এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় -- একজন গায়িকার মৃত্যু

    Partha Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯৬৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • বাংলার মাটির ভালোবাসার গল্প বলি একটা। 

    কেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বাঙালির এতো প্রিয়? কেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সুবীর সেন, তালাত মাহমুদ আমাদের এতো প্রিয়?

    সীমানার বাধা পেরিয়ে, এই ভয়ঙ্কর ধর্মীয় বেড়াজাল ডিঙিয়ে আজও কেন তাঁরা দুই বাংলার ঘরে ঘরে? এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা!
     
    নিজের চোখে দেখেছি, এই ব্রুকলিনে, কুইন্সে প্রবাসী বাংলাদেশী এবং ভারতীয় বাঙালির ঘরে ঘরে আজও প্রতিদিন বেজে চলেছে সন্ধ্যা হেমন্ত মান্না শ্যামলের গান। হিন্দুর ঘরে, মুসলমানের ঘরে, খৃস্টানের ঘরে। আস্তিকের ঘরে, নাস্তিকের ঘরে। 

    এর উত্তরটা খোঁজা দরকার। কারণ, আজ এঁরা সকলেই বিগত। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সঙ্গীতজগতের, শিল্পজগতের একটা অদ্ভুত আশ্চর্য্য যুগের অবসান ঘটলো। আজ এই বিশ্লেষণটা না করলে কখনোই আর করা হবেনা।

    বাঙালি এখনো নস্ট্যালজিক। পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভালোবাসে। উগ্র আধুনিক বলিউডে হলিউডে আচ্ছন্ন, আপ্লুত "বাঙালি" হয়তো বলবে, ওসব পুরোনো কথা ছাড়ুন। কবে ঘি দিয়ে পোলাও খেয়েছিলেন, তার কথা আর ভালো লাগছেনা। নতুন কিছু বলুন। নতুন কিছু করে দেখান। এ হলো ইতিহাসকে অস্বীকার করার, ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়কে ভুলিয়ে দেওয়ার খেলা। নতুন এক মগজধোলাই, যেখানে বাঙালিকে শেখানো হয়েছে, তোমাদের গর্ব করার মতো কিছু নেই। শুধু তাই নয়, তোমাদের গর্ব করার মতো কক্ষনোই কিছু ছিলোনা।

    এই মারাত্মক শক্তিশালী ইতিহাস-ধ্বংসের মারণাস্ত্র অদৃশ্য। ডিপ্রেশন বা অবসাদ রোগের মতোই তার কোনো শারীরিক সিম্পটম নেই। আমেরিকার বোমায় কোনো বাড়ি, ঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ ভেঙে পড়ছে না। হেলিকপ্টার থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে ক্ষেতের পর ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছেনা। বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছেনা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সত্তর বছর পরেও। পরিবেশ দূষণ বা ক্লাইমেট চেঞ্জ জেলার পর জেলা পুড়িয়ে মারছেনা। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেনা।

    সীমানা পেরিয়ে দলে দলে জীর্ণ শীর্ণ উদ্বাস্তু বাচ্চাদের হাত ধরে শহরে ভিক্ষে করতে আসছেনা।

    এই অদৃশ্য কিন্তু সভ্যতা ধ্বংসকারী নতুন সিস্টেমের পারমাণবিক বোমায় আমরা ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। আমাদের গা পুড়ে যাচ্ছেনা। কিন্তু আমাদের মন, মস্তিস্ক পুড়ে যাচ্ছে। আমরা চীৎকার করে কাঁদছি। কিন্তু আমাদের কান্না কেউ শুনতে পাচ্ছেনা। কেউ শুনতে চাইছেনা।

    আমরা বাংলার মাটির গন্ধ মুখে, বুকে মেখে নিয়ে বাঁচতে চাইছি। এই বাংলার মাটির গন্ধে মেশানো আছে রবীন্দ্রনাথের-জীবনানন্দের কবিতা, নজরুলের-লালনের গান, নন্দলাল-জয়নুল-যামিনীর ছবি, বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মুজতবা-লীলা-মহাশ্বেতার গল্প। সত্যজিতের মৃণালের ঋত্বিকের তপনের সিনেমা। 

    মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী, সাঁওতাল পল্লীর কানু সিধু বীরসা, এলগিন রোডের সুভাষ। এই বাংলার ইতিহাসের কণায় কণায় এখনো সিমলা পল্লীর নরেন্দ্রনাথ দত্ত, দক্ষিণেশ্বরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চট্টগ্রামের সূর্য সেন ও তাঁর শিষ্যা প্রীতিলতা।

    স্কটিশ চার্চ ইস্কুলের পাশেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যাঁর গবেষণা নিয়ে অন্ততঃ পাঁচজন ইউরোপীয়ান ও আমেরিকান নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু তিনি পাননি। আমহার্স্ট স্ট্রীটের রামমোহন রায়, আর হিন্দু কালেজের বাইশ বছরে কলেরায় চলে যাওয়া শিক্ষক ভিভিয়ান ডিরোজিও। একুশে যক্ষ্মায় চলে যাওয়া সুকান্ত।

    আর সঙ্গীতজগতের নোবেল প্রাইজ না পাওয়া বাঙাল বাবা আলাউদ্দিন, ছেলে আকবর আর মেয়ে অন্নপূর্ণা। ছাত্র রবি, তার আশ্চর্য দাদা উদয়।

    আরো কত কত নাম। ভাষা বাঁচানোর লড়াইতে প্রাণ দিয়ে দেওয়া ঢাকার রাস্তায়, বরাক উপত্যকার, মানভূমের বাঙালি। মেরে শেষ করে দেওয়া, জমি দেশ কেড়ে নেওয়া, গলা কেটে পরিবারের সদস্যদের মাথাগুলো পাঁচিলে রেখে যাওয়া বর্বরতার সাক্ষী বাঙালির আজও বেঁচে থাকার আশ্রয় এই বাঙালিত্ব, এবং বাঙালির ভালোবাসার গল্প, গান।

    এই ইতিহাসের পাতাতেই ওই সন্ধ্যা, ওই হেমন্ত, ওই সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক। ওই মান্না, ওই উত্তম, ওই সুচিত্রা।

    একটা আশ্চর্য, অদ্ভুত সুন্দর জীবনবোধের গল্প চলেছে হাজার বছর ধরে। সে গল্পের শেষের দিকে একটা পাতা আমরা পড়ছি এখন। সেই পাতায় কালকের অধ্যায় শেষ হলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান দিয়ে। উজ্জ্বল, আধুনিক, ঝকঝকে গান। পাওয়ারফুল, ঋজু, হাস্যমুখী স্নেহশীলা সন্ধ্যা মুখার্জী, যিনি হেলায় এসব সস্তা খেতাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে পারেন।

    এই শিল্প, সঙ্গীত এবং এই ঋজু ব্যক্তিত্বের কাছেই বাঙালি আজীবন ঋণী। এই মানুষগুলোর কাছেই আমাদের বন্ধক রাখা ভালোবাসা।
     
    আমরা রাস্তায় হাঁটবো এই ইতিহাসকে মুখে বুকে মেখে নেওয়ার জন্যেই। 

    _____
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • santosh banerjee | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:১৫504089
  • একদম ঠিক কথা বলেছেন। আচ্ছা, ক'জন লোক এখন এই সময়ে এই মুহূর্তে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়'র গান শুনছে , বলুন তো ? এইযে লতা মঙ্গেশকর প্রয়াত হলেন, ক'জন ওনার গান শুনলেন ? খুব অল্প সংখ্যক। এই প্রজন্ম এনাদের সম্মন্ধে কতটা জানেন সন্দেহ হয় ( বিশেষ কিছু চটুল গান ছাড়া ) তাই, এই আত্ম বিস্মৃত জাতির কাছে ঋত্বিক রোশন পরিচিত..... ঋত্বিক ঘটক নয় ! কিছু উন্নাসিক বঙ্গ সন্তান খেপে উঠতে পারেন, কিসসু যায় আসেনা। উচ্ছন্নে যাওয়া বাঙালি !! 
  • Partha Banerjee | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:০১504098
  • santosh banerjee আসলে, দীর্ঘ তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বাঙালিকে বোঝানো হয়েছে, যেহেতু তোমার অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়, তোমার কোনো স্ট্যাটাস আর নেই। কিন্তু কেন শোচনীয় হলো, সেটা বলা হয়নি। এবং সেই ফোর্সড ইতিহাস বিস্মৃতিকরণের ব্যালান্স যাদের করার কথা ছিল, তারা করেনি। একদিকে দেশ আনন্দবাজারী শান্তিনিকেতনী এলিট ক্লাস, আর একদিকে শূন্যগর্ভ আন্তর্জাতিকতাবাদ। একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে এই ভ্যাকুয়ামের মধ্যে। এখন বোতল থেকে জিনি বেরিয়ে পড়েছে। তাকে আর বোতলবন্দী করা অসম্ভব। 
  • Sobuj Chatterjee | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:২৭504121
  • খবরের কাগজে ই পড়েছিলাম যে মান্নাদের মতো শিল্পী কাকুতি মিনতি করেও এই সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র দিয়ে তাঁর কন্যা দের প্রভাবিত করতে পারেননি। জানিনা কেন এমন হয়।
    এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! 
    আপনার লেখা এই সংকটে এক আনন্দের দিশা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন