এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ৪/বর্ষাশেষে ... পাহাড় ও পাহাড়ের কান্না

    Mousumi Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ অক্টোবর ২০২১ | ৫১৭ বার পঠিত
  • বর্ষা যাই যাই করছে। আকাশ, বাতাস প্রকৃতিতে  অদ্ভুত  এক আনন্দের ছোঁওয়া জাগে যেন এই সময়। নীল আকাশের বুকে ধবধবে সাদা মেঘ দলে দলে ইতিউতি ভেসে চলেছে,  কাজের শেষে ছুটি পাওয়ার আনন্দে।  ধূ ধূ  সবুজ মাঠ, প্রান্তরের রূপ দেখে চোখ যেন ফেরানো যায় না। রাস্তার ধার ঘেঁষা  জঙ্গলে এক এক গাছের এক একরকম সবুজ  সাজ। গাছে গাছে রঙবেরঙের পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছিদের তো ব্যস্ততার শেষ নেই যেন। ঘরের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীর্ণ  নদীটির শরীরেও লেগেছে যৌবনের পরশ। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে সকালের প্রথম লালচে হলদে রোদ্দুরে জড়োয়ার ঝিকিমিকি।প্রকৃতির রাজ্যে পালাবদলের সূচনা হয়েছে। 
     
    এমন এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম নীলপাহাড়ের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছা নিয়ে – ঘরের জানলা  দিয়ে এতদিন যাকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখেছি।
    মনের মধ্যে  আনন্দের সুর বাজছে। যাওয়ার পথটিও ভারী চমৎকার। উঁচু, নীচু ঢেউ খেলানো রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে থেকে থেকে দেখা দিচ্ছে নীলপাহাড়। মাথার উপরে সুনীল আকাশ। বর্ষাশেষে  গাছের সবুজ পাতায়  সূর্যের আলো পড়ে এক অপরূপ দৃশ্য তৈরী করেছে। বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ। এরই মধ্যে দেখলাম  জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু মেঠো পথ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে  – মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, আহা ! ঐ পথে একবারটি যদি যেতে পারতাম! 
     
    মনের ইচ্ছে মনের মধ্যে সযত্নে রেখে এগিয়ে যাওয়া হল নিরিবিলি পিচের রাস্তা ধরে। জঙ্গল এবার হালকা হতে শুরু করেছে।  গ্ৰাম আসছে একটি। মাঝেমধ্যে লোকজনের দেখা পাওয়া  যাচ্ছে। গরু বা ছাগলের দলকে নিয়ে চলেছে কেউ, কারোও মাথায় জঙ্গল থেকে আনা কাঠের বোঝা, কেউ বা কাঁধে কোদাল ইত্যাদি নিয়ে চলেছে, কেউ কেউ  রাস্তার ধারে নিছক গল্পেই ব্যস্ত। এবার রাস্তার দুধারে কয়েকটি মাটির ঘরের দেখা পাওয়া গেল। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। ঘরের বারান্দাগুলি বেশ মনকাড়া। মাদুর জাতীয় কিছু বিছানো রয়েছে সেখানে। মুরগি, ছাগল, কুকুর, মানুষ সকলেই যে যার মতো ব্যস্ত।
     
    গ্ৰামের শেষে আবার জঙ্গল শুরু। আঁকা বাঁকা পথ। ইতিমধ্যে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। সঙ্গে হাওয়াও। একটা বাঁক ঘুরতেই  রাস্তার শেষে নীলপাহাড়কে অনেক কাছে দেখতে পেলাম। মনে বেশ উত্তেজনা বোধ করছি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলেছে এবার। আরোও কিছু এগিয়ে বেশ বড়সড় নদীর দেখা পাওয়া গেল। নদীর উপরের ব্রীজ পার করলেই পৌঁছান যাবে নীলপাহাড়ের কাছে।
     
    নদীর সঙ্গে সখ্যতার আশায় গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। হাওয়া বইছে বেশ জোরে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি  বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সামনে দু কূল ছাপানো জলে ভরা নদী, নদীর তীরে ধবধবে কাশফুলের সারি,  মাথার উপরে ছাই রঙা আকাশ, আর ঠিক ওপারে আমার অনেকদিনের চেনা নীলপাহাড়। আনন্দের বান ডাকল মনে। 
     
    নদীর এইপারে কয়েকটি  মাছ ধরবার  ছোট নৌকো বাঁধা রয়েছে। দূরে  মাঝনদীতেও দুই একটা নৌকো দেখতে পেলাম। জোরাল হাওয়া, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নীলপাহাড় বেয়ে এপারে এসে আমার চোখ, মুখ স্পর্শ করল। খুব ভালো লাগছিল এমনভাবে নদী, পাহাড়, কাশবনের সঙ্গে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে। কেটে গেল এইভাবে বেশ কিছু সময়।
     
    হাওয়ার বেগ একটু কমলে মনে হল  নীলপাহাড় কি আমাকে চিনতে পারল? আমি কি তার মনের কথা জানতে পারব?  কি আছে তার মনে?  
     
    পাহাড়কে দেখে আমি আত্মহারা হই। রোমাঞ্চিত হই নীল আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া সবুজের সাজে পাহাড়কে  দেখে অথবা বর্ষার জলভরা কালো মেঘের উত্তরীয় জড়ানো সাজ দেখে। ঘন বর্ষায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টিধারা  কত কি মনকে ভাবিয়ে তোলে! পাহাড়, নদী, গাছপালা, আকাশ সকলেই আলাদা। অথচ, সকলে মিলেমিশে কেমন এক সংসার রচনা করেছে!  সে সংসারে আমিই  শুধু অতিথি একজন! তাই হয়তো এত ভালোলাগা গ্ৰাস করে আমাকে ! আমাকে চিনতে নদী, পাহাড়ের ভারী বয়েই গেল।  
     
    তবুও নদীকে প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন। "সবসময় কিসের এত তাড়া, নদী?" নদী  যেন তার নিজের ছন্দে বয়ে যেতে যেতে বলেছিল, "সময় নেই গো। অনেক  দূর যেতে হবে, বড় নদীর  কাছে। তারপর একসঙ্গে যাব সাগরে।"  কাশফুলেরাও মাথা দুলিয়ে কত কিই বলতে চেয়েছিল!  নীল আকাশের বুকের ভাঙা ভাঙা বাদলা মেঘেরা বলল "এবার কাজ প্রায় শেষ। আমরা এবার ফিরে যাচ্ছি। আবার হবে দেখা"। কিন্তু  পাহাড়?  রোদ, ঝড়, মেঘ, বৃষ্টির  তোয়াক্কাও করে না সে।  নেই আনন্দ, নেই দুঃখ, নেই তার  কোনও পরিবর্তন। নদীর জলে নিজের ছায়া পড়ে, তাও সে দেখে না মাথা নুইয়ে। জানতে চাইলাম, সকলেই আমার সঙ্গে কথা বলল, তুমি কিছু বলবে না?  আমি যে আজ কতদূর থেকে এলাম তোমার কাছে, শুধু তোমাকে দেখব বলে?  অহংকারী পাহাড় নিরুত্তর রয়ে গেল।  নির্নিমেষ চোখে চেয়ে থাকলাম নীলপাহাড়ের দিকে।  যতই সে অবহেলা করুক সে তো রাজা আমার কাছে। কিছুতেই তার আকর্ষণকে আমি অগ্ৰাহ্য করতে পারি না। বারেবারে পাহাড়ের কাছে ছুটে যাই। 
     
    আরোও কিছু এগিয়ে ছোট পাহাড়ী ঝর্ণা দেখতে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে ভরদুপুরেও আধো অন্ধকারে সে ঝর্ণা যেন নিঃসঙ্গভাবে  নীলপাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে।  উচ্ছলতা নেই তার স্বভাবে মোটেও। বড় শান্ত পরিবেশ সেখানকার। জঙ্গলের মধ্যে থেকে  একা কোনোও অচিন পাখির ডাকে মন উদাস হয়ে গেল। আশপাশে একটু ঘুরে দেখছিলাম। বেলা পড়ে আসছে। পাখিরা এবার ঘরে ফিরে আসছে একে একে। 
     
    ঘরফিরতি এক ঝাঁক বনটিয়া পড়ন্ত বেলায় উড়ে যেতে যেতে যেন বলে গেল, "পাহাড়ের উপর রাগ করো না। সে বড় একা।  সে মুখ লুকিয়ে কাঁদে, আমরা জানি"। 
     
    পাহাড় কাঁদে!  মুখ লুকিয়ে! কেন?  আমি অবাক। 
     
    পাখিরা বলল, "সে যে অচল। আমাদের মতো উড়তে পারে না। নদীর মতো ছুটতে পারে না। হাওয়ার মতো বইতে পারে না"।
     
    পাহাড় কাঁদে বুঝলে কি করে তোমরা? আমার প্রশ্ন।
     
    পাখিরা  বলল, "জানি গো জানি।  তার চোখের জলই যে ঝর্ণা হয়ে বেয়ে চলেছে।"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • নন্দিতা রায় | 2409:4061:10a:e1a0::30f:f8a0 | ২৬ অক্টোবর ২০২১ ২২:৩১500254
  • বাহ্ , খুব সুন্দর লিখেছো !  এভাবেও ভাবা যায় !!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন