অনেকক্ষণ ধরে অনেকগুলো দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে যেরকমটি চাইছিলেন, ঠিক সেরকমটি নাহলেও কিছুটা কাছাকাছি ধরনের পেলেন। সেই সস্তার যুগ তো আর নেই ! এখন সবই অগ্নিমূল্যের বাজার। তাই ভাবনার চেয়েও বেশ কিছু গুণ বেশিই পকেট থেকে খসলো। তা কি আর করা যাবে...! এখন মূল্যেও উচ্চ আর গুণমানে নিম্ন, এটাই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে সকলেই একপ্রকার বাধ্য। বস্তুটিকে পরম যত্নে হাতের ছোট্ট ব্যাগটিতে ভরে শালের আড়ালে সেঁধিয়ে ফেললেন। যেন লোকচক্ষুর নজরে না পড়ে, সেই ভয়ে।
শীতকাল পড়লেই মনটা ভীষণ উচাটন হয়ে যায়। ডিসেম্বরের বেলা সাড়ে এগারোটাতেও হনুমান টুপি, মাফলার, পায়ে মোজা পরে পাম্প শু, ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর দিয়ে শাল জড়িয়ে তবে বের হবার অনুমতি মিলেছে। ছোট ভাইপোর বৌটি সরেজমিনে শীতের এসব গয়নাগাঁটি নিজের হাতে পরিয়ে তবেই ছেড়েছে। সবে তো মোটে বাহাত্তর, এখনই এত বাড়াবাড়ি নৃসিংহবাবুর একদম ধাতে সয় না। বাড়ি থেকে বের হবার তো জো নেই। যদিও কালেভদ্রে একটু বেরোনোর সুযোগ পান, তার ফ্যাসাদে নাকানি চোবানি খেতে হয়। বাড়িতে মেজ আর ছোট বৌমার ধমকি। দিল্লি থেকে বড় বৌমার ফোনে হুমকি। বেচারা নৃসিংহবাবুর এতেও রক্ষে নেই। ভাইঝিটিও কম যায় না। তার বিয়ে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সুদূর মেলবোর্ন থেকে মাসে তিন চারবার ভিডিও কল করে কাকামনির আগাপাশতলা মেপে নেয়। আর লম্বা চওড়া ফিরিস্তি সমেত হুমকি দিতে ছাড়ে না। নৃসিংহবাবু রীতিমত হাঁফিয়ে উঠেছেন। নিজে বিয়ে করেননি। দাদার অকালমৃত্যুর ফলে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব স্বকন্ধে ধারণ করেছিলেন। দাদার চার ছেলেমেয়েকে দায়িত্ব সহকারে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করেছিলেন। কড়া অনুশাসনে সবকটাকে তৈরি করেছেন। সকলেই আজ প্রতিষ্ঠিত। এখন বড় হয়ে তাঁরাও বোধহয় সেই শাসনের শোধ তুলছে। তাদের একমাত্র কাকামনিকে নানানপ্রকার অনুশাসনের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে তারা বেঁধে রেখেছে। সেই বন্ধনের ফাঁস এতটুকু আলগা হওয়ার অবকাশ নেই। সর্বদা কঠিন পাহারার বেষ্টনীতে বেষ্টিত। সকালবেলা মর্নিং ওয়াকে যেতে হলেও বংশীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেই হবে। মানুষটার স্বাধীনতা বলতে কিচ্ছুটি আজ আর অবশিষ্ট নেই। নির্ভেজাল বন্দী জীবন বলতে যা বোঝায় তাইই...।
পেনশনের মাসকাবারি টাকাটা নৃসিংহবাবু খুব বুঝেশুনে খরচা করেন। বেশি তো মেলে না। তাই যে কটা পান, গুনে গেঁথে ভেবেচিন্তে বের করেন। এমনিতে তাঁর ওপর চারদিক থেকে যা নজরদারি, তাতে এই যেটুকু বেঁচেবর্তে আছেন সেটাই বড় কথা বলে মনে করেন। এই শীতের সকালে বংশীহীন নৃসিংহবাবুর বের হওয়াটা যে কি বিষম ঝকমারির ছিল, তা তিনি ব্যাতীত অন্য কারোর পক্ষে বোঝা অসম্ভব। মেজটি যেমন তেমন, ছোটটি তো আর এক কাঠি সরেস। সর্বসময়ে খবরদারি তো আছেই, তারসাথে চলে গোয়েন্দাগিরি। নৃসিংহবাবু কি খাচ্ছেন, কখন খাচ্ছেন, কেন খাচ্ছেন, ঠিক সময়ে খাচ্ছেন কিনা, বা ঠিক সময়ে আজ খেয়ে থাকলে আগে কোন সময়ে খেয়েছিলেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি কৌতূহলের সমুদ্রে নৃসিংহ প্রসাদ সিংহ সর্বদা নিক্ষেপিত। মাঝেমধ্যে মনে করেন, ধূত্তোর ! এরচেয়ে এসব ছেড়ে পালাই যেদিকে দুচোখ যায়... কিংবা সংসারের পাততাড়ি গুটিয়ে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে ওঠেন। ভাবেন কিন্তু পারেন না। ভাইপোগুলো তো আছেই এখন তাদের বৌগুলো জুটেছে। নাতি নাতনিগুলিও মায়ার বাঁধনে টেনে ধরে।
সন্ধ্যের সময়ে নৃসিংহবাবুর খাদ্যতালিকায় বিশেষ কিছু থাকে না। বিকেলে এককাপ চায়ের সঙ্গে দুটি বিস্কুট। সন্ধ্যেবেলায় একটু চিনেবাদাম সহযোগে শুকনো মুড়ি। রাতে অল্প একটু সব্জি আর বিনা মিষ্টতায় মাখা ছানার সঙ্গে দুই বা তিনটি রুটি। ব্যস, এর থেকে বেশি কিছু... কদাকচিৎ পাতে জোটে। আর সঙ্গে থাকে নিয়ম করে বেশকিছু ওষুধ। খাওয়ার আগে কোনোটা বা কোনটা খাওয়ার পরে, এসব মেজ বৌমার মুখস্ত। একটুও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। যেদিন মেজটি অনুপস্থিত সেদিন সেই দায়িত্ব ছোটর ঘাড়ে বর্তায়। নৃসিংহবাবুর জীবনে নিয়মের কোনো ফাঁক নেই। এদেরও ওপরে রয়েছে বংশীর বাঁশি... সে ওইসব নিয়মকানুনের মধ্যে কোনোরকম ছিটেফোঁটা ফাঁক ফোকর কিংবা এদিক ওদিক দেখলেই পিঁ... পিঁ... করে বাঁশি বাজিয়ে বৌমনিদের সজাগ করে দেয়। সচক্ষে কিছু দেখলে শুধু বৌমা নয়, ভাইপোদের কানেও সে নিজে মুখে না জানালে শান্তি পায় না। এর পরেও গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ফোন যায় দিল্লি আর মেলবোর্নে। সেখান থেকে বাড়ির ল্যান্ডফোনে চোটপাট হওয়ার পর নৃসিংহবাবুর সেকেলে ছোট্ট মোবাইল ফোনটিকেও ওরা রেহাই দেয় না। সেই ফোনে গুঁতোর পর গুঁতোয় তিনি চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। ভাবেন আর কখনও তেমন কিছু করবেন না। যারফলে চারদিক থেকে এত তীর বর্শা বল্লম যেন ধেয়ে না আসে। কিন্তু চোরের মন বোঁচকা দেখেও কি স্থির থাকতে পারে ! তাই আবারও কোনো নতুন গেরো পাকিয়ে ফেলেন...।
রাতের খাবার তিনি নিজের ঘরেই খান। নৃসিংহবাবু বরাবর রেডিওর ভক্ত। এখন সেই রস বেতারে না পেলেও শুনতে ছাড়েন না। সেই রেডিও চালিয়েই রাতের খাবারটি উদরস্থ করার প্ল্যানে ছিলেন। বংশী খাবারের থালাটি খাটের সামনে ছোট টেবিলে রেখে যায়। যাওয়ার সময়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই যায়। আজও তাই করেছিল। নৃসিংহবাবু ভাবলেন এইতো উপযুক্ত সময়... খুব সন্তর্পণে খাট থেকে নামলেন। এগিয়ে গেলেন ঘরের কোণে দাঁড়ানো প্রায় শ'খানেক বছরের পুরানো সেগুণ কাঠের আলমারির দিকে। একটুও শব্দ না হয় এমন ভঙ্গিতে চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন ডানদিকের পাল্লাটা। নিজের ধুতি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, চাদরের পিছনে লুকানো বস্তুটির পানে হাত বাড়িয়ে দিলেন। নির্ধারিত স্থানটিতে বেশ কয়েকবার হাত ঘুরিয়েও বস্তুটির নাগাল পেলেন না। কি আশ্চর্য্য ! কোথায় গেল বস্তুটি ? যেখানে রেখেছিলেন সেখানে তো কিচ্ছুটি নেই ! নৃসিংহবাবুর মাথার ভিতরের প্রত্যেকটি স্নায়ুর সলতে দপ দপ করে জ্বলে উঠতে লাগল। পাগলের মত খুঁজতে লাগলেন। জামাকাপড় সব মেঝেতে নামিয়ে ফেললেন। এই তাকেই রেখেছিলেন কিনা, ঠিক মনে করতেও পারছিলেন না। বাহাত্তুরে শরীরের মগজটিতে স্মৃতি শক্তিটিও মাঝেমাঝে বেঈমানী করে বসে। সেই ভেবে পুরো আলমারিটাই উথালপাথাল করে খোঁজার চেষ্টায় ব্রতী হবেন কিনা ভাবছিলেন। সব তাকগুলো উল্টে পাল্টে ফাঁকে ফোকরে খুঁজে দেখছিলেন...
নাহ্ কোত্থাও বস্তুটির নাম ও নিশান নেই ! ঠিক এমনি সময়ে মেজ ও ছোট বৌ, তাদের পিছনে বংশী হারামজাদাটাও ভেজানো দরজাটা হাট করে খুলে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। ছোট বৌয়ের দুহাতে ধরা নৃসিংহবাবুর এতক্ষণ ধরে উথালপাথাল করে খোঁজা সেই বস্তুটি। ছোট্ট একটি নলেন গুড়ের নাগড়ি। যা আজ সকালবেলা বেরিয়ে অনেক খুঁজে পকেটের রেস্ত খসিয়ে জোগাড় করে এনেছিলেন। ভেবেছিলেন, সকলের চোখের আড়ালে নিজের ঘরে, নিজের মত করে গরম রুটির সাথে একটু একটু করে খাবেন। আহা ! কয়েকদিন ধরে এই ভাবনাটা ভেবেই তাঁর চোখ আয়েশে বুজে যেত। শীত পড়ার সাথে সাথেই মনটা আঁকুপাকু করে উঠেছিল বিশুদ্ধ সরেস সুগন্ধযুক্ত নলেন গুড়ের জন্যে। এ বাড়ির সকলে জানলে, আয়েশ করে গুড় খাওয়া তো দূর অস্ত। সে অমৃতের একটি ফোঁটাও তাঁর লালায়িত জিভের ডগায় জুটবেনা। এটা তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন।
- এত তন্ন তন্ন করে এইটাকেই খুঁজছিলেন তো কাকামনি ? ছোট বৌমার কঠিন মুখে প্রশ্ন। নৃসিংহ বাবু আমতা আমতা করছেন। তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে হাত পা সেঁধিয়ে পেটের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার যোগাড়। বৌমাদের হম্বিতম্বির চোটে এবার ভাইপো দুটিও ঘরে এসে হাজির হয়েছে। সকলের শ্যেন দৃষ্টি একযোগে এসে বিঁধছে নৃসিংহবাবুর দিকে। সভয়ে উনি পা ঘষে ঘষে এবার খোলা আলমারির থেকে পিছিয়ে গিয়ে খাটে ঠেস দিলেন। নৃসিংহবাবুর কানে বাজছে সকলের মুখে একই "রা"। "কাকামনি, গত সপ্তাহের রিপোর্টে এসেছে তোমার রক্তে চিনির মাত্রা এখন তিনশ পেরিয়ে গেছে... সেই তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে নলেন গুড় খাবে বলে..." মেজ ও ছোট ভাইপো আর তাদের বৌদের ঝনঝনানির মাঝে খাটের ওপর বালিশের পাশে রাখা ছোট্ট মোবাইল ফোনটাও এবার বেজে উঠল। ফোনের ছোট্ট পর্দায় আড়চোখে দেখবার চেষ্টা করলেন, দিল্লি না মেলবোর্ন !
________________________
All copyrights reserved ©Rajat Das II 12.12.2020