এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিচকে - ২ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ জানুয়ারি ২০২২ | ৫৪৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • #বিচকে_২

    পরদিন সকালে বাজারে বেছে বেছে চারাপোনা গামলায় তুলছিলেন তপনজ্যোতি দত্ত। একশো ষাট টাকা কেজি। এর কম দামে খাওয়ার যোগ্য মাছ বাজারে পাওয়া গেল না। বাড়িতে তিনটে লোক। তপন-কনিকা দম্পতি ছাড়া তপনবাবুর এক ভাগ্নে তাদের সঙ্গেই থাকে। হাসনাবাদের ওদিকে বাড়ি। কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইংরীজিতে অনার্স পড়ে। মামার খুব ভক্ত এবং মামীর খুব প্রিয়পাত্র। কনিকার মতে ‘খুব করিতকর্মা ছেলে। মামার মতো লগবগে নয়।’ তারা নিজেরা নি:সন্তান।

    তা নিয়ে তেমন ক্ষোভ বা অসন্তোষ কিছু নেই এদের দুজনের মনে।

    ‘দাদা, কালকের খবর পেয়েছি। আপনার নতুন আবিষ্কার তো ক্যান্টার করে দিয়েছে খবর পেলাম। রিয়েলি চাইল্ড প্রডিজি।’

    তপনবাবু চারাপোনার থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে। সিদ্ধার্থ বিশ্বাস, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

    তপনবাবু গামলাটা মাছওয়ালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে .... আরে ... তুমি জানলে কি করে? পেপারে তো পাবলিশড হয় নি।’
    — ‘ আরে দাদা ... খবর কি আর চাপা থাকে ! পেপারে এক কোণে খুব ছোট করে বেরিয়েছে। ভাল, খুব ভাল .... আপনার দিন আসছে ।’
    — ‘ আরে না না, মগডালে তুল না এখনই। স্পনসর না পেলে এগোতেই পারব না। এতগুলো ছেলের খরচ .... খাওয়া দাওয়া, কনভেয়্যান্স এইসব তো আছেই, তাছাড়া ইমারজেন্সি মেডিক্যাল এক্সপেন্সের ব্যাপার আছে। অনেক ছেলের জন্য নতুন বুট কেনার দরকার এক্ষুণি। সব মিলিয়ে ভাল খরচার ধাক্কা। টুর্নামেন্ট না জিতলে তো কোন ফিনান্সিয়াল বেনিফিট পাব না।খুব টেনশানে আছি। জানি না স্পনসর না পেলে শেষ পর্যন্ত টানতে পারব কিনা।’

    সিদ্ধার্থ অতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া দিল— ‘ না না সে সেটা হতে দেওয়া যাবে না ..... ব্যবস্থা একটা করতেই হবে ।’
    সিদ্ধার্থর সহযোগিতাপ্রবণ অনুভূতিশীলতা দেখে তপনজ্যোতি গভীরভাবে আপ্লুত হলেন।

    তিনি বললেন, ‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু ব্যবস্থাটা কি হবে ? আমি তো তেমন কোন দিশা দেখতে পাচ্ছি না। এসব সামলে সেকেন্ড রাউন্ডের ওপর কনসেনট্রেট করতে হচ্ছে। সামনের শনিবার ম্যাচ। কি হবে জানি না। আমি ওই অমিত মাঝি মানে, বিচকের ওপর ভীষণভাবে ওপর ভরসা করে আছি।’

    — ‘আপনি ম্যাচের ওপর কনসেনট্রেট করুন তপনদা। আমাদের কোম্পানি ইন্ডিয়ান ফুটবল ডেভেলপমেন্টের ওপর একটা প্রোজেক্ট আন্ডারটেক করেছে। আমি আপনাকে থিয়েটার রোডের অফিসে আপনাকে নিয়ে যাব। ওখানে পি আর ও-র সঙ্গে আপনাকে মিট করিয়ে দেব। আমি যতটা পারি বলে রাখব। মনে হয় প্রবলেম হবে না।’

    তপনবাবু বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন সিদ্ধার্থর মুখের দিকে। কিছু হোক না হোক ছেলেটা তার কথা গুরুত্ব দিয়ে তো ভাবছে। তার উপকার করতে চাইছে। সেটাই বা কম কি। দুনিয়ায় কে আর কার কথা ভাবে।

    বেলা আড়াইটে নাগাদ থিয়েটার রোডে পনেরতলা বিল্ডিং-এর আটতলায় তপন দত্তকে নিয়ে সাইনার্জি ফার্মাসিউটিক্যালসের পিআরও-র চেম্বারে ঢুকল সিদ্ধার্থ।

    পিআরও-র স্থূলকায় চর্বিবহুল চেহারা। কোমরের বেল্ট উপচে পেট বেরিয়ে আসতে চাইছে গায়ের শার্ট ফুঁড়ে। বেশ ভালমানুষ ধরণের গোলগাল চোখমুখ। ধুরন্ধর টাইপের নয়।

    — ‘ আসুন আসুন .... সিদ্ধার্থর মুখে আপনার কথা এত শুনেছি কি বলব.... আপনার সবকিছু আমার মুখস্থ হয়ে গেছে মশায়। আমি নিজেও একজন ডাই হার্ড ফুটবল ক্রেজি।’
    — ‘ না না আমি অতটা কিছু নই। সিদ্ধার্থ আমাকে ভালবাসে বলে ....’
    — ‘ না না সে কখনও হয় না। শুধু ভালবাসা থেকে বললে সে বলত, লোকটা খুব ভাল.... এর বেশি কিছু নয়। যাক সে কথা, আমি হানড্রেড পারসেন্ট চেষ্টা করব আপনার টিম যাতে সাইনার্জির স্পনসরশিপ পায়। অন্তত আমার দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। কিন্তু একটা ছোট ক্রাইটেরিয়া আছে। সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচটা জিততে হবে। ওটা জিতলে আমি আশা করি ফুল স্পনসরশিপ বার করে আনতে পারব। আমি এম ডি-কে একটা হিন্ট দিয়ে রেখেছি।’

    তপন দত্ত আশা নিরাশার দোলা মেশানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদুস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ.... তা তো বটেই ..... সেকেন্ড রাউন্ডটা তো জিততেই হবে .... নইলে আর কি করে হবে ....’
    — ‘ নিশ্চয়ই জিতবেন.... নিশ্চয়ই জিতবেন .... শুনলাম আপনি একটা মারাদোনা পেয়ে গেছেন .... লাকি এনাফ.... ’
    — ‘ হ্যাঁ .... ছেলেটার কোয়ালিটি আছে । কিন্তু প্রপার গ্রুমিং দরকার । জানিনা ওর ভবিষ্যৎ কি। খুব গরীব ওরা।’
    —‘ লেটস বি অপটিমিস্টিক । দেখা যাক কি দাঁড়ায়। ওক্কে .... সিদ্ধার্থ, গিভ মি আ কল আফটার দা ম্যাচ।’

    সামনের শনিবার ম্যাচ। তার আগে কদিন তার তুরুপের তাস বিচকেকে অন্তত দেড় ঘন্টা করে প্র্যাকটিসে নামাতে হবে রোজ।শুধু বল প্লেয়িং আর স্ট্রাইকিং নয়, সেটপিস স্পেশালিস্ট তৈরি করতে হবে ওকে। আগের খেলায় সেটপিস এফেক্ট একদম জিরো। পাসিংও খুব হতাশাজনক হয়েছে। নেহাৎ বিচকে একটা অসাধারণ গোল করে দিয়েছে তাই উতরে গেছে তার টিম। পুরো
    টিমটাকেও প্র্যাকটিসে নামাতে হবে কাল থেকে। হাতে সময় খুব অল্প। এইরকম নানা ভাবনা মাথায় ঘুরছে তপনজ্যোতির মাথায়। সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচটা শুধু তার নয়, অমিত মাঝির জীবনেরও মোড় ঘোরানো ম্যাচ হতে চলেছে — যাকে বলে, ক্লিফ হ্যাঙ্গিং সিচুয়েশান। জাগরণে বা নিদ্রায়, স্বপ্নে বা বাস্তবে একই চিন্তা পাক মেরে ঘুরছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে ..... টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন ..... । নক আউটের ম্যাচ। হারলেই টিম ডাস্টবিনে। তাতে যে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে তা না। জীবন কখনও থেমে থাকে না। খেলার সুযোগ আরও অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু এটা একটা দারুন প্ল্যাটফর্ম ছিল। এ ধরণের সুযোগ বারবার আসে না। সে যাই হোক জীবন তো আর সিনেমার মতো নয় যে, ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে যথাযথ ইচ্ছাপূরণ হবে। সুতরাং রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তপনজ্যোতির নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে। রুদ্ধশ্বাস অবস্থা তো বটেই। এবারে অপোনেন্ট খুব ‘টাফ’ বলে খবর পেয়েছেন তপনজ্যোতি। বাহারিনের টিম। কি সিস্টেমে খেলে কিছুই জানা নেই। স্পেন থেকে কোচিং করাতে এসেছেন একজন প্রাক্তন খেলোয়াড়। খুব চিন্তায় আছেন তপনবাবু ।

    সকাল ছটায় তিনি রায়পাড়ার মাঠে নেমে পড়লেন বিচকের সঙ্গে আরও চারটে ছেলেকে নিয়ে। ওদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়েছে। সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে পনের হাজার টাকা তুলেছেন তপনবাবু। আপাতত টুর্নামেন্টের খরচ তো চালাতে হবে। সেকেন্ড রাউন্ডে জিতে সাইনার্জির স্পনসরশিপটা পেলে পুষিয়ে যাবে। না হলে আবার নতুন করে লড়াই শুরু করতে হবে। ভাবলেই শিউরে উঠছেন সারা জীবন ধরে লড়াই চালিয়ে আসা তপনজ্যোতি দত্ত।লড়াই করতে আর ভাল লাগে না। তারপর ভাবেন, লড়াই ছাড়া কি জীবন হয় !

    তপনবাবু পাঁচটা ছেলেকে দিয়ে নানারকম পাস খেলাতে লাগলেন ডেড বল এবং রানিং দুরকম অবস্থাতেই। বিপক্ষকে ধোঁকায় ফেলতে ডামি রান নেওয়া শেখাতে থাকলেন। সেকেন্ড বল যাতে
    টিমের দখলেই থাকে বারবার বোঝাচ্ছিলেন। এছাড়া সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শোটা ফ্রিকিক, কর্নার এবং নানাধরনের সেটপিস মুভমেন্ট প্র্যাকটিস করালেন। পেনাল্টি শুটিংও নেওয়ালেন অন্তত পঞ্চাশটা। উঁচু এবং নীচু দুরকম শট। বিচকে যথারীতি অসম্ভব দক্ষতায় ইনস্টেপ দিয়ে আউটসুয়িং ফ্রিকিক মারতে লাগল ডান বাঁ দু পায়েই। এরকম দু পায়েই একই রকম শুটিং দক্ষতা প্রায় বিরল ঘটনা বলা যায়।তাও এই বারো বছর বয়সে। ইনসুয়িংটা তেমন আসেনি এখনও। কিন্তু ওর যেরকম সহজাত দক্ষতা, ওটা আসতে বেশি দিন লাগবে না। বিচকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার জন্য তপনবাবু উপরওয়ালার উদ্দেশ্যে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। আর্জেন্টিনিয় কোচ বিলার্ডোর মতো তারও মনে হল, তার ফুটবল দলে আছে ‘বিচকে এবং আরও দশজন।’

    এই হাড়ভাঙ্গা কসরতের পর আর এক দফা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে হল। জিতলে সবই ফেরত আসবে কোন সন্দেহ নেই। পরের দিন সকালেও সকলকে এই সময়ে মাঠে আসতে বলে দিলেন তপনবাবু । তিনি ভেবে রেখেছেন পুরো চোদ্দটা ছেলেকেই প্র্যাকটিসে নামাবেন আগামীকাল।

    বাড়ি ফেরার সময়ে তপনজ্যোতি দেখলেন নন্দিতা তরকারিওয়ালার ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে ফুলকপি দর করছে। তপনবাবু ভাবলেন, নন্দিতার বোধহয় প্রায় চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বছর বয়স হল। কাছাকাছি গেলে মাথার চুলে রূপোলী রেখা দেখতে পাওয়া যাবে। পেট এখন মেদবহুল। ঘটনাক্রমে একই পাড়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নন্দিতার। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি একই পাড়ায়।

    ফুলকপি কেনা শেষ হলে হাতের থলে সামলে পিছন ফিরতেই ট্রাকস্যুট পরা তপনজ্যোতির মুখোমুখি হল নন্দিতা। চল্লিশ বছর আগে হলে তপনজ্যোতির হৃৎপিন্ডের রক্তপ্রবাহ চঞ্চল হত, কিন্তু কালপ্রবাহে সবকিছুই বদলে গেছে। কিন্তু এখন ওই চাঞ্চল্য আর ঘটা সম্ভব নয়। ভরা নদী যে শুকিয়ে গেছে তা নয়, স্রোতধারা বইছে এখন অন্য খাতে, ভিন্ন দিশায়।
    — ‘ আরে তপনদা .... কি খবর... কেমন আছ ? আজকাল তো দেখাই যায় না।’ নন্দিতা অকপট আন্তরিকতায় বলল।
    — ‘ এই আর কি ... তোরও তো দেখা পাই না আজকাল। সকলেই ব্যস্ত এখন। তোর কর্ত্তার খবর কি? এখন কি কলকাতায় না বাইরে ? ’
    — ‘না না কলকাতাতেই আছে। তুমি হঠাৎ ট্রাকস্যুট পরে ! কোথাও কোচিং টোচিং করাচ্ছ নাকি? ’
    — ‘হ্যাঁ ওই একটা দায়িত্ব নিয়েছি..... জানি না কতখানি কি করতে পারব।’ তপনজ্যোতি ব্যপারটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।
    — ‘ বা: খুব ভাল ..... নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবে। খবর দিও কিন্তু।’ নন্দিতাকে বেশ উৎসাহিত দেখায়।
    — ‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আচ্ছা আসি এখন..... অনেক কাজ আছে।’ ব্যাপারটা চাপা দিয়ে তপনবাবু ওখান থেকে সরে যান। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাবার কোন শখ তো নেইই, বাহারিনের একটা কড়া ধাঁচের দলের মোকাবিলা কি ভাবে করা যাবে সেই চিন্তা তাকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছে। এখন মেঘলা দিনের বিষাদ ছায়ার তলায় গিয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। যদিও তরুন বয়সের আত্মবিশ্বাসহীন সংকোচভরা প্রস্তাব নীরস কড়া প্রত্যাখ্যানে ফিরিয়ে দেবার মুহূর্ত এখনও কখনও কখনও মেঘলা দিনের বাদল হাওয়ার মতো এলোমেলো বয়ে যায়।

    পরের দিন ভোরে পনেরটা ছেলেকে প্র্যাকটিসে নামালেন তপনবাবু। বিচকেকে ছাড়া বাকি চোদ্দজনকে দুদলে ভাগ করে ম্যাচ খেলালেন। দুটো দলই খারাপ খেলল না। কিন্তু ওদের স্ট্রাইকিং এবিলিটি নিয়ে চিন্তায় থাকলেন তপন দত্ত। অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে ছেলেগুলো।তপনজ্যোতি ভাবলেন, একমাত্র অমিত মাঝিই দেখছি ভরসা। তপনবাবু রেফারিং করছিলেন। ডিফেন্ডারদের বলছিলেন হার্ড ট্যাকল না করতে, কারো যেন চোট না লাগে। বিচকেকে বসিয়ে রেখেছেন এই জন্যই।আধঘন্টায় খেলা শেষ করে দিলেন তপনবাবু। হঠাৎ চোখ তুলে দেখলেন মাঠের ধারে বাজারের থলে হাতে সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে। তপনকে তাকাতে দেখে একটা হাত তুলল।

    তপনবাবু ওর দিকে এগিয়ে আসছিলেন। সিদ্ধার্থ হাত নেড়ে ইশারায় বলল— আপনি কাজ করুন, পরে কথা হবে। আপনি চালিয়ে যান।

    শনিবার ওই সাড়ে চারটেতেই খেলা শুরু হল। বাহরিনের ছেলেগুলোর স্বাস্হ্য এবং উচ্চতা তপনজ্যোতির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল। তিনি অবশ্য কাল প্রায় একঘন্টা ধরে তার ছেলেদের কড়া ডোজের ভোকাল টনিক খাইয়েছেন। তাতে দেশ, জাতি বা ক্লাবের সম্মান ইজ্জতের কথা তিনি কিছুই বলেননি। ওসব কথায় এখন আর কেউ উদ্দীপিত হয় না। তিনি গরীব গুর্বো ছেলেগুলোর সামনে নানা লোভনীয় স্বপ্নিল ভবিষ্যতের ছবি এঁকে যেতে লাগলেন তাদের ব্যক্তিগত জীবনের। সামনের এই সিঁড়িটা ভাঙা যে তাদের জীবনের মোড় ঘোরানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা এদের মাথার মধ্যে তীব্রভাবে চালান করে দিতে চেষ্টা করেছেন। কাজ যে বেশ কিছুটা হয়েছে তা এদের চোখমুখ দেখে অনুভব করা যাচ্ছিল। নির্ভীক দৃঢ়সংকল্প কাঠিন্যের আবরণ পড়ল শরীরি ভাষায়।

    খেলা শুরুর কুড়ি মিনিটের মধ্যে দুগোল খেয়ে গেল তপনজ্যোতির দল ইয়োলো ডায়মন্ড। স্রেফ বডি স্ট্রেংথে ওদের পনের নম্বর জার্সির স্ট্রাইকার তপনের টিমের দুটো ডিফেন্ডারকে দুপাশে ঠেলে রেখে মাঝখান বেরিয়ে গেল বল নিয়ে। সামনে শুধু গোলকিপার ছিল। ওর কোন অসুবিধে হয় নি। দ্বিতীয় গোলটা হল সেটপিস থেকে। নিখুঁত মাপের ইনসুইং কর্নার কিকে প্রথম পোস্ট থেকে একটা অসাধারণ একটা ফ্লিক হেডে গোল করে গেল ওদের একটা মিডিও শুধু উচ্চতার সুযোগ নিয়ে। ছেলেটা এই বয়সেই পাঁচ এগারো। তপনজ্যোতির বুকের ভিতর মরুভূমি ধু ধু করতে লাগল। হঠাৎ কি জানি কেন বিশ বছর আগে মারা যাওয়া দু:খী মায়ের মুখটা মনে পড়ল। বুকের ভিতর থেকে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। দুবার ঢোক গিললেন তপনজ্যোতি। পরাস্ত, ব্যর্থতার গ্লানিমাখা জীবনের এটাই লাস্ট ল্যাপ। এরপর পুরোপুরি বেরিয়ে যেতে হবে ট্র্যাক ছেড়ে। সেখানে আর কোন প্রতিযোগিতা নেই। আছে শুধু মহা শূন্যতা। কিন্তু মানুষ মরতে চায় না। যেভাবে হোক বাঁচবার চেষ্টা করে। চল্লিশ বছর আগের নন্দিতার মুখটা মনে পড়ল। সেখানে কোন মেঘলা দিনের ছায়া ছিল না। ওর কথায় ছিল মরুভূমির ক্যাকটাসের জ্বালা। সেই নির্মম জ্বালার স্মৃতিই বোধহয় চারশ চল্লিশ ভোল্টের স্পার্ক লাগাল তপন দত্তর মাথার কোষগুচ্ছে। তিনি ডাগ আউট থেকে উঠে গিয়ে সাইডলাইনের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। সাধারণত: কোচেরা এই সময়ে আরও বেশি গোল খেয়ে কলঙ্কজনক হারের ভয়ে কুঁড়ে যান। ডিফেন্সে নটা প্লেয়ার নামিয়ে এনে আল্ট্রা ডিফেন্সিভ হয়ে যান। কিন্তু ভিতর থেকে চাবুক মেরে তপন দত্তকে কে যেন সম্পূর্ণ উল্টো এবং ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় নামিয়ে দিল। বাঁচার জন্য মরীয়া তপনজ্যোতি মরতে চাইলেন না। একটা থ্রো ইন হয়েছিল। সেই সময়ে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিয়ে সিস্টেমটা চার চার দুই থেকে বদলে চার দুই চার করে দিলেন। অর্থাৎ, বিচকের সঙ্গে আরও দুটো ফরোয়ার্ড বাড়িয়ে মোট চারটে ফরোয়ার্ড করে দিলেন। ওই দুটো ছেলেও বেসিক্যালি বল প্লেয়ার। তপন বল প্লেয়িং-এর কাঁটায় সম্মোহিত করতে চাইলেন বিপক্ষকে। ডু অর ডাই .... । বিচকেকে মাঠের ধারে ডেকে নিয়ে রোমিং ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতে বললেন। ইয়োলো ডায়মন্ডের আক্রমণ বাড়তে স্বাভাবিকভাবেই বাহারিনের আক্রমণের ঝড় অনেক স্তিমিত হয়ে গেল। কারণ তাদের ডিফেন্সে লোক বাড়াতে হচ্ছিল। ওদের স্প্যানিয়ার্ড কোচকে বেশ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কি সিদ্ধান্ত নেবে গভীরভাবে ভাবছে মাঠের দিকে চোখ রেখে। খেলা এখন পঁয়ত্রিশ মিনিটের মাথায়। আর কোন গোল হয় নি।

    বিচকের মধ্যে হঠাৎ যেন মারাদোনা নেমে আসল। সে সহসা ডান বাঁ দুপায়ের আড়াই মিনিটের একটা ভেল্কি দেখাল। হাফ লাইনের কাছে একটা লুজ বল পেল। সামনের দুজনকে হেলায় ডজ করল নিজের শরীর বাঁচিয়ে। বাঁ প্রান্তে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে আছে মিঠুন দাস। পুরোপুরি বাঁ পায়ের প্লেয়ার। বিচকে প্রায় কুড়ি গজ ঝড়ের গতিতে কভার করার পর রাইট স্টপার কোন উপায় না পেয়ে ফাইনাল ট্যাকল করল। কারণ বিচকে তাকে পেরোতে পারলেই গোলের মুখ খুলে যাবে। বিচকে আর কোন ডজ করার ঝুঁকি নিল না। ডান পায়ে বল তুলে দিল লেফট ফ্ল্যাঙ্কে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা মিঠুনের দিকে। মিঠুন দারুণ বল রিসিভ করল। সামনে ফাঁকা জায়গা। রাইট ব্যাক ছুটে আসছে ওকে ক্লোজ করার জন্য। তপন দত্তর ভোকাল টনিকের ফল হিসেবেই হয়ত একটা অদৃশ্য স্পিরিট ছেলেগুলোর রক্তে এবার ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে। মিঠুন স্প্রিং-এর মতো একবার আউটসাইড, একবার ইনসাইড করে রাইট ব্যাককে একপাশে ফেলে তরতর করে বল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কোনাকুনি ছুটে বক্সে ঢুকে পড়ল। জীবন মরণ এক করে পেনাল্টি বক্সে ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে হলুদ হীরের পাঁচটা হলুদ জামা। বাহরিনের আটজন নেমে এসেছে ওদের সামলাতে। মিঠুন দারুণ ধোঁকা দিল। গোলকিপার প্রথম পোস্ট আগলে দাঁড়াল। মিঠুন বাঁ দিকে ক্রস করার ভঙ্গী করে বাঁ পা তুলে ক্রস না করে গোলকিপারের বাঁ দিকে ছেড়ে রাখা গোললাইনে গড়ানে প্লেস করল কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। বাহরিনের মধ্যবয়স্ক পোড় খাওয়া সাহেব কোচ প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে। তপনজ্যোতি ডাগ আউটের সামনে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে হাততালি দিতে লাগলেন। সন্ধে নেমে আসছে ময়দানে। গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া আসছে নাগাড়ে। বেলা ফুরিয়ে আসছে। এই টুর্নামেন্টকে মর্যাদা দিয়ে মাঠে ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হল। তপন দত্তর দশটা ছেলে একসঙ্গে উঠে নেমে কুটিকুটি মরণপণ লড়ছে। হয়ত নিজেদের উত্তরণের জন্যই লড়ছে। কিন্তু লড়ে চলেছে রক্তের কণার কণায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে।

    আর কোন গোল হল না প্রথমার্ধে। বিরতির সময় তপনজ্যোতি কোল্ড ড্রিঙ্ক-এর সঙ্গে ছেলেগুলোকে প্রচুর ভোকাল টনিক খাওয়ালেন আবার। স্ট্র্যাটেজিও বাতলালেন জলের মতো সোজা করে। বারবার বললেন ফিজিকাল স্ট্রেংথের অ্যাডভানটেজ যেন ওরা কিছুতেই না পায়। ওদের স্কিল আহামরি কিছু না। নিউম্যারিক্যাল সুপ্রিমেসি ......দিয়ে ওদের কাউন্টার করতে হবে। যেখানেই ওদের কেউ বল ধরবে তিনজন করে ব্লক এবং ট্যাকলে যেতে হবে। কিন্তু ডেঞ্জারাস পজিশানে যেন ফাউল না হয়। ওদের ওই এগারো নম্বরটা যেন বক্সের মধ্যে বলই না পায়। ওর সাপ্লাই লাইনটা কাটতে না পারলে মুশ্কিল হয়ে যাবে। তপনবাবু বললেন, ‘গ্রাউন্ডে বল রেখে যেমন অ্যাটাকিং খেলেছিস তেমনি খেলে যা। ওদের হাইট অনেক বেশি..... বল তুলবি না বেশি। বল হোল্ড করলে ক্লোজে যেন কেউ থাকে পাস রিসিভ করার জন্য। সেকেন্ড বল যেন ওরা না পায়। তিকিতাকা স্টাইলে খেলার চেষ্টা কর স্পীডের মাথায়।’

    ছেলেগুলো খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল কোচের কথা। বিচকে হঠাৎ বলে উঠল, ‘দেখ না কেমন নাচাই এবার ....’ । তপনজ্যোতি চমকে উঠে বিচকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওর দুচোখে বিদ্যুৎপ্রভা ঝিলিক দিচ্ছে। তপন দত্তের বুকের ভেতর বাদল মেঘের মাদল বাজতে লাগল গুড়গুড় করে। দিকদিগন্ত ভাসানো বানভাসি বর্ষা ডাক দিতে লাগল হৃদয়ের আকাশ জুড়ে ।

    বিরতির পর খেলা শুরু হয়ে গেল। হলুদ জামার তপন দত্তর ছেলেরা কাঁকড়ার মতো ঝাঁক বেঁধে ছেঁকে ধরল বাহরিনের অ্যাটাকিং থার্ডে। নিঁখুত দক্ষতায় তিকিতাকা খেলতে লাগল সামনে এবং পেছনে। বাহরিনের কারো পায়ে বল গেলেই একসঙ্গে তিনজন যাচ্ছিল ব্লকিং এবং স্ন্যাচিং-এ। এইভাবে পনের মিনিট কাটল। ইয়োলো ডায়মন্ডের বল পজেজন দেখা গেল এইট্টি ফাইভ পারসেন্ট। কিন্তু গোলের মুখ খুলতে পারছিল না। বিচকের ‘দেখ না কেমন নাচাই এবার’ মনে পড়ল তপনবাবুর। আশ্চর্য সমাপতন বলতে হবে। মনে পড়ার পরই বিচকের পায়ে বল পড়ল বক্সের ডানদিক ঘেঁসে তিরিশ মিনিটের মাথায়। একসঙ্গে দুজন ব্লক করতে এল এবং ছোট্টখাট্টো বিচকে এবার নাচাতে শুরু করল। ওর ডানদিকে এবং বাঁদিকে রমিত আর সুখবীর ছোটাছুটি করছে পাস নেওয়ার জন্য। বিচকে বল ছাড়ল না। পিচ্ছিল নমনীয় শরীরসম্পন্ন সরীসৃপের মতো এক পলকে দুজনকে ডজ করে বেরিয়ে গেল ওরা ট্যাকলের জন্য পা তোলার আগেই। সামনে দীর্ঘদেহী লেফট স্টপার। সে বিচকের শরীরের দোলা দেখে ভেবে নিল নিশ্চিতভাবে আউটসাইড ডজ করবে এবং প্রতিবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সেই দিকেই হেলে গেল তার শরীর কারণ বিচকের বাঁ পায়ে ছিল বল। তাই স্টপারটার মনে হল নিশ্চয়ই বাইরে দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করবে বিচকে। বিচকে কিন্তু ডান পায়ে বল নিল না। বাঁ পা দিয়েই ইনসাইড ডজ মারল। তারপর চার পা ঢুকতেই ছ গজের বক্সের মাথায় ....। গোলকিপারের কোনদিকেই যাবার নেই। সে লাইনের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে শটটা আসার প্রতীক্ষা করছে। শরীর ছোঁড়ার জন্য তৈরি। কিন্তু বিচকের নাচাবার নেশা লেগেছে। সে কোন শট নিল না। সে গোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গোলকিপার এবার বল লক্ষ্য করে ঝাঁপ মারল । বিচকে আবার সরীসৃপের মতো পিছলে গেল মাটিতে পড়ে থাকা গোলকিপারের পাশ দিয়ে ডান পায়ে ছোট্ট ইনসাইড করে। সামনে শুধু গোলের জাল। বিচকে বলে টোকা মারল না। পায়ে বল নিয়ে গোলের মধ্যে ঢুকে গেল। পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগল মাত্র ষোল সেকেন্ড।

    মাঠে প্রায় তিনশো লোক জমেছে। তারা ওইটুকু ছেলের স্কিল দেখে হাঁ হয়ে গেল। তুমুল হাততালি দিতে দিতে নানারকম হর্ষধ্বনি করতে লাগল।

    বাহরিনের ছেলেগুলো এবার বিপদের গন্ধ পেয়ে মরীয়া হয়ে পা চালিয়ে খেলতে শুরু করল।পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওদের তিনজন হলুদ কার্ড দেখল। খেলা শেষ হতে আর তিন মিনিট বাকি। বিচকে ঠিক একই জায়গায় আবার একটা বল পেল আঠারো গজের মধ্যে। একজনকে ছোট একটা ড্রিবল করল। দ্বিতীয় ডিফেন্ডার ভুক্তভোগী। সে এবারে আর কোন ঝুঁকি নিল না। বিচকের গোড়ালিতে পা চালাল। বিচকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ভাবার কিছু ছিল না। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টি দিয়ে দিলেন।

    ওই দক্ষিণদিকে, আগে যেখানে রামপার্ট ছিল সেদিকে বাহরিনের গোলপোস্ট। পশ্চিম দিকে আকাশ লাল করে সূর্য অস্তাচলে যাচ্ছে।

    তপনজ্যোতি দত্তর বুকের ভিতর মাদল বাজতে লাগল।

    বল বসানো হচ্ছে পেনাল্টি স্পটে। তপনবাবু ভাবলেন, জীবনবৃত্তের লাস্ট ল্যাপ চলছে তার। চকিতে একটা বিদ্যুৎগতির স্প্রিন্ট টেনে সবার আগে ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে ফেলার একটা গোধূলি মায়ার মতো ধোঁয়াটে স্বপ্ন আচ্ছন্ন করে ফেলল তপনজ্যোতিকে। বুকের মধ্যে গুরুগুরু মেঘের ডমরু কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। শেষের দিনে সব পাওয়া আর রিক্ত হাতে নতমস্তকে হারিয়ে যাওয়া এ দুইয়ের মাঝখানে একটা পেনাল্টি শট।

    তপনজ্যোতি চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলেন — ‘সুখবীর কিক নে ....সুখবীর.... । বিচকে ...তুই মারিস না।’ তপনবাবু জানেন তার দলে সবচেয়ে দক্ষ পেনাল্টি শুটার পাঞ্জাবি ছেলে সুখবীর সিং। তিনি জানেন বল প্লেয়াররা সাধারণত: ভাল পেনাল্টি শুটার হয় না। তাই বিচকেকে নিতে দিলেন না।

    সুখবীর বল বসিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল। মনে মনে বিড়বিড় করে কি বলল। তারপর তিন পা হেঁটে, চার পা ছুটে ডান পায়ে শট নিল — উঁচু শট , গোলপোস্টের ডানদিকের কোণে। গোলকিপার ঝাঁপাল উল্টোদিকে।

    খেলা শেষ হতে আর এক মিনিট বাকি। তাছাড়া সংযুক্ত সময় কিছু হতে পারে। সেটাও হয়ত মিনিট তিনেক হবে। তপনবাবু জানেন এই সময়টায় বাহরিন মরণপণ ঝাঁপাবে। তিনি সবাইকে নীচে নামিয়ে টিম আল্ট্রা ডিফেনসিভ করে দিলেন। আক্রমণের ঝড় আছড়ে পড়তে লাগল অতিরিক্ত সময়ে। অ্যাডেড টাইম শেষ হতে আর চল্লিশ সেকেন্ডের মতো বাকি। ইয়োলোর ছেলেগুলো ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে। শরীর আর বইছে না। বাহরিন এই মোক্ষম সময়ে একটা কর্নার কিক পেল। তপনজ্যোতির বুকের ভেতর কে হাতুড়ি পিটতে লাগল। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন দুর্গম পর্বত অভিযাত্রীর যেমন ঘটে।

    ওদের যে ছেলেটা কর্নার নিচ্ছিল সে যে ভীষন স্নায়ুচাপে কাতর ছিল সেটা তার শটটা দেখেই বোঝা গেল। কর্নারটা হল বিরাট লম্বা এবং আউটসুয়িং করে গোললাইনের বাইরে বেরিয়ে গেল। অতিরিক্ত উত্তেজনার ফল। তপনবাবুর বুক থেকে পাথর নেমে গেল।

    গোলকিক নেবার সঙ্গে সঙ্গে রেফারি খেলা শেষ করে দিলেন।

    আলো ঝলমলে মাঠ।চারদিকে নানা রঙের পতাকা সান্ধ্য হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। যে কজন দর্শক খেলা দেখার টানে এসেছিল তারা অনেকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এখনও দাঁড়িয়ে বেঁটে মতো ছেলেটা’র ‘পায়ের কাজ’-এর তারিফ করছে। ছেলেরা ক্লান্তির ভারে মাঠে বসে পড়েছে। কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে। তপনজ্যোতি দত্ত মাঠের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারাভরা আকাশের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন বুড়ো তপন দত্ত। জীবনের শেষ পাক দৌড়তে থাকা একটা জীর্ণ মানুষ সামনে সম্মানজনক আলোকোজ্জ্বল ফিনিশিং পয়েন্ট দেখতে পাচ্ছেন।

    সুভাষনগরের বস্তিতে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই রাত নটা বাজল। অন্য ছেলেদের রায়পাড়ার মাঠে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ওখান থেকে যে যার বাড়ি চলে গেল। সুভাষনগর কলোনিতে ঢোকার মুখে তপনজ্যোতির মোবাইল বেজে উঠল। তপনবাবু ফোন তুললে ওদিক থেকে সিদ্ধার্থর গলা ভেসে এল — ‘ তপনদা কনগ্র্যাচুলেশান .... খবর পেয়ে গেছি .... ব্যস এবারে আর চিন্তা কি ? এবার কনসেনট্রেট করুন টুর্নামেন্টটা জেতার জন্য। আপনি একটা দারুন অ্যাসেট পেয়েছেন সত্যি..... ওই যে বিচকে না কি নাম .... ঠি ক আছে .... কাল দেখা হবে .... আপনার বাড়ি যাব....’

    বিচকের মা সন্ধ্যামণি বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘মুখার্জী বৌদি অন্য লোক রেখে নিয়েছে। এতদিন কামাই হয়ে গেল..... এখন ওইরকম মোটা টাকার কাজ এখন কোথায় পাই।’
    তারপর বিচকের বাবা সিদ্ধেশ্বরের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘এ লোকটা তো একেবারে অকর্মন্য। আমি বসে গেলে গোটা সংসার না খেয়ে মরবে।’
    তপনবাবু বলললেন, ‘না দিদি, আমরা কজন আর না খেয়ে মরব না .... বিচকে আমাদের খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছে শক্ত জমিতে। মুখার্জি বৌদিকে আর দরকার নেই।’
    সন্ধ্যামণি বলল, ‘বিচকে ভাল খেলেছে বাবু?’
    তপনজ্যোতি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি কোন বাবু নই দিদি .... আপনি রত্নগর্ভা। বিচকে আমার অন্ধকার রাস্তায় একটা বাতি জ্বেলে দিল।’
    সন্ধ্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তপনজ্যোতির দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘মানে?’
    তপনবাবু বললেন, ‘মানেটা তো আমিও খুঁজছি।’
    সিদ্ধেশ্বর যথারীতি ভ্যাবলামুখে তাকিয়ে রইল।
    রাস্তায় নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন তপনজ্যোতি। তার মনের গভীরে একটা ফোন কলের প্রতীক্ষা জেগে বসে আছে। কলারের নাম মাথার চুলে রূপোলি ঝিলিক পড়া নন্দিতা চৌধুরি। তারপর তপনজ্যোতি হাঁটতে হাঁটতেই ভাবেন, তিনি সেই বোকাই থেকে গেলেন। তিনি কি এমন মহাকার্য করে ফেলেছেন যে নন্দিতা তাকে ফোন করবে ! তার স্বভাব আর বদলালো না।

    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:9f:eea7:8f3c:c8e | ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৫৮502565
  • ভাল লাগল। 
    ভারতীয় ফুটবল যদি সত্যিই এমন কোন খেলোয়াড়-কে  পেত 
  • Anjan Banerjee | ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:৫৪502568
  • খেলোয়াড় আছে। তুলে আনার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পরিকাঠামো নেই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন