এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পুলিশ

    রজত দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ এপ্রিল ২০২২ | ৭০১ বার পঠিত
  • যতদূর মনে পড়ছে, জানুয়ারি মাসের শেষের দিক হবে। অফিস থেকে ফেরার পথে একটা বাসে চড়ে বসলুম। রাত তখন কটা হবে ! বড়জোর আটটা কি সাড়ে আটটা হবে। বিশ্বব্যাপী করোনার দাপাদাপির পর থেকেই বাসে আর তেমন গাদাগাদি ভিড় চোখে পড়ে না। ড্রাইভারের পিছন দিকের সারিতে একটা খালি সিট পেয়ে বসে পড়লুম। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর লক্ষ্য করলুম, কন্ডাকটর ভাড়া পাওয়ার প্রত্যাশায় বাসময় ঘোরাঘুরি করছে। কিন্তু আমার দিকে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অন্য যেকোনো দিন, অন্য যেকোনো বাসে চড়তে না চড়তেই টিকিট চেয়ে নাজেহাল করে। তাহলে আজ এহেন বদান্যতা কিসের জন্য ! বোধগম্য হলনা। কিঞ্চিৎ অস্বস্তিও শুরু হল। তার কারণবশতঃ এরই মধ্যে বয়স্ক কন্ডাকটর মহোদয়কে কয়েকবার ডেকেও ফেলেছি। টিকিটটি কেটে ফেলব বলে। আমার ডাকে দু একবার ঘুরে তাকালেও আসছেন না মোটেই। যে যাত্রীদের টিকিট কাটায় বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তাঁদের কাছেই উনি বারংবার যেতে উৎসাহিত বোধ করছেন। এদিকে আমি টিকিট কাটতে উৎসাহী। অথচ তেনার দেখা নাই।

    এমনভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি অন্যান্য যাত্রীদের কাছ থেকে নিজেকে কিঞ্চিৎ অব্যাহতি দিলেন, মনে হল। বাসের দরজাটিকে একটু সামলেসুমলে নিয়ে আমার পানে এগিয়ে এলেন। তারপর হঠাৎ বলা কওয়া নেই, ঝুপ করে নিচু হয়ে গেলেন। বোধহয় কিছু একটা বলতে চান। আমার কান ঘেঁষে ঝুঁকে খুব নিচুস্বরে যাতে অন্য কোন যাত্রীর কানে না যায় তেমনিভাবে বলে উঠলেন,

    আপনাকে টিকিট দিতে হবে না।

    শুনে আমি তো অবাক। যাচ্চলে ! বেসরকারি বাসে এরকম অযাচিত আতিথেয়তা পাব কস্মিনকালেও ভাবিনি। সেই ছোটবেলা থেকে বাসে চড়তে চড়তে বলতে গেলে বুড়ো হতে চল্লুম। এইভাবে আমায় কোনোদিন কোনো কন্ডাকটর ভালোবেসে কাছে এসে বলেননি,

    আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না...।

    আমি আপ্লুত। আনন্দিতও বটে। কারণ এই ভাড়া না দেওয়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সুপ্ত তাগিদ। অন্য কেউ করে কিনা জানি না। মানে এখনো পর্য্যন্ত জানতে পারিনি, কেউ আমায় শ্রদ্ধা ভক্তি করে কিনা ! কিন্তু আজ নিজের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা ভক্তি প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেল। আধ বাস লোকের মধ্যে কন্ডাকটর বেছে বেছে শুধু আমার ভাড়া নিতে ইচ্ছুক নয় কেন ? নিশ্চয়ই আমার মধ্যে উনি বিশেষ কিছু লক্ষ্য করেছেন। গর্বে আনন্দে আমার ছাতি ফুলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে গেল। এই দেশেও যেন কার ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি বিশেষ চর্চিত। তাঁর ছাতি চর্চিত হলে আমার ছাতি আজ গর্বিত।

    ওয়ান্স আপুন এ টাইম, স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের জন্যে বাস ভাড়ায় ছাড় মিলত। কনসেশন কুপনের ব্যবস্থা ছিল। সেই কুপন জোগাড় করতে আমাদের ব্যারাকপুর যেতে হত। বাস ভাড়ার কয়েকটা টাকা বাঁচানোর জন্য কয়েক প্রস্থ হ্যাপাও পোহাতে হত। যাইহোক এমনভাবে কোনো কন্ডাকটর কখনো সহৃদয়তা দেখাতে আসেননি। বরং ঝাঁঝানো স্বরে তাঁরা ভাড়াই নিতে চান। আজ হলটা কি ! আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনি বুঝলেন, ব্যাপারটা আর একটু খোলসা করা উচিত। তাই ফের নিচু হয়ে নিচুস্বরে বললেন,

    আপনি পুলিশে আছেন তো ? তাই আপনার ভাড়া লাগবে না।

    এতক্ষণে বুঝলুম। কুয়াশা ক্লিয়ার হল। আমার পিতৃদত্ত চেহারা দেখে ওঁর মনে হয়েছে আমি পুলিশ। অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা বাসে উঠে যথারীতি কেউ ভাড়া দেননা। বিরক্ত ও সন্ত্রস্ত কন্ডাকটররাও বোধহয় পুলিশদের কাছ থেকে ভাড়া চাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। যারফলে আমার ভাড়া দেওয়ার জন্যে ঔৎসুক্য ওঁর অন্যরকম ঠেকেছে। আর পুলিশদের থেকে ভাড়া না নেওয়াটাই দস্তুর। তাই আমার কাছে এসে নিচুস্বরে ঐভাবে ভাড়া না নেওয়ার কথা বলা। 

    আমায় দেখে পুলিশ ভেবে নেওয়ার অন্যতম কারণ হল আমার "পোশাক"। অফ হোয়াইট প্যান্টের উপর কালো রঙা জ্যাকেট। ভিতর থেকে সাদা শার্ট উঁকি দিচ্ছিল। মাথায় ছিল নেভি ব্লু রংয়ের উলের টুপি। সেটি অনেকটাই শীতকালে পুলিশদের ইউনিফর্মের সাথে পরা টুপির মতই দেখতে। পায়ের জুতোর রংও ট্যান। সবমিলিয়ে হঠাৎ দেখলে আমার দশাসই চেহারায় ওইরকম বেশভূষা একটি পুলিশি ছবি তৈরি করে দিয়েছিল। মনে মনে তীব্র হাসি পেল। হাসিটা চেপে ওয়ালেট থেকে বের করা টাকাটা বাড়িয়ে ধরে গম্ভীর স্বরে বললুম,

    নিন ধরুন। ভাড়াটা কাটুন। আর এরকম একদম করবেন না। যে পুলিশ অফিসারই বাসে উঠুক। পুরো ভাড়া নেবেন। 

    আমার বলা কথাগুলো বেশ হুকুমের মত শোনালো। আশপাশের কয়েকজন যাত্রীর কানেও বোধহয় তা পৌঁছল। তাঁরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। আর কন্ডাকটর মহোদয় থতমত খেয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেন। তারপর অতীব ক্ষুদ্র চিরকুটের মত টিকিটখানা হাতে ধরাতে ধরাতে বললেন,

    কি বলব স্যার ! আপনাদের ডিপার্টমেন্টের কেউই বাসের ভাড়া দিতে চায়না। এবার থেকে আপনার নাম করে ভাড়া চাইব...

    এবার আর একটু নিচু হয়ে নিজের গলার স্বর আরো খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে বসল,

    আপনার নামটি যদি বলেন স্যার...!

    এবার আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলুম। লোকটা তো মহা ধুরন্ধর। পুলিশের নাম জেনে রাখতে চায়। পরে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবে বলে। আমি কি সত্যিই পুলিশ নাকি... তাই নাম বলে কি হবে ! মনে মনে ভাবলুম। আর মুখে বললুম,

    দ্যাখো, নাম বলার দরকার নেই। আমি কোনো বড়ো কর্তা নই। যে নাম বললেই সকলে চিনে ফেলবে। শুধু এইটুকু বলবে, গাড়িটা তেলে চলে। জলে নয়। তাই সবাইকে ভাড়া দিয়েই যেতে হবে।

    ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলার সময়েই বাসের দরজার দিকে চোখ গেল। বাস, স্টপেজে দাঁড়িয়েছে। দুজন নেমে গেল। আর তাদের পরেই একজন সত্যিকারের পুলিশ বাসে উঠল। খাকি পোশাক পরা। আমি এর পরের স্টপেজে নামতুম। কিন্তু সেটা আহাম্মকির শামিল হবে। ভাবতে ভাবতে দেখলুম, বাস ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎ করেই সিট ছেড়ে উঠে পড়লুম।

    এই রোক্কে রোক্কে... আমি নামব।
    _____________
    © রজত দাস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৮:৫১506265
  • মাছের রাজা ইলিশ, আর মানুষের রাজা পুলিশ! 
     
    লেখাটি ভাল লাগলো  yes
  • Swati Chakraborty | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১১:০৪506288
  • বেশ মজার
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন