আমার আর এলগিন রোডের সম্পর্কটা দিনদিন আরও দৃঢ় হচ্ছে। পথ চলতে গিয়ে এক টুকরো ঘটনা থেকেও আমি একটা গোটা গল্প খুঁজে পাই। আর যেরকম ভাবে ভাবা যায়, সেইভাবে লেখাটা বড় মুশকিল। তাই শব্দের প্যাচে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা ছোট্ট ঘটনাকে গল্পের রুপ দেওয়াটাই আমাদের কাজ।
আজ সকালে বাস থেকে নেমে অফিসের দিকে রওনা দিয়েছি। মাথায় হুডির টুপি হাত জোড়া জ্যাকেটের ভিতর। বেশ জোড়ে জোড়েই হাঁটছি। জোড়ে হাঁটলে শরীর টা একটু গরম হবে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজ শহরে।
রাস্তার ফুটপাতের সেই হ্যান্ডসাম চা-ওয়ালা তখন সবে দোকান খুলছে। পাশে দুজন ভদ্রলোক তার স্পেশাল চা খাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে। হোটেলের কাকিমার আলু, বেগুন আর সম্ভবত মূলো কেটে রাখা আছে একটা গামলায়। উনি কয়লার উনুনে ভাত চাপিয়ে একবার নমস্কার করলেন। পান বিড়ির দোকানের দাদাটা ধূপ ঘোরাতে ঘোরাতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন " গুড মর্নিং ভাইয়া।"
আমি বললাম " সুপ্রভাত দাদা।" এক টুকরো সুন্দর হাসি দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে লক্ষী গণেশের উদ্দেশ্যে ধূপ ঘোরাতে লাগলো সে।
আমার থেকে বেশ খানিকটা আগে একজন মহিলা বেশ হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলেন। আমি লক্ষ্য করেছিলাম ওনাকে। বুঝলাম ওনার কাজের জায়গায় যাতে দেরি না হয় তাই ওনার জোড়ে হেঁটে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা।
পাশ থেকে একটা ছেলে ইনফিল্ড নিয়ে ভোক করে বেরিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখছি বাইক টাকে আমার খুব প্রিয় একটা বাইক। অনেকটা দূরে গাড়িটা কয়েক মূহুর্তে মিলিয়ে গেলেও তার ওই রাজকীয় আওয়াজ আমার কানে তখনও বাজছিল। কিন্তু প্রতিদিনের মতই বুকে দায়িত্বের পাথর রেখে এগোব বলে যেই সামনে তাকিয়েছি দেখলাম আমার সামনের মহিলাটি ফুটপাতের উপর পড়ে আছেন আর তাকে ঘিরে দুজন ভদ্রলোক ও একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।
আমি আমার এগারো নম্বর গাড়ির স্পিডটা বাড়িয়ে কাছে গেলাম। দেখলাম মহিলাটি বেশ জোড়েই পরে গেছেন। কারন ওনার হাতে থাকা একটা পলিথিন সামনের দিকে অনেকটা দূরে ছিটকে গেছে। আর তার থেকে ভাত আর একটা সবজি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে।
মহিলাটি হাঁটুতে ডান হাতটা বোলাতে বোলাতে আর বাম হাতটা উঁচু করে বলছেন " আমাকে একটু তুলুন না দাদা, উঠতে পারছি না। " চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি বলছেন " ওই পাশের দেওয়ালটা ধরে ওঠার চেষ্টা করুন। উঠুন উঠুন পারবেন ঠিক পারবেন।"
ভদ্রলোক দুটি একে অপরের মুখ দেখতে ব্যস্ত।
আমি এগিয়ে গিয়ে বাম হাতটা ধরে ওনাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলনা। উনি একদম উঠতে পারছেন না দেখে আমি একজন ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম " দাদা ডান হাতটা একটু ধরুন না। " উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন " দাদা, যা পরিস্থিতি কি করে ধরি বলুন তো?"
প্রশ্নটা ঠিক আমার কোন জায়গায় লাগলো জানিনা। বুঝলাম সাহায্য পাবনা। ওনাকে পিঠের দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে তুললাম। হাঁটুতে দারুন লেগেছে বুঝলাম।
ভদ্রলোক দুটি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। অন্য মহিলাটি তখনও দাঁড়িয়ে। মিনিট দুই দাঁড়িয়ে মহিলাটি বললেন " যাও বাবা তোমার দেরি হয়ে যাবে। আমি দেওয়াল ধরে ধরে চলে যাব। পাশের স্কুলে কাজ করি। দেরি হয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে এই বিপদ।"
বললাম " পারবেন?"
উনি বললেন " হ্যা পারব। দেখলাম এক পা দু পা করে এগোচ্ছেন উনি।"
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি আমাকে বললেন " ভাই হাতটা দাও।" আমি অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাতে একটা ছোট স্যানিটাইজারের বোতল নিয়ে উনি আমার দিকে এগিয়ে রেখেছেন।
মনে হাজারটা প্রশ্ন নাড়া দিল। কিন্তু কিছু ভাবার আগেই উনি উপর থেকে আমার হাতে বেশ খানিকটা স্যানিটাইজার দিয়ে বললেন " এভাবে সবাইকে হাত দেওয়ার সময় নয় এটা। সবাই সব জায়গায় স্যানিটাইজার নিয়ে থাকবে না।"
আমি মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম এখন স্যানিটাইজার দেওয়া সহজ হাত দেওয়া নয়।
জয় করোনার জয়।