ডিসেম্বর ডুবু ডুবু, সামনে জানুয়ারি। বিষে বিষে বিশ ক্ষয়, ওই দেখো আসছে একুশে! অতিমারির বছর ঘুরলো সর্বশেষে, বছর ঘুরলো গেরস্তের, যা সর্বনেশে!
সব খারাপ জিনিসেরই আড়ালে একটা ভালো দিক আছে। অতিমারিই বা বাদ যায় কেন ? এই যেমন বাড়িতে অতিথি আসা যাওয়া বন্ধ। গৃহস্বামী খরচের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন অতি সহজেই। চক্ষুলজ্জার কোনো বালাই নেই। গৃহিনীও শান্ত। ছেলে-মেয়েরাও সুবোধ বালক বালিকা। এটাও মন্দের ভালো নয়? বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই নতুন ক্লাসে উঠে গেল সবাই। সেও তো অতিমারি হেতু। এজন্য সবাই খুশি। সামনে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। টেস্ট ছাড়াই পরীক্ষা হলে ঢোকার সুযোগ - এও বা কম কি?
সব খারাপ অবস্থার পিছনে একটা ভাল দিক ফুটে ওঠে। অতিমারির হাজার ঝকমারি। তার বাইরেও কিছু সুযোগ নিজের থেকে ধরা দেয়। মেঘের আড়ালে রোদের ঝিলিকের মতো। তবু বলা যাচ্ছে না বছর ফুরুলেও অতিমারি তুমি যেওনা, থাকো! এই মুহূর্তে দুনিয়া জুড়ে অতিমারির অবাধ লীলা। কেউই চাইছে না বিধি নিষেধের বেড়াজালে বন্দি দশায় আর একটা দিন ও থাকতে। টীকার কোনো ভরসা নেই, অতএব চাই না এই ভয়ে ভয়ে বাঁচার দুঃসময়!
বছর ফুরিয়ে আসছে। সামনে নতুন বছর। মাস পয়লা নতুন দেওয়াল পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার পাবো তো? না, কোনো ভরসা নেই! অতিমারির দোহাই দিয়ে দেওয়াল পঞ্জিকা ছাপানো এবার বন্ধ! ডায়েরি উপহার দেওয়ার চল আগেই উঠে গিয়েছে। এবছর থেকে ক্যালেন্ডার বিলোনোর পাঠও উঠলো। সেই সঙ্গে বাঁচল গাঁটের কড়ি। তার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়!
নিউ নরমাল মানে কি? সাত খুন মাফ? এখন ভুল গুলো সব নিউ নরমালের দোহাই দিয়ে ঠিক বলে মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। শুভ বিজয়া র প্রণাম কবেই উঠে গিয়েছে, ছিল কোলাকুলি। নিরাপদ দূরত্বের প্রশ্ন তুলে সেটাও হাওয়া! নিউ নরমাল প্রচলিত শিষ্টাচার ধুয়ে দিয়েছে সহজে। হাত তুলে নমস্কার, তাই যথেষ্ট! অতিমারি পর্বে ছোট, মাঝারি সব রকম ব্যবসা বন্ধ। কাজকর্ম লাটে উঠেছে! আয় নেই, খরচ মেটানো হবে কি ভাবে?
মহিমা মন্ডিত অতিমারির মহিমা আরও আছে! স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ দিন তালাবন্ধ। অথচ মাস পয়লা বেতন সটান পৌঁছে যাচ্ছে যে যার অ্যাকাউন্টে! এতে কারোরই বলার কিছু নেই, সেটাই তো উচিত কাজ! অনেকেই সময় নষ্ট করতে রাজি নন। উপার্জনের অন্যান্য পথ খোলা। যার যেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে, তিনি সু্যোগ বুঝে কবেই সেদিকে চলে গিয়েছেন চুপচাপ। গাছেরও খাচ্ছেন, তলারও কুড়চ্ছেন অতিমারির সৌজন্যে! সময়টা ভালো যাচ্ছেনা। শীত এলেও বাড়ি ছেড়ে কেউই বাইরে দূরে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাবছেন বলে মনে হচ্ছেনা! তার ফলে, ভ্রমন পরিকল্পনা স্থগিত। ওদিকে গাইড কাজ হারিয়ে বাড়ির সামনে তেলে ভাজার দোকান দিয়েছেন। কর্মকর্তারা পেট চালাতে অন্যান্য কাজে হাত লাগিয়েছেন লক ডাউনের আভাস পেয়ে।
নিউ নরমাল ভালোই বলতে হবে, সহজেই নয় কে হয় করা যায়! লোক লৌকিকতা অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছি আমরা। বিয়ে করছি, নেমন্তন্ন করার বালাই নেই। বললেও কেউই খেতে আসবে না করোনার ভয়ে। বাবা মা মরলেও অশৌচ নেই, লোক খাওয়ানোর দায় নেই। খরচ বাবদ বলে হিসেব কষতে বসতে হচ্ছে না, এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?
সেয়ানা ফোন হারিয়ে দিয়েছে ক্যাবলা ফোনকে। হাতে সেয়ানা ফোন থাকা মানে দুনিয়ার দিকে বুড়ো আঙ্গুল, থোড়াই কেয়ার ভাব নিয়ে চলা। যা খুশি করার অধিকার অর্জন করা। টাচ করো খাবার হাজির, টিকিট রেডি। ডিজিটাল দুনিয়ায় সেয়ানা ফোন থাকা মানে জগৎ হাতের মুঠোয়,কুছ পরোয়া নেই! কাউকেই মানতে হবে না। শুধু মগজটা আয়ত্ব করতে হবে। তখন সব কিছুই অধীনে চলে আসবে আপনাআপনি ই! দুনিয়া টাকার বশ, একদম বাজে কথা! নিউ নরমালে যার যত বুদ্ধি সে ই তত তেজী। দুর থেকে চোখের ইশারায় কাজ হয়ে যায়, বিফলে মূল্য ফেরত !
এই নিউ নরমালে বোকারা ঘরেই থাকুন। বুদ্ধিমানরা তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে পড়ুন পুরি, দীঘা, যা হবে দেখা যাবে। ফলভোগের দায় সহজেই সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে কতক্ষন! বুদ্ধির একটা রেভিনিউ আছে না? নিউ নরমাল বলে কথা!
পুরনো এই পৃথিবীতে মানুষও দেখতে দেখতে কত পু্রনো হয়ে গেল, তবু মানুষের চেহারাটা সঠিক ভাবে কোনো ছবিতে ধরা পড়ল না! মানুষ বড় বিচিত্র সৃষ্টি। মানুষ নিজেই জানে না সে ঠিক কি চায়! যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না! বয়স তো যথেষ্টই হলো, এখনও না বুঝলে আর কবে বুঝবো!
ঘরে বাইরে এত রকম ঝকমারি, তা সত্ত্বেও মহিমামণ্ডিত অতিমারিকে নিয়ে আমরা গোটা একটা বছর খেলার ছলে দিব্যি কাটিয়ে দিলাম। অসীম ধৈর্য্য ধরে এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখনও যে টিকে আছি আমরা,কেউ না বলুক,কেউ না দিক, সজোরে একটা হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে “সাবাস” বলতে হয় নিজেকে! আলবাৎ নিজেকেই!
শুধু আফ্সোস একটাই, এই এক বছরে আমরা বহু সহ নাগরিককে হারালাম। দুনিয়াটা সত্যিই অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেল!