এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গোলকিপার - ৩

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ডিসেম্বর ২০২১ | ৩৪১ বার পঠিত
  • (তৃতীয় এবং শেষ পর্ব)

    সৈকতের বুটটাই চমৎকার ফিট করে গেল নিতুর পায়ে। কয়েক জোড়া অতিরিক্ত হোর্স আর গোলকিপারের জার্সি ক্লাবে ছিল। সেগুলোই কাজে লেগে গেল। ওগুলো কেনাকাটার সময়ও হাতে ছিল না।

    আড়াইটের মধ্যে স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে পৌঁছে গেল সুহাসিনী স্পোর্টিং। পুরুলিয়ার দলটার নাম বল্লভপুর ইলেভেন। বেশ দাপুটে টিম বলে শোনা যাচ্ছে।

    স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। কোন টিকিট লাগবে না। প্রবেশ অবারিত। এক পশলা জোরালো বৃষ্টি হয়ে গেছে দুপুর দেড়টা নাগাদ। মাঠের ঘাস এখনও ভিজে। ঘাসের তলায় মাটির কি অবস্থা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আকাশের মেঘ অনেকটাই কেটেছে। আবহাওয়া বেশ গুমোট।

    মাঠে নামার আগে সবাইকে প্রচুর ওআরএস মেশানো জল খাওয়ালো জগন্নাথ, যাতে ডিহাইড্রেশান থেকে মাসল্ ক্র্যাম্প না হয় কারো।

    স্টেডিয়ামের গ্যালারি এখন ফাঁকা। এই পর্যায়ের খেলা দেখতে সাত তাড়াতাড়ি কে আর হাজির হবে। রোদটা কিছুটা পড়লে হয়ত কিছু লোক জমতে পারে।

    চারটে বত্রিশ নাগাদ খেলা শুরু হয়ে গেল। সুহাসিনীর কিক অফ। নিতু বারের তলায় সমানে নেচে যাচ্ছে। দেখলে মনে হয় নার্ভগুলোকে ঝাড়া দিয়ে চাঙ্গা করে তুলছে।

    প্রথম মিনিটেই একটা দারুন মুভ হল সুহাসিনীর। মাঝমাঠে নিখুঁত চারটে পাশ খেলল প্রশান্ত, সেলিম আর তড়িৎ। ডানপাশে তড়িতের মাপা থ্রু। সৌরভ পাল সেন্টার লাইনের দশ মিটার ওদিকে রাইট উইং-এর জায়গায় বলটা নিল। সামনে ওদের লেফট মিডিও। চমৎকার বডি ফেন্টে ওকে ডানদিকে ফেলে একটা দারুন আউটসাইড ডজে বল বার করে নিয়ে ফ্ল্যাঙ্ক ধরে ছুটতে আরম্ভ করল। সৌরভের গতি ভয়ঙ্কর। এই উয়িং ধরে ছোটাটাই সৌরভের প্রধান অস্ত্র। পিছন থেকে তাড়া করে কেউ আর তাকে ধরতে পারে না। ফাঁকা অবস্থায় গোললাইনে পৌঁছল। মাপা সেন্টার প্রায় সাত ফুট হাইটে। প্রদীপ পাল স্পট জাম্প করার পর একদম কপালের সামনে বলটা পেল। বল্লভপুরের ডিফেন্স এখনও থিতু হয়নি। ফোরহেডের নিখুঁত টোকা এবং ..... গোল।

    শ্যামপুকুর থানার ওসি সলিল সেনকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেখা গেল। ঠিক সেই সময়ে গোলটা হল। তিনি ফেন্সের ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ও মাই গুডনেস ..... অনলি সেভেনটিন সেকেন্ডস..... এ তো জাস্ট সেভেন্টি সেভেনে ইস্টবেঙ্গলের এগেনস্টে আকবরের গোল।’

    বিনাপয়সার খেলা দেখতে মাঠে দুচারজন করে লোক ঢুকতে আরম্ভ করেছে।

    ব্যাস ওই পর্যন্ত। দশ মিনিটের মধ্যে বল্লভপুর খেলা ধরে নিল। প্রত্যেকটা ছেলে স্কিলফুল এবং দারুন বল কন্ট্রোল। জগন্নাথের টিম চার পাঁচ এক সিস্টেমে দাঁড়িয়েছিল। এখন কার্যত ছয় তিন এক হয়ে গেল। পুরুলিয়ার ছেলেগুলো সুহাসিনীকে নাকানি চোবানি খাওয়াতে আরম্ভ করল। সাত মিনিটের মধ্যে দুটো সিটার মিস করল। নিতুকে একা পেয়েও একটা পোস্টের বাইরে আর একটা ক্রসবারের অনেক ওপর দিয়ে মারল দুজন। নিতুকে কিছু করতে হয় নি। গোলে বল গেলে কি হত বলা মুশ্কিল। খুব ক্লোজ রেঞ্জের শট ছিল। নিতুর বডি মুভমেন্ট ঠিক ছিল। বলের ওপর চোখ ছিল আগাগোড়া।

    সুহাসিনীর স্টপার দুটো যেন পায়ের নীচে জমি পাচ্ছিল না। বৃষ্টি ভেজা মাঠে ঘাসের তলায় চটটটে কাদা। তাতে সুহাসিনীর ডিপ ডিফেন্সকে আরও নড়বড়ে লাগছিল। আর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে ভাল হত। আঠাল কাদাটা ধুয়ে যেত।

    একটা কর্ণার পেল বল্লভপুর। বক্সে ছটা প্লেয়ার ছটফট করছে রক্তের স্বাদ পাওয়া হায়েনার মতো। দুটো লম্বা স্ট্রাইকার ছ গজের ভিতরে সুযোগ খুঁজছে। নিতু মাথা ওদের কানের কাছে। ডান পায়ের লম্বা ইনসুইঙ্গার আসছে। ফাঁকায় দাঁড়ানো অরক্ষিত আট নম্বর জার্সি দুই পোস্টের মাঝখানে। দরকার শুধু মাথার একটা টোকা। দ্বিতীয় পোস্ট থেকে চার পা ছুটে এসে নিতু লাফিয়ে উঠল সমুদ্রের বুকে ডলফিনের মতো। স্ট্রাইকারের মাথার ওপর থেকে দুহাতের গ্রিপিং-এ বল পেড়ে নিয়ে নিখুঁত ল্যান্ডিং-এ মাটিতে শরীর নামাল। সলিল সেন হাততালি দিতে লাগলেন ফেন্সের ধারে দাঁড়িয়ে।

    তিরিশ মিনিট কাটল। আশ্চর্যের ব্যাপার সুহাসিনী এখনও গোল খায় নি। খেলা একেবারেই একতরফা হচ্ছে। জগন্নাথের ছেলেরা একবারেই বল হোল্ড করতে পারছে না। দশজনে নেমে এসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে লড়ছে। উল্টোদিকে বল্লভপুরের প্রায় সবাই উঠে এসেছে অ্যাটাকিং থার্ডে। তিনটে কর্ণার পেল আট মিনিটের মধ্যে। দুটো কর্ণার একদম বাজে হল। একটা বাইরে গেল। একটা সোজা নিতুর হাতে। তৃতীয়টা কুশল খাঁড়া দারুন অ্যান্টিসিপেশনে বিপক্ষ লেফট মিডিওর মাথা টপকে চমৎকার হেডে বল ক্লিয়ার করল। সেকেন্ড বলটা পড়ল সৌরভের পায়ে ডানদিকের প্রান্তে নিজেদের অর্ধে। সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি। মাঠের এ অংশটা বেশ শুকনো। সৌরভ বল নিয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ গতিতে দৌড় লাগাল। পিছনে তাড়া করেছে বল্লভপুরের চারটে প্লেয়ার। প্রশান্ত, সেলিম এবং তড়িৎ চড়চড় করে উঠতে লাগল বক্সে জায়গা নেবার জন্য। সৌরভ একা ছুটে চলেছে তীব্র গতিতে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে। আঠারো গজের বক্সের বাঁদিক দিয়ে ঢুকে পড়ল দুরন্ত গতিতে। সন্ত্রস্ত গোলকিপার অসহায়ভাবে একবার এগোচ্ছে একবার পেছোচ্ছে। জগন্নাথ আর আবীর নিষ্পলক প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে। সৌরভের সামনে আরও জায়গা আছে গোলের মুখে যাবার। তাছাড়া তিনটে প্লেয়ার জায়গা নিয়েছে সাত আট গজের মধ্যে। কিন্তু সৌরভ বোধহয় বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের কারণে গোলের আরও নিকটবর্তী হবারও চেষ্টা করল না কিংবা বক্সে অপেক্ষমান সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বল ছাড়ার উদ্যোগও নিল না। গোলের প্রায় দশ গজ দূর থেকে চোখ কান বুজে ডানপায়ের আউটস্টেপে জোরাল ড্রাইভ পাঠাল। লক্ষ্যহীন শট ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। জগন্নাথ প্রবল হতাশায় পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। আবীর হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে লাগল হতাশ ভাবে।

    ঠিক এর পরেই বল্লভপুরের কাউন্টার অ্যাটাক হল ঝড়ের গতিতে। ওদের লেফট আউট বল ধরে ছবির মতো দুটো অসাধারণ ডজে ছিটকে দিল তপন আর শক্তিব্রতকে। তারপর আড়াআড়ি বল ঠেলল ফাঁকায় দাঁড়ানো সেন্ট্রাল মিডিওকে। ছেলেটা একজন দক্ষ বল প্লেয়ার। হেলায় ডজ করল মনোজ বিশ্বাসকে। ডজ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দুটো সাইড ব্যাকই জায়গায় নেই। বক্সে ঢুকে পড়তে পারলে গোলকিপারকে একা পাবে। মনোজ ঝুঁকি নিতে চাইল না। পেছন থেকে জামা টেনে ধরল। মোটামুটি পঁচিশ গজের ওপর ফ্রি কিক মাঝামাঝি জায়গায়। সুহাসিনীর পাঁচজন ওয়াল তুলেছে। জগন্নাথ আর আবীর মনে মনে প্রমাদ গনল। গোলটা হাফ টাইম পর্যন্ত বোধহয় রাখা গেল না। গ্যালারিতে এতক্ষণে হাজার দুয়েক লোক জমেছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ মন দিয়ে খেলা দেখছে তারা।

    নিতু পোড় খাওয়া গোলকিপারসুলভ দায়িত্ব সহকারে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ম্যান মার্কিংয়ের বন্দোবস্ত করতে লাগল। নিজে দাঁড়াল খানিকটা বাঁ পোস্টের দিকে সরে, ডানদিকে মুভ করার জায়গা রেখে।

    ন নম্বর ডামি রান দিল। কিক নিল বল্লভপুরের সাত নম্বর। দুর্দান্ত কিক .... তীব্র গতির আউটসুয়িং। ওয়াল টপকে পোস্টের ডান কোন দিয়ে বল ঢুকছিল। সকলেই বুঝে গেল অবধারিত গোল।নিতুর তো পালিয়ে যাবার উপায় নেই। তার তো উপহার দেবার কথা আছে অশ্রুতকে। একটা ধনুকের ছিলায় যেন কোন নিপুন ধনুর্ধর টান লাগাল। তীক্ষ্ণ তীরের মতো ডান পোস্টের দিকে ছিটকে গেল একটা ছোটখাটো গোলকিপারের কিশোর শরীর। পোস্টের ঠিক চার ইঞ্চি আগে বলে চারটে আঙুলের ছোঁয়া লেগে বল ছিটকে গেল গোললাইনের বাইরে। সাত নম্বর জার্সি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হতবাক হয়ে। একজন এসে তার পিঠে সান্ত্বনার হাত রাখল। সলিল সেন ফেন্সের ধারে একা একা দাঁড়িয়ে দু হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, ‘কাম অন.... বয়..... কাম অন ..... ওয়েল ডান .... গ্রেট জব.... গ্রেট জব’ চেঁচাতে লাগলেন। জগন্নাথ, আবীর সহ গোটা রিজার্ভ বেঞ্চ তুমুল হাততালি দিতে লাগল।

    সুহাসিনীর প্রাণপন লড়াই জারি থাকতে থাকতেই হাফ টাইম হয়ে গেল। জগন্নাথরা আপাতত ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন কিছুক্ষণের জন্য। ওরা মাঠের বাইরে আসার পর জগন্নাথ নিতুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নিতু বলল, ‘দাঁড়াও কাকু ..... এখনও তো খেলা শেষ হয় নি। এখনও গোটা হাফ বাকি।’
    জগন্নাথ বলল, ‘তা ঠিক..... কিন্তু আমি জানি তুই পারবি। আর তুই পারলে এরাও পারবে ...’

    নিতু ঠান্ডা বোতলে চুমুক দিল।

    বিরতিতে অনেক ভাবনা চিন্তা করে প্রশান্তকে বসিয়ে লেফট আউট নামান হল কৌশিক দত্তকে। দুটো উইং দিয়েই গতিশীল আক্রমণ তুলে আনার দরকার আছে বলে মনে হল ওদের।

    কৌশিকের গতি আছে প্রচন্ড । এছাড়া বাঁচবার কোন রাস্তা নেই। আর একটা পরিবর্তন হল, সেলিমকে বসিয়ে মিডফিল্ডে গাট্টাগোট্টা চেহারার টাফ ডিফেন্সিভ ব্লকার মলয় পালকে নামান হল।

    নিতু জগন্নাথ সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে চুমুক দিচ্ছিল। হঠাৎ যেন বাবার গলা শুনতে পেল.... ‘নিতু.... অ্যাই নিতু’। জল কাদা মাখা গোলকিপারের গেঞ্জি পরা নিত্যানন্দ পিছন ফিরে দেখে তার বাবা সত্যেন প্রামাণিক দাঁড়িয়ে আছে একগাল হেসে। পরীক্ষার রেজাল্টজনিত রাগের চিহ্ন দেখা গেল না তার মুখে। নিতু ছুটে গিয়ে বলল, ‘বাবা তুমি কখন এলে?’
    সত্যেনবাবু বললেন, ‘এই মিনিট পাঁচেক হবে ..... রাস্তায় যা জ্যাম .... বাপরে ....’
    জগন্নাথ এগিয়ে এসে বলল, ‘নমস্কার ..... আমি জগন্নাথ সরকার। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।’
    — ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। অনেক ধন্যবাদ। অনেক উপকার করলেন। ছেলেটা যা হতচ্ছাড়া....’
    জগন্নাথ হেসে বললেন, ‘যা বলবার এখনই বলে নিন। খেলার পর আর বলার সুযোগ পাবেন না।’
    — ‘মানে?’
    — ‘মানেটা খেলার পরে ক্লিয়ার হবে বলে আমার ধারণা’
    নিতু বলল, ‘মা আসে নি?’
    — ‘আসে নি আবার! ওই যে ...’
    দেখা গেল প্রায় শূন্য গ্যালারির নীচের দিকে জড়সড় হয়ে গায়ে আঁচল জড়িয়ে বসে আছে নিতুর মা। তিনি কোনদিন কোন খেলার মাঠে যান নি। যাবেন বলে ভাবেনও কোনদিন। জগন্নাথ ছুটে গেলেন তার দিকে।

    রেফারির হুইসল্ এল মাঠের থেকে। আকাশে আবার মেঘ ঘনাচ্ছে। অসম্ভব গুমোট।

    আবীর ঘোষকে ঘিরে সুহাসিনীর ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। আবীর বলছে, ‘দুটো উয়িং দিয়ে ফানেলিং কর। সৌরভ আর কৌশিকের স্পীড দিয়ে ওদের প্রেস কর। প্রেস করলে ওদের অ্যাটাক অনেক কমে যাবে। মলয় রোমিং মিডিওর মতো খেলবে। যেখানে বল সেখানেই ব্লকিং হবে। ফ্রি কিক যেন ডেঞ্জারাস পজিশানে না হয়। ইয়োলো কার্ডের ব্যাপারে সাবধান থাকবি সবাই। মাঠ খুব আঠালো। বেশিক্ষণ দম ধরে রাখতে পারবে না ওরা। উয়িং প্লে ছাড়া মাঝমাঠে তোরা স্লো খেল দমটা ধরে রেখে। দরকার হলে লাস্ট পাঁচ মিনিট স্পীড তুলবি।’

    দুটো উইংই স্পীড তুলতে আরম্ভ করল দু দিক দিয়ে। বল আউটসাইড ডজে বের করে নিয়ে হুড়মুড় করে দৌড় লাগাচ্ছিল সৌরভ আর কৌশিক। কিন্তু পুরুলিয়া খেলাটা ধরে নিল খুব তাড়াতাড়ি। সৌরভ আর কৌশিকের সামনের ফাঁকা জায়গা ব্লক করে ছোটার জায়গা বন্ধ করে দিল। ফানেলিং ক্লোজ হয়ে গেল।

    সে যাই হোক, সুহাসিনীর ছেলেরা আপ্রাণ লড়াই দিতে লাগল। দুজন স্টপারকে এখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ লাগছে খুব সম্ভবত নিতুর ক্রমাগত চিৎকারে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কিন্তু ওরকম একটা দক্ষ দলের বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ দেয়াল তুলে রাখা খুব কঠিন কাজ। জগন্নাথ ঘনঘন ঘড়ি দেখতে লাগল।

    পঁয়ত্রিশ মিনিটের মাথায় সুহাসিনীর লেফট ব্যাক একটা মারাত্মক ভুল করল, বোধহয় এতক্ষণ ক্রমাগত লড়াইয়ের ক্লান্তির ফলে। সহজ বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে বুটের পাশের দিকে লেগে বল ঘুরে গিয়ে পড়ল আঠারো গজের মধ্যে ফাঁকায় দাঁড়ানো ন নম্বরের পায়ে। অযাচিত উপহার বলা যায়। দুটো স্টপারের মাঝে বিরাট ফাঁক। দুজন দুদিকে এই মুহুর্তে। শিউরে উঠল সুহাসিনীর রিজার্ভ বেঞ্চ। জগন্নাথের চোখ উদ্বেগে নিথর হয়ে গেল।

    ছোট একটা স্প্রিন্ট টানলেই সামনে শুধু নিত্যানন্দ। নিতু নিশ্চিৎ বিপদের গন্ধ পেয়ে গেল। কিন্তু সে গোলকিপার, মাঠের সংসারে সে নি:সঙ্গ, একক যোদ্ধা। গোটা দলের মরণ বাঁচনের ভার এখন তার কাঁধে। হাতে কোন সময় নেই। নিতু মুহুর্তে তৈরি হয়ে নিল। ওসি সলিল সেন ফেন্সের রেলিং খামচে ধরলেন। চোখ বুজে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। বোধহয় তার ইস্টদেবতা লেভ ইয়াসিনকে স্মরণ করলেন।

    নিতু লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসল ক্ষিপ্র চিতার মতো। ওদের স্ট্রাইকার সোজা ঢুকছে। নিতু বুঝে গেছে প্লেয়ারটা ডানপায়ের। বাঁ পায়ে কিচ্ছু করতে পারবে না। বলের দিকে চোখ রেখে সাত আট গজ এক নিমেষে পেরিয়ে গোলের বাঁ দিকটা কভার করে ক্লোজ করে দিল। স্ট্রাইকারের সামনে শুধু গোলের ডানদিক খোলা। ওর সামনে এখন দুটো উপায়। হয় ডান পায়ে আউট সাইড ডজ করে নিতুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা সময় নষ্ট না করে আর না এগিয়ে ওখান থেকেই গোলে চিপ করা। কিন্তু ও সামনে নিতুকে ছটফট করতে দেখে দোটানায় পড়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল।

    নিতুকে এই সময়টা দেওয়াটাই হয়ে গেল ওর মারাত্মক ভুল।

    নিতু কিন্তু এক পলকও সময় নষ্ট করল না। জঙ্গুলে চিতার মতো ছ গজ দূর থেকে ঝাঁপ মারল স্ট্রাইকারের পায়ে। আটকে গেল বল নিতুর শরীরে।

    জগন্নাথ সরকার ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল। চোখ খুলে একটা অবিশ্বাস্য গোল বাঁচানো দেখল।

    নিতুর মা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন গ্যালারিতে হাজার দুই লোকে ভরা গ্যালারি চিরাচরিত শব্দ মুখরিত ফুটবল পরিমন্ডলে পরিণত হয়েছে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার ছোট্ট নিতুর খেলা দেখে তারা অনেকক্ষণ ধরে হাততালি দিচ্ছে। সত্যেন প্রামাণিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

    জগন্নাথ সরকার আবার ঘড়ি দেখলেন। পাঁচ মিনিট। আর পাঁচ মিনিট বল্লভপুরকে রুখতে পারলে এতক্ষণের লড়াই সফল হয়। স্বপ্নপূরণের একটা ছোট ধাপ পেরনো যায়।

    কিন্তু প্রচুর কাঁটা বিছোনো এ পথ। বড় দুর্গম এ রাস্তা।

    খেলা শেষ হতে পাঁচ মিনিট বাকি। জগন্নাথ আর আবীর উত্তেজনায় ছটফট করছে। এই সময়ে সমীর শিকদার একটা কেলেঙ্কারি করে বসল। ডানদিক থেকে করা পুরুলিয়ার একটা ক্রসে হাত লাগিয়ে বসল। বলটা নিশ্চিৎভাবেই ফাঁকায় দাঁড়ানো আট নম্বরের মাথায় যাচ্ছিল ছ গজের মাথায়। দ্বিতীয় পোস্ট একদম খোলা ছিল।

    জগন্নাথ তীব্র আফশোষে দুহাতে নিজের মাথার চুল চেপে ধরলেন। বুকে কে একমন পাথর চাপিয়ে দিল। আর মাত্র পাঁচটা মিনিট গোলটা রাখা গেল না! কষ্টে বুক ফেটে যেতে লাগল।

    কিন্তু বিদ্যুতের ঝলকানির মতো একটা কথা হঠাৎ ঝলসে উঠল জগন্নাথের মনে — ‘ভাইকে আমি একটা উপহার দেব।’

    মনে হল, অশ্রুত এখন কি করছে? সে কি ঘুম থেকে উঠেছে?

    দেবকী মাসি কি তাকে ঠিক মতো খাইয়েছে?

    আমতার বাগানে পড়ন্ত রোদ্দুর পড়েছে আমগাছের বোলে পাতায়। শিমূলের আঁশ ঝরে যাচ্ছে থেকে থেকে।

    পেনাল্টি স্পটে বল বসানো হচ্ছে উত্তর দিকের গোলপোস্টের সামনে। মাঠে প্রায় তিন হাজার লোক দাঁড়িয়ে উঠল তীব্র উত্তেজনার খোরাক পেয়ে।

    নিতু লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটু ঝুঁকে। চোখের দৃষ্টি বাজপাখির মতো স্থির। অশ্রুতকে এখনও উপহার দেওয়া হয় নি। জগন্নাথ কাকুকে কথা দেওয়া আছে। তার চিন্তাকুল মা আর বাবা তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে। এই সময়ে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। গ্যালারির লোকগুলো কিন্তু নড়ল না।

    ডানপায়ে পেনাল্টি মারল বল্লভপুরের ন নম্বর। নিতুর বাঁ দিকে। ও দিকটাই বেছে নিয়েছিল নিতু। লেগে গেল। শটটা একটু কমজোরি, কিন্তু দুর্দান্ত নীচু প্লেসিং। নিতু এক ঝটকায় ছিটকে গেল। দুহাতে বল গ্রিপ করে মাটিতে পড়ল ছবির মতো বাঁ পোস্টের সামনে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ওসি সলিল সেন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাতাসে ঘুসি মারতে মারতে চেঁচাতে লাগলেন — ‘ডান .... ডান.... ও ইয়েস .... ও ইয়েস .... ও ইয়েস ....’

    জগন্নাথ উত্তেজনা সামলাতে না পেরে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ডাগ আউটে।

    আর বিশেষ কিছু ঘটল না সৌরভের দুরন্ত গতির একটা সোলো রান ছাড়া। কিন্তু এবারেও বলটা নষ্ট করল সৌরভ।

    কোন অতিরিক্ত সময় হল না। মিনিট তিনেক বাদে রেফারি বাঁশী বাজিয়ে দিলেন। পুরো গ্যালারি হাততালি দিতে লাগল। বোধহয় নিত্যানন্দের উদ্দেশ্যে।

    নিতু এখনও জলকাদা মাখা পোশাক ছাড়ে নি। মা-র সামনে গিয়ে বলল, ‘মা .... বাড়ি চল।’

    তার মা কখনও কোন ফুটবল মাঠে যাননি। তিনি গোটা কান্ডটায় কি বুঝলেন কে জানে। নিতুকে নিয়ে প্রবল উল্লাসরত সুহাসিনী স্পোর্টিং-এর লোকজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি ডান হাত দিয়ে নিতুর জলে ভেজা মাথায় এবং মুখে সনাতন মাতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

    সত্যেন প্রামাণিক নির্বাক এবং বিভ্রান্ত ভঙ্গীতে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এরপর জগন্নাথবাবু নিশ্চয়ই নিতুর অ্যাডমিশানের ব্যাপারটা চেষ্টা করবেন। চার সাবজেক্টে ফেল .....

    শ্যামপুকুর থানার ওসি সলিল সেন হঠাৎ সেখানে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ‘কি দাদা চিনতে পারছেন? আফটার অল ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট..... নো প্রবলেম .... হরনাথ পাঠমন্দিরের সেক্রেটারি আমার বন্ধু। আর হ্যাঁ .... এবার থেকে নিতুর টিউশন আমিই দেব।’

    সত্যেন প্রামাণিক ওসির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি ভাবলেন, সলিলবাবু শিক্ষক না হয়ে কেন ওসি হলেন।

    জগন্নাথবাবু ফেরবার সময় সেই কথাটা আবার পাড়লেন — ‘সত্যেনবাবু, মানেটা এবার ক্লিয়ার হয়েছে তো? সেই যে বলেছিলাম ....’

    প্রতিমা দেবী ছেলে নিত্যানন্দকে জড়িয়ে ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন, ছেলে ফের হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে।

    ঝিরঝির করে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে এখনও ।

    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন