এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রিসাইকেল বিন

    Rajkumar Mahato লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ জানুয়ারি ২০২১ | ৯০৬ বার পঠিত
  • আমার স্কুল লাইফে দু-একজন বন্ধু ছাড়া তেমন কোন বন্ধু ছিল না। একটু একগুঁয়ে টাইপের ছেলে আমি চিরকাল। যদিও নিজেকে পরিবর্তন করেছি এখন। অবশ্যই যতটা প্রয়োজন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাড়াবাড়ি করাটা আমার আগাগোড়াই পছন্দ নয়। ঠিক যতটুকুনি আমার মনে হয় করা উচিৎ ততটাই করতে ভালোবাসি। তারজন্য ওই একগুঁয়ে, মিশুকে নয়, মুখচোরা তকমাগুলো আমার নামের সাথে জুড়ে গেছে সেই কবে থেকেই।

    মনে পড়ে আমার, আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত শুনতাম অথবা দেখতাম আমার সমবয়সী ছেলে-পুলেরা টিফিনে পাঁচিল টপকে স্কুল থেকে পালিয়ে গেছে। পরদিন আবার তাদেরকে দেখতাম কান ধরে স্কুল গ্রাউন্ডে দাঁড়াতে। মজা হত, মনে মনে নিজেকে খুব ভালো ছেলে মনে হত আর ওঁদের নাম দিয়েছিলাম “বাজে ছেলে।“

    ক্লাসে খুব একটা বেশি যেহেতু কারোর সাথে কথা বলতাম না। তাই টিফিনে একা একাই বসে ভাবতাম অথবা পড়তাম। বাজে ছেলেদের সাথে মেশার কোন ইচ্ছে হতনা। দু-একজন বন্ধু যারা ছিল তারাও একদিন টিফিনে পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেল। এবং আমাকে শতবার বলার সত্বেও আমি না যাওয়ায় তারা আমার থেকে নিজেদের আলাদা করে নিল। তার উপর আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল আমাদের একজন স্যার। প্রদীপ পড়া না পারায় পুরো ক্লাসরুমের সামনে আমাকে উদাহরন হিসেবে পেশ করলেন তিনি। আমাকে দেখিয়ে বললেন “ দেখেছ রোল নং ঃ২ কে। ও এই বছর আমাদের স্কুলের নাম উজ্বল করবে। খুব ভালো ছেলে।” গর্বে বুকটা ফুলে উঠল। তবে সাইলেন্সারের মত সবার দিকে তাকাইনি আমি। যাই হোক, মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট হল। তবে স্কুলের নাম উজ্বল করার মত নয়। স্যার রেজাল্ট দেখে বললেন “আরও ভালো আশা করেছিলাম।”

    যখন স্কুল জীবন শেষ হল। এগারো-বারো ক্লাসে আমার বন্ধুত্বটা একটু বেশি মাত্রায় ধরা পড়েছিল। আমরা সাতজন ছিলাম একেবারে বন্ধু অন্ত প্রান। নামগুলো বলতে ঠিক ভালো লাগছে না। তবে আমাদের বেশিরভাগ সময়টাই একে অপরের বাড়িতে কাটত।

    এখানে বলা বাহুল্য, আমি আমার মাধ্যমিকের থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে বেশি ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। যাই হোক, শেষ দিনে সাতজন একে অপরকে দেখে হাত ধরে প্রতিজ্ঞা হল “সপ্তাহে একবার অন্তত দেখা হবে।” যেহেতু আমরা সবাই আলাদা আলাদা কলেজে যাচ্ছিলাম।

    সেই প্রতিশ্রুতি মাস দুয়েক পরেই চাপা পড়ে গেল বাস্তবতায়। সময় নিজের বল দেখিয়ে আমাদের দেখা করা তো দূর, রাস্তায় দেখা হলে দু-মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলাতেও বাঁধা দিতে থাকল। আর আমরাও সময়ের ঘেরাটোপে পরে সমস্ত স্মৃতিগুলোকে বুক থেকে ডিলিট করে দিলাম।

    তারপর থেকে প্রায় ১২টা বসন্ত পেরিয়ে গেছে। সময় পাল্টেছে, দিন পাল্টেছে। আমরা আর বাজে ভালো ছেলের ঘেরাটোপে নেই। এখন সবাই কিশোর থেকে পুরুষ হয়ে উঠেছি।

    গতকাল বন্ধুর বাড়ি পিকনিক ছিল। আমি সেখানে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়েও যখন বাস পাচ্ছিনা। খুব টেনশনে ঘামছি। কারণ আমি ওঁকে কথা দিয়েছিলাম ৯টার মধ্যে যাব। কিন্তু এখানেই সাড়ে আটটা। আমার কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে খুব খারাপ লাগে।

    অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছি। এমন সময় হঠাৎ করে আমার সামনে একটা বাইক এসে দাঁড়াল। সদ্য কেনা পালসার ১২৫ সিসি। একেবারে জ্বলছে গাড়িটা। আমি ভাবলাম ছেলেটি হয়ত সাইডে দাঁড়াবে বলে দাঁড় করালো বাইকটা এখানে। দু-পা পিছনে সরে গেলাম। দেখলাম হেলমেট পরা মুখটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ দুটোকে ভালো করে দেখলাম কিন্তু হায় আমার পোড়া কপাল আমি চিনতেই পারিনি।

    মিনিট দুই পর দূরে তাকিয়ে দেখলাম একটা ১বি বাস আসছে। তৈরি হলাম বাসে ওঠার জন্য। বাইকটা তখনও দাঁড়িয়ে।

    আমি বাসে উঠতে যাব এমন সময় কানে একটা চেনা স্বর ভেসে এল “কিরে চিনতে পারলি না?” দেখলাম বাইকের ছেলেটা মুখটা ঘুরিয়ে হেলমেটটা খুলছে। হেলমেটটা খুলল ছেলেটি। চিনতে পারলাম আমার একসময়ের ছায়া “অর্পন”।

    বাসে আর উঠতে পারলাম না। অর্পন ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে স্ট্যান্ড করে দিয়েছে। আর হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে “এতক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম, চিনতে পারলি না?”

    একদিকে মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে থাকার পর আসা বাস, একদিকে বন্ধুকে দেওয়া কথা, আর একদিকে আমার কৈশোর কালের স্মৃতি। প্রথমের দুটোকে ভুলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওঁকে। আমার বলার মত কোন ভাষা ছিলনা। মুহুর্তের মধ্যে আমার স্কুল জীবন কৈশোরকাল আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। হ্যাঁ, আমিও অর্পনের পাল্লায় পড়ে প্রথমবার পাঁচিল টপকে স্কুল পালিয়ে কলেজ-স্ট্রীট গেছিলাম। কিন্তু কেউ টের পায়নি। ওই বাজে ছেলেগুলো সেদিন আমাকে প্রোটেক্ট করেছিল আর অর্পন বলেছিল “একবার ট্রাই করনা ভাই। দেখবি আলাদা আনন্দ।”

    অর্পন বলল “অনেক ফেমাস হয়ে গেছিস ভাই। দেখি ফেসবুকে তোর বইয়ের রিভিউ গুলো। কিন্তু কোন কমেন্ট করতে পারিনা।”

    আমি জিজ্ঞেস করলাম “কেনো?” না থেমেই বললাম “আগে বল কাকিমা, কাকু, ভাই কেমন আছে?”

    অর্পন বলল “সবাই ভালো। তোর বাড়ির সবাই? তোর মেয়ে?”

    একটূ রাগ দেখিয়ে বলল “একবার দেখতেও গেলিনা আমার মেয়েকে।”

    অর্পন মুখটা নীচু করে বলল “সেই মুখ আর নেই। তবে জানিস একটা কথা আমি তোর থেকে বেশি তোর মেয়েকে মিস করি।“

    চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল অর্পনের। ওঁর দিকে তাকিয়ে বললাম “খারাপ লাগা থাকে তবে এতটা। কেউ আমরা কারোর সাথেই যোগাযোগ রাখিনি। হয়ত পুরানোকে ভুলে গেছি।” না থেমেই আবার বললাম “কেনো আমার বইয়ের ফটোয় কমেন্ট করিসনি বললি না তো।”

    ও মুখটা শুকনো করে বলল “আজ এতগুলো বছর তোর কোন খবর নিই নি আর এখন বইয়ের খবর পেয়ে যদি তোকে ফোন করি ! আমাকে স্বার্থপর ছাড়া তুই তখন অন্য কিছু আর ভাবতে পারবি না।”

    আমি একটা মন্দভাষা বলে ওঁকে বললাম “আমি তোর ব্যাপারে এইসব ভাবতে পারব, তুই ভাবলি কি করে?”

    কিছু না বলে চুপ করে রইল অর্পন। আমিও চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষন পর অর্পন বলল “আসলে কি জানিস ভাই। আমরা যতটা সহজে নতুনকে স্বাগত জানিয়েছি, ততটা সহজেই পুরানো গুলোকে ভুলেও গেছি।”

    কথাটা বুকে তীরের ফলার মত বাঁধল। ভেবে দেখলাম একপ্রকার ঠিকই বলেছে অর্পন। তবে পরক্ষনেই মনে পড়ল অন্য একটা কথা । ওঁর দিকে তাকিয়ে বললাম “ভাই, আসলে কম্পিউটারে একটা রিসাইকেল বিন বলেও ফোল্ডার আছে জানিস তো। আসলে আমরা ভাবি যেগুলোকে আমরা ডিলিট করে দিয়েছি সেগুলো সেখানে জমা হয়। সেরকমই মনেও একটা আছে। সব সেখানে জমা আছে। ওই কবিগুরুর ভাষায় – রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।”

    অর্পন হাসলো। আমিও হাসলাম। ওঁর বাইকে চেপে রাসবিহারী এসে বাস ধরলাম। আবার যে যার পথে নেমে পড়লাম। হয়ত আবার কোনদিন দেখা হবে ওর অথবা আমার রিসাইকেল বিন ফোল্ডারে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • keya bagchi | ১১ জানুয়ারি ২০২১ ১২:১৮101617
  • বাঃ খুব  সাবলীল  মন ছোঁয়া। যে লেখা  অনুভূতি 


    দরজায় কড়া নাড়ে, মনে পড়ায় কিশোরী  কালের


    ধুলো বালি কথা.......

  • Rajkumar Mahato | ১১ জানুয়ারি ২০২১ ২০:৪৬101631
  • ধন্যবাদ আপনাকে উৎসাহিত করার জন্য

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন