এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভ্রান্তিবিলাস 

    রজত দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মে ২০২২ | ৫৬২ বার পঠিত
  • "উঁহু, ওটাতো ভ্রান্তিবিলাস নয় শান্তিবিলাস...।" 
    ষষ্ঠীদাকে থামিয়ে ফোনে আমি হাঁ হাঁ করে উঠলুম।

    "আরে ওইটাই তো ! আমারই ভুল হয়েছে। এ বাড়ির আসল নাম যে, 'শান্তিবিলাস' সেটা ভুলতেই বসেছি।" 

    বুঝলুম ষষ্ঠীপদ সরখেল এতক্ষণ ভুল বলছিল না। বেচারা মফস্বলের মানুষ। কলকাতায় এলে একটু ধাঁধিয়ে যায়। আমারই উচিত ছিল ওকে ঠিক করে বুঝিয়ে বলা। ওর সাথে এরপর কিছু কাজের কথা সেরে 'ভ্রান্তিবিলাস' বাড়িরই পিছনের দিক দিয়ে দোতলায় উঠে যাব। এই বাড়িতেই ভাড়া থাকি। বৃটিশআমলের পলেস্তারা খসে পড়া। বটগাছের শিকড় দিয়ে ডিজাইন করা। এক ঢাউস বাড়ি। তারই দোতলাতে দুটি ঘর জুড়ে আমাদের সংসার। ষাটটাকা ভাড়ায় দাদু এই বাড়ি এককালে জুটিয়ে ছিল। এখন ভাড়া বেড়ে হয়েছে পঁচাত্তর। ভাবছিলুম, ষষ্ঠীদার সাথে এই কাজটা যদি হয়ে যায়...! 

    একটা আধ খাওয়া বিড়ি, নেভিকাটের প্যাকেটে ভরে রেখেছিলুম। গলিতে দাঁড়িয়ে রংচটা পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে সেই বিড়িখানাই বের করে জ্বালালুম। প্যাকেটে দুটি সস্তার সিগ্রেট বাদে সবই বিড়ি। ক্লায়েন্ট মিট্ থাকলে তবেই সিগ্রেট খাই। নচেৎ সদাই বিড়িই ভরসা। বিড়িটায় দুটো সুখটান মেরে উদাস হয়ে ভাবছি। যদি কোটিখানেক পাই, তাহলে আমরা কে কি করব ? বা কি কি করব...!

    এমন সময়ে কাঁধে হাত। ঘুরে দেখি ট্যারাচোখো ঢ্যাঁড়সদা। ট্যারাচোখে অন্য কোনোদিকে তাকিয়ে বলল, 

    "কাজটা কদ্দুর এগোলো ? আর তোকে যে বলেছিলাম, পিসিমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষবি না...!"

    "কই, আমি তো যাইনি !" মিনমিনিয়ে বললুম। 

    "এ্যাই, মিথ্যে বলবি না। তোকে পিসিমা দেখেছে। আমায় জিজ্ঞেস করছিল, ভাড়াটে দালালটা বাড়ির চারদিকে আবার ঘুরঘুর করছে কেন রে ?"

    উফ ! কত সাবধানে রাতের অন্ধকারে সেদিন একটা পার্টিকে দেখাতে এনেছিলুম। বুড়ি ঠিক দেখে ফেলেছে..!

    "মাইরি বলছি। তোমার পিসিমা কোথায় ছিলেন দেখতেই পাইনি। দেখতে পেলে কেউ রিস্ক নেয় ? তবে নিশ্চিন্তে থাকো। আর তো কটা দিন ! পার্টি ফিট ধান্দা হিট...। বায়না হল বলে।" 

    ঢ্যাঁড়সদার ট্যারা চোখদুটো চকচক করছে। টের পেলুম। জাঁদরেল পিসিমার চোখ এড়িয়ে ভ্রান্তিবিলাসকে বিক্রি করা আর হাতিকে জাঙ্গিয়া পরানো, দুটোই সমান। 

    বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ সাহস রায়। ওরফে ঢ্যাঁড়সদার যত ক্যার্দানি মস্তানি সব ফুসস্ হয়ে যায়। পিসিমা সামনে এলেই ওর সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়। নামেই সাহস। আদতে ঢ্যাঁড়স।

    ঢ্যাঁড়সদার দাদু শেঠ ভীতরাম রায় বাহাদুর বৃটিশআমলে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর ছেলে ভোলারাম রায় ছিলেন ভীষণ ভুলোমনা। তাঁর ভুলের নানান কীর্তিকলাপ সকলের মুখে মুখে ঘোরে। ওনার জন্যই বাড়ির নাম শান্তিবিলাসের অপভ্রংশ "ভ্রান্তিবিলাস"। ভীতরামের ছেলে ও নাতি দুজনেই কুঁড়ে দ্য গ্রেট। বসে খেতে খেতে শেষ সম্বল, অগণিত ভাড়াটেশুদ্ধ বাড়িটাতেই আজ হাত পড়েছে। শুধু পিসিমার জন্যই তা সম্ভব হয়েও হচ্ছে না। 

    অবশেষে আমি আর ষষ্ঠী কোমর বেঁধে লেগেছি। এই দুই দালালের দালালিতে এবার হালাল হবেই ভ্রান্তিবিলাস। ষষ্ঠীর শাঁসালো খদ্দেরটা আজ বায়না করবে। গোপনে কাগজপত্র সব রেডি করিয়েছি। এবার শুধু পিসিমার সইটা হলেই... ঢ্যাঁড়সদা নাকি কিসব ঢপের চপ বুঝিয়ে পিসিমাকে রাজি করিয়েছে ! আমার হাড় জিরজিরে বুকটা আশায় বেঁধেছি। খোদ কলকাতার বুকে ষোলকাঠার ওপর দোতলা বাড়ি। বারো কোটিতে রফা হয়েছে। 
    বৈঠকখানায় সকলে গোল হয়ে বসে। ঢ্যাঁড়সদার হাতে ধরা অগ্রিমবাবদ এককোটির ড্রাফটখানা। পিসিমা ঘরে ঢুকলেন। তারপর বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, 

    "হ্যাঁরে ঢ্যাঁড়স, বন্ধকী বাড়ি কি বেচা যায় ?"

    "সে কি পিসিমা ? তারমানে ?" সকলে সমস্বরে বলে উঠলুম।

    "এই বাড়িটা তোর বাবা সেই কোনকালেই বন্ধক রেখে গেছে ! এই যে বসে বসে আজন্ম গিলছিস, সে কোন পয়সায় ? তা নাহলে কি সত্তরটাকার ভাড়াটেগুলোর ভাড়ার টাকায় সংসার চলছে ভেবেছিস ?" 

    এ কি শোনালো পিসিমা...! খান খান হয়ে ভেঙে যাওয়া বুকের ভিতর থেকে সব হাওয়া বাতাস যেন ফুস করে একসঙ্গে বেরিয়ে গেল।

     আড়চোখে দেখলুম। পিসিমার কথা শুনে ঘরের সকলে অন্যমনস্ক। এইফাঁকে এককোটির ড্রাফটটা হাতে নিয়ে হঠাৎ ঢ্যাঁড়সদা উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঘর ছেড়ে দুদ্দাড় করে দৌড় লাগালো। 
    আমিও এদিক ওদিক তাকিয়ে তড়াক করে লাফ মারলুম। তেড়ে ছুটলুম ওর পিছন পিছন...

    "ও ও ঢ্যাঁড়সদা, চললে কোথায় ? আমিও যাব তো....। আমাকেও নিয়ে চলো..…!"

    __________________________
    ©রজত দাস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন