এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রাজভাষা 

    Chayan Samaddar লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৬১৯ বার পঠিত
  • স্টাফরুমে শ্মশানের স্তব্ধতা। সকলের মাথায় হাত। শুধু সেকেন্ড মাস্টারের মুখে বিজয়ীর হাসি। হেডমাস্টারকে উদ্দেশ্য করে বললেন - আমি আপনাকে সাবধান করেছিলুম। এসব অনার্স, ফার্স্ট ক্লাস এই ভুরশুটপুর হাই স্কুলে চলে না। শুনলেন না। আমার মেজ ভায়রার সেজ ছেলে রেডিই ছিল। এখন সামলান। সাহেব ইনসপেক্টর। এইড তো গেলই। স্কুলই না তুলে দেয়!

    হেডমাস্টার আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি ওঁর আরাধ্য দেবতা বঙ্কিমবাবুকে গালমন্দ করেছি; নয়তো ওঁর সাধের কলাবাগান তছনছ করে দিয়েছি। চোখ ছলছল করছে। ধরা গলা - এটা কী করলে দেবমাল্য? ইনসপেকশনের সময় ইংরিজিতে কথা বলতে ওই অলম্বুষকে বারণ করো নি?

    দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হেডস্যারর বাগানের কোণার ঘরটায় থাকি। ওঁর গৃহেই আহারাদি। স্যারের ছোটমেয়ে টেঁপি আমার লোকাল গার্জেন। ছয় বছরের গিন্নি। আজ বেরোনর আগে নথ নাড়া দিয়ে বলেছে - দেবুদা' আজ ছুটির পর সোওজা বাড়ি আসবে। কেলাবে নাটকের মহড়ায় জুটে যেওনা। তোমার তো হুঁশ চৈতন্য নেই! জলখাবারে আজ কলার পায়েস আর লুচি।

    আর জলখাবার! এই চল্লিশটাকা মাইনের থার্ড মাস্টারির চাকরি ছাড়তে হলো। সদাশয় বৃটিশ সরকার বাহাদুরের কেরানি, মাস্টার আর শিক্ষিত বেকার সৃষ্টির শিক্ষাব্যবস্থার প্রোডাক্ট আমরা। আমাদের এই নিয়তি। আবার কলকাতা। আবার জুতোর সুকতলা খোয়ানো। আবার উমেদারি। আবার নো ভেকেন্সি! মিনমিন করে বললাম - আমি শেখরকে পই পই করে বলেছিলাম, স্যার, ইংরিজি বলিসনে! হতভাগা যে এই কাণ্ড করবে বুঝব কী করে?

    হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে! কী কুক্ষণে যে নতুন চালু ডাইরেক্ট মেথডে ইংরিজি শেখানোর ভূত চেপেছিল। শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের কাছে এভাবে পড়েছি ম্যাট্রিক পর্যন্ত। তারপর তো কলকাতা নিয়ে এলেন বাবা। যাক, সে কথা। ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেরা ইংরিজিতে কথা বলার ব্যাপারটা যে যার মতো করে বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু, শেখর মিত্তির উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে লাগলো। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে লাগলো অধীত বিদ্যা। একটা কথা মানতেই হবে, ও যা বলতো, তাকে জোর দিয়ে ভুল, কোনওমতেই বলা যায় না। শিক্ষক হিসেবে আমার গর্বিত হওয়াই উচিত ছিলো। কিন্তু, আমি তটস্থ হয়ে চলতে আরম্ভ করলাম। পণ্ডিতমশাইয়ের বাবা মারা গেছেন। পিতৃশোকটা খুব বেজেছিল তাঁর। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝেই তাঁর চোখে জল চলে আসত।
    একদিন শেখর খুব সহানুভূতি নিয়ে বলল - সার, আই অ্যাম সিইং ওয়াটার ইন ইওর আই। মাই মাইন্ড ইজ হার্টিং ব্যাড। ফোরহেড সার! নোবডি হ্যাজ এ পার্মানেন্ট ফাদার।

    পণ্ডিতমশাইয়ের মুখ থেকে শোকের ছায়া সরে, দেখা দিল প্রগাঢ় আতঙ্কের ছাপ। ঠিক সেই মুহূর্তে হেড স্যার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এমন এক বিষম খেলেন যে, গ্রুপ ডি থাকোহরি এক গেলাস জল নিয়ে ছুটে এল। মুখে, ঘাড়ে জল দিয়ে একটু সুস্থ বোধ করার পর হেড মাস্টার ক্লাসে ঢুকলেন।
    - শেখর।
    - স্যার।
    - যা বললে, বাংলায় বলো।
    - সার, আপনার চোখে জল দেখতে পাচ্ছি। আমার খুব মন খারাপ লাগছে। কপাল সার! কারও বাবা চিরকাল থাকেন না।
    - শেখর।
    - সার।
    - ভবিষ্যতে, দেবমাল্যর ক্লাস ছাড়া, এই ইস্কুলের কোথাও ইংরিজি বলবে না তুমি!

    স্টাফ রুমে এসে পণ্ডিতমশাই আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন - পিতৃশোকের ওপর এই শক যদি আরএকবার পেতে হয়, তবে আর বাঁচবো না দেবমাল্য। ব্রহ্মহত্যার পাতক হবে তুমি।

    ওঁকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে হয়েছিল। কথা রেখেছিল শেখর। ইসকুলে আর ইংরিজি বলেনি। কিন্তু, সমস্ত ভুরশুটপুর তার ইংরিজির দাপটে কেঁপে উঠলো। উফ! গেনির বিয়ের কথা ভাবতে এখনও আতঙ্ক হয়। জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা কানাইলাল বোস, শেখরদের প্রতিবেশী। গেনিকে শেখর কোলে পিঠে করেছে। মা বলে ডাকে। গেনিও আধো স্বরে তাকে 'ছেয়ে' ডাকতো। এখন ছেলে বলে। তা সেই কানাইবাবু, সনাতন হিন্দুধর্মের প্রথা মেনে, ন'বছরের গেনিকে গৌরীদান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গেঞ্জির হাতায় চোখ মুছতে মুছতে, কোমরে গামছা বেঁধে খাটতে লাগলো শেখর। বিয়ের আসরে আমরা সবাই যখন বসেছি, খবর এলো ছেলের পিশেমশাই বলেছেন, তাঁদের হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। কনেপক্ষ তাদের একটিবারও জানায়নি, কলকাতা থেকে ভুরশুটপুর এতটা দূর। গাঁটের কড়ি খসিয়ে রেলভাড়া দিয়ে তাঁদের আসতে হয়েছে। হিন্দুস্কুলের ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র, তাঁর শ্যালকপুত্রকে মাত্র ত্রিশ ভরি গয়না, আর দুহাজার টাকা নগদে পাচ্ছেন বলে, কনের বাপ জুচ্চুরিও করবেন? জরিমানা স্বরূপ আরও দু'হাজার টাকা এখনই না দিলে বর উঠবে না। এত টাকা জোগাড় করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। কানাইবাবু পাগলের মতো কান্নাকাটি করছেন। বরকত্তার হাত পা ধরছেন। কিন্তু, তিনি নির্বিকার। ভগ্নীপতির সূক্ষ্মবুদ্ধিতে মুগ্ধও বোধহয়। সব শুনে শেখরের চোখ লাল হয়ে উঠলো। সোজা ছুটলো বর যেখানে বসেছে, সেখানে। পেছন পেছন আমরাও। গিয়ে দেখি সেই পিশেমশাইয়ের গলা টিপে ধরেছে শেখর।
    - দি আনম্যারেড ডটার অফ দিস ম্যান ইজ মাই মাদার!

    আমি রগ টিপে ধরলাম। এই লোকের মেয়ে, আজকের কনে, যে তোর মা, সেটা ইংরিজিতে বললে কে বুঝবে রে বাপ? কিন্তু শেখর তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

    - হোয়াট মাঙ্কিনেস হ্যাভ ইউ স্টার্টেড?

    এটা ঠিক বলেছে। এসব কী বাঁদরামি শুরু করেছে লোকটা? শেখরের রুদ্রমূর্তি থেকে মারাত্মক ঘাবড়ে গিয়ে পিসেমশাই বললেন - ক্কি ক্কিছু না তো!

    শেখর একটা বিকট ভেংচি কাটলো।
    - ওওঃ! মাই ব্রাদার ইন ল ইজ এ ওয়েট ক্যাট! ডাজ নট নো হাউ টু টার্ন এ ফ্রায়েড ফিশ!

    মাথা নেড়ে সায় দিতেই হলো। ঠিকই তো! শালা আমার ভিজে বেড়াল! ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না! শেখরের রাগ আরও চড়ল।
    - সান অফ এ পিগ! ইফ ইওর নেফিউ ডাজ নট রাইজ দিস মিনিট, উই উল কীপ ইওর হেডস।

    এহে! আজে বাজে গাল দিতে শুরু করেছে এবার। আর, এখুনি বর না উঠলে মাথাগুলো রেখে দেবে মানে? চেয়ে দেখি, গাঁয়ের রোখা ছেলের দল পাকা বাঁশের লাঠি হাতে জড় হয়েছে। গিয়ে শেখরকে জড়িয়ে ধরলাম।

    - ব্যস! এবার চুপ!

    বরকর্তার দিকে ফিরে বললাম - একটা বিশ্রী কিছু হওয়ার আগে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বসুন। এমনিতেই তো ছেলে বেচছেন, এতটা নীচে নাই বা নামলেন।

    ভালোয় ভালোয় বিয়ে মিটে গিয়েছিল। না হলে কী হতো ভাবতে গেলে গলা শুকিয়ে যায়। শেখর কখনও আমার অবাধ্য হয় না সেটাই বাঁচোয়া। কিন্তু, আজ তুই এটা কী করলি রে ছোঁড়া? স্কুল ইনসপেকশনের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে, সাত দিনের মধ্যে, ইসকুলের কলি ফিরে গেল, বরাবরের মতো। ঘরগুলো ঝকঝক, তকতক করছে। সেক্রেটারির বাড়ি থেকে ফুলের টব এনে বারান্দা সাজানো হয়েছে। ক্লাসে ক্লাসে, আমরা সবাই, যা যা প্রশ্ন করবো, উত্তর সমেত, বোর্ডে লিখে মুখস্ত করিয়ে দিয়েছি। ঠিক বেলা সাড়ে দশটায় ইনসপেকটরকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন সেক্রেটারি। সদাশয় ভদ্রলোক। এডুইন আর্নল্ড নাম। ইটন-এর ছাত্র। সদ্য এদেশে এসেছেন। অবাক কাণ্ড! টেগোরের ভক্ত। গতবছর গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পাওয়াতে খুব খুশি। আমি ওঁর সরাসরি ছাত্র শুনে বারবার হ্যান্ডশেক করলেন। রাউন্ড শুরু হলো। বীভৎস গরম আজ। এডুইন ঘন ঘন কপালের ঘাম মুছছেন। আমার ক্লাসে যখন এলেন, ঘন্টা পড়তে আর মিনিট পাঁচেক। গোটা কতক প্রশ্ন করে, সন্তুষ্টভাবে মাথা নাড়লেন। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার সামনে অবধি গেছি, তখনই ঘটলো দুর্বিপাক।

    - সার। শেখরের উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
    - ইয়েস মাই ফ্রেন্ড?
    - সার আর ইউ ব্লাডি?

    আমরা চিত্রার্পিতবৎ স্তব্ধ। কিছুক্ষণ পর, এডুইন পরিষ্কার বাংলায় বললেন
    - কী জানিতে চাহ পুনর্বার কহ তো?
    - আপনার কি রক্ত পড়চে সার?

    আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সাহেবের লাল কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে না রক্ত, এই নিয়ে সমস্যা শেখরের। কিন্তু, আমার বোঝায় তো কিছু হবে না, সাহেবের না বোঝার বোঝা বইতে হবে আমাদের সকলকেই। আমি ঘরে এসে বসার, একটু পরেই হেডস্যার এসে বসলেন। তারপর থেকেই আমরা অপেক্ষা করছি ভবিতব্যতার। এডুইন ঘরে ঢুকলেন। অনেকের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে, আমাকেই প্রশ্ন করলেন - ব্যানার্জি, হোয়্যার ইজ দ্য হেডমাস্টার?
    হেডস্যার কীরকম নার্ভাস হয়ে গিয়ে বলে বসলেন - আই ইজ হিয়ার সার।
    ঝকঝকে হেসে এডুইন বললেন - আ! দেয়ার ইউ আর!
    আরও নার্ভাস হয়ে হেডমাস্টার বললেন - ইয়েস সার! আই আর!

    এডুইনের অট্টহাসিতে স্কুল কেঁপে উঠলো। তারপর ধীর লয়ে, ঝোঁকহীন ইংরিজিতে বললেন - এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার এই স্কুল খুব ভালো লেগেছে। ইনফ্যাক্ট আপনারা লাকি। টেগোরের ছাত্র এখানে পড়ান। ব্যানার্জি, একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করা যায় কি?

    আমি মাথা হেলালাম। সাহেব পরিতোষের হাসি হাসলেন।

    - ভালো কথা, ওই ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেটির যত্ন নেবেন। এত দ্রুত অনুবাদ, সে যেমনই হোক, করার ক্ষমতা খুব সুলভ নয় কিন্তু।

    ইনসপেকটর চলে যেতেই হেডমাস্টার আমায় জড়িয়ে ধরলেন।

    - তুমি আমাদের সম্পদ। তোমার মাইনে বাড়াবার কথা আজই বলব সেক্রেটারিকে। হয়েও যাবে। নিশ্চিন্ত থাকো। আহা, কী আনন্দ। জ্যোৎস্নাময়ী, শান্তিশালিনী, পৃথিবীর প্রান্তর-কানন-নদ-নদীময় শোভা দেখিয়া তাঁহার চিত্তের বিশেষ স্ফূর্তি হইল – সমুদ্র যেন চন্দ্রোদয়ে হাসিল। ভবানন্দ হাস্যমুখ, বাঙ্ময়, প্রিয়সম্ভাষী হইলেন।

    আমরা একসঙ্গে হাসলাম। বঙ্কিম মুখস্থ বলছেন মানে সত্যিই বড় খুশি আমাদের হেডমাস্টার মশাই।

    একমাস পরের কথা। হরিশ ছুটতে ছুটতে এল। শেখরকে পুলিশ ধরেছে। আমি আঁতকে উঠলাম। কারণটা শোনার পর কথা হারিয়ে ফেললাম। হরিশ, শেখর ও আরও কয়েকজন রেল লাইনের ধারের মাঠে একটা মোরগ কেটে খাওয়ার আয়োজন করছিলো। আচমকা হাত ফসকে সে মোরগ স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে। এখানে একটা কথা বলা দরকার। ভুরশুটপুরে কোনও স্টেশন নেই। মাইল পাঁচেক দূরে সদর শহর ফুলডিহি। স্টেশন সেখানেই। স্টেশন মাস্টার কালো সাহেব মাইকেল বিশ্বাস ও তাঁর মেম এমিলি, নেটিডদের ছায়া-ছোঁয়া এড়িয়ে চলে। ইংরিজি ছাড়া কথা বলে না। ছেলেরা পড়লো মুশকিলে। ইংরিজি বলার ভয়ে কেউই এগোয় না। শেষ অবধি শেখরকেই দায়িত্ব নিতে হলো।

    এগিয়ে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে, এমিলি বেরিয়ে এসে, নাক সিঁটকে বলে - হোয়াট?
    শেখর খুব সপ্রতিভভাবে জানতে চায় - হ্যাভ ইউ সীন মাই কক?
    এমিলি বেগুনি হয়ে গিয়ে, দমচাপা গলায় আবার বলে - হোয়াট?
    শেখর ততক্ষণে বাগানে মোরগটা দেখতে পেয়েছে। একগাল হেসে বলে - উইল ইউ সী মাই কক?

    এমিলি দুম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাগান উঁচু কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা। গেলে, কোয়ার্টারের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। অনেকবার ধাক্কানোর পর দরজা যখন খুলল না, তখন শেখর রণে ভঙ্গ দিল। ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই পুলিশ এসে শেখরকে ধরে নিয়ে গেছে। থানায় ঢুকে দেখি দারোগা রমণীমোহন উদাস ভাবে বসে আছেন। আমায় দেখে বললেন,

    - মাস্টারমশাই, পুলিশে কাজ করে আর থানায় বসে তো রাজদ্রোহমূলক কথা বলতে পারি না। তবু, চুপি চুপি জিগ্যেস করি, আপনার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে, যুগান্তর বা অনুশীলনের কোনও সভ্য আছে নাকি?
    - কেন বলুন তো?
    - যদি থাকে, তো এই ছোকরাকে তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে বলুন, বোমা, পিস্তল কিচ্ছু লাগবে না। শুধু এই রকম হাজার হাজার রত্ন গড়ে নিয়ে ইংরেজদের মধ্যে ছেড়ে দিন তাঁরা। তিন বছরের মধ্যে ওরা দেশছাড়া হবে! ওরেব্বাপরে বাপ! কী জিনিস গড়েছেন মশাই? কী বলবো ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকলাম।

    রমণীবাবু বললেন - স্টেশনমাস্টার অভিযোগ করেছে, ছোঁড়া ওর স্ত্রীকে অপমান করেছে। তা সেসব কিছু যে হয়নি, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। মাঝের থেকে একটা মোরগ ফাউ জুটে গেল বিশ্বাসের। মানে, হি হ্যাজ গট অ্যান এক্সট্রা কক!

    এতক্ষণের চেপে রাখা হাসিটা বোমার মতো ফেটে বেরিয়ে এল। হাসতে হাসতেই রমণীবাবু বললেন - যান, নিয়ে যান ব্যাটাকে।

    পুজোর সময় এবার নতুন রকম প্রতিমা হয়েছে। কার মাথা থেকে বেরিয়েছে এই আইডিয়া কে জানে। দুর্গার রঙ কুচকুচে কালো, অসুর টকটকে ফরসা। কাল বোধন। মণ্ডপে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ, রমণী দারোগা এসে হাজির। হেসে বললাম - কী? কালোর হাতে সাদার মরণ, সিডিশাস নাকি?

    দারোগাবাবু কোনও উত্তর না দিয়ে জমিদারবাবুর ছোট ছেলে সন্তোষের কলার চেপে ধরে কাছে টেনে আনলেন। মুখের কাছে মুখ নিয়ে, ফিসফিস করে বললেন
    - শত্রুকে কখনও বোকা ভাবতে নেই, এটা যুগান্তরের নেতারা কবে বুঝবেন? দশমীর দিন বিলি করার জন্য এক হাজার প্যামফ্লেট আনা হয়েছে, সেগুলো ঠাকুরের মূর্তির পেছনে লুকোনো আছে, সি আই ডি জানবে না, ভাবেন কী করে? হিন্দু পুলিশ প্রতিমা ধরতে সাহস পাবে না মানছি। কিন্তু, ম্যাজিসট্রেট তো মুসলমান সেপাই আনবে। আমাকে তল্লাসির হুকুম দেওয়া হয়েছে। সেটা আমায় করতেই হবে। তার আগে, ওগুলো সরান। এক্ষুণি।

    মুখের কথা মুখেই রইলো। মণ্ডপের সামনে এসে থামলো ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি। আমরা শ্বাস বন্ধ করে ফেলেছি। হঠাৎ, কোথা থেকে ছুটে এল শেখর। হাঁফাচ্ছে।
    - সার! সার!
    - ইয়াস? ওয়টসিট?
    - মিসেস বুল ইজ ডেড সার!
    - ওয়ট!
    - ইন ফ্রন্ট অফ ইওর বাংলো।
    - ইউ শিওর?
    - শিওর সার! স মাইসেলফ্!
    - মাই গড! সাহেব এক লাফে গাড়িতে উঠলেন।

    গাড়ি ছেড়ে দিল। সন্তোষ আর মিহির প্রতিমার পেছন থেকে একটা বান্ডিল বার করে এনে, তীর বেগে ছুটলো পুব দিকে।

    রমণীবাবু শেখরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন,
    - সাহেবকে কী বললে?
    - বললাম, ওঁর বাংলোর সামনে একটা গোরু মরে পড়ে আছে।
    - গোরু?!
    শেখরের মুখে স্বর্গীয় সারল্য।
    - হ্যাঁ। নিজের চোখে দেখলাম। গোরুর ইংরিজিটা মনে আসছিল না। অনেক ভেবে মনে পড়লো, ষাঁড় হলো বুল। তাহলে, ষাঁড়ের বউ, গোরু, মিসেস বুল হলো না? রমণীবাবু শেখরের দিকে এমনভাবে চেয়ে আছেন, যেন এই মুহূর্তে ইংরেজের দেশ ছাড়ার খবর শুনেছেন। আমার চোখের সামনে ভাসছে ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর গেটের ছবি। গেটের গায়ে নেমপ্লেট। নেমপ্লেটে নাম। এইচ.পি. বুল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 68.184.245.97 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৪২498102
  • এই লেখারও স্টাইল ভালো লাগলো। কক অ্যান্ড বুল জোক দুটো অবশ্য আগে শুনেছি :-)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন