এলেবেলে (পর্ব - ১) : বাঘ দেখা, বাঘ শোনা
আমি বর্তমানে যেখানে চাকরি করি, সে জায়গা সুন্দরবনের অন্তর্গত হলেও, বাঘের ডেরার কাছাকাছি যেতে চাইলে আরও আড়াই-তিন ঘন্টার পথ পেরোতে হবে, ভিতরের দিকে। তাই আমার চাকরির অঞ্চলটি নিতান্তই 'নিরিমিষ' সুন্দরবন। তবু, আমরা যেহেতু সাধারণভাবে হিমালয়ের সঙ্গে বরফ, পাকিস্তানের সঙ্গে উগ্রপন্থা, এবং সুন্দরবনের সঙ্গে বাঘ মিলিয়ে থাকি, তাই প্রথম এখানে পোস্টিং পাওয়ায় আশেপাশের সকলে বেশ শিহরিত হয়েছিল, মায় আমিও। কোথায় পড়াতে যাও? না, সুন্দরবন। আহা উত্তর তো নয়, যেন একটা তীব্র বোঁটকা গন্ধ, একটা চাপা গররর্ আওয়াজ! তাছাড়াও, কতটা দূর শহর থেকে! In the deep recesses of the jungle ... সহকর্মীর নাম বলতে গিয়ে মুখ ফস্কে আলভারেজ বেরিয়ে যায় আর কী!
বাঘের সঙ্গে এরকম গায়ে-পড়া ঘনিষ্ঠতা পাতানোর কারণ ছিল অবশ্য আমার। ছোটবেলায় একটা আস্ত বাঘ দেখার আগে থেকেই আমার বাঘের স্মৃতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল -- শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, সত্যি। কিভাবে হলো? যবে থেকে নিজের স্মরণশক্তির উপর ভরসা করতে পারি, তবে থেকে শুরু করে আমার বেশ বড়বেলা অব্দি মনে আছে, মা একটা হার পরতো -- সোনার চেন, তার মধ্যে আটকানো ইংরেজির সাতের (7) মতো দেখতে সোনারই একটা পেন্ডেন্ট, তার মধ্যে আটকানো একটা বাঘনখের ক্রস-সেকশন। মায়ের কিশোরী বয়সে কোনও আত্মীয় উপহারে দিয়েছিলেন, যদ্দূর শুনেছি। বাঘের নখ কিভাবে সোনার হারে এসে বসলো, সে নিয়ে বড় হওয়ার পর ফাউল-প্লে'র কড়া গন্ধ পেলেও এবং বিষয়টিকে বেশ ঘৃণার চোখে দেখলেও, সে বয়সে নখটি নিয়ে আমার উৎসাহের অন্ত ছিল। প্রায়দিনই একাধিকবার আমার প্রশ্ন সামলাতে হতো মা'কে, "এটা বাঘের? হ্যাঁ মা? আসল নখটা তাহলে কত বড়? হ্যাঁ? বাঘটাকে দেখেছিলে তুমি, মা?" আড়াআড়ি সেই নখকে দেখতে ছিল অনেকটা একটা শুকিয়ে যাওয়া পেঁয়াজের টুকরোর মতো; হলদেটে আর কালচে ধূসর রঙের মিশেল তাতে। সেটা ছিল একটা নখ থেকে কেটে নেওয়া একফালি অংশমাত্র। সেই অনুপাতে পুরো নখটা, এবং তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুরো বাঘটা কত বিরাট হতে পারে, তা আমার ছোটবেলার দীর্ঘমেয়াদি কিছু কল্পনার একটি ছিল। স্কুলের উঁচু ক্লাসে যখন পড়ি, তখন একদিন নিজে থেকেই মা এই হার পরা বন্ধ করে দেয় হঠাৎ; বলা বাহুল্য, সে সময়ে নখের অধিকারীকে নিয়ে আমারও আর খুব বেশি প্রশ্ন ছিল না মনে। আমার কল্পনায় তদ্দিনে সে প্রোথিত হয়ে গেছে।
এর পাশাপাশি বলতেই হয় আমাদের বাড়িতে পুরোনো খাটের নিচে রাখা ততোধিক পুরোনো একটা টিনের, চৌকো বাক্সের কথা। আকার-আয়তনে ছোটই; দৈর্ঘ্য-প্রস্থে দেড় ফুট করে, আর মাটি থেকে উচ্চতায় হয়তো ইঞ্চি চারেক। একটা আংটা দিয়ে আটকানো থাকতো বাক্সটা, ধরার জন্য attaché case এর মতো একটা হাতল ছিল। আমার ছোটবেলার এই সাধের প্যান্ডোরার বাক্সের মধ্যে ছিল একতাল, জমাট বাঁধা মাটি। আরও গভীরে বলতে গেলে ফিরে যেতে হয় একটু অতীতে।
সময়টা আশির দশক। বাবার সে সময় পোস্টিং হাসনাবাদে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বানের আশঙ্কায় নদীর বাঁধ দেওয়ার/ নবীকরণের কাজে লঞ্চে করে বাবাকে চষে বেড়াতে হয় মাতলা, রায়মঙ্গল নদী। সারাদিন ঘুরে বেড়ায় নদীর বুকে, এখানে সেখানে কাঠের পাটাতন পেতে পা টিপে টিপে পিছল মাটিতে নেমে বাঁধের কাজে তদারকি করে, ওই লঞ্চেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া; একেবারে সন্ধেতে হাসনাবাদে ফিরে এসে ফিল্ড হোস্টেলের ছোট ঘরে বেশিরভাগ সময়ই লোডশেডিংয়ের মাঝে বিশ্রাম। এরকম একবার খুব বৃষ্টি নামল সেখানে, তিন দিন তিন রাত একনাগাড়ে। নদীর পাড়ের মাটি তো বটেই, এমনকি ডাঙার ভিতরের দিকের মাটিও এমন ভিজে নরম হলো যে শুকোনোর আর নাম নেই। বৃষ্টি থামার পর আবার জোরকদমে কাজ শুরু হয়েছে মেরামতির, ভোর-ভোর বাবাকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে নদীতে -- এরকম এক ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই, হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন গিরিবাবু, বাবার আপিসেরই সহকর্মী। ভদ্রলোক স্থানীয়, দুটো গ্রাম পরে থাকেন, তাঁর এমনিতে সাইটে আসার কথা দশটা নাগাদ। কিন্তু এত ভোরে...? গিরিবাবু খুব সাবধানে ধরে আছেন একটা চকচকে টিনের বাক্স, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে দেড় ফুট করে, উচ্চতায় ইঞ্চি চারেক। সন্তর্পণে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, খুলে দেখুন স্যর, আপনার জন্য নিয়ে এসেছি তাড়াতাড়ি। এরকম সাত সকালে সাধারণত মানুষ পুজোর ফুল, আর তাড়ি হয়ে যাওয়ার আগে খেজুরের রস দিয়ে যায়। দুটির একটিরও সম্ভাবনা ক্ষীণ এখানে। কিছুটা অবাক হয়েই বাবা বাক্সটা সাবধানে টেবিলে রেখে খুললো। ভিতরে নরম, ভেজা একতাল মাটি, কেমন ডেবে যাওয়া। বাবা হতবাক, কিছুটা বিরক্তও বলা যায় --- গিরিবাবু উজ্জ্বল মুখে আবার বললেন, "একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখুন স্যার!" কথামতো দু-তিন পা পিছিয়ে ভালো করে আবার দেখতেই চোখে পড়লো, মাটিটা শুধু ডেবে গেছে তাইই নয়, একটা নির্দিষ্ট আকৃতিতে ডেবেছে। একটা অসম্ভব ভারি কিছু যেন... "বাঘের থাবার ছাপ!" বাবা অস্ফুটে বলে উঠল।
"হ্যাঁ স্যার", একগাল হেসে বলে উঠলেন গিরিবাবু, "গতকাল রাতে গ্রামে ঢুকে পড়েছিল। আজ ভোরে উঠে দেখি বাড়ির পিছনের নরম রাস্তায় ভিড় জমেছে, মাটির উপর তেনার পায়ের ছাপ। একটা খুপরি দিয়ে ওই মাটিটুকু কেটে এই বাক্সে নিয়ে এলাম। কলকাতায় নিয়ে যান, দেখাবেন সবাইকে।"
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি যখন খাটের তলা থেকে সেই ধুলো-ধূসরিত বাক্স বার করে তার আংটা খুলতাম, চোখের সামনে বেরিয়ে পড়তো সেই জমাট-বাঁধা একতাল মাটি। শুকিয়ে কাঠ, ধার থেকে ঝুরো ঝুরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু মাঝে সেই থাবার প্যাডিংয়ের যে ছাপ, তা অক্ষত। মাটিতে লেগে থাকা সে সময়ের ঘাস এখন শুকনো, হলুদ। নাকটা খুব কাছে নিয়ে গিয়ে আমি গন্ধ শুঁকতাম। শুকনো মাটির ধুলো-ধুলো গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু, ওই মাটিতে নাক ঠেকিয়ে আমার মনে আসতো তুমুল বৃষ্টি, নদীতে বান এসেছে, গ্রামের রাতের অন্ধকারে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ, কোনও বাড়ির দরজার ক্ষীণ আলোয় এক শ্বাপদ-রূপরেখা।
বাঘনখের পেন্ডেন্ট পরা সেই ভদ্রমহিলা ও হাসনাবাদ থেকে ভিড় বাসে চেপে কলকাতায় বাঘের পদচিহ্ন নিয়ে আসা ভদ্রলোকের সুযোগ্য সন্তান হিসেবে আমারও বাঘের আবহে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, একবারই। তবে সে আমার চাকরিক্ষেত্রে নয়, বরং এইসব অঞ্চল থেকে বহু, বহু দূরে, কুমায়ুন হিমালয়ের কোলে। ২০০১ সাল, পরিবার-আত্মীয়রা মিলে বেড়াতে গেছি। কৌশানি থেকে আলমোড়া যাওয়ার পথে গাড়ি থেমেছে চকৌরিতে। একটি উপত্যকার একেবারে ধারে ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন সরকারি নিবাস। আমরা অবশ্য থাকবো না এখানে, দুপুরের খাওয়া খেয়েই বেরিয়ে পড়বো আবার; সন্ধে নামার আগে আলমোড়া পৌঁছতে হবে।
দুপুরের খাবার তখনও রান্না হচ্ছে, আমরা নিবাসের সামনের মাঠে রোদ পোহাচ্ছি। মাঠের শেষ প্রান্তে ছোট ছোট ন'টা কটেজ -- পিছনের নিবাসে কেউ না থেকে, বেশি খরচে যদি প্রকৃতির (এবং খাদের) আরও কাছে থাকতে চায়, তাদের জন্য। সামনে শুধু শূন্য, দূরে আরও দূরে সব ঢেউ খেলানো ছোট-বড় উপত্যকা, আর তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল তুষারাবৃত শিখরেরা -- নন্দাদেবী, নন্দাঘুঁটি, হাতিপাহাড়, পঞ্চচুল্লী, প্রমুখ। দুপুর দেড়টাতেও কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাত জমে যাচ্ছে; আমাদের ড্রাইভার ঠাকুরজি সঙ্গ দিচ্ছেন, বলছেন, এই যে খাদ নেমে নিচের দিকে গেছে, দূর দূর তক জনবসতির উপত্যকা নেই কোনও। "তাহলে কী আছে নিচে?" জঙ্গল, সিরফ জঙ্গল।
ব্যাস, আমার মন চলে গেছে বোঁচকার দিকে। "ইঁয়াহা পর শের হ্যায়, ঠাকুরজি?" জি বিলকুল। শের হ্যায় বহুত সারে। "শের ডাকতা হ্যায়?" আশেপাশে ইতস্ততঃ হাসি চাপার আওয়াজ শুনে বুঝলাম ছড়িয়েছি, তাই তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বললাম, "মানে মতলব শের পুকারতা হ্যায়?" এবার দেখলাম কেউ আর হাসি চাপারও চেষ্টা করলো না। রুনি দি বললো, "হ্যাঁ রে, আয় আয় করে ডাকে।" হিন্দির সঙ্গে আমার সখ্য এমনই। চুপ করে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর খাদের পাশের একটা সরু পায়ে হাঁটা পথ ধরে আমরা দু-তিনজন একটু উঠছি পাহাড়ের গা দিয়ে, যাতে ক্যামেরায় আরও ভালো ধরতে পারি তুষারশৃঙ্গদের। একটা ফাঁকা মতো জায়গায় এসে পৌঁছেছি, বেশ সুন্দর ধরা পড়ছে পুরো রেঞ্জটাই; লেন্স-ক্যাপ খুলে চোখে ঠেকিয়েছি ক্যামেরা, ফোকাস করতে করতে ভাবছি, আহা এমন নির্জন চারদিক, একটা পাখিও ডাকছে না! শুধু গাছের পাতায় বাতাসের শনশন শব্দ, যদি রেকর্ড করা যেত! হঠাৎই একটা শব্দ পেলাম -- অস্ফুট, অস্পষ্ট। ঠাহর করতে পারলাম না কোনদিক থেকে আসছে, বা কিসের আওয়াজ। এতটা নীরব চারদিক বলেই হয়তো কানে এল, নাহলে তেমন আলাদা করে ধরা পড়ার মতো শব্দ নয়। দশ-বারো সেকেন্ডের তফাতে, আবার শব্দটা শুনলাম। আগের থেকে অনেকটা স্পষ্ট, আসছে নিচের উপত্যকা থেকে। একটা চাপা হুঙ্কারের মতো। মাটি যেন আমাদের পা-গুলো আঁকড়ে ধরেছে, কিছুতেই নড়তে পারছি না; একে অন্যের মুখে চাইছি। "বা-" বলার পর তৃতীয়বার শুনলাম, আরও কাছে, খাদ ধরে উঠে আসছে যেন আওয়াজটা! এবার আর চাপা হুঙ্কার-টুঙ্কার নয়, ব্যারিটোনে গর্জন! এলাকা কাঁপিয়ে একবার বুঝিয়ে দেওয়া, জায়গাটা আসলে কার!
পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়ার কাছাকাছি অভিজ্ঞতা সেই; আওয়াজটা আরেক ধাপ কাছে এলে সেই মুগ্ধতা সামলানোর অবস্থায় থাকতাম কিনা জানিনা, কারণ ততক্ষণে আমরা বেজায় ছুটছি! লেন্স-ক্যাপ পিছনে পড়ে গেছে, যা গেছে তা যাক! ছুটছি নিবাসের দিকে। কানে ভাসছে ঠাকুরজির কথা ... দূর দূর তক জনবসতির উপত্যকা নেই কোনও ... জঙ্গল, সিরফ জঙ্গল ... জি বিলকুল, শের হ্যায় বহুত সারে ...
অতি রম্য গদ্য , পরের পর্বের অপেক্ষা রইল।
অনিন্দিতা দি
ধন্যবাদ, খুব ভালো লাগল আপনার মতামত পেয়ে। :) আশা করি পরবর্তী পর্বগুলিও মনোগ্রাহী করে তুলতে পারবো।
দারুন লাগলো . বাঘ নখ টা আমারো মনে আছে কিন্তু পায়ের ছাপ আমায় দেখাওনি তুমি
ভালো। পরবর্তী পর্বে বাঘ শোনার আশায় রইলাম।
দারুন। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। শেষ করেছ দারুন জায়গায়।
Shreyasi Datta Pal
ওটা দেখো নি তুমি? আচ্ছা। এখন বোধ হয় একেবারেই ঝুরঝুরে হয়ে গেছে সে।
রথীন বাবু
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
অমিতাভ দা
ধন্যবাদ। তবে পরের পর্ব বাঘ নিয়েই হবে, এমন নয়। 'এলেবেলে' মূলত আত্মকথনের একটা সিরিজ। তার প্রথম পর্ব এটা ছিল।
Sher ডাকা!!
ভাল লাগছে
Shriparna
প্রচন্ড্ জোর সে!
Aranya
ধন্যবাদ। :)
খুব ভাল লাগছে। খাসা লেখা।
ধন্যবাদ রঞ্জন বাবু। আপনার মতামত পেয়ে ভালো লাগল। :)
দুর্দান্ত! রীতিমত পাকা হাতের লেখা।
পড়ছি...
গ্রাহক হলাম।
ধন্যবাদ বিপ্লব বাবু। আপনার মতামত পেয়ে খুব ভালো লাগল। :)