পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
দেবেশদা
--- সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
দেবেশদার কাছে প্রথমবার যাই -- বাগুইহাটির সেই বল্মীক আবাসনে -- আমার প্রথম বই " দ্রিঘাংচুর দিগ্ দর্শন " এর " দুটি খন্ড নিয়ে। সেদিনের দুটি... না... তিনটি ঘটনার কথা কখনও ভুলবো না।
এক ।
রবিবারের সকাল। সারা রাস্তা জুড়ে বাজার বসেছে। আবাসনটি খুঁজে পেতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। একটি মনিহারি দোকানে জিজ্ঞেস করেও হদিস মিলল না।
পাশেই একটি সাইকেল সারাইওয়ালা একমনে কাজ করছিলেন। একমনে যে কাজ করছিলেন না... বুঝলাম তখনই। আমার দিকে প্রায় না তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন -- " দেবেশবাবুর কাছে যাবেন ? ওই যে বাঁদিকে... ওই বাড়িটা... সাইডে গেট... চারতলায় । "
দুই ।
পৌছলাম ওনার দ্বারে। এগিয়ে এলেন উনি। পরিচয় দিলাম। দেবেশদা বললেন ,
" খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়েছে তো ? "
আমি বলেছিলাম --
"নাহ , তেমন কিছু হয়নি। স্টলিয়ারনি লেনে ঢুকে রাসকোলনিকভের মত গুনে-গুনে তেরটি ধাপ উঠে ডানদিকে তাকালাম।
দেখলাম সারি সারি ছবি। তার মাঝেই দেখলাম -- এক্কেবারে যেন শম্ভু মিত্র মশাইয়ের ফোটোগ্রাফ । বুঝলাম ঠিক বাড়িতেই এসেছি। "
আমার পাশে বসে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে হো হো করে হেসে উঠলেন।
শ্রবণযন্ত্রটিকে ঠিক করে নিয়ে বললেন -- " আপনি বুঝি অরুণ সোমের " ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট " র অনুবাদটি পড়েছেন ? "
-- "হ্যাঁ । আপনার লেখা ভূমিকাটিও । সেখান থেকেই তো বললাম...। একটা কথা বলি? ....
আপনার পুরোনো দিনের ছবিগুলি কিন্তু সত্যি শম্ভু মিত্র-র মতো ! "
-- " উনিও তাই বলতেন । "
দেবেশদা কি একটু লজ্জা পেলেন ?
আমাকে চা ইত্যাদি দিতে বলে ভিতর ঘরে গেলেন।
তিন।
পরিচারিকা অর্চনাদি চা-রসগোল্লা দিয়ে যেতে না যেতেই , অন্তঃপুর থেকে দেবেশদা ডাকাডাকি শুরু করলেন তাকে।
" ওই লাল টুলটার ওপর দাঁড়াও... ওই দিকে... আরেকটা এদিকে আছে... "।
হাসিমুখে বাইরে এলেন। হাতে দুখানি বই। ভারি মিষ্টি হেসে বললেন -- " এই দেখুন আপনার বই দুটো। আছে তো আমার কাছে । একটা সুশীল ( সাহা) দিয়ে গিয়েছিল... আর একটা আমি জোগাড় করে নিয়েছি। পেন্সিলে দাগ দিয়ে দিয়ে পড়েছি। এই যে...। "
আমার বই ! ...দেবেশ রায় ! ... সেই
' লেখকের লেখক '!
কথা বলতে পারিনি। বলুন তো , কথা বলা যায় ?
প্রণাম করতে গিয়ে দেখি , পা দুটি বেশ ফুলেছে । একটু ডাক্তারি করলাম । রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দরকার হলে প্রোটিন একটু বেশি খাওয়ার কথা বললাম।
উনি বললেন --
" এবার বুঝলাম , কেন ডাঃ সিদ্ধার্থ লিখেছেন লেখকের নামে। ওটা না লিখলেও চলতো কিন্তু। "
★★
সাক্ষাতে, দীর্ঘ ই-মেলে এবং কদাচিৎ দূরাভাষে আলাপ বেড়েছিল । আমার বিস্ময়ও । দেবেশদা সম্পাদিত
" সেতুবন্ধন " পত্রিকার জন্য লেখা চেয়েছেন। পড়ে জানিয়েছেন --" ভাল লাগল "।
আমি ধন্য হয়েছি বারবার।
কখনও যোগাযোগ করতে দেরি হলে মেল করেছেন --
" আপনার সাড়া না পেয়ে দুঃখ হয়েছে । "
দেবেশদা !
★★
আর একদিন ।
ভালো চা পছন্দ করতেন দেবেশদা। একবার স্বাতী ( গুহ) এনে দিয়েছিল দারুণ এক চা । দেবেশদা বললেন -- " পান করে দেখুন। এই চা কিন্তু একেবারে 'হট শ্যাম্পেন ' ! জানিনা, অর্চনা কি বানিয়েছে । "
ইতিমধ্যে ওনার আরেক পুরোনো কর্মচারী, ঝাড়ুদার বংশী এসে উপস্থিত। দেবেশদা বললেন -- " ও আমার মালিও বটে। ছাদের টবগুলোর যত্ন আত্তি করে। "
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম -- " একে বংশী তায় মালি ! নাম পাল্টে বনমালী করে দিন ।
অর্চনা , বনমালী -- আপনি যথার্থ দেবলোক সৃষ্টি করেছেন , দেবেশ দা ! "
ঝোঁকের মাথায় কথাগুলো বলে ফেলেই আমি মাথা নিচু করে ফেলেছিলাম। নিজেকে গভীর তিরস্কার করেছিলাম এমন চাপল্যর জন্য।
আর উনি? সেই তিস্তাপারের দেবোপম মানুষটি কি করলেন ?
হো হো করে হেসে উঠে বললেন --
" ডাক্তারিটা ছেড়ে দিন। লিখুন। লিখুন। ধারাবাহিক লিখবেন ? "
--- " ডাক্তারি করে কিছু হয়নি, দেবেশদা। কিন্তু লেখার সেই ক্ষমতাও যে নেই । "
উনি হাসলেন। সেই পরিচিত আস্কারা দেওয়া হাসি।
-- " তিনবার লিখবেন। প্রথমবার , কালির কলমে। দ্বিতীয়বার , চোখের কলমে।
তৃতীয়বার , মনের কলমে।
সেই লেখা কখনও ব্যর্থ হয়না। "
★★
শ্রী দেবেশ রায়ের সাহিত্য প্রজ্ঞা , সৃষ্টিশীলতা, হৃদকলমের ছলাৎছল .... এমনতর বিষয়গুলি নিয়ে লেখার কোন ক্ষমতা বা দুঃসাহস এই অর্বাচীন অলেখকের কখনও ছিল না , হবেও না।
কিন্তু নিজের এই অন্তরকথাগুলি যে এত তাড়াতাড়ি বলতে হবে --- ভাবিনি। কক্ষনও ভাবিনি।
★
আমার সাড়া না পেয়ে দুঃখ পাওয়ার মতো হাতেগোনা মানুষ আরও একজন কমে গেছেন ।
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
অসাধারণ
ভালো। বেশ ভালো।
এই অনবদ্য স্মৃতিচারণের থেকে মস্ত পাওনা এই তিনবার লেখার চাবিকাঠি। কালির কলমে, চোখের কলমে আর মনের কলমে।
দেবেশ রায়কে একবারই দেখেছিলাম শিলচরে, সালটা বোধহয় ১৯৯১। তখন সদ্য 'তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত' আকাদেমি পেয়েছে। টাউন হলে আলোচনা চক্রের পরদিন 'রাবীন্দ্রিকী'র কর্ণধার রূপক দামের বাসায় চা-চক্রে আড্ডা দিতে এলেন। আমি ছিলাম প্রায় নীরব দর্শক মাত্র।
এমন একটা মানুষ নীরবে থাকলেন।..নীরবে কাজ টি করলেন।..আর একেবারে নীরবে চলে গেলেন !! কর্পোরেট লেখক হয়ে ওঠা হয়নি তো !!তাই !! এই পোড়া দেশে ওনারা কেন জন্মান ??কেন ? আক্ষেপ না , রাগ হয় !!আমার যাঁরা এখনো বেঁচে আছি ....মানে শ্বাস নিচ্ছি ....আসুন না , ওনাকে নতুন করে জানি ।..জানার চেষ্টা করি !!!