এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • যযাতি 

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ এপ্রিল ২০২২ | ৬৬১ বার পঠিত
  • ১ 
    কিছুক্ষনের জন্য নীলচে অন্ধকার হয়ে গেছিল চারদিক। পরে হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরে এলে যযাতি রায়কে জানানো হয়েছিল, একটি বিশেষ খাদ্যে তার এলাৰ্জি ছিল যা সে জানতো না এবং খেয়ে ফেলায় তার শ্বাসনালী ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে চার ঘন্টার জন্য সে চলে গেছিল কোমায়, যা থেকে জেগে ওঠা প্রায় অলৌকিক ঘটনা। অলৌকিকভাবে কোমা থেকে জেগে ওঠার থেকেও, এই বিশেষ খাদ্যে এলাৰ্জির বিষয়টা জানতে যে তার অর্ধেক জীবন চলে গেল, এটাই তার রীতিমতন আশ্চর্য লেগেছিল।
    সে জীবনে সফল একথা বলা যায় , স্ত্রী , ছেলে মেয়ে , মাথার ওপর ছাদ , মাস গেলে টাকা। কিন্ত একবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরলে হয়ত মানুষের কাছে অনেক কিছুরই মানে বদলে যায়। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেও তাই নীলচে অন্ধকারটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছিল।
    চুনিবাবুর নাম্বারটা সে পেয়েছিলো সরসীজের কাছে। সরসিজ তাদের অফিসের চল্লিশের এক ডিভোর্সি যুবক। 
    ওই নাম্বারে শুধু মেসেজ করা যায় , কল করলে রিং বেজে যায় কিন্তু কেউ ধরে না। চুনিবাবু এক বা একাধিক নানা বয়সী মহিলা, কিছু অন্যরকম নেশার সামগ্রী সমেত সরবরাহ করে থাকেন। চুনিবাবুর নানা রকম প্যাকেজ আছে , তাতে সর্বনিম্ন একজন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পাঁচ জনকে একসাথে বুক করা যায়। চুনিবাবুকে সরসিজও মুখোমুখি দেখেনি কোনোদিন , তার ধারণা ওটা একটা এজেন্সির নাম , কোনো একজন লোকের নাম নয়। 
    আগে থেকে বলে দিলে চুনিবাবুর মেয়েরা রঙিন কিছু ট্যাবলেট নিয়ে আসে। তা খেলে চারপাশ সময় ধীর হয়ে যায় বলে মনে হয়। পাঁচ মিনিট কে মনে হয় আধ ঘন্টা , তাই তূরীয় আনন্দ আসে সেই সময়। 
    এই সব সময় নীলচে অন্ধকারটা ভালোভাবেই ফিরে ফিরে আসছিল তার কাছে , কিন্তু পুরোটা তাও ফেরত পাচ্ছিল না সে। ঠিক সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি  যেন আর হচ্ছিল না।
    পুরো অন্ধকার ফেরত না আসায় কিছুদিন বাদে এত নারী সঙ্গও অবিশ্বাস্যভাবে একঘেয়ে  লাগতে শুরু  করে তার, একধরণের অস্বস্তি জন্ম নেয় মাথায়। তারপর ঘাড় বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যযাতি বুঝতে পারে তার আনন্দ করার স্নায়ুগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে আবার। তারা চাইছে নতুন কিছুর স্বাদ।

    ২ 
    একদিন রোববার সকালে আকাশ মেঘলা করে ঝড় বৃষ্টি হল। দুপুরে ভাত, পাঁঠার মাংস খেয়ে ঘুমের পর বিকেলে সে নিচে নেমে এল চায়ের দোকানে যাবে বলে। রাস্তা পেরোনোর সময় এক গাড়ি এসে থামে , একজন কালো চশমা পরা যুবক মুখ বার করে বলেছিল - "চুনিবাবুর থেকে আসছি , অনেকদিন আপনি কিছু চান নি, আমাদের দিক থেকে কি কিছু সমস্যা হয়েছে যে আপনি পরিতৃপ্তি পান নি ? আপনি কি চুনিবাবুর সাথে নিজে দেখা করে এ ব্যাপারে আরো কথা বলতে চান ?”  
    সে সামান্য সন্দিহান হয়েছিল ছেলেটার পরিচিতি নিয়ে কিন্তু ছেলেটা আরেকবার বলাতে শেষে উঠে পড়েছিল গাড়িতে।
    গাড়ি চলতে থাকে , শহর থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে তারা। এখানে দুপুর বেলাতেও বৃষ্টি হয়েছে, তার পর এখন চারদিক ধুয়ে পরিষ্কার, মনোরম ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে। 
    একসময় ছেলেটা কথা বলতে শুরু করেছিল -”আপনার লজ্জা করে না?”
    "সেকি লজ্জা কিসের?"
    "আপনি একবার জীবন ফিরে পেয়েছেন, তারপর এরকম সব কাজ করে যাচ্ছেন! "
    "এসব কাজ আগে শুধু করব বলে ভাবতাম, একবার বেঁচে ফিরে এসে মনে হলো এগুলো সত্যি সত্যি একবার করে দেখি, আবার কবে মরে যাবো।"
    "এসব না করে অনাথ আশ্রমে শনি রোববার বাচ্চাদের পড়াতে পারতেন। দান ধ্যান করতে পারতেন, কত মানুষের কত কষ্ট, তাদেরকে সাহায্য করতে পারতেন। আপনার আগে যতজনকে আমরা জীবন ফিরিয়ে দিয়েছি,অনেকেই তো এরকম সব পজিটিভ কাজ করেছেন। "
    "অনেকে? জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন মানেই বা কি? আপনারা জীবন ফেরত দেবার কে?"
    "আমি কে সেটা না জানলেও চলবে, ধরে নিন প্রতিদিন একটা লটারী করা হয়, তাতে পুরো পৃথিবীতে যে কোন দশ জনকে জীবন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন আপনি দশজনের একজন ছিলেন তাই আপনি আরেকবার জীবন ফিরে পেয়েছেন। আর হ্যাঁ, আপনার মত অনেক ভোগবাদীই জীবন ফিরে পেয়ে শুধু ভোগই করে, তাদের সাথে চুনিবাবু নিজে দেখা করেন | আপনার সাথেও করবেন, কথা বলবেন। "
    একসময় গাড়ি থেমেছিল এক ধানমাঠের পাশে , আদিগন্ত সেই মাঠের মধ্যে দেখা যায় একটা বটগাছ। 
    ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে বলেছিল  , "আমার সাথে আসুন, ওই বটগাছের নিচে যেতে হবে। “
    যযাতিকে সে আদেশ করেনি , তবু নিছক কৌতূহলবশত অথবা বিশেষ এক সম্মোহনবশত সে কথা না বাড়িয়ে পা বাড়িয়েছিল নিৰ্দিষ্ট বটগাছটার দিকে। গোড়ালি অবধি জল থাকা মাঠের ওপর দিয়ে যেন ভেসে ভেসে বটগাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল ওরা দুজন। দূরে আকাশে ফের বিদ্যুৎ চমকায়, সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। 
    বটগাছের কাছে এসে বোঝা যায় বটগাছটায় একটা বাজ পড়েছে দুপুরের বৃষ্টিতে এবং একটা গরু মারা গেছে তাতে, ঝলসে গেছে তার দেহ, জিভ বার করে সে এলিয়ে আছে মাটিতে। বাতাসে সোঁদা মাটির আর পোড়া মাংসের গন্ধ কটু মিশে চারিদিকে বৃষ্টির জলকণা ভেসে আছে ধোঁয়ার মতন।
    ছেলেটা বলেছিল - "আপনার লাইটারটা দিন , একটা সিগারেট ধরালেন না যে অনেকক্ষন ?”
    এক গোছা ধূপ পকেটের একটা ধূপের বাক্স থেকে বের করে , ছেলেটা লাইটারটা  দিয়ে জ্বালিয়েছিল। একটা মিষ্টি গন্ধ ভাসতে শুরু করেছিল বাতাসে। বট গাছের তলায় হাঁটু গেড়ে বসে , সে কাদা মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল ধূপগুচ্ছ।
    ফেরত দেওয়া লাইটার দিয়ে নিজের সিগারেট জ্বালিয়ে যযাতি বিরক্ত হয়ে বলেছিল "সিগারেট তো ধরাচ্ছি , কিন্ত চুনিবাবু কোথায় ?”
    এই প্রশ্ন শোনার পর প্রত্যুত্তরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালো চশমা খুলে বলেছিল  - "আমার চোখের দিকে তাকান..."
    যযাতির মনে হয়েছিল আরো একবার যেন বজ্রপাত হল বটগাছের ওপর।
    অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেই বহুকাঙ্খিত নীলচে অন্ধকার, যার কাছে সে এতদিন ধরে ফিরে যেতে  চেয়েছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন