শক্তিরহিত অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে। 
    ইলেকট্রিকের পোলে একটা দোয়েল বসে আছে চুপচাপ। 
    নিঃশব্দ প্রকৃতিতে মগ্ন হয়ে আছে পাখিটা।

    বেলা বাড়ল। 
    আজ ভীষণ পড়তে ইচ্ছে করছে নীলিমার। 
    বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা কয়েকটি নিবন্ধ পড়ে আছে টেবিলের ওপর বেশ কয়েকদিন হলো! পড়ে ফেলবে নাকি আজ? 
    খুব গুরুগম্ভীরভাবে না পড়ার পক্ষে নীলিমা। 
    এলোমেলোভাবে পড়া শুরু করল সে। হাতে একটা পেন্সিল। কোনো লেখার কোনো অংশ বিশেষভাবে মনে দাগ কাটলে আন্ডারলাইন করার বাজে অভ্যাস আছে তার। কতজন কতকিছু বলে এ ব্যাপারে। কিন্তু এ কাজটা হয়েই যায় নীলিমার অবচেতনে।

    পড়া শুরু করল নীলিমা। "...নজরুল হিন্দুপ্রধান রাঢ়বঙ্গে জন্মগ্রহণ করলেও মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গের অভিজ্ঞতা তাঁর কম ছিল না। তাই সম্প্রদায়গত সমস্যা তাঁর মতো করে অন্য কোনো কবি সাহিত্যিক বুঝতে পারেননি। পারেননি সংস্কৃতিকর্মী বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব।..."

    ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো। 
    কথাগুলোর নিচে বেশ গভীরভাবে পেনসিলের দাগ দিলো সে। 
    তারপর আবার পড়া শুরু করল এলোমেলোভাবে। "...উল্লেখিত সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা সঠিকভাবে উপলব্ধির কারণে নজরুল দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মিলনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর বিচক্ষণবোধে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে দেশের দুই বিবাদমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া ‘বিদেশী হঠাও’ অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনের কাজটি মোটেই সহজ হবে না। তাই এ দুই মেরু মেলানোর ব্রতই হয়ে ওঠে তাঁর জন্য প্রধান কাজ- যা প্রকৃতপক্ষে ছিল এক অসম্ভবের সাধনা।... কিন্তু নজরুল পিছুহটতে রাজি ছিলেন না। ...তাই সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সবাইকে লড়াইয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নজরুল লেখেন : ‘এস ভাই হিন্দু। এস মুসলমান। এস বৌদ্ধ। এস ক্রিশ্চিয়ান। আজ আমরা সবগণ্ডি কাটাইয়া সব সঙ্কীর্ণতা, সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ আশ্চর্য যে নজরুলের ওই সর্বজনীন আহ্বানে সবাই একযোগে সাড়া দেয়নি।..."

    কিন্তু কেন? সাড়া দেয়নি কেন? নীলিমা ভাবে।
    অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবে। 
    এর জন্য দায়ী কি ওই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতা? 
    নাকি ওই সময়ের ধর্মীয় সংগঠনগুলোর রক্ষণশীলতা? 
    নাকি কোনোটিই সত্য নয়? 
    নাকি ভিন্ন কোনো সত্য অন্তরালে ক্রিয়াশীল? ঠিক জানে না নীলিমা!

    ভিন্ন একটি নিবন্ধে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার, সেখানে লেখা, "...শুধু দুই ধর্মীয় সংস্কৃতির ছাপই নয়, দুই সম্প্রদায়কে একই বৃত্তের অন্তর্গত করার এবং একই ধারায় চলার ক্ষেত্রে উদ্দীপ্ত করে তোলার অভিপ্রায় নিয়ে নজরুল সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সমন্বয়বাদী পথ তৈরি করেছিলেন, রাজনৈতিক চলার পথও নির্ধারণ করেছিলেন। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজনে’ নিছক কথার কথা ছিল না, ছিল না প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন। ধর্মবিশ্বাস-নির্বিশেষে বাঙালি মাত্রেই এ মাটির মায়ের সন্তান- এ সত্যই তাঁর জন্য ছিল বড়, এবং সবার জন্যই তা সত্য বিশ্বাসে পরিণত করতে আপ্রাণ লড়াই করে গেছেন নজরুল। ভৈরবী-সুরে গভীর বিশ্বাসে গেয়েছেন ‘মোরা এক বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মুসলমান’।
    তাঁর এ লড়াই ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায়, ছিল রাজনীতির চর্চায়। স্বাদেশিকতার ভুবনে স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠায় লড়াকু সৈনিক নজরুল এখানে কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না।..."


    পড়তে পড়তে আরো সামনে এগোল নীলিমা। 
    অদ্ভুত লাগছে তার পড়তে। একজন ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো দ্রুত সে পড়ল, "...অসম্ভবের সাধনা জেনেও ওই পথেই এগিয়েছেন নজরুল তাঁর ইসলামী গান আর কীর্তন শ্যামাসঙ্গীতের পসরা নিয়ে। কবিতায় হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির বিশিষ্ট শব্দ, মিথ ও অনুষঙ্গ অকাতরে ব্যবহার করে। তাঁর গদ্যরচনাও একই আদর্শের প্রকাশ ঘটিয়েছে। 
    এসব কিছুর পেছনে ছিল স্বপ্নদ্রষ্টা কবির স্বাধীন বাঙালি জাতির জন্য এক শক্তিমান ভুবন নির্মাণ যা হবে সংকীর্ণতামুক্ত, এবং মানবিক বোধে ঋদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতার কলুষ সেখানে ছায়া ফেলবে না। তাঁর একাধিক অভিভাষণে তিনি একই কথা বারবার বলেছেন এবং জাতীয় জীবনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি এই যে আমরা সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম জানি।’ জাতিকে বোঝাতে চেয়েছেন যে আমাদের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ‘হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’..."


    নাহ! পড়ায় আর মন বসছে না নীলিমার। 
    তার চিন্তার জগতে উদিত হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ভিন্ন এক চেহারা! 
    নজরুলের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল সে। 
    বারান্দার উত্তরকোণে ছোট্ট একটা টবে অপরাজিতার লতা বাড়ছে কী বিচিত্র প্রাণের আবেগে! 
    দেখতে দেখতে নীলিমা ভাবতে থাকে, আমরা যে ধারায় নজরুলের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় চিহ্নিত করতে চাই, তাতে সম্ভবত নজরুলের খণ্ড চরিত্র উঠে আসে, সম্ভবত একটি পার্শ্বমুখের প্রকাশ ঘটে! সম্ভবত নজরুলের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পরিস্ফুট হয় না!
    ভাবতে ভাবতে নীলিমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আকাশে। 
    সেখানে অসম্ভব সুন্দর সজল মেঘ জড়ো হচ্ছে! 
    সম্ভবত ভীষণ বৃষ্টি হবে আজ!

    সহায়ক নিবন্ধ :
    ১. নজরুলীয় স্বদেশচেতনার নানামাত্রা, আহমদ রফিক
    ২. কেন নজরুল জাতীয় কবি, আহমদ রফিক
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন