সেইবার ঠিক হলো ফ্যামিলি নিয়ে দোলের সময় শান্তিনিকেতন যাওয়া হবে। বাবার হাতে সময় নেই, কাকারাও ব্যস্ত। তাই হোটেল বুক করার ভার পড়লো আমার ঘাড়ে।
আমি তখন সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। মনটা উড়ু উড়ু। তাই নিজে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে নিলাম।
দুএকটা ট্যুর ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথা বলে বুঝলাম একদিনের হোটেল ভাড়া তিন হাজার অব্দি পৌঁছতে পারে। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় হাতে মোবাইল ছিল না, মেকমাইট্রিপ তখনো ট্রিপগুলোকে গুছিয়ে উঠতে পারে নি। ট্যুর ট্রাভেল এজেন্সির বাইরে বেশি ইনফরমেশন দরকার হলে ভ্রমণ পত্রিকা।
কিন্তু সেগুলো তোয়াক্কা না করে বাড়িতে সাজেশান দিলাম যে একাই একবার দেখে আসি। এতগুলো লোক গেলে খরচ তো অনেক হবে। তাই আগে থেকে পরিস্থিতি এভালুয়েট করাটা দরকার।
ছেলে একা একা অতদূর যাবে শুনে মা একটু নাকচ করছিল। দুয়েকবার আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছিল ,"তুই একা চিনতে পারবি তো? ফিরে আসতে পারবি তো?"
মার বড় ভয় ছিল ছেলে হারিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সেই সব ভয় অতিক্রম করে আমি এক শনিবার হাওড়া স্টেশনে হাজির। শীতকালের সকালে জ্যাকেটের পকেটে একটু বেশী টাকা আর একমুঠো রোদ্দুর নিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। প্যাসেঞ্জার ট্রেনেই উঠেছিলাম।
দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। প্রথমবার বোলপুর যাচ্ছি ,লালমাটির দেশে, কবিগুরুর জগতে।
আমার মনটাও কেমন কবি কবি হয়ে উঠেছিল। নেহাত একটা খাতা ছিল না, নাহলে দুই একটা সেদিনই লিখে ফেলতাম। পরে হয়তো কোনোদিন বই ছাপাতাম, বইমেলাতে লোকে এসে প্রশংসা করতো। এরকম হাজার রকম কল্পনা আগত বসন্তের মিষ্টি হওয়ার মতো আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল।
তবে সেই মিষ্টি হওয়াতেই একটা গন্ধ নাকে ভেসে এসেছিল। কোন ফুল সেটা বুঝতে পারিনি, তবে কোথা থেকে আসছিল তা অনুভব করেছিলাম।
আমার পরের বার্থগুলোতেই একটা পরিবার উঠেছিল। তার মধ্যেই একজন সেই স্বর্গীয় সুগন্ধের অধিকারিনী। বাসন্তী রঙের চুড়িদার পরিহিতা সেই মেয়েটি সাইড বার্থের এক কোনায় বসেছিল। মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না, সত্যি বলতে আমি এমন এক আবেশে ছিলাম যে নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠার ইচ্ছে হচ্ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল এই পথ যদি না শেষ হয় তাহলে কেমন হতো।
বাসন্তী রঙের তার ওড়না এলোমেলো হওয়াতে কিসের যেন ইশারা দিচ্ছিল, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। খুব ইচ্ছে করছিল আলাপ করার। খুব ইচ্ছে করছিল পাশে গিয়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার হাতে হাত রেখে একসাথে কোন এক স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্নে আমি এক রাজপুত্তুর আর সে এক স্বর্গের অপ্সরা। সত্যি একটা খাতা থাকলে আমি আজ বড় কবি হতে পারতাম। বাসন্তী রঙের কবিতা লিখতাম।
এমনিতে আমি ভীষণ লাজুক, কিন্তু সেদিন কোন এক চৌম্বক শক্তির টানে আমার লজ্জার বাঁধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল। আমার ভুলে যাওয়া খাতার পৃষ্ঠাগুলো ছিড়ে ছিড়ে বুকের ভেতরে আগুনটাকে আরো তীব্র ভাবে জ্বালিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলাম, ইসপার নাহলে উসপার। কথা বলতেই হবে।
আমি নিজের জায়গা থেকে যেই না উঠতে যাবো অমনি দেখি গাড়িটা স্লো হয়ে গেল। দেখলাম সেও উঠেছে আর তার সাথে বাকি প্যাসেঞ্জারগুলোও । আমরা বোলপুরে পৌঁছে গেছি।
ট্রেন থেকে নেমে পিছু নিলাম। আমি যেন আর নিজের মধ্যে নেই। যন্ত্রচালিত কোন রোবট হয়ে গেছি যার রিমোট সেই বাসন্তীফুলের পাপড়িতে আটকে গেছে। হওয়ার যেইদিকে নিয়ে যাচ্ছে আমি মগ্ন মৈনাকের মতো সেই দিকেই ছুটছি।
সে রিকশায় উঠে বসলো। আমি রিক্সাওলাকে বললাম সামনের রিকশাকে ফলো করতে। শহরের পাকা রাস্তা ছেড়ে লালমাটির রাস্তায় আমাদের দুজনের রিকশার চাকা একসাথে ঘুরছে। ভেবেছিলাম একবার ডাকবো, কিন্তু সেই সাহস আর হলো না। অবশেষে তার রিকশা কোন এক পাড়ার ভেতরে ছোট গলিতে ঢুকলো। আর সেই মুহূর্তেই একবার, কেবলমাত্র একবার আমি তাকে দেখেছিলাম। আমার কবিতাকে।
রিকশাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,"ভাই ,আর কি ভেতরে যাবো?গলির ভেতরে যাওয়া কিন্তু ঠিক হবেনা"
আমি যেন কেমন একটা লজ্জা পেয়ে গেছিলাম। রিকশাওয়ালা হয়তো আমার মনের কথা ধরে ফেলেছিল, তাই শেষে ওই "ঠিক" শব্দটা জুড়লো।
লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল। বললাম,"না, কোন ভালো হোটেলের দিকে নিয়ে চলো"
রিকশাওয়ালা গাড়ি ঘোরালো আর আমার কবিতা তার বাড়ির গলিতে ঢুকে পড়ল। আমি বিষন্ন মনে বোলপুরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু সেই বিষণ্ণতা বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না। বোলপুরের হওয়াতে সেটা কখন যেন উধাও হয়ে গেল। কখন যেন পলাশের রঙে আর মাধবিলতার সাজে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। কেন জানিনা প্রতিটা রাস্তায় মনে হচ্ছিল কবিগুরুর সুর অপেক্ষা করছে তার শ্রোতাদের জন্য। যে যেমনভাবে শুনতে চায় সে তেমনভাবেই শুনতে পাবে । তেমনভাবেই গুরুদেবকে নিজের মতো করে পাবে। প্রকৃতি ও মানুষ একসাথে স্থান,কাল সীমানার গন্ডি অতিক্রম করে একসাথে বেড়ে উঠবে কবিগুরুর আদর্শে।
সেইদিন রিকশাওয়ালা আমাকে আরো অনেক কিছু দেখিয়েছিল। অমর্ত্য সেনের বাড়ি, সোনাঝুড়ি গ্রাম, উপাসনা গৃহ, মেলা প্রাঙ্গন। আকাশে বাতাসে নব বসন্তের গান অনুভব করেছিলাম । অনুভব করেছিলাম আমার মনে, আমার সারা শরীরে। সব কিছুতেই দোল লেগেছে। স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল।
ওই অনাকাঙ্খিত নতুন ভালো লাগার জোয়ারে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করছিল সেই অজানা পাড়ার অজানা গলিতে আবার যাই। গিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করতে থাকি সেই বাসন্তী সুগন্ধের জন্য।
সেইদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বারে বারে আসবো । অন্তত বছরে একটা দিন কাটাবো এই ছন্দময় শান্তিনিকেতনে।
আমার ভাড়া করা রিকশাওয়ালা তার মধ্যে বেশ কয়েকটা হোটেল দেখিয়েছিল । কিন্তু দোলের দিনের রেট শুনে মনে হচ্ছিল পাড়ার ট্যুর এজেন্সির লোকেরা খুব একটা বাড়িয়ে বলেনি । তবে যাইহোক আমি মোটামুটি একটা হিসেব কসে বিকেলের ট্রেনে চেপে বসলাম।
ফেরার সময় মনটা বড় উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতন আমার মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছিল। আমাকে একলা করে শুন্য হাতে বাড়ি যেতে হয়েছিল। বোলপুর থেকে হাওড়া যাওয়ার ওই সময় টুকু আমি শুধু দরজার পাশে বসে কাটিয়েছিলাম। আমাদের গাড়ি কত খেত, কত জনপদের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছিল সেই খেয়াল আর আমার ছিল না।
চোখদুটো খালি খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেই বাসন্তী বসনা অজানা সুন্দরীকে। যার নাম, ধাম কোন কিছুই আমার জানা নেই।
তবে সেইবার আমরা গেছিলাম শান্তিনিকেতনে। তারপর থেকে প্রত্যেক বছর গেছি । দোলের সময় নানা মানুষের ভিড়ের মধ্যে আমি এখনো গন্ধ পাই সেই বাসন্তী ফুলের । সেই অজানা পাড়ার অজানা গলিতে আজও খুঁজে বেড়াই আমার না লেখা কবিতাকে।