এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  বিবিধ

  • দেকার্ত:  দর্শনের আঙিনায় যুক্তিবাদের কন্ঠস্বর 

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১১ নভেম্বর ২০২০ | ১৭৬৪ বার পঠিত
  • দেকার্ত: দর্শনের আঙিনায় যুক্তিবাদের কন্ঠস্বর

    ভূমিকা

    আজ থেকে প্রায় পৌনে চারশ’ বছর আগের কথা। হল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন ঘোষণা করলেন—প্রশ্ন কর, প্রশ্ন কর সবকিছুকে; কাউকে বাদ দিও না। সত্যের খোঁজে বেরিয়ে প্রথম কাজই হল সমস্ত আপ্তবাক্য, সমস্ত প্রচলিত তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। কোন কিছুকেই বিনা প্রশ্নে ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিয়ে থেমে গেলে চলবে না। যা কিছু এতদিন চিরন্তন সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে তাদের প্রাথমিকভাবে দেখতে হবে সংশয়ের চোখে। পরখ করে দেখতে হবে সমস্ত স্বতঃসিদ্ধকে, যুক্তির আলোকে। এমনকি ঈশ্বরকেও। তাঁকেও যুক্তিসিদ্ধ হতে হবে।

    ইনি রনে দেকার্ত। ফরাসী দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক। স্কুলের দশম শ্রেণীতে আমরা অনেকেই যে স্থানাংক জ্যামিতি বা কার্টেজিয়ান জিওমেট্রি পড়ি তার ভিত ইনিই গড়েছিলেন জ্যামিতিতে বীজগণিতের সফল প্রয়োগ করে। এই যে একটি বিন্দুর অবস্থানকে দুটি পারস্পরিক লম্বরেখার থেকে দূরত্বের মাধ্যমে চিহ্নিত করা—মেকানিক্স ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় এর অবদান সুদূরপ্রসারী।

    কিন্তু এঁর সবচেয়ে বড় অবদান হল জ্ঞানচর্চায়, মধ্যযুগীয় দর্শনে আপ্তবাক্যের অচলায়তনে বন্ধ জানলা খুলে দেওয়ায়, যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেওয়ায়। তাই বার্ট্রান্ড রাসেল এবং অনেকের মতে দেকার্তই হলেন দর্শনশাস্ত্রে আধুনিকতার জনক।

    একদিকে ভ্যাটিকানের অধীনে জ্ঞানচর্চায় অচলায়তনের পাঁচিলে মনের জানলা খোলা নিষিদ্ধ, পাছে একজটা দেবীর শাপ লাগে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট আবহাওয়ায় বেকনদের যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচর্চা শুধু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সীমিত। মননের স্বতন্ত্র ভূমিকা দুই বিপরীত মেরুর চিন্তাধারায় যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না । এর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রেনে দেকার্ত দেখালেন বস্তুজগত ও মনোজগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং একই সঙ্গে মনের বিশ্লেষণী শক্তির গুরুত্ব। কিন্তু সবকিছুকেই যখন প্রশ্ন করব, বাজিয়ে দেখব, কোন কিছুর অস্তিত্বকেই বিনা প্রশ্নে মেনে নেব না, তাহলে আমার, অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষের নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কেন প্রশ্ন করব না? কী করে নিঃসন্দেহ হব যে আমি আছি, আমার অস্তিত্ব আছে?

    এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে দেকার্ত পৌঁছে গেলেন যুক্তিশাস্ত্রের এক উচ্চতম স্তরে। ধ্বনিত হল এক অমর উক্তিঃ Cogito Ergo Sum. (I think, therefore I exist.)

    আমি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করছি, কাজেই আমি আছি ।

    তিনটে শতাব্দী পেরিয়েও ওঁর ওই কথাটি আমাদের চমৎকৃত করে, দর্শনচর্চার নানা কচকচির মধ্যে এক দমকা হাওয়ার মত। আমরা ভাবি, এই সিদ্ধান্তে উনি কী করে পৌঁছলেন? এ কি স্বজ্ঞা (ইন্টুইশন) জাত? নাকি আরিস্ততলীয় অবরোহী যুক্তি পরম্পরার সমান্তরাল অন্য কোন তর্ক পদ্ধতি?

    এ নিয়ে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করব দ্বিতীয় অধ্যায়ে।

    ইনি আদ্যন্ত রোমান ক্যাথলিক ধর্মশিক্ষায় বড় হয়ে ওঠা আস্তিক মানুষ। তখন জ্ঞানের জগতে শেষ কথা বলার অধিকার ভ্যাটিকানের বা ভ্যাটিকান অনুমোদিত যাজকশ্রেণীর। বেয়াড়াকথা বললে রোমান ‘ইনকুইজিশনের’ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শাস্তির জন্যে মাথা নোয়ানোই ভবিতব্য।

    কিন্তু সময়টা সপ্তদশ শতাব্দী। তখন জ্ঞানচর্চার জগতে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, সৃষ্টি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপারে নতুন চিন্তা মানুষের ভাবনায় আলোড়ন তুলেছে। সৌরজগতের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিও বাইবেল অনুমোদিত টলেমি-আরিস্টটলের পৃথ্বীকেন্দ্রিক (geocentric) তত্ত্বকে খারিজ করে সূর্যকেন্দ্রিক (heliocentric) মডেলকে গাণিতিক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করছেন। আবার গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ নিয়ে কেপলারের তিনটে সূত্র ১৬১৯ নাগাদ প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন যে সেই গতিপথ বৃত্তাকার নয়, ডিম্বাকার (ইলিপটিক্যাল)। আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে প্রায় পৌনে দু’হাজার বছর ধরে সযত্নে লালিত টলেমির পৃথ্বীকেন্দ্রিক মডেল, পাইথাগোরাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সৌন্দর্যশাস্ত্রীয় যুক্তি - যেমন ঈশ্বরের সৃষ্ট গ্রহ, ব্রহ্মাণ্ডের আকার ও গতিপথ অবশ্যই বৃত্তাকার হবে - কারণ, জ্যামিতিতে বৃত্ত সবচেয়ে সুন্দর দেখতে। আরিস্ততলের যুক্তি - চাঁদের চেয়ে উঁচুতে যত গ্রহ বা নক্ষত্র আছে সব স্থির, অপরিবর্তনীয়। পরিবর্তন ও ক্ষয় শুধু নীচে যারা আছে তাদের ধর্ম।

    বেদান্তের ছাত্রদের কি মনে পড়বে না --যা শাশ্বত বা অপরিবর্তনীয় তাই সত্য আর যার নামরূপ স্থায়ী নয়, বদলে বদলে যায় তা মিথ্যা ! এই শতকেই গণিতে নেপিয়ারের লগারিদম নিয়ে থিওরেমগুলো প্রকাশিত হয়ে গেছে। নিউটনের আবির্ভাব শুধু সময়ের অপেক্ষা।

    এবার অংক ও পদার্থবিদ্যার অনুরক্ত মানুষটি লেগে পড়লেন যুক্তি দিয়ে ঈশ্বর ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে। চার্চকে বোঝালেন যে ওঁর এই চেষ্টা আসলে আপামর জনসাধারণের মধ্যে ঈশ্বরকে আরও বিশ্বাসযোগ্য, আরও গ্রহণীয় করে তুলবে। তাতে চার্চের হাতই শক্ত হবে। কিন্তু ভবি ভোলেনি। জার্মানীর দুটি ইউনিভার্সিটি ইউট্রেখট ও লীডেন সেই ১৬৪২ ও ১৬৪৭ সালেই দেকার্তের সমস্ত বই ও থিওরিকে নিয়ে চর্চা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল - নাস্তিকতার বীজ দেখতে পেয়ে।

    দেকার্তের যুক্তিবাদের ভূত তিনশ’ বছর পরেও অনেককে তাড়া করে বেড়ায়। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি অধিকৃত ফ্রান্সের ভিশি’তে মঁসিয়ে পেতাঁর ফ্যাসিস্ত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আবেল বোনার(Abel Bonnard)। উনি চাইছিলেন ‘যেসব বিগ্রহগুলোকে আমাদের পথের ধুলোয় টেনে নামাতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে আগে চাই দেকার্তের ভাবমূর্তিকে জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা। জনতা তাকে আবার ফরাসী প্রতিভার সর্বোত্তম নিদর্শন বলে মনে করে!’

    আজকে দেকার্ত কেন পড়বঃ

    দেকার্তের সন্দেহবাদ কিন্তু ‘নেতি নেতি’ করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে শূন্যে পৌঁছানো নয়; নুনের পুতুলের জ্ঞানের সাগরে ডুবে গলে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা নয়। দেকার্তের সবকিছুকে সন্দেহ করা একটি সত্যান্বেষণের পদ্ধতি মাত্র, বা বলা উচিত পদ্ধতিটির প্রথম চরণ। আসল লক্ষ্য সত্য বলে কোন কিছুকে মেনে নেওয়ার আগে তাকে ভাল করে সন্দেহের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিঃসন্দেহ হওয়া।

    তাই যখন প্রশ্ন ওঠেঃ সবকিছুকে সন্দেহ করার এই প্রবণতা শেষে কোথায় নিয়ে যাবে? নিজেকে অস্বীকারে? কোনকিছুই যখন সন্দেহের উর্দ্ধে নয় এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্ব পর্যন্ত প্রমাণসাপেক্ষ তাহলে ‘আমি’ বলে কিছু আছে কী নেই? আমি যে আছি তার কী প্রমাণ?

    এর উত্তরে আমরা পেলাম একটি যুগান্তকারী যুক্তি - ল্যাটিন ভাষায় ‘Cogito Ergo Sum’ অর্থাৎ এই যে আমি সন্দেহ করছি, প্রশ্ন তুলছি সবকিছু, এমনকি নিজের অস্তিত্ব নিয়েও তার মানেই আমি আছি, দস্তুরমত বেঁচে আছি।

    এভাবেই আমাদের একুশ শতকের আস্থাহীন সন্দেহাকুল দ্বিধাদীর্ণ মনকে ছুঁয়ে ফেলেন দার্শনিক দেকার্তে। হয়ে যান আমাদের আত্মার আত্মীয়। আজ আমাদের সামনে কোন ‘হোলি কাউ’ নেই। কোন সংশয়হীন বিশ্বাসের ভূমি নেই। কোন পথে মানবমুক্তি ঘটবে আমাদের জানা নেই। আজ সত্যের রং সাদা বা কালো নয়, বরং ধূসর। একুশ শতকের বিজ্ঞানচেতনা আমাদের শিখিয়েছে দেশ-কাল নিরপেক্ষ কোন শাশ্বত সত্য নেই। বৈজ্ঞানিক সত্যও আপেক্ষিক। আজ যা অন্তিম সত্য কাল তাই নতুন সাক্ষ্য বা নতুন প্রমাণের ভিত্তিতে সীমিত সত্য হয়ে যেতে পারে।

    তাই আজ আমরা কোন কিছুকেই পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনা মেনে নেব না। বাজিয়ে যাচাই করে দেখব - তা ঈশ্বরই হোন বা মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র অথবা একনায়কতন্ত্র। দেকার্ত তো মানুষের কাছে এই চেয়েছিলেন।

    আজ যখন জ্ঞানচর্চার বিশিষ্টজনেদের সম্মেলনে দেশের বরেণ্য রাজনৈতিক গণেশের শুঁড়কে প্রাচীন স্টেমসেল অপারেশনের উদাহরণ হিসেবে ঘোষণা করেন বা পেপার পড়া হয় পুষ্পক রথের ব্যাকগিয়ার নিয়ে আর কথিত গুণীজনেরা কৌরবসভায় মহাজনেদের পদাংক অনুসরণ করে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেন তখন প্রায় চারশ’ বছর আগে বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের এবং পৃথ্বীকেন্দ্রিক ব্রহ্মান্ডের বদলে সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের জন্যে যুক্তি দিয়ে কথা বলা কত কঠিন ছিল তার খানিকটা আন্দাজ পাই।

    তবে এইই সব নয়। সমসাময়িক আরেক যুক্তিবাদী ফ্রান্সিস বেকন শিল্প ও টেকনলজির পক্ষে দাঁড়িয়ে তথ্যসংগ্রহ ও প্রয়োগকে গুরুত্ব দিয়ে মধ্যযুগীন অন্ধবিশ্বাসের বিরোধিতা করলেন বটে, কিন্তু জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব মাত্র ব্যবহারিক প্রয়োজনের মধ্যে আটকে রেখে উনি আসলে তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার বিরোধিতা করে বসলেন। তাঁর কোপার্নিকাসের সৌরমডেলের কড়া সমালোচনা এর একটি উদাহরণ। এদিকে গণিতজ্ঞ দেকার্ত শুদ্ধ গণিতের চর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে খুঁজে বের করলেন সত্যাসত্য যাচাই করবার এক বিশুদ্ধ তার্কিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে উনি নির্মাণ করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে ধারণাভিত্তিক দার্শনিক যুক্তি বা অন্টোলজিক্যাল প্রুফ।

    বেকনের প্রয়োগবাদ ও দেকার্তের বুদ্ধিবাদ - দুইয়েরই ফল হয় সুদূরপ্রসারী। ইউরোপে চার্চের কর্তৃত্বের থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞানচর্চা – দর্শন ও বিজ্ঞান—এগিয়ে চলে এক্সপেরিমেন্ট ও উন্নত লজিককে অনুসরণ করে।

    বেকনের অনুগামী লক ও হিউম, এবং দেকার্তের পদ্ধতির অনুরক্ত স্পিনোজা ও লাইবনিজ, মানবচিন্তার ক্ষেত্রকে আরও গভীর আরও বিস্তৃত করলেন। লাইবনিজও গণিতের জগতে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করলেন, তবে নিঊটনের থেকে স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে। আবার চার্চের রক্তচক্ষু এড়াতে স্পিনোজা ও লাইবনিজ, দুজনেই, ঠিক দেকার্তের মত, তাঁদের দার্শনিক মডেলে ঈশ্বরকে একটি আবশ্যিক তত্ত্ব রূপে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু এঁরা চিন্তার জগতে যে বিপ্লবটি ঘটালেন তা হল সত্যকে খুঁজে পাওয়া ও তাকে প্রকাশ্য স্বীকৃতি দেয়ার অধিকার কেবলমাত্র চার্চের হাতে রইল না। দেকার্ত দেখালেন যে একজন সাধারণ মানুষও কোন দৈব আদেশ ছাড়াই নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে খুঁজলে সত্যকে পেয়ে যেতে পারে।

    আর একটি কথা। দেকার্ত ছিলেন দ্বৈতবাদী (Dualist)। উনি একই সঙ্গে মন ও বস্তুজগতের অস্তিত্ব - দুটোই স্বীকার করতেন। যদিও দেহ নামের বস্তুটি মন নামক সত্তা থেকে শুধু আলাদাই নয় বিপরীতধর্মী, তবে মানবদেহে অবস্থিত ‘পাইনিয়াল গ্ল্যান্ড’ (Pineal gland) এর সাহায্যে মন মানবদেহের উপর ক্রিয়াশীল হয়।

    এখানে বঙ্গের বামমার্গীরা খেয়াল করে দেখুন যে মার্ক্সের ডায়ালেক্টিক্যাল মেটিরিয়ালিজম বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদেও রয়েছে দ্বৈতবাদের ছায়া। মার্ক্সীয় দর্শনে বস্তুর প্রাধান্য থাকলেও তা যান্ত্রিক বস্তুবাদ নয়। সেখানে বস্তু ও চেতনা পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়াশীল। আবার দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নিয়মের - ‘দুই বিপরীতের ঐক্য’ এবং ‘ দুই বিপরীতের দ্বন্দ্ব’ (ল’ অফ কন্ট্রাডিকশন) - মধ্যে স্পষ্টতঃ দ্বৈতবাদের ছায়া।

    বাস্তবে দুই বিপরীতের সহাবস্থান ও দ্বন্দ্ব আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও দৈনন্দিন ব্যক্তিজীবনের অংগ। রাষ্ট্র না নাগরিক, সমাজ না ব্যক্তি, ধর্মীয় অনুশাসন না ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ – কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এই প্রশ্ন আমাদের প্রতি নিয়ত ভাবাচ্ছে।

    আর গত দুই শতাব্দী ধরে ‘ অধিকতম মানুষের প্রভূততম সুখের সাধনায়’ নিযুক্ত থেকে হিতবাদ, সমাজবাদ হয়ে কল্যাণকারী রাষ্ট্রের বন্দনায় মুগ্ধ আমরা কেমন করে যেন ক্রমশঃ খাটো করে ফেলেছি একক ব্যক্তি মানুষের আর্তিকে। আমাদের ভেতরের ছোট্ট ‘বামি’ মাঝেমাঝেই ফুঁপিয়ে ওঠে—‘হারিয়ে গেছি আমি’।

    তাই দেকার্তের ‘আই’ বা ‘আমি’ আজ আবার কয়েক শতাব্দীর দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের কাছে প্রাসংগিক হয়ে উঠেছে, ধ্বনিত হচ্ছে “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে”।

    এই সামান্য লেখাটি দেকার্তের যুক্তিবাদ বা র‍্যাশনালিজমের সামনে নতজানু হয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলির একটি প্রয়াস মাত্র।

    লেখাটির পরিকল্পনাঃ

    আমরা দেকার্তের জীবন, দর্শন, বইগুলির প্রতিপাদ্য এবং ঈশ্বর, বিশ্বজগৎ ও তাঁর নিজস্ব যুক্তিবিচারের পদ্ধতি বা জ্ঞানকান্ড নিয়ে কী ভাবে কথা বলব তার একটা খসড়া এখানে দেয়ার চেষ্টা করছি।

    প্রথম অধ্যায়ে সংক্ষেপে ধরা হয়েছে ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমি এবং ওঁর জীবন, বিশেষ করে দেকার্তের মানসে সমসাময়িক ব্যক্তিবিশেষ ও ঘটনার প্রভাব নিয়ে তথ্য ও বিশিষ্টজনের মতামত; এর পর ওঁর বিশ্লেষণের পদ্ধতি বা জ্ঞানকান্ড।নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ওঁর বিখ্যাত উক্তিটির—কজিটো এরগো সুম—গঠন, প্রতিপাদ্য ও তাৎপর্য এবং সমালোচনা নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা আছে।

    তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা সংক্ষেপে কথা বলেছি দেকার্তের নিজস্ব অধিবিদ্যা নিয়ে। তাতে আসছে মন ও মনের শক্তি – যা দেকার্তের দর্শনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। আছেন ঈশ্বর। আমরা পরিচিত হব দেকার্তের ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তার্কিক প্রমাণের সঙ্গে; দেখব সত্যও মিথ্যার প্রভেদ বোঝার পদ্ধতি। আর থাকবে বস্তুজগতের অস্তিত্ব, আত্মা, ঈশ্বর ও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক।

    এর পর দুটি পরিশিষ্ট।

    পরিশিষ্ট-১ এ আছে বিশিষ্ট দার্শনিক দের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও পারিভাষিক শব্দাবলীর বাংলা পরিভাষা ও সরল ব্যাখ্যা এবং পরিশিষ্ট-২য়ে আগ্রহী পাঠকদের জন্যে কিছু বইয়ের নাম ও লেখক তালিকা।

    বলে রাখা ভাল যে দেকার্তের বইগুলো লাতিন ও ফরাসী ভাষায় লেখা। কাজেই আমাকে মূল বইগুলো পড়তে হয়েছে ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদে ভর করে। দেকার্তের দর্শনের মূল কথাগুলোকে তুলে ধরতে ভরসা করেছি ওঁর প্রধান তিনটি বইয়ের উপর - ডিসকোর্স অন মেথড (১৬৩৭), মেডিটেশন্স ডে প্রাইমা ফিলজফি(১৬৪১) এবং প্রিন্সিপলস অফ ফিলজফি (১৬৪৪)।

    আর আমি যেহেতু দর্শনের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই, তাই এই লেখায় উপস্থাপনা বা ব্যাখ্যায় সমস্ত ত্রুটি ও প্রমাদের দায়িত্ব একান্তভাবে আমার। এবং কেউ ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.196.12 | ১৩ নভেম্বর ২০২০ ০০:২৮733166
  • " জার্মানীর দুটি ইউনিভার্সিটি ইউট্রেখট ও লীডেন"


    এই দুটো  বিশ্ববিদ্যালয়ই  হল্যান্ডে। 

  • Ranjan Roy | ১৩ নভেম্বর ২০২০ ০৮:২৫733168
  • b,


    "এই দুটো  বিশ্ববিদ্যালয়ই  হল্যান্ডে"।


    --অনেক ধন্যবাদ ভুল শুধরে দেবার জন্যে ।

  • হল্যান্ডএ নয় | 161.65.237.26 | ১৩ নভেম্বর ২০২০ ১১:১২733169
  • ইয়ে, Utrecht কিন্তু ঠিক  হল্যান্ড এ নয়, নেদারল্যান্ডস এ বলতে পারেন ।


  • Ranjan Roy | ১৩ নভেম্বর ২০২০ ১৩:৪০733170
  • বেশ, কিন্তু ১৬শ শতাব্দীতে ওই দুটো ইউনি কোথায় ছিল , মানে কোন দেশে?

  • Shamsul Choudhury | ১৬ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৫৮733182
  • ভাল লেগেছে, 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন