শুভর জীবন কিন্তু শুভ এবং মঙ্গলময় রাস্তায় হাঁটে নি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে তার মাকে দেখে নি। রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে একটা নির্মিয়মান বাড়ির তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে। শুভর তখন দু বছর বয়স। তখন মাকে খুঁজত। তারপর ধীরে ধীরে মায়ের মুখ আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল কোথায়। বাবা দেবেশ নস্কর পেশায় ভ্যানচালক। মধ্যমগ্রামের অনেক ভিতরে ধানখেতের ধারে শুভদের গ্রাম। সৌভাগ্যক্রমে দেবেশ নস্করের প্রতিবেশীরা কিন্তু ভীষণ ভাল ও হৃদয়বান। বলতে গেলে, শুভ যে বেঁচে বর্তে থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বেড়ে উঠল, সেটা তাদেরই লালনে পালনে। ক্লাস ফাইভের পর আর স্কুল কিংবা পড়াশোনার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই শুভর। সবকিছু তো আর পাড়া প্রতিবেশীরা করে দিতে পারে না। ওসব ব্যাপার দেখভাল করার কেউ ছিল না। তৃপ্তি-র মালিক ব্রজেন বক্সীর সঙ্গে দেবেশের জানাশোনা শুভর জন্মের আগে থেকেই। ওটা ব্রজেনবাবুর বাঁধা ভ্যানরিক্শা। শুধু যাতায়াত করা নয়। প্রতিদিন হোটেলের কাঁচামালও দেবেশের ভ্যানেই আসে। ব্রজেনবাবু পাকা ব্যবসায়ী হলেও খুবই স্নেহপ্রবণ। তিনি বেকার বসে থাকা শুভকে ঢুকিয়ে নিলেন তার হোটেলের কাজে। তিনি শুভকে মাসমাইনে ছাড়াও প্রতিদিনের যাতায়াতের ভাড়া দেন, নেহাৎই স্নেহপরবশতার কারণে। তবে, জোরে দৌড়তে পারাটার যে কোন বাস্তব পার্থিব মূল্য থাকতে পারে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল।
পরের দিন দুপুরে ব্রজেনবাবু দেবেশ নস্করকে তার দোকানে ডেকে পাঠালেন স্পন্দনের সঙ্গে দেখা করাবার জন্য।
স্পন্দন দেবেশকে বলল, ‘তোমার ছেলে কত দূরে যেতে পারে তোমার কোন ধারণা আছে?’
— ‘হ্যাঁ তা অনেকখানি যেতি পারে.... বারাসাত পর্যন্ত ভালভাবে টানতি পারে। তবে কি জানেন আমি ওর হাতে ভ্যান ছাড়ি নি এখনও। হাজার হোক ছেলেমানুষ ....’, দেবেশ নস্কর তার নিজস্ব বৃত্তের সরল বয়ান দেয়।
স্পন্দন হেসে ফেলে। বলে, ‘না না আমি ভ্যান চালাবার কথা বলছি না। বলছি মাঠের দৌড় প্রতিযোগিতার কথা ....’
দেবেশ স্পন্দনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘ও ... আচ্ছা বুইতে পেরেছি .... ইসকুলের ওই এসপোটসের কথা বলছেন? শুভকে আর ইসকুলে পড়াতে পারলাম কোথায়। আমাদের ওসব চিন্তা না করাই ভাল। কপাল ভাল এই ব্রজেনবাবু ছিল তাই.... নইলে তো ....’, দেবেশ নস্কর মাথা নীচু করে কি যেন চিন্তা করতে থাকে।
স্পন্দন সময় নষ্ট না করে দ্রুত আসল প্রস্তাবে আসে — ‘ধর যদি এমন হয় যে মাঠে জোরে দৌড়বার জন্য দেশের সব লোক তোমার ছেলের নাম জেনে গেল। অনেক টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি সবকিছু হল তা হলে কেমন হয়?’
শুভর বাবা দেবেশ নস্করের কাছে কথাগুলো সম্পূর্ণ অজানা বিদেশী কোন ভাষা মনে হল। কোন কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্পন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শুভ যথারীতি দুপুরবেলার ভরা হোটেলের খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। ব্রজেনবাবু কাউন্টারে বসে টাকার লেনদেন করছেন ঠিকই কিন্তু অপার কৌতূহলে উৎকর্ণ হয়ে আছেন স্পন্দন আর দেবেশের কথাবার্তার দিকে।
স্পন্দন কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে — ‘আরো ভালভাবে দৌড়নোর জন্য কিছু শরীরের যত্ন এবং ট্রেনিং-এর দরকার আছে শুভর। ভালভাবে তৈরি হতে পারলে অনেক লাভ হবে আপনাদের। লাভ অবশ্য আমারও হবে, সারা দেশেরও হবে। কিন্তু ওকে তৈরি করা এবং পরীক্ষা করার জন্য এখন কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকতে হবে।’
— ‘কোথায়?’
— ‘আপাতত কিছুদিন আমার বাড়িতে। তারপর হয়ত দিল্লী বা অন্য কোথাও যেতে হতে পারে কিছুদিনের জন্য।’
— ‘কিন্তু ততদিন তো ....’, দেবেশ নস্কর তার মূল সমস্যাটা প্রকাশ করতে যাচ্ছিল।
স্পন্দন মাঝপথে ধরে নেয়। বলে, ‘ওর খরচাটা এখন আমার। আর শুভর এই হোটেলের রোজগার হয়ত মাসখানেক বন্ধ থাকবে। এক মাসের মধ্যে যদি স্পনসর যোগাড় হয়ে যায় তাহলে এখানে আর ওর চাকরি করতে হবে না। আর যদি কোন স্পনসর না পাওয়া যায় তাহলে এখনকার মতো ও আবার এখানে ফিরে আসবে। আর শুভর ওই একমাসের মাইনের টাকা আমি দিয়ে দেব।’
শুভর বাবা বেশ ধন্দে পড়ে গেল। কি সিদ্ধান্ত দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। চুপ করে ভাবতে লাগল।
ঠিক এইসময় ব্রজেন বক্সী প্রবল কৌতূহল এবং আগ্রহের বশে নিজের চেয়ার ছেড়ে ওদের দুজনের মধ্যে এসে পড়ল। বলে উঠলেন, ‘না না সে কি কথা! ওটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। এরকম একটা দারুন ব্যাপার। শুভর একমাসের টাকা আমিই .... মানে আমিই .... বুঝলেন না .... কি দেবেশ ঠিক আছে তো?’
দেবেশ পুরো ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে না পেরে একটা আধা সম্মতি গোছের মত প্রকাশ করল, ‘আ... চ্ছা .... দ্যাখেন, আপনারা যা ভাল বোঝেন ... ওর যদি ভাল হয় .... ’
স্পন্দন আবার বলল, ‘আমি চেষ্টা করব ওকে যাতে এখনই বাইরে যেতে না হয়, ট্রায়ালটা যাতে কলকাতাতেই হয়ে যায়।’
ব্রজেনবাবু বললেন, ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। আপনি এগিয়ে যান।’
রাত নটা নাগাদ স্পন্দন সুরিন্দরকে ফোনে ধরল। সুরিন্দর সব শুনে বলল, ‘হোয়াট আ গড সেন্ড চান্স! শোন স্পন্দন, তোর ওকে নিয়ে দিল্লী আসার দরকার নেই এখন। আমি আর সানি ডিসুজা নেক্সট উইকে কলকাতায় যাব সাই অফিসে। ওখানে আরও আটটা ছেলের ট্রায়াল হবার কথা আছে সেদিন সাইয়ের মাঠে। সেদিনই টেস্ট হয়ে যাবে তোর ছেলেটা, শুভ না কি নাম বললি তার। সিলেকশানের ব্যাপারে ডিসুজার ওপিনিয়ন বিরাট ওয়েট ক্যারি করে বাট পারহ্যাপস ইউ নো, হি ইজ এ ভেরি ডজি ফেলো।’
স্পন্দনের ছেলের বয়স আট। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তার স্ত্রী পায়েল পুরোপুরি গৃহবধূ। স্বামীর অতীত অ্যাথলেটিক সত্ত্বা নিয়ে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ আছে মনে। স্বামীর খেলাধূলা সংক্রান্ত যে কোন ব্যাপারে তার সম্পূর্ণ অনুমোদন আছে। সুতরাং স্পন্দন জানে যদি প্রয়োজন হয় শুভকে তার ফ্ল্যাটে কিছুদিন রাখতে কোন অসুবিধে হবে না।
পঁচিশে অক্টোবর সল্ট লেকে সাই ক্যামপাসের মধ্যে ট্র্যাক তৈরি হয়েছে শুভ সহ নটা ছেলের একশো মিটার স্প্রিন্টিং -এর ট্রায়াল নেবার জন্য। সুরিন্দর শুভর নামটা নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শুভর বায়োডাটা এবং ছবি স্ক্যান করে ই-মেল করেছিল স্পন্দন।
ট্রায়ালের দু দিন আগে শুভকে উল্টোডাঙায় নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এল স্পন্দন। রাত্রে ওকে প্রায় আধঘন্টা বেশ কিছু মাসল ফ্লেক্সিং এবং হাঁটু ও কোমরের এক্সারসাইজ করাল। কোন ভিটামিন বা এনার্জি বুস্টার খাওয়ানোর ধারে কাছে গেল না। সে তার নিজের খেলোয়াড় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে এই সময়ে এসব ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না।
সাইয়ের মাঠে ট্র্যাক ফেলা হয়েছে। বেশ গুমোট আবহাওয়া। সানি ডিসুজা ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় আর মুখের ঘাম মুছছে। সুরিন্দর স্পন্দনের সঙ্গে কি সব আলোচনা করছে। সুরিন্দর বলল, ‘ছেলেটার বয়েস তো খুবই কম। আন্ডার এজ বলে ক্যানসেল না করে দেয়। আর হ্যাঁ, রানিং শ্যু পরে ছোটা প্র্যাকটিস করিয়েছ তো?’
— ‘হ্যাঁ, দুদিন প্র্যাকটিস করিয়েছি। ওর কোন ডিসকমফোর্ট হচ্ছে বলে মনে হল না। হি ইজ জিনেটিক্যালি গিফটেড। ইন ফ্যাক্ট রানিং ইজ হিজ সেকেন্ড নেচার।’
স্পন্দনের কাছে যে সব রানিং শ্যু ছিল তার মধ্যে একটা বেশ ফিট করে গেল শুভর পায়ে। দেশবন্ধু পার্কে সকালবেলায় গিয়ে দুদিন দৌড় করিয়ে দেখে নিল। শুভ শুভর মতোই স্প্রিন্ট টানল। কোন অস্বাচ্ছন্দ্য নেই।
************ ******** ****
যে যার স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে গেছে। ঘড়িতে বারোটা পঁয়ত্রিশ। এখানে কোন স্টার্টিং ব্লকের ব্যবস্থা নেই।
স্পন্দন, ডিসুজা এবং অন্যান্যরা দাঁড়িয়ে আছে ফিনিশিং লাইনের দিকে। সাইয়ের এক কর্মকর্তা আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্প্রিন্টারদের সমান্তরাল একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন — ‘রেডি’
এক পা এগিয়ে রেখে নটা শরীর সামনে শিকারির মনসংযোগী চোখ রেখে ঝুঁকে পড়ল। শুভ দাঁড়িয়েছে ডান প্রান্তের দিকে সাত নম্বর লেনে।
পিস্তলের ট্রিগার টেনে দিলেন স্টার্টার। ব্লক থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল নটা শরীর।
যে কারণেই হোক শুভর স্টার্ট-এ গন্ডগোল হয়ে গেল। সে এসবে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। দু সেকেন্ড পরে বেরল। স্পন্দন কপাল চাপড়াল। তার বুকে কে হাতুড়ি পিটছে। ষাট মিটারের লাইন ছুঁল কর্ণাটকের একটা ছেলে।শুভ এখন পাঁচ নম্বর জায়গায়। বাকি আর মাত্র চল্লিশ মিটার। ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
ঠিক এই সময়ে শুভর জংলী সত্ত্বা যেন বল্লমের খোঁচা খেল।
শুভর পরা ছিল লাল গেঞ্জি। স্পন্দনের মনে হল একটা লাল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল রানিং ট্র্যাকে। তিন সেকেন্ডে চারজন শুভর পিছনে পড়ে গেল। পাঁচটা স্টেপে কর্নাটকের ছেলেটাকে দেড়ফুট পেছনে রেখে এক ঝলকে ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে গেল শুভ নস্কর। সানি ডিসুজার হাতের রুমাল হাতে রইল। তিনি মুখের ঘাম মুছতে ভুলে গেলেন।
( পরের অংশ পরের পর্বে )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।