উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরদিন ১১ই মার্চ, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক প্রতাপ ভানু মেহতা ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় যে বিশ্লেষণটি লিখেছেন তার থেকে দুটি পয়েন্ট নিচে অনুবাদ করে দিলাম।
(১) বেশির ভাগ বিরোধী পার্টি, বিশেষত কংগ্রেসের হাবভাব দেখলে মনে হয় বুর্বোঁ রাজবংশ নিজেকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টায় আছে। কিন্তু সেটা ফরাসী বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর।পুরোনো রাজত্ব বা তার অপস্মৃতিভার ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখলেই ,তা সে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীই হোক বা নতুন চেহারায় পুরোনো অখিলেশ, মাঠে মারা যাচ্ছে পুরোনো দলগুলির সম্ভাবনা। ভারতবর্ষের বিরোধী রাজনীতির সামনে তাই কংগ্রেসের পুনর্গঠন বা রাহুল গান্ধীর ভবিষৎকী সেটা কোনো ইস্যু নয়, ইস্যু হল শুণ্য থেকে একটা নতুন বিরোধী শক্তি তৈরী করা।
(২) নিশ্চয়ই যোগীর কিছু সমাজকল্যাণ প্রকল্প, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মধ্যস্বত্বভোগীর ওপর শাস্তি বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে। কিন্তু যদি ধরে নেওয়া হয় যে তাই দিয়ে কোভিড ১৯ এর ধ্বংসলীলা, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, গ্রাহক চাহিদার হ্রাস, তুমুল কর্মসংস্থান সংকট সবকিছুকে ঢাকা দেওয়া গেছে তাহলে সেই ব্যখ্যা অসম্পূর্ণ থাকে। সম্ভবত সবচেয়ে ক্রুদ্ধ, সবচেয়ে বিপর্যস্ত অংশ যাঁরা , তাঁরা আর মনে করেন না যে রাজনীতি তাঁদের সমস্যার জ্ঞাপনের মাধ্যম হতে পারে। তাই আপনার প্রতিবাদ রাজনৈতিক বিদ্রোহ নয়, সামাজিক উপসর্গের প্রকাশ হিসেবে গণ্য হতে থাকছে।
এবার (১) আর (২) কে যদি আমরা মিলিয়ে পড়ি , যদি মনে করি এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে তাহলে পুরোনো লব্জ ধার করে বলতে হয় ভারতে পরিবর্তনের ‘অবজেকটিভ কনডিশন আছে , নেই সাবজেকটিভ কনডিশন অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য কোনো বিকল্প । যারা আছেন পুরোনো ব্যাগেজ তাদের গ্রহণীয় হতে দিচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শূণ্য থেকে যদি শুরু করা যায়, তবেই দ্রুত উথ্বান সম্ভব। কিন্তু তার জন্য দরকার বাম, গণতান্ত্রিক কিছু এজেণ্ডাকে সামনে রেখে একটা অভিন্ন মঞ্চ গড়ে তোলা। আপাতত বিপ্লবের স্বপ্নকে মুলতুবি রাখুন। রাষ্ট্রচরিত্রের বিশ্লেষণ নিয়ে অনন্ত কলহ বন্ধ করুন। নতুন ভাবনাকে, নতুন মুখকে গুরুত্ব দিন। কমাণ্ড ভিত্তিক সাংগঠনিক কৌশলগুলি বন্ধ রাখুন। কারণ আপনাদের কমান্ডে আজ আর কিছু আসে যায় না।উল্লম্ব দল নয়, অনুভূমিক মঞ্চই আজ বিকল্প। লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে সেগুলো এভাবেই হচ্ছে। সেগুলোকে অনুধাবন করুন।গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ, আদর্শনিষ্ঠ ও সৎ এক নেতৃত্ব, যাদের জনগণ পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সেভাবে আইডেন্টিফাই করেন না, তাঁরাই একমাত্র পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে ধারণ করে আছেন। আপাতত ঘ্যাম বামপন্থী এম পিদের মত (এখন যদিও কেই প্রায় নেই) পার্লামেণ্টে সুচারু ইংরেজীতে বক্তৃতা প্রদান বা উল্টোদিকে জঙ্গলের আদিবাসীদের লড়াইতে বন্দুকের নলের ব্যবহার শিক্ষা , এর বাইরেও বা মধ্যবর্তী স্থানে অনেক কিছু করার আছে। কারণ মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাই দখল হয়ে যাচ্ছে হুহু করে।
তবে আপনি মনে করতে পারেন যে নিজস্ব মতাদর্শ, সাংগঠনিক রীতিনীতি এসব একেবারে অলঙ্ঘ্য। তাহলে আপনি পালন করুন না নিজস্ব দলীয় পরিসরে সেসব । কিন্তু বৃহত্তর মঞ্চের অংশীদারিত্ব আপনাকে নিতেই হবে। বলবেন এ আর নতুন কথা কি । যুক্তফ্রণ্ট, ডিমিট্রভ এসব তো আমরাই শেখালাম মশাই। হ্যাঁ, শেখালেন , কিন্তু এবার সেই ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেওয়া নয়, পেছনের সারিতে বসাও আপনাদের শিখতে হবে। আপনি যতখুশি সেলফি তুলে আত্মতৃপ্ত থাকতে পারেন। কিন্তু সময়ের চাহিদা হল গ্রুপ ছবি । সেখানে অন্যদের সামনে রেখে পেছনে দাঁড়ানোর সহবৎ আপনাকে শিখতে হবে।আর কিছু না পারলে অন্তত হান্নান মোল্লাকে দেখে শিখুন।
আমরা বামপন্থীদেরই শুধু আত্মসমালোচনা করতে বলি বটে। কিন্তু অন্যদেরও সেটা করার দরকার। যেমন দলিত রাজনীতির অনুগামীরা এতকাল অন্যদের শুধু মনুবাদী বলে এসেছেন। কিন্তু স্বয়ং দলিত নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও তা কেমন করে ব্রাহ্মণ্যবাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সেটা উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী ভোট কাটুয়া হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক শংকর রায় দেখিয়েছেন যে বিজেপির জেতা ২৫৫টা আসনের মধ্যে অন্তত ১২৬টিতে বহুজন সমাজ পার্টির ভোট কাটা বিজেপিকে সাহায্য করেছে। আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী লড়াইকে সব বর্গের অর্থনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও প্রয়োজনে যুক্ত করা দরকার এটা না বুঝলে সুবিধাবাদ আর আর আদর্শচ্যুতির জন্ম হয় সেটা ভারতের দলিত রাজনীতির ক্ষেত্রে বারবার দেখা গেছে। অন্যথায় বামপন্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিটব্যুরোতে কতজন দলিত বা মুসলমান আছে সেটা দিয়েই তাদের বিচার করতে হয়। এটা নয় যে এই বাস্তবতা আমাদের উদ্বেগের কারণ নয়। কিন্তু শ্রেণীপরিচয়কেই সবার ওপরে জায়গা দেন বলে এই দলগুলির ক্ষেত্রে এটা খামতি বলে ধরা যেতে পারে মতাদর্শগত বিচ্যুতি নয় (সেই বিচ্যুতি ধরার আরো কয়েকশ জায়গা আছে )। কিন্তু দলিত নেতৃত্ব অধ্যুষিত দল বা সেই দলের অনুগামী ব্যক্তিরা যখন সেই অজুহাতে সমস্ত আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন, সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইস্যু ছাড়া অন্য ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখেন তখন মনে কি হয় না এই দলিত রাজনীতিরও আত্মসমালোচনা দরকার ?
ভারতবর্ষে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নবীন মানুষের বাস। ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের বয়স ২৮ বছর বা তার কম। নতুন কোনো বিকল্প , যার পুরোনো ব্যাগেজ নেই (সীমাবদ্ধতা নিশ্চয় আছে যেমন আম আদমী পার্টি) দেখলেই তারা কিন্তু আঁকড়ে ধরছে। শুধু সংঘাত নয়, নির্মাণও যে জনচিত্ত জয় করতে পারে তার প্রমাণ আপ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেই তারা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিতে পেরেছে। নয়তো, আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ছাড়া কেজরিওয়ালের গণ আন্দোলনের ইতিহাস কোথায়? জ্যোতি বসু এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই বোধহয় ‘ ঐতিহাসিক ভুল’ বলেছিলেন সিপি আই এমের প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখানের সিদ্ধান্তকে। সরকারে গিয়ে জনকল্যাণমুখী কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলেও মানুষের মনে বামপন্থীদের একটা জায়গা তৈরি হত এটা তিনি বুঝেছিলেন। না,বড় কোনো কম্যুনিস্ট এজেণ্ডা নয়, কিছু সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক এজেণ্ডা। অন্তত সেটুকু করার মত এলেম তাদের ছিল (আমি জ্যোতিবাবুর ফ্যান নই কস্মিনকালে, এখানে শুধু একটা রাজনৈতিক কৌশলকে বিবেচনা করছি সংসদীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে)। কিন্তু নিজেদের খাঁটি কম্যুনিস্ট ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করার লোক সেদিনও যেমন ছিল ,আজও আছে। এখন অবশ্য এই মনোভাব আত্মপ্রতারণার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত কার্যকারিতার দিক থেকে, বাস্তবতার দিক থেকে। সামাজিক ন্যায়ের ধারণায় বিশ্বাস করেন সততার সঙ্গে---আপাতত এটুকু হলেই চলবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস (?) নিয়ে আপনি থাকতে পারেন। কিন্তু কিছু আধিপত্যবাদী অনুশীলনকে সেই নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আপনাকে বিফল হতে হবে। এই যে এত কথা বলছি—এসব কি একটু চরমভাবাপন্ন মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, আসলে চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতি চরমভাবাপন্ন সমাধান দাবি করে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।