এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • লৌকিক দেবদেবীর কথা : কুমির পূজা

    Manab Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১১৯৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • কথায় বলে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। হিন্দু শাস্ত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে হিন্দুরাও একইশ্বরবাদীই। মুস্কিল হলো বাঙালিদের একেবারে নিজস্ব কিছু দেবদেবী আছেন, যাদের কথা কোনো শাস্ত্রে উল্লেখ করা নেই, তাঁরা বোধহয় সংখ্যাটা এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। লৌকিক দেবদেবীরা আসলে স্থানীয় চাহিদা থেকেই হাজির হয়েছেন। যেমন, এই কুমির পূজার কথা বলতে গিয়ে বলা যায়, সুন্দরবনের মানুষ, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নিয়ে বসবাস করেন। তাই অন্তত মৎস্যজীবি সম্প্রদায় কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই পুজার আয়ােজন করেন।

    সুন্দরবনের মূর্তিমান যমদূত কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাবার বিশ্বাসে জল ও বনজীবী মানুষেরা কুমির-দেবতা "কালু রায়"-এর পূজা করে। কালু রায় - দক্ষিণ রায়ের মত এর মূর্তি একেবারে মানবী, পোশাক পৌরাণিকযুদ্ধের দেবতার মত। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পিঠে তীর ধনুক। আরণ্যক দেবতার প্রাচীন পূজা পদ্ধতি মেনে কালু রায়-এর পূজায় বনঝাউ ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়।

    কুমির পূজার কথা বলতে গেলে বলা যায় - প্রাচীন উপকথা মতে, গন্ধর্বকালীর অভিশপ্ত রূপই হলো কুমির। বনবিবির বাহন হিসেবে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ যেমন বাঘকে মান্য করেন, ঠিক তেমনি গঙ্গার বাহন রূপে, হয়তো অবতার হিসেবে কুমির এ অঞ্চলের নানা উপকথায় আবির্ভুত হয়েছে। কুমির নদীভিত্তিক সুন্দরবন এলাকার একটি অন্যতম জলজ প্রাণী। এই কারণে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের একটি অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কুমির পূজাকে যোগ করা হয়।

    চড়ক পূজার বিভিন্ন অনুসঙ্গের একটি হল এই কুমির পূজা। এসব অঞ্চলে নানা জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের সন্নিবেশ ঘটে চৈত্র সংক্রান্তিতে। সম্মিলিতভাবে সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে সব কৃত্য পালিত হচ্ছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ পত্তনের আগে শিকারকেন্দ্রিক সমাজের পালিত আচারের একটি হল কুমির পূজা। আবার কৃষিতন্ত্রের চর্চা থেকে একই অনুষ্ঠান পালিত হয় ‘ধান্য পূজা’।

    যাই হোক সুন্দরবনের কুমিরপূজার রীতি শত বছরের ঐতিহ্য। ‘খেজুর ভাঙা’ বা ‘খেজুর সন্ন্যাসী’ উৎসবের একটি অন্যতম আচার। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাতদিন ধরে একবেলা শুধু নিরামিষ খেয়ে এই আচারে যোগ দেন। নিত্য অভাব-বঞ্চনা, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামের মানুষগুলো এই উৎসবের ঐতিহ্য এখনও নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। চৈত্র সংক্রান্তির বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানকে ঘিরেই নাচগানের আয়োজন থাকে।

    গান গেয়ে গানের দল পুরো গ্রামবাসীকে একত্রিত করেন ‘খেঁজুর ভাঙা’ উৎসব উপভোগ করতে। ঢাকের তালে তালে মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসীরা খেজুর গাছে উঠে খেঁজুর ভেঙে আনেন। বছরের এই সময়টাতে খেঁজুরের রঙ থাকে সবুজ। পরদিন এসব খেজুর দিয়ে সাজানো হয় মাটির কুমির। চৈত্রের শেষদিনে সকাল থেকেই মাটি নিয়ে কুমির গড়ার কাজে ব্যস্ত থাকে একদল সন্ন্যাসী। আগের দিনের ভাঙা খেঁজুর দিয়ে কুমিরের গায়ের খাঁজকাটা রূপটি ফুটিয়ে তোলা হয়। বিকেলের দিকে মন্ত্রপাঠ, পাঁঠা বলি ও নানা অর্চনা থাকে কুমির পূজায়। সবশেষে সন্ন্যাসীরা মণ্ডপের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে সম্মিলিতভাবে ‘বধ’ বা ধ্বংস করেন কুমিরকে। চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে উৎসবের দুদিন আয়োজন থাকে নানা ধরনের খেলাধূলা ও মেলার।

    তবে নদীয়া জেলায়ও কুমীর পূজা হয়, কিন্তু সেখানে এটি হয় বাস্তু পূজা হিসাবে। যদিও এটি এখন বিলুপ্তির পথে। এখানে এই পূজাতে যুবক সম্প্রদায়ের উৎসাহ বেশি ছিল, আসলে এই ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান এর চেয়ে এটি উৎসব হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। রাতের বেলায় গান গেয়ে সংগ্রহ করা হত পূজা উদযাপন সামগ্রী, সাথে তাল, ডাল, সবজি। ফলমিষ্টি প্রসাদের সাথে, একবেলা পেটপুরে ভুঁড়িভোজ হত পূজার পর। কুমির তৈরি করা হয় এখানে ওই গ্রামের সামগ্রী দিয়েই, কুমীরের নিখুঁত রূপ দিতে চোখ এর জায়গায় ব্যবহৃত হয় গুগলি ঝিনুক। তবে কীভাবে কুমীর বাস্তুঠাকুর হল সে কাহিনি আমার অজানা। এটি অবশ্যই পৌষ সংক্রান্তিতে হয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন