এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নবদিগন্ত - ১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ | ৮০৬ বার পঠিত
  • ‘দেবুদা আপনি তো রনজি খেলেছিলেন না?’ কৌস্তভ জিজ্ঞাসা করে।
    — ‘না রে .... সে সৌভাগ্য হয় নি। স্পোর্টিং ইউনিয়নে তিন বছর আর মোহনবাগানে দু বছর ছিলাম। খুব ইরেগুলার ছিলাম ফার্স্ট ইলেভেনে। আর বাকি কেরিয়ার তো নবদিগন্তে মানে, নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এ খেলেই কেটে গেল।’
    কৌস্তভ বলল, ‘অম্বরীশ কাকু বলত আপনার মতো টেকনিক্যালি পারফেক্ট ব্যাটসম্যান খুব কম দেখা যায়। আপনার আরও অনেক অপরচুনিটি পাওয়া উচিৎ ছিল।’
    যে পুরনো সোফাটায় বসে ছিল তাতে হেলান দিয়ে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জী বলল, ‘আর বলিস না.... অনেক শুনেছি ..... আর ভাল লাগে না। এইসব স্তোকবাক্য শুনে শুনে দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। কাজের কাজ কিছুই হল না আজ পর্যন্ত।’
    বাইশ বছরের তরুণ কৌস্তভ চুপ করে বসে রইল মেঝের দিকে তাকিয়ে। পাড়ার ছেলে কৌস্তভ জয়পুরিয়া কলেজে কমার্স পড়ে। নাইট ক্লাস।
    সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকে। নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান । সাধারণত: চার নম্বরে নামে এবং পার্টটাইম অফস্পিনার। সকলেই বলে হাতে খেলা আছে। ‘বার’ খেয়ে গেঁজিয়ে না গেলে অনেক দূর যাবে। বাঁ হাতে ব্যাট করে, বোলিং করে ডানহাতে। ঠিক দেবপ্রসাদ বা ময়দানে পরিচিত দেবু ব্যানার্জীর মতো। কৌস্তভ এখন পর্যন্ত ক্লাব ক্রিকেটে ছটা সেঞ্চুরি তেরটা হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। আশা করা যায় সামনের সিজনেই বড় ক্লাবে ডাক পাবে। কালীঘাট ক্লাবের এক কর্মকর্তা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে তার সঙ্গে। কৌস্তভ মিত্রর পা কিন্তু মাটিতেই আছে। সাফল্যের মদিরায় মাথা টাল খেয়ে যায়নি। দেবু ব্যানার্জীর কাছে প্রায়ই আসে টিপস নেওয়ার জন্য। সে খুবই পরিণতমনস্ক। বুঝতে পেরে গেছে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে গেলে ব্যাটসম্যান হিসেবে টেকনিক্যালি কারেক্ট হওয়াটা বিশেষ জরুরী।
     
    রবিবার সকালে নবদিগন্ত ক্লাবের কার্যকরী কমিটির একটা মিটিং ছিল। সেখানে ক্লাব সেক্রেটারি প্রদ্যুৎ ঘোষ একটা প্রস্তাব রাখলেন। বললেন, ‘দেবুদা আমাদের ক্লাবে একটানা চোদ্দ বছর খেলেছেন। বড় ক্লাবে অবশ্যই তার খেলার যোগ্যতা ছিল বলে আমি মনে করি। রনজি খেলাও অবশ্যই উচিৎ ছিল। যে কোন কারণেই হোক দু:খের ব্যাপার, তা হয় নি। দেবুদা ক্রিকেটকে, বিশেষ করে আমাদের নবদিগন্তকে অনেক দিয়েছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তাই, আমি মনে করি আমাদেরও কর্ত্তব্য তাকে কিছু সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ, তিনি আমাদের কিছু বলুন বা না বলুন, আমরা জানি তিনি ইদানীং যথেষ্ট আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি ক্রিকেটে এত ডেডিকেটেড ছিলেন যে, চাকরি বাকরির দিকে ঠিক মত মন দিতেই পারলেন না। এই ডেডিকেশানকে আমরা কুর্নিশ জানাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ক্লাবের কোর কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জীর সাহায্যার্থে একটা চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করা হবে নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এর সঙ্গে বেঙ্গল রনজি দলের । আমরা চেষ্টা করব যাতে ইডেনে খেলাটা হয়। টিকিট বিক্রির পুরো টাকাটাই দেবুদার হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই সামান্য একটা ম্যাচে স্পনসরশিপ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ডোনেশানের জন্য কিছু ইন্ডাস্ট্রিতে আবেদন করা যেতে পারে। এছাড়া আর একটা প্রস্তাব আছে। ওই ম্যাচে নবদিগন্ত স্পোর্টিং  টিমে খেলবেন দেবুদা এবং ব্যাটিং অর্ডারে ওই চার নম্বর পজিশানে। সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিক এগোয় তাহলে আগামী সেভেন্থ জানুয়ারি ম্যাচটা হবে বলে আশা রাখি।’
    প্রস্তাবটা সাতাশজন কমিটি মেম্বারের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল দু মিনিটের মধ্যে।
     
    হাতের পাঁচ আঙুল কিন্তু সমান হয় না। সজল দাস আর পার্থ মুখার্জি একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিল।
    সজলবাবু বললেন, ‘প্রোপোজালটা পাস হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটা একটু কেমন হল না!’
    পার্থ বলল, ‘কেন সজলদা, কোন ব্যাপারটা?’
    — ‘এই দেবুকে চার নম্বরে খেলানোর ব্যাপারটা। ফিনান্সিয়াল হেল্পের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। দেবুর হয়ত কন্ডিশান সত্যি খারাপ ....’ এই অব্দি বলে আবার ধোঁয়াশা বজায় রাখেন — ‘যদিও ওর কি আছে না আছে আমরা কেউই ঠিক জানি না ..... এই আর কি ....’
    — ‘এটা মানতে পারলাম না সজলদা। এটুকু স্বীকৃতি দেবুদার অবশ্যই প্রাপ্য। তিনি কেমন খেলতেন আমরা অনেকেই জানি। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। ওরকম লেফট হ্যান্ডার বাংলায় বেশি আসে নি। এখন আর কতটুকু খেলা আশা করা যায় তার কাছে। সেটা কোন ব্যাপার নয়। আর ফিনান্সিয়ালি স্ট্রং উনি হবেন কি করে। তার তো সেরকম কোন সোর্স অফ ইনকাম নেই।’ পার্থ জোরালো সওয়াল করে।
    — ‘হ্যাঁ .... সে তো বটেই .... এই মনে হল....তাই বললাম আর কি ..... নবদিগন্তে আছি প্রায় বিশবছর আর কোন ক্লাবে যাইনি.... টিমে আমি দেবুরই সমসাময়িক। ও কিরকম ব্যাট করত আমি জানব না! .....’ - সজল দাস সামলে নিলেন নিজেকে।
    পার্থ আর কোন কথা বলল না। দুজনে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
     
    দেবপ্রসাদ বাড়ি ঢুকে বললেন, ‘মা তোমার অম্বলটা আজ একটু কম আছে?’
    গৌরীদেবী বললেন, ‘হ্যাঁ একটু কম মনে হচ্ছে। তুই আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস নি। আমি বারোমেসে রুগী। এইভাবে যে কদিন থাকি .... তুই ভাল থাকলেই আমার শান্তি। বিয়ে থা কিছু করলি না। আমি চলে গেলে কে দেখবে তোকে তাই ভাবি রাতদিন....’
    দেবু ব্যানার্জি মায়ের পাশে এসে বসে। বলে, ‘আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করে শরীর খারাপ কোর না মা। আমি ঠিক  থাকব। অবিবাহিত মানুষদের কি জীবন কাটছে না?  তাছাড়া ফ্যামিলি হয়নি বেঁচে গেছি। কোন ফিক্সড ইনকাম নেই। খাওয়াতাম কিভাবে। ক্রিকেটের পেছনে ছুটেই তো জীবন কাটল। কিছু করতেও পারলাম না। অর্ধেকের ওপর জীবনও ফুরিয়ে গেল। আর তো কটা দিন।’
    গৌরীদেবী বুড়ো ছেলে দেবপ্রসাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ওরকম কথা বলিস না বাবা ..... আমি এখনও বেঁচে আছি। বেঁচে থাক বাবা। সুখে থাক। সব রেখে যেন যেতে পারি, ভগবানের কাছে শুধু এই কামনাই করি .....’
    দেবুর একটা আফশোষের শ্বাস পড়ে। বলে, ‘তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না .... এতখানি জীবন কেটে গেল। বাবার তেমন চিকিৎসাও করাতে পারলাম না। ওই সরকারি হাসপাতালে ..... তাও ভাগ্যিস পারমিতা প্রায় সব খরচটা সামলে দিয়েছিল। প্রভাসদার মতো লোক হয়না।’
    পারমিতা দেবপ্রসাদের তিন বছরের ছোট বোন। আর প্রভাস হল ভগ্নিপতি। ব্যবসায়িক সূত্রে শক্ত পোক্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে আছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বোনের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়া দেবুর আত্মগ্লানির অন্যতম কারন।
     
    কৌস্তভই খবরটা দিল দেবু ব্যানার্জীকে। 
    — ‘দেবুদা সব শুনেছেন নিশ্চই’
    — ‘কি ব্যাপারে ....’
    — ‘আপনার জন্যে একটা চ্যারিটি ম্যাচ অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে.... মোস্ট প্রোব্যাবলি সেভেন্থ জানুয়ারি। নবদিগন্ত ভার্সেস বেঙ্গল ইলেভেন। আপনিও খেলবেন নবদিগন্তে .... ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বরে। জেনারেল বডি মিটিং-এ কাল ডিসিশান  ইউন্যানিম্যাসলি পাস হয়ে গেছে।’
    — ‘সেকি ! এত কান্ড হয়ে গেল, আমি তো কিছুই জানি না।’
    — ‘না ... মানে, ডিসিশান পাস হবার আগে বোধহয় আপনাকে জানাতে পারছিল না ওরা।’
    তারপর একটু চাপাস্বরে বলল, ‘কাঠি করার লোকও তো আছে দু একজন .....’
    — ‘কি জানি। আমার আর কি বাকি আছে! আমার পেছনে কাঠি করে কার আর কি ফয়দা হবে? এতকাল তো অনেক কাঠি করা হল। তবে কি জান হাতে খেলা থাকলে তাকে আটকানো যায় না। কিন্তু খেলতেই যদি না দেওয়া না হয় তাহলে সে এগোবে কি করে .....’
    — ‘সে যাই হোক, ওরা আজ কালই আপনাকে জানাতে আসবে। আপনি প্লিজ না করবেন না। আমি খুব এক্সাইটেড হয়ে আছি আপনার ব্যাটিং দেখব বলে .... অম্বরীশ কাকুর কাছে অনেক শুনেছি আপনার স্কোয়্যার কাটের কথা।’
    — ‘দূর পাগল.... অম্বরীশটাও যেমন পাগল!  আমার কি আর কোন রিফ্লেক্স আছে নাকি? ওসব দিন এ জীবনের মতো বিদায় নিয়েছে।’ দেবুর কথায় পূরবীর বিষাদ। সন্ধে নেমে এসেছে। বাতাসে হিমের পরশ লাগছে। ব্যস্ত রাস্তার দুপাশে দোকানগুলোয় জ্বলে উঠেছে ঝলমলে আলো।
    — ‘সে সব সেদিন দেখা যাবে ... এখন চলি। আপনি কিন্তু না করবেন না প্লিজ .....’
    কৌস্তভ সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
     
    নিকাশিপাড়ার মাঠে নেট প্র্যাকটিস হচ্ছিল। দুপুর একটা বাজে। দেবু দেখল আঠারো থেকে আটত্রিশ সব বয়সের পনের ষোল জন ছেলে নেট প্র্যাকটিস করছে। কোন ক্লাবের নেট পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেগুলো সবই অচেনা। উঠতি প্লেয়ারদের নেট দেখলে দেবু দাঁড়িয়ে পড়ে। এটা দেবুর স্বভাব। ওদের প্র্যাকটিস দেখে মন দিয়ে। টেকনিকে হোক, হ্যান্ড আই কেঅর্ডিনেশানে পারফেকশান আনতে হোক নেট প্র্যাকটিসের কোন বিকল্প নেই। ক্রিকেটারদের যতটা বেশি সম্ভব নেটেই পড়ে থাকা উচিৎ।
    নেটে একটা ছেলে ব্যাট করছিল। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়েস। ডানহাতি ব্যাটসম্যান। একটা ছেলে লেগব্রেক করাচ্ছিল অনেকটা করে। ডানহাতি ব্যাটসম্যান একটা বলও ঠিক মতো খেলতে পারছিল না। হয় অফস্টাম্পের বাইরে মিস করছিল বা কানায় লাগছিল কিংবা ফরোয়ার্ড শর্টলেগে ক্যাচ হচ্ছিল। দুবার লেগস্টাম্পের বাইরে পড়া বলে টার্ন মিস করে ল্যাজেগোবরে হয়ে বোল্ড হল। তিনজন মিডিয়াম পেসার আর একটা অফস্পিনারের বলগুলো মোটামুটি ভালোই সামলাচ্ছিল। আবার একবার অফস্টাম্পের ওপর লেগব্রেকটা কানায় লাগাল। ফার্স্ট স্লিপে পরিষ্কার ক্যাচ হত। 
    দেবু ব্যানার্জীর কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। সে দূর থেকে দেখছিল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে নেটের সামনের দিকে শর্ট এক্সট্রা কভার যেখানে দাঁড়াত সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। তার পায়ে একটা অনেক পুরনো স্নিকার শ্যু।  পারমিতা কিনে দিয়েছিল। 
    ওখান থেকে বেশ জোরে নেটের ব্যাটসম্যানকে বলল, ‘ আরে কি করছ কি ! বাঁ পা আরও বাড়াও। ফোর্থ স্টাম্প কভার কর। মাথা ওপরে থাকছে কেন ? ঝোঁকাও ঝোঁকাও..... বাঁ পায়ের টো মিড অফের দিকে থাকছে না .... সেই জন্যেই বিট হচ্ছ .....’
    ব্যাটসম্যান এখনকার ছেলে। দেবুকে চেনে না। আসলে এরা কেউই চেনে না। ছেলেটা স্টান্স থেকে উঠে অবাক হয়ে দেবু ব্যানার্জীর দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লাবের একজন সিনিয়র প্লেয়ার বোলিং ক্রিজের ওখান বলল, ‘আরে দূর দূর ..... খেল খেল .... ফালতু জ্ঞান দিচ্ছে।’ দেবু শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘বাচ্চা ছেলে সব..... যথেষ্ট প্রমিসিং ..... প্রপার গাইডেন্স দিন .....’
    এই কথা শুনে গ্রুপ লিডারের মাথা গরম হয়ে গেল। ঠোঁট বেঁকিয়ে তেঁতো স্বরে বলল, ‘তা দাদা আপনি একটু দেখিয়ে দিন না। দেখি কেমন ক্যালি.... মলয়েশের লেগব্রেক খেলতে গিয়ে সাঁতার কাটতে হবে .... কেউ পারে না ..... কোথাকার কে .....’
    মলয়েশ একটুও উত্তেজিত হল না। বলল, ‘সে তো খুব ভাল কথা। জেনুইন অরথোডক্স রিস্ট স্পিনারের খুব অভাব এখন। বিশেষ করে লেগস্পিনার।’
    কথা বলতে বলতে ওর দিকে এগিয়ে যায় দেবু। আবার বলে, ‘.... কিন্তু তাই বলে ব্যাটসম্যান নেগোশিয়েট করতে পারবে না এটা কোন কথা হল না।’
    বছর পঁয়ত্রিশের সিনিয়র প্লেয়ারটি এ কথায় আরও গরম খেয়ে গেল। উৎকট ব্যাঙ্গের সুরে বলল, ‘ও.. ই তো, বললাম তো .... দয়া করে একটু দেখিয়ে দিন না ..... আমরা শিখতে চাই।’
    অহমবোধে ঘা লাগা ওই প্লেয়ার কাম কোচ ভাবল, দেবু এবার রণে ভঙ্গ দিয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে। কিন্তু দেবু মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই .... দুটো প্যাড আর গার্ডটা দিন। ‘
    নেটে ব্যাট করা ব্যাটসম্যান নেট থেকে বেরিয়ে এল। দেবু প্যান্টের ওপরেই গার্ড পরে নিল। বলল, ‘ওই ছেলেটিকেই শুধু বল করতে বলুন। মানে ওই লেগস্পিনার ....’
     
    দেবু ব্যানার্জী বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। মলয়েশের লেগব্রেক তার অফব্রেক হবে। তাতে কিছু আসে যায় না। ম্যাট পাতা পিচ। বলের টার্ন নিশ্চিত একই থাকবে।
    প্রথম বল। মলয়েশ থ্রি কোয়ার্টার লেংথে বল রাখল অফস্টাম্পের একটু বাইরে। বীভৎস টার্ন নিল। প্রথম বলের সামনাসামনি হয়েছে দেবু অনেক দিন পরে। পা নড়ল না। ব্যাট আর প্যাডের খোলা দরজা দিয়ে বলটা ঢুকে এসে দেবুর লেগস্টাম্প ফেলে দিল। সিনিয়র প্লেয়ার কাম কোচ ভদ্রলোক  কুৎসিতভাবে হ্যা: হ্যা: হ্যা: করে হেসে উঠল। মলয়েশ খিক খিক করে হাসতে লাগল মুখে হাত চাপা দিয়ে। অন্য কয়েকজন  হাততালি দিতে লাগল। বোধহয় মলয়েশকে অভিনন্দন জানাবার উদ্দেশ্যে। দেবু অঞ্চলভাবে ব্যাট ঠুকে ঠুকে স্টাম্পটা খাড়া করল। বেল সাজিয়ে দিল। তারপর আবার স্টান্স নিল লেগস্টাম্প গার্ড নিয়ে । পরের বল একই লেংথে ছাড়ল মলয়েশ ফ্লাইটটা একটু বেশি রেখে। ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্কের যোগাযোগ সরাসরি বাঁধা মস্তিষ্কের সঙ্গে। মনে চাপ থাকলে ব্যাটসম্যানের পা নড়ে না। দেবু মাথার ভার ঝেড়ে ফেলে বিশ বছর আগে ইস্টবেঙ্গল মাঠে একটা বিরানব্বই রানের প্রাণবন্ত ইনিংসের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চটপটে পায়ে দু স্টেপ এগিয়ে মাথা একদম বলের লাইনের ওপরে নিয়ে বলটা হাভভলিতে নিল। নিখুঁত টাইমিং-এ বল উড়ে গেল টার্নের দিকে মিড অনের ওপর দিয়ে। সিনিয়র প্লেয়ার উড়ন্ত বলের দিকে তাকিয়ে রইল কোমরে হাত দিয়ে। মলয়েশ আদৌ বিব্রত বোধ করল না। বল হাতে পেয়ে পরের বল করার জন্য তৈরি হল। এবারেও একই লাইনে রাখল কিন্তু একটু বড় লেংথে এবং জোরের ওপর। দেবুর ফুটওয়ার্কে এখন তরঙ্গ খেলছে। সে চকিতে ইনসাইড আউট করে লেগস্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে আবার হাফভলিতে বলটা মিট করল মাথা একদম সোজা রেখে বল ঘোরার কোন সুযোগ না দিয়ে। কভারের ওপর দিয়ে বল উড়ে  গেল আবার অন্তত পঁচাত্তর মিটার। মাঠের বাইরে একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক প্র্যাকটিস দেখছিলেন। তিনি হাততালি দিতে লাগলেন।
    মলয়েশের রোখ চেপে গেছে। পরের বলটা আবার একটু ছোট লেংথে করল জোরের ওপর মিডল স্টাম্পে, দেবু যাতে চালাতে না পারে। দেবু বুঝে গেছে গুগলি এখনও রপ্ত হয়নি ছেলেটার। সবকটাই লেগব্রেক ছাড়বে। বলটা ছেড়ে দিলে লেগস্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দেবু বলটা ছাড়ল না। লেংথ ছোট ছিল। ব্যাকফুটে গিয়ে টার্নের জন্য অপেক্ষা করল ..... তুলে দিল মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। বারান্দায় বসা ভদ্রলোক আবার হাততালি দিতে লাগলেন। মলয়েশের মুখ লাল হয়ে গেল। বোকার মতো হাসল একবার। সিনিয়ার প্লেয়ার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে জুতোর টো দিয়ে মাঠে আঁকিবুকি কাটতে লাগল।
    মলয়েশের জেদ আরও বেড়ে গেল। সে তার হাতের সবচেয়ে বড় টার্ন করাবার তৈরি হল। 
    এ বলটা করল অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে। গুড লেংথে। তার হাতে প্রচুর টার্ন আছে। বল ঘুরে লেগের দিকে যাচ্ছিল । দেবু পিটারসেনের মতো সুইচ হিট মারল পপিং ক্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে। সবাই দেখল, বিশ বছর আগে যেমন দেখত, বলটা ফাইন লেগের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে একটা গোডাউনের চালের ওপর গিয়ে পড়ল। মাঠের সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল। 
    এরপর আর একটা বল করল মলয়েশ । হতাশা এবং উত্তেজনায় বলটা হয়ে গেল নীচু ফুলটস, অফ এবং মিডলে। ঠিক ছবির মতো কপিবুক স্টাইলে শরীর সোজা রেখে সোজা ব্যাটে মিডলিং করল। বল তীরের মতো সোজা গতিতে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
    দেবু গ্লাভস খুলে নেট থেকে বেরিয়ে এল। নেটে যে ছেলেটা আগে ব্যাট করছিল সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকু আপনি কোন ক্লাবে খেলতেন ?’
    দেবু আর কোন ক্লাবের নাম করল না। বলল, ‘নবদিগন্ত স্পোর্টিং ক্লাব’। ততক্ষণে ক্লাবের অন্য ছেলেগুলো ঘিরে ধরেছে দেবু ব্যানার্জীকে। এক ফাঁকে ওই নেটে ব্যাট করা ছেলেটা বলল, ‘নবদিগন্তে আমাকে ঢুকিয়ে নিন না কাকু ..... আমি খুব খাটব। আমার নাম কান্তম মুখার্জী।’
    দেবু তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘হ্যাঁ দেখব ..... এখন এখানেই ভাল পারফর্ম করার চেষ্টা কর।’
    সিনিয়র প্লেয়ার কাম কোচ এবার দেবুর সামনাসামনি এল। বলল, ‘আপনি কি আগে খেলতেন? আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। বোধহয় স্পোর্টিং ইউনিয়ন টেন্টে। আমি তখন খুব ছোট। আমার পিসেমশায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। উনি একজন মিডিয়াম পেসার ছিলেন। চোটের জন্য বেশিদিন খেলতে পারেননি অবশ্য ..... ’। ছেলেটির অহমিকা কিন্তু জেগে আছে এখনও। ভাঙে তবু মচকায় না। সে বলে, ‘তবে জানেন কি দাদা আপনি হলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। মলয়েশের লেগস্পিন আপনার অফস্পিন হচ্ছে। তাই অনেকটা অ্যাডভান্টেজ পেলেন আর কি.....’ । বলে দাঁত বার করে চালাকের মতো হাসে। 
    দেবুর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না ওর কথায়। বলে, ‘চায়নাম্যান বোলারকেও একইভাবে খেলতে পারি। আসল হল প্রপার ফুটওয়ার্ক। আর হ্যান্ড আই কোঅর্ডিনেশান ..... ঠিক আছে চলি এখন। আবার পরে দেখা হবে। ছেলেগুলোকে দেখবেন ঠিকমতো। চলি .....’
     
    দুপুর প্রায় আড়াইটে বাজে। বাড়ি ফিরে দেবু বলল, ‘মা ভাত দাও .... এ কি! তুমি এখনও না খেয়ে বসে আছ? না না মা.... তুমি এত দেরি কোর না। তোমার বয়েস হয়েছে .... ঠিক টাইমে খাওয়াদাওয়া কর ....’
    — ‘তুই থাম দেবু ..... তোর খাওয়া হয় নি .... আর আমি খেয়ে দেয়ে বসে থাকব .... আর জ্বালাস না।’
    গৌরী দেবী ভাত বাড়তে থাকেন। আর দেবপ্রসাদ ভাবতে থাকে — মায়ের এতখানি বয়েস হয়ে গেল। আর কদিন আছে কে জানে। সে মায়ের জন্য কিছুই করতে পারল না। এখনও যদি একটা সুযোগ হয় ..... হায় ভগবান।’ নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে দেবপ্রসাদের।
     
    সন্ধে সাতটা নাগাদ নবদিগন্তের সেক্রেটারি প্রদ্যুৎ ঘোষ আরও দুজন কমিটি মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে দেবু ব্যানার্জীর বাডির দরজায় কলিং বেলে চাপ দিল।
     (বাকি অংশ পরের পর্বে)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন