এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বিজ্ঞান সহজিয়া

  • প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য, মনে করেন ভাইনবার্গ

    গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
    পড়াবই | বিজ্ঞান সহজিয়া | ২৭ জুন ২০২১ | ২৬১২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • স্টিফেন ভাইনবার্গ। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। তাঁর লেখা বিজ্ঞানের ইতিহাস। কখনও কৌতুক, কখনও বিদ্রূপ মেশানো তাঁর লেখার ভঙ্গি চমৎকার। সাবধান করেছেন, প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সমস্ত ধারণাই ঠিক নাও হতে পারে। পড়লেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


    স্টিফেন ভাইনবার্গের মতো নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীর লেখা বিজ্ঞানের ইতিহাস ‘টু এক্সপ্লেন দি ওয়ার্ল্ড: দি ডিসকভারি অফ মডার্ন সায়েন্স’ (To Explain the World: The Discovery of Modern Science) হাতে নেওয়ার সময় কিছুটা সংশয় কিছুটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। প্রত্যাশা এই কারণে যে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানে ভাইনবার্গ আমাদের কালের পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেবেন। পাশাপাশি বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের ক্ষেত্রে তাঁর ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্‌স’ বইটির তুলনা চলতে পারে শুধুমাত্র স্টিফেন হকিঙের ‘এ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম’-এর। সেই বই জীবনের দিকনির্দেশ করে দিয়েছিল এমন বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম নয়। তাই তাঁর কাছে আমরা নতুন কিছু আশা করতেই পারি।



    স্টিফেন ভাইনবার্গ


    সংশয় এই কারণে যে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকের পথ আলাদা। ইতিহাস বা বিজ্ঞান, কারও গতিই সরলরেখায় এগোয় না। কিন্তু বিজ্ঞানীর কাছে কানাগলির কোনো মূল্য নেই, তিনি বর্তমানের সাপেক্ষে প্রাচীনকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত। ঐতিহাসিক সাধারণত সেই পথ পরিহার করেন। অনেক বিজ্ঞানীর কাছেই সাধারণত বিজ্ঞানের ইতিহাস হল একমুখী বিবর্তনের কাহিনি। প্রাচীন অন্ধকার যুগ থেকে আধুনিক আলোকময় যুগের দিকে প্রগতির সরলরৈখিক ইতিহাসকে বলা হয় হুইগ (Whig), কথাটা এক্ষেত্রে খুব সম্মানের নয়। আধুনিক ঐতিহাসিকরা কোনো যুগের ইতিহাসকে দেখতে চান সেই যুগের নিরিখে, আজকের বিচারে নয়। স্বাভাবিক ভাবেই হুইগ ইতিহাস তাঁদের পছন্দ নয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা কাছাকাছি উদাহরণ মনে পড়ে, তা হল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। গভীরভাবে তলিয়ে না ভাবলে মনে হতেই পারে যে জীবজগতের বিবর্তন একমুখী, প্রাচীন সরল প্রাণ থেকে সোজা পথে মানুষ সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু বিবর্তন আসলে অন্ধ, অসংখ্যবার সে কানা গলিতে ঢুকে পড়েছে। মানুষ জীবজগতের বিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন, এই ধারণাও সেই ভ্রান্তিরই ফল। ডারউইনীয় মাপকাঠিতে টিকে থাকা ও বংশবিস্তার করা হল যোগ্যতার মাপকাঠি; হোমো সেপিয়েন্সের বুদ্ধিবৃত্তি, প্রযুক্তি বা সংস্কৃতি কোনো আলাদা গুরুত্ব বহন করে না।

    নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানও বারবার পথভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে বিজ্ঞানের চরিত্রের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। তার মাপকাঠিতে টলেমির থেকে কেপলারের তত্ত্ব উন্নত, অ্যারিস্টটলের থেকে গ্যালিলিওর গতিবিদ্যা বেশি সঠিক, বা এমনকি সর্বকালের সম্ভবত সেরা বিজ্ঞানী নিউটনের তত্ত্বকেও সংশোধিত হতে হচ্ছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের একটা value judgement বা মূল্য বিচার সম্ভব। সেই তত্ত্বই বেশি সঠিক যা প্রকৃতির বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বেশি সফল। আগের আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সাধারণত পরের যুগের কাছে সহজলভ্য, ফলে আজ কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র গ্যালিলিও বা নিউটনের থেকে ওই বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক বেশি জানে। তাই আধুনিক মাপকাঠিতে প্রাচীনকে বিচার বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রযোজ্য হতে পারে। এই বইয়ের লেখক সচেতনভাবেই সেই পথ বেছে নিয়েছেন।

    তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসের আরও একটা সমস্যা আছে। টলেমি পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলেছিলেন, আরিস্টার্কাস বলেছিলেন সূর্যকেন্দ্রিক জগতের কথা। আমরা এখন জানি যে আরিস্টার্কাসের মতটাই ঠিক, তাই টলেমিকে তুচ্ছ করার একটা প্রবণতা বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের কারও কারও মধ্যে এসে যায়। কিন্তু সেই সময়ের জ্ঞানের বিচারে বিচার করলে টলেমিই বেশি সফল। ভাইনবার্গ সে বিষয়ে সচেতন, এবং তা এই বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

    ভাইনবার্গ আধুনিক বিজ্ঞানের যেচরিত্রের উপর ভিত্তি করেই তাঁর মত উপস্থাপন করেছেন, তার সঙ্গে এ যুগের প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীই একমত হবেন। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা ও তাদের থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া, এই হল আধুনিক বিজ্ঞানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিছুদিন আগে গুরুচণ্ডা৯-তেই এক বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম যে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও, কারণ গ্যালিলিওই প্রথম সচেতনভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে সাধারণীকৃত তত্ত্বে উত্তরণের পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন। জনৈক পাঠক দ্বিমত পোষণ করে লিখেছিলেন যে গ্যালিলিওর জন্মের দশ হাজার বছর আগে ভারতে যে সমস্ত আবিষ্কার হয়েছে, লোকে এখনও তা উদ্ধার করতে পারেনি। এই লেখাতে বিজ্ঞানের ইতিহাস বা প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অনুমান করি যে বিজ্ঞান বলতে আমরা আধুনিক যুগে ঠিক কী বুঝি তা সম্ভবত অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। একটা উদাহরণ দেখা যাক। আমাদের সভ্যতার মূলে আছে চাকা উদ্ভাবন। যে বা যাঁরা এই কাজ করেছিলেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিচারে তাঁরা বিজ্ঞানী নন। কিন্তু তাতে তাঁদের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র খাটো হয়ে যায় না।

    ভাইনবার্গ এ ব্যাপারে একেবারে স্পষ্ট মত দিচ্ছেন; তাঁর কাছে পিথাগোরাস, অ্যারিস্টটল, এমনকি প্রাচীন গ্রিসের সেরা বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসও আধুনিক অর্থে বিজ্ঞানী নন। পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁরা কেউ কেউ করেছিলেন, কিন্তু তার থেকে তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে পোঁছাতে চাননি। আগে থেকেই যে মত তাঁরা পোষণ করতেন, তার সত্যতা দেখানো ছিল তাঁদের লক্ষ্য। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে প্রদর্শন; তার গুরুত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু তা কখনোই পরীক্ষানিরীক্ষার মারফত সত্যে পৌঁছানোর বিকল্প নয়। পরীক্ষার সঙ্গে যখন তাঁদের মতের পার্থক্য দেখা দিয়েছিল, তখন তাঁরা পরীক্ষার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতার দিকেই নজর দিয়েছিলেন। প্রাচীন যুগের দার্শনিকরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করতেন যে চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই সত্যে পৌঁছানো সম্ভব, তাই এমনকি আমরা যাঁদের আজ বস্তুবাদী বলে চিহ্নিত করি, পরমাণুবাদের প্রবক্তা সেই ডেমোক্রিটাস বা কণাদও কিন্তু আধুনিক যুগের বিচারে বিজ্ঞানী নন। তাঁরা যে পরমাণুর কথা বলেছিলেন, আধুনিক যুগের আবিষ্কার তার খুব কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগের পরমাণুবাদ ছিল নেহাতই কল্পনা, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণই উপস্থিত করা কণাদদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই কারণে সক্রেটিস, প্লেটো বা শঙ্করাচার্যের পরমাণুবাদ বিরোধিতা এত কার্যকর হয়েছিল।



    টলেমি। হাতে ‘আর্মিলারি স্ফিয়ার মডেল’। শিল্পী জুস্টুস ফান গেন্ট ও পেড্রো বেরুগেট। ১৪৭৬


    এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ভাইনবার্গ টলেমির প্রশংসা করেছেন, কারণ তিনি আকাশে গ্রহদের গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য শুধুমাত্র প্রাচীন মতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাকে উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন। পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সমতল ও বক্রতলে আলোর প্রতিফলনের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারে টলেমির সাফল্য আরিস্টার্কাসের থেকে বেশি; কারণ তাঁর বিশ্বের মডেল ভুল হতে পারে, কিন্তু তা পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরিস্টার্কাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের থেকে বেশি সফল। সোজাসুজি কথায় অভ্যস্ত ভাইনবার্গের কাছে পাশ্চাত্যের প্রাচীন যুগের প্রায় কোনো বিখ্যাত দার্শনিকই ছাড় পাননি। প্লেটো তাঁর কাছে silly, অ্যারিস্টটল tedious। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আধুনিক বিজ্ঞানের বিপ্লবের সঙ্গে যে দুই দার্শনিকদের নাম প্রথমেই আসে,সেই ফ্রান্সিস বেকন ও রেনে দেকার্তে তাঁর কাছে most overrated। ভাইনবার্গ প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের কৃতিত্বকে অস্বীকার করছেন না, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে তাঁদের চিন্তাভাবনাকে বিজ্ঞান বলা যায় না। তাঁরা আধুনিক অর্থে বিজ্ঞানচর্চা করেননি, কারণ তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই তাঁরা অবহিত ছিলেন না। অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকের কোনো বিজ্ঞানীর কাছে একবিংশ শতকের বিজ্ঞান জটিল মনে হবে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁরা একমত হবেন; প্রাচীন বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে কিন্তু সে কথা বলা যাবে না। ঐতিহাসিকরা নিশ্চয় সমালোচনা করবেন যে ভাইনবার্গ তাঁর নিজের যুগের চিন্তাধারাকে অ্যারিস্টটলদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, লেখক তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন।

    তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম কবে? লেখকের সহজ উত্তর হল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এক বিপ্লবের ফলে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম; এই বইতে সেই বিপ্লবের উৎস সন্ধান করেছেন তিনি। বইয়ের নামে ‘ডিসকভারি’ বা আবিষ্কার শব্দের ব্যবহার তিনি সচেতনভাবে করেছেন। ডেভিড উটনের বিখ্যাত বই ‘দি ইনভেনশন অফ সায়েন্স’-এর সঙ্গে এই বইয়ের তফাত কোথায়? উটন সমাজে বিজ্ঞানের পদ্ধতি কেমনভাবে উদ্ভাবন হল তা খুঁজেছেন। ভাইনবার্গ বলছেন যে এই পদ্ধতি সমাজনিরপেক্ষ। আধুনিক বিজ্ঞান এত সফল, কারণ তা প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি আছে বলেই আধুনিক বিজ্ঞান আছে; তা কোনো ইনভেনশন বা উদ্ভাবন নয়, তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। কোন্‌ সময়ে বা কোন্‌ সমাজে সেই আবিষ্কার হল, বিজ্ঞানের চরিত্রের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

    পদার্থবিজ্ঞানী ভাইনবার্গের লেখাতে বেশি এসেছে পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা, তবে তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি, কারণ এই বিজ্ঞানের এই দুটি শাখাই প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছিল। প্রাচীন ভারত, মিশর, চিন বা ব্যাবিলনের বিজ্ঞান তাঁর আলোচনায় আসেনি। বিজ্ঞান বিভিন্ন কারণে এই সমস্ত সভ্যতাদের কাছে ঋণী, কিন্তু লেখক বিশ্বাস করেন যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কার সেই কারণগুলোর মধ্যে পড়বে না। তা একান্তভাবেই ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইউরোপের অবদান, যদিও মধ্যযুগের আরব বিজ্ঞান তার ভূমি প্রস্তুত করেছিল। বইয়ের প্রথমেই আছে প্রাচীন গ্রিসে গণিত, গতিবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পদার্থবিদ্যা ও বিজ্ঞানের দর্শনের কথা। জ্যোতির্বিজ্ঞান আলাদা অধ্যায় দাবি করেছে কারণ প্রাচীন যুগে একমাত্র সেই বিদ্যাই আধুনিক অর্থে বিজ্ঞানের সব থেকে কাছে এসেছিল। শুধু তাই নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানই কোপার্নিকাস ও তাঁর পরে কেপলার ও গ্যালিলিওর হাত ধরে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিল। পৃথিবী, চন্দ্র বা সূর্যের ব্যাস বা পৃথিবী থেকে চাঁদ সূর্যের দূরত্ব মাপার প্রাচীন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনাগুলি বেশ কৌতূহলের জন্ম দেয়। এখানে বা পরেও অপেক্ষাকৃত জটিল গণিতের প্রয়োজন হয়েছে, সেগুলি পাদটীকায় স্থান করে নিয়েছে। ফলে পাদটীকাই বইয়ের প্রায় চল্লিশ শতাংশ জায়গা অধিকার করেছে। সেগুলো এড়িয়ে গেলেও মূল বইয়ের রসাস্বাদনে অসুবিধা হবে না, তবে সময় নিয়ে পড়লে প্রাচীন যুগে অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়।

    বইয়ের তৃতীয় অংশে আছে মধ্যযুগের কথা, যখন ইসলামি দুনিয়া বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে রেখেছিল। আরব সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানচর্চার ইউরোপে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস সুবিদিত। রেনেসাঁ ও রিফর্মেশন আন্দোলনের অব্যবহিত পরে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হল। সেই কাহিনি চতুর্থ অধ্যায়ে বিবৃত আছে। প্রথমে কোপার্নিকাস ও পরে কেপলারের সৌরজগতের মডেল দেখাল যে প্রাচীন দার্শনিকদের তত্ত্বের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। কেপলারের সমসাময়িক গ্যালিলিওর জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ এবং গতিবিদ্যা সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যার মূলে আঘাত করল। বিজ্ঞানের প্রগতিতে অ্যারিস্টটলের কর্তৃত্ব অস্বীকারের প্রয়োজন ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে দার্শনিক বলতে একজনকেই বোঝাত, তিনি অ্যারিস্টটল। তাঁর পরম কারণবাদ (Final cause) আধুনিক বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, তাই তার থেকে মুক্তি ছাড়া বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের সৃষ্টির যুগ নিউটনের সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে ইউনিফিকেশন বা একীকরণের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। আলোচনার সুযোগ নেই, শুধু মনে করিয়ে দিই সেই বিষয়ে কাজের জন্যই ভাইনবার্গ, আবদুস সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশো ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন। গ্যালিলিও গতিবিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর তত্ত্বকে প্রথম চলমান পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন, তাও একফহরনের একীকরণ বলতে পারি। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব প্রথম সার্থক একীকরণ তত্ত্ব, তিনি পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিণ এবং পৃথিবীর আকর্ষণে আপেলের মাটিতে পড়াকে এক সূত্রে বেঁধেছিলেন।

    ভাইনবার্গ আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের যে ইতিহাস লিখেছেন এই বইতে, তা খুবই চিত্তাকর্ষক সন্দেহ নেই। ক্লাসে এই বিষয় তিনি পড়িয়েছেন, তার থেকেই এই বইয়ের জন্ম। কখনও কৌতুক, কখনও বিদ্রুপ মেশানো তাঁর লেখার ভঙ্গিটি ভারী চমৎকার। গ্যালিলিও, কেপলার বা নিউটনের মতো বিজ্ঞানীরাও নানা ভুল ধারণা পোষণ করতেন; ভাইনবার্গ সাবধান করে দিয়েছেন যে প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সমস্ত ধারণাই ঠিক নাও হতে পারে। ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্‌স’ বা ‘ড্রিমস অফ এ ফাইনাল থিওরি’-র লেখকের কাছে হয়তো আরও একটু প্রত্যাশা ছিল। বিজ্ঞানী হিসাবে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের প্রগতির উপরে জোর দেওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞানের বাইরে যে সমস্ত ঘটনা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল, তাদের নিয়ে আলোচনা আরও একটু বেশি থাকলে ভালোলাগত। তবু যা পেয়েছি তাও কিন্তু কম নয়, হয়তো ব্যস্ত বিজ্ঞানীর পক্ষে এর থেকে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না।

    ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্‌স’-এর একেবারে শেষে ভাইনবার্গ লিখেছিলেন The more the universe seems comprehensible, the more it also seems pointless। ব্রহ্মাণ্ডের কোনো উদ্দেশ্য নেই; ভাইনবার্গ কিন্তু বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞান এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিবর্তিত হচ্ছে, প্রকৃতিকে আরও সফলভাবে ব্যাখ্যা করাই সেই লক্ষ্য। এ কথা বলব না যে ভাইনবার্গ অনেক নতুন কথা লিখেছেন, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে নিজেকে হুইগপন্থী ঘোষণা করতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। ঐতিহাসিকরা অনেকেই তাঁর সঙ্গে একমত হবেন না, অন্তত বিভিন্ন পত্রিকাতে সমালোচনা থেকে তাই মনে হয়। শেষ কথা হল, স্বল্প পরিসরে প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে নিউটনীয় বিপ্লব পর্যন্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসের মূল ঘটনাগুলিকে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়, সেই কাজে এই বই সম্পূর্ণ সফল।




    টু এক্সপ্লেন দ্য ওয়ার্ল্ড: দ্য ডিসকভারি অফ মডার্ন সায়েন্স
    স্টিফেন ভাইনবার্গ
    পেঙ্গুইন
    ৫২৩ টাকা


    বইটি অনলাইনে কেনা যেতে পারে এখানে



    গ্রাফিক্স: মনোনীতা কাঁড়ার
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৭ জুন ২০২১ | ২৬১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ar | 96.230.106.154 | ২৭ জুন ২০২১ ০৬:১৫495338
  • স্টিভেন ওয়াইনবার্গঃ

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন