( দশম ও শেষ পর্ব )
দুশো মিটার শুরু হবার আগে স্পন্দন অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল শুভর সঙ্গে। নতুন কোন পরামর্শ দিল না অবশ্য। টাইমিংটা যাতে ঠিক থাকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে বলল। একশ মিটারের পর থেকে স্পীড তোলার কথা বলল।
স্টেডিয়ামে খুব ভাল মানের ক্যান্টিন আছে। সেখানেই সবাই খাওয়াদাওয়া সারল। লাভলির ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। পড়াই স্বাভাবিক। সেই কোন সকালে উঠেছে। ওইটুকু ছেলের এত ধকল সয় !
কৌস্তভ সত্যেন্দ্রনাথকে এক ফাঁকে জানিয়ে দিল অভ্রর ফরেনসিক রিপোর্টের কথা। সত্যেনবাবু বললেন, ‘ অলরাইট..... এখন পুলিশ ইনভেস্টিগেট করুক কোন প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স পাওয়া যায় কিনা ।’
লাভলি আধঘুমন্ত ছেলেকে খাওয়াতে লাগল। তার হঠাৎ মন কেমন করতে লাগল। অভ্রর সঙ্গে তার জীবনের নানা ঘটনা মনে পড়তে লাগল। কি থেকে কি যে হয়ে গেল। অনেক কথা, অনেক স্মৃতি এলোমেলো বাদুলে হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল লাভলির মনের মাঠে ঘাটে।
ক্যান্টিনের দরজার ফাঁক দিয়ে স্টেডিয়ামের ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে।
বিভিন্ন ইভেন্ট হয়ে যাচ্ছে ওখানে। প্রাণের তুফান ওড়া এক রঙীন উৎসব যেন। একপাশে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন মেহিনীমোহনবাবু পরমানন্দে ভরভূর হয়ে। পুরো পরিবেশটা যেন এক রঙীন বসন্তোৎসবের মতো লাগছিল তার কাছে। গতিময় স্রোতে ভেসে যাওয়া এক চঞ্চল নৌকার মতো । চুরাশি বছরের বৃদ্ধ মোহিনীবাবুর চোখের তারায় এক উজ্জ্বল আনন্দের আলো খেলা করতে লাগল। নিরুপমা স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ কি ভাল লাগছে , না ? ‘
মোহিনীবাবু মাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ হুঁ .... বড্ড ভাল লাগছে। কি আনন্দময় সবকিছু .... তাই না ?’
— ‘ এখানেই এরকম । অলিম্পিকে কি না জানি হয় .... যদি যেতে পারতাম .... ‘ নিরুপমা বললেন।
— ‘ হুঁ .... তাই তো । আমাদের শুভ তো নিশ্চয়ই যাবে । আমরা ওর দিকেই তাকিয়ে থাকব .... ‘
ব্রজেনবাবু দেবেশকে বললেন, ‘ কি দেবেশ .... এখন কি বুঝছ ? কেমন লাগছে বল। আমার তো সাঙ্ঘাতিক ভাল লাগছে। তোর ছেলের দৌলতেই তো আমরা পেসাদ পাচ্ছি । এখন ওকে ভালয় ভালয় প্লেনে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্দি .....’
দেবেশ আনন্দে ডগমগ হয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ- অ্যা-অ্যা ..... তা আর বলতে .... হ্যা: হ্যা হ্যা: ....’।
সেই স্বপ্নদর্শনের কথা বোধহয় রোদের তাপে শিশির উবে যাওয়ার মতো তার মন থেকে আপাতত বাষ্পীভূত হয়ে গেছে।
সকলে আবার গ্যালারিতে চলে গেল। দুশো মিটারের দৌড় শুরু হবে। এটাই আজকের শেষ ইভেন্ট। একশ মিটারের সময়ের হিসেবে শুভ নিশ্চিতভাবে অলিম্পিক স্কোয়াডে ঢুকছে। তবু সকলে উদগ্রীব হয়ে রইল দুশো মিটারে শুভর দৌড়টা দেখার জন্য।
পাঁচ নম্বর লেনে লাল কস্টিউম পরা শুভ স্টার্টিং ব্লকে তৈরি হচ্ছে ।
দেবেশ ছেলের এমন অভাবনীয় রূপ কখনও দেখেনি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। জৌলুসে ভেসে যাচ্ছে তার শুভর শরীর। রিক্শাভ্যানওয়ালা দেবেশ নস্কর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল প্রকান্ড স্টেডিয়ামের বিশাল বর্ণময় রানিং ট্র্যাকের দিকে। শুভ মাথা নীচু করে ব্লকের কাঠে পেরেক ঠুকছে।
খুব সুন্দর স্টার্ট নিল শুভ। ষাট মিটার পর্যন্ত অন্তত দুফুট এগিয়ে থাকল লুধিয়ানার বলবিন্দর সিং -এর থেকে। তিন নম্বর লেনের মিজোরামের একটা ছেলে শুভর কাঁধের লাইনে চলে এল আশি মিটারের মাথায়। আট নম্বর লেনে তার ঠিক দু ইঞ্চি পিছনে পাঞ্জাবের আর একটা ছেলে। একশ মিটার লাইন দুরন্ত গতিতে ছিটকে বেরোল মিজোরামের ছেলেটা। শুভ ছ ইঞ্চি পিছনে পড়ল। আট নম্বর লেনের ছেলেটা শুভকে ধরে ফেলল।
সত্যেন্দনাথ চেঁচাতে লাগলেন, ‘ কাম অন শুভ..... কাম অন.... ইউ ক্যান ..... ইউ ক্যান .... কাম অন ,কাম অন , কাম অন..... ফিনিশ ইট আপ মাই সান ....গো গো গো .... ‘
দেড়শ মিটারের মাথায় শুভ, তিন নম্বর আর আট নম্বর প্রায় এক লাইনে চলে এল ..... হয়ত সেকেন্ডের ভগ্নাংশের এদিক ওদিক হতে পারে।
স্পন্দন চেঁচাবার মতো অবস্থায় নেই। তার পালস বিট বোধহয় নব্বই ছাড়িয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে উঠে রুদ্ধশ্বাসে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে তিনটে চিতা তিনটে শিকারের পিছনে তাড়া করেছে জীবনের শেষ বাজি জিততে।
একশো সত্তর মিটার ...... । তিনজনের কাঁধ এক রেখায়। ফটো ফিনিশে কি দেখাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এই সময়ে কি জানি কি কারণে একটা বিদ্যুৎরেখা চমকে উঠল শুভর মনে। দুটো মুখ ভেসে উঠল বিপজ্জনক তড়িৎরেখার মতো। মোহিনীদাদুর ভাইপো বিমলানন্দ এবং জামাই জয়ন্তর মুখ দুটো। ঝিলিক দিয়ে উঠল তাদের মুখের বাঁকা হাসি এবং তাচ্ছিল্যে চোবানো শ্লেষোক্তি। মনে পড়ে গেল তার নিজের বলা কথা — ‘ আবার দেখা হবে আপনার সঙ্গে..... ‘
মস্তিষ্ক বেয়ে হাজার ভোল্টের একটা স্পার্ক নেমে এল শুভর দুপায়ে। মেশিনগানের গুলির মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে পাঁচ নম্বর লেনের একটা লাল কস্টিউমের স্প্রিন্টার বাকি ত্রিশ মিটার ছিটকে গেল মাত্র সাড়ে চার সেকেন্ড। টাইমিং — উনিশ দশমিক পাঁচ এক সেকেন্ড। প্রথম বাছার জন্য কোন ফটো ফিনিশের দরকার হল না।
উত্তেজনার ঝড় শান্ত হলে স্পন্দন হাঁফাতে লাগল ঘনঘন শ্বাস ফেলে। দলের সবারই প্রায় একই অবস্থা, একমাত্র দেবেশ বাদে। সে ব্রজেনবাবুকে নিপাট সারল্যে জিজ্ঞাসা করল, ‘ শুভ পেরেছে ? ‘
ব্রজেনবাবু দেবেশের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ধুসস্ ..... তোর দ্বারা কিস্যু হবে না ! ’
......... ......... ............
এখনও দু মাস দেরী আছে অলিম্পিক শুরু হতে। শুভকে দিল্লী যেতে হবে স্কোয়াডের সঙ্গে যোগ দিতে । এদিকে স্পন্দন অ্যান্ড কোম্পানি নিত্যনতুন পরিকল্পনা করে চলেছে কিভাবে শুভকে দিল্লিতে পাঠানো হবে। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত কে কে যাবে। দিল্লি পর্যন্তই বা কে কে যাবে। কিভাবে তাকে বিদায় জানানো হবে— এইসব হাবিজাবি মন্তর জপ করা অহোরাত্র। মোহিনীবাবুর হ্যালুসিনেশান আপাতত গায়েব। তিনি দিব্যি খোশ মেজাজে আছেন । ফলে তার গিন্নীও খোশ মেজাজে। স্পন্দন দিল্লী গিয়ে সুরিন্দরের সঙ্গে দেখা করবে সামনের সপ্তাহে। কোচ হিসেবে স্পন্দন নিশ্চিতভাবে শুভর সঙ্গে যাবে।
এরকম ঠিক আছে। ব্যবস্থা এগোচ্ছে ভালই। শুধু দেবেশের মুখটা কেমন ব্যাজার দেখাচ্ছে । স্বপ্নের ব্যাপারটা বোধহয় তার আবার মনে পড়ে গেছে। ব্রজেনবাবু তৃপ্তি হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে বসে খদ্দের সামলানোর ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ তোর আবার কি হল রে.... অমন মুখ কালো করে বসে কেন ? ‘
— ‘ মনটা ভাল নেই .....ছেলেটা নাকি কোন বিদেশে যাবে শুনছি ..... ওখানে কোথায় থাকবে , কি খাবে কে জানে.... মা মরা ছেলে.... ‘
ব্রজেনবাবুর মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ।তিনি সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন— ‘ ধুসস্ .... তোর দ্বারা কিস্যু হবে না .... ‘।
লাভলি একটা নতুন ফিল্ম অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছে। শঙ্করপুরে শুটিং আছে। কাল ভোরে ওখানে রওয়ানা দেবে ইউনিটের সঙ্গে। নিউ থিয়েটার্সের গেটের কাছে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে পুরো ইউনিটকে পিক আপ করার জন্য।
বেশ ঠান্ডা পড়েছে । কুয়াশায় মাখা ভোরবেলা। সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি রোজকার মতো প্রাতভ্রমণে বেরোলেন। শুভর সাফল্যের আলোয় তার মন ভরে আছে। রাস্তায় যেমন ঠান্ডা তেমনি কুয়াশা। কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি মনে মনে হাসলেন। পুলিশ কি কোনদিন কোন প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স খুঁজে পাবে অভ্র গোস্বামীর মৃতদেহের আশেপাশে ?
আগাগোড়া ব্যবস্থাটা যে তারই।ব্যাপারটা চিরকাল কুয়াশা ঢাকাই থাক। তিনি মনে মনে মুচকি হাসেন।
ঠিক সেই সময়ে কৌস্তভের বাইকের পিছনে বসে লাভলি আর তার ছেলে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর গেটে এসে পৌঁছল। লাভলি তার বাচ্চাকে কার কাছেই বা রেখে যাবে ?
ওরা বাইক থেকে নামার পর কৌস্তভ বলল, ‘ তাহলে দিল্লি যাচ্ছ তো ? ‘
— ‘ কি যে বল, শুধু দিল্লি ! অলিম্পিকেও শুভর দৌড় দেখতে যাব। ওই তো আমার প্যানাশিয়া ....সঞ্জীবনী সুধা।’
কৌস্তভ এটা ভাঙ্গল না যে শুভ সঞ্জীবনী সুধা হলেও কাহিনীর বিষহরণবাবু হলেন সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় । সুধাপাত্র থেকে বিষটুকু যিনি তুলে ফেলে দিলেন।
পুলিশ ‘কচুরিপানা‘ লেখা একটা খাবারের প্যাকেট পেয়েছে যেটায় অভ্রর জন্য বিরিয়ানি এসেছিল অনলাইন অর্ডারের সূত্রে। এটাই কেউ জানে না যে সারা বিশ্বে ‘কচুরিপানা’ নামে কোন অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি নেই।
আর আশ্চর্যের ব্যাপার প্যাকেটের কোথাও নেই কোন আঙুলের ছাপ। কি আশ্চর্য !
একটু অবসর পেলেই শুভর মাথায় চিন্তা আসছে সে স্বপ্ন দেখছে না তো ! তারপর নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে ..... না না , সব সত্যি....সব সত্যি ....
( সমাপ্ত )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।