এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চলন্তিকা বোর্ডিং (৬) - ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় 

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ অক্টোবর ২০২০ | ১০৭০ বার পঠিত

  • বেথুন রো-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের অন্যতম সুসন্তান মহাত্মা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি ধর্মপ্রচারক, তিনি বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ ও পরিচালনা করেছিলেন । তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। ব্রহ্মবান্ধবের পূর্বনাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 


     হুগলী জেলার খন্যানের বাসিন্দা ভবাণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১ তে (১লা ফাল্গুন। ১২৬৭ বঙ্গাব্দ)। এঁদের আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগরের খানাকুল গাঁ-এ। ভবানীচরণের প্রপিতামহ মদনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ধার্মিক ও সৎ ব্যক্তি হলেও কৌলিন্যপ্রথানুযায়ী পঞ্চাশখানা বিয়ে করেছিলেন। এখন ভাবলেই কেমন যেন গা শিরিশির করে ওঠে। পঞ্চাশবার বিয়ের পিঁড়েতে চাপা – জাস্ট ইনকরিজেবল। ব্যানার্জী মশাই শেষ বিবাহখানি করেছিলেন মাত্র একটা সুপারী গ্রহণ করে। ভাবানীচরনের ঠাকুর্দা হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মামার বাড়িতে মানুষ হচ্ছিলেন। কোন মাতুলালয় – তা প্রশ্ন করবেন না। জবাব নেই আমার কাছে। খন্যান গ্রামের বসতবাড়ি ইনিই তৈরি কএন। কাজ করতেন ঠগি-বিভাগে, সুদূর জব্বলপুরে। হরচন্দ্রের তিন ছেলে। দেবীচরণ, কালীচরণ আর তারিণীচরণ। দেবীচরণের তিন ছেলের নাম হরিচরণ, পার্ব্বতীচরণ আর ভবানীচরণ। 


     ভবানীচরণের যখন মাত্র বছরখানেক বয়স তখনই তাঁর মা মারা যান। এই এক বছর ধরে ভবাণী বিভিন্ন চর্মরোগে ভুগতে ছিলেন। যার ফলে মা তাঁকে সুস্থ অবস্থায় দেখেই যেতে পারেননি। শিশু ভবানী ঠাকুমা’র কোলে পিঠেই বড় হ’তে থাকেন। 


     গ্রামের এক পাঠশালায় ভবানীচরণের লেখাপড়ার শুরু। এরপরে চুঁচুড়ার হিন্দু স্কুল। কিছুদিন পরেই হুগলীর ব্রাঞ্চ স্কুল। সে স্কুলের হেডমাস্টার তখনকার ইংরেজি সাহিত্যের এক দিকপাল যজ্ঞেশ্বর ঘোষ। আর প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন রবার্ট থোরেস। তীক্ষ্ণ মনোযোগী ভবানী সব সময়েই প্রথম হতেন। 


     হুগলী থেকে কলকাতা। ভর্তি হলেন জেনারেল এসেম্বলী স্কুলে। প্রিন্সিপ্যাল ডাক্তার জার্ডিন। আবার ফেরত গেলেন হুগলীতে বাবার চাকরীর বদলীর সূত্রে। হুগলী কালেজস্কুলে স্থান হ’ল এবারে। ভবানীর উপনয়ন হ’ল হুগলীতেই। তখন ভবানী তের’ বছরের। এর এক বছর পরেই মাছ মাংস ত্যাগ করে নিরামিষাশী হয়ে গেলেন বাকি জীবনটার জন্যে। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র একবার আমিষ তাঁকে খেতেই হয়েছিল বাধ্যতায়। 


     এন্ট্রান্স পাশ পনেরো বছরে। সংস্কৃতে প্রচণ্ড আগ্রহ। ভাটপাড়া যেতে শুরু করলেন সংস্কৃত ব্যাকরণ আর সাহিত্যের অনুরাগে। এর সাথে ছিল শরীরচর্চা। ব্যায়াম, কুস্তী, লাঠি, জিমন্যাস্টিক, ক্রিকেট সবেতেই তুখোড়। ছোটখাটো এক নেতা হয়ে উঠলেন ভবানীচরণ। 


     এর মধ্যেই দুচারবার আর্মানীয় ছেলেদের সাথে মারপিট হয়ে গেল। তাদের অসভ্যতার বিরুদ্ধে। মাথায় ঢুকল আর্মানীদের উচিৎ শিক্ষা দিতে গেলে সৈনিক হতেই হবে। গোয়ালির যাত্রা করলেন সৈনিক হবেন বলে। বাড়ির লোক পিছু ধাওয়া ক’রে পাণ্ডুয়া স্টেশন থেকে নামালেন এ ছেলেকে। বড় ভাই হরিচরণ তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ভাইকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রেখে ভর্তি করালেন জেনারেল এসেম্বলী কলেজে (আজকের স্কটিশ চার্চ কলেজ)।  


     আবার তিন বন্ধু জুটিয়ে চারজন চললেন গোয়ালিয়র। সঙ্গে মাত্র চার কি পাঁচ টাকা। অনেক কষ্টে গোয়ালিয়র পৌঁছলেন। এই তিন বন্ধুর মধ্যে একজনের বাবা ছিলেন পুলিশ বিভাগের উচ্চপদাধিকারী। গন্ধ শুঁকে ঠিক তিনি হাজির হলেন গোয়ালিয়রে। কলকাতায় এসে এবারে ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। মনের দুঃখে ধরলেন সিদ্ধির নেশা। কলেজেই একবার ধরা পড়ার পর আর কখনো ছুঁয়েও দেখেন নি তা !


     আবার পালালেন। এবারে একা। আগ্রায় নেমে ধোলপুরের টিকিট কাটলেন। এবারে হাতে ছিল তেত্রিশ টাকার মতো। ধোলপুরে গিয়ে উঠলেন সর্দ্দার উমাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। রাতে খেতে বসে দেখলেন বড় বাটি করে পাঁঠার মাংস। অথচ বলতে পারছেন না। তিনি সৈনিক হতে যাচ্ছেন আর মাংস খাবেন না তা কি করে হয়। পাঁচ বছর বাদে আবার খেলেন মাংস। ব্যস এই শেষ। 


     ধোলপুর থেকে উটের গাড়িতে গোয়ালিয়র। প্রথমে এক বাড়িতে ইংরেজি মাস্টারের কাজ পেলেন। তাঁর মধ্যেই এক জনের বদান্যতায় খুলে ফেললেন ইংরেজি শেখানোর স্কুল। এরই মধ্যে পরিচয় হ’ল সিন্ধিয়া মহারাজের সেনাপতির সাথে। কিন্তু কিছুই সুবিধে না হওয়ায় কলকাতায় ফিরে মেমারিতে মাস্টারি করতে চলে গেলেন।   


     এরপরে শরীর অসুস্থ হ’লে চলে যান জব্বলপুরে। সেখানে একটু সুস্থ হয়েই হিমালয় ভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। সে সব সাঙ্গ করে পুনরায় কলকাতা। যথারীতি মাস্টারী আবার। 


     জন্মসূত্রে হিন্দু ভবানীচরণের ধর্ম সম্পর্কে অসীম কৌতুহল ছিল। আর সে সময় কেশবচন্দ্র সেন নিজের বাগ্মিতায় দেশকে মাতিয়ে দিচ্ছেন। পড়াশোনার পাঠ শেষ হতে না হতে কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে ভবানীচরণ নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। পরে একে একে প্রোটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের এই দুই শাখাতেই দীক্ষিত হয়ে ধর্মপ্রচারের কাজে যুক্ত হন। নিজের দেওয়া নতুন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামেই পরিচিত হন তখন থেকে। ঘুরে বেড়ান সিন্ধু প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে। এই সময়কালে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের সাথেও সাক্ষাৎ হয় তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই পিতৃবিয়োগ ঘটে। সে সময় কলতায় মহামারী প্লেগ রোগে অবসন্নপ্রায়। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে দেশবাসীর সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভবানীচরণ।


     উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিককার কথা। ১৮ বেথুন রো-র বাসিন্দা সিমুলিয়ার বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ কৃষ্ণচন্দ্র নান তাঁর এমএ পরীক্ষার্থী পুত্র কার্তিকচন্দ্রের গৃহশিক্ষক হিসেবে পেলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক তেজী শিক্ষককে। সে যুগের রীতি অনুসারে, গৃহশিক্ষক ভবানীচরণ ছাত্রের বাড়িতে থেকেই তাকে পড়াশোনা করাতেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ছিন্ন হয়নি ওই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শুধু সেই ছাত্রই নয় তাঁর উত্তরপুরুষরা নিজেদের উদ্যোগে ব্রহ্মবান্ধবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন পাথরের ফলক বসিয়ে। ব্রহ্মবান্ধবের বিশাল কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়িটি।


     এর মধ্যেই ‘কনকর্ডক্লাব’ নামে একটা সমিতি তৈরি করলেন। আর সাথে বার করলেন একটা মাসিক পত্রিকা ‘কন্কর্ড’। ১৮৮৬ সালেই এই ১৮ নং বেথুন রো’র বাড়িতেই এই ক্লাবের জন্ম। কুচবিহারের মহারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় আর উইলিয়াম উইলসন হান্টারের সম্পাদকীয়তার গুণে নতুন বাড়ি নেওয়া হ’ল সার্কুলার রোড-এ (এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড)। এখন সেই জায়গায় রাজাবাজার ট্রাম ডিপো। ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতির আলোচনা ছাড়াও বক্তৃতা, গানবাজনা, খেলাধুলা, ব্যায়াম ইত্যাদি নিয়েই কংকর্ড ক্লাব চলতে লাগল। 


      ১৯০০-এ কলকাতায় ফিরে প্রাক্তন ছাত্র কার্তিকচন্দ্রের সহায়তায়, তাঁর ১৮ বেথুন রো-এর বাড়ি থেকে নতুন করে প্রকাশ করলেন ক্যাথলিকদের মুখপত্র 'সোফিয়া’ নামে এক মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকার একটি সংখ্যায় ব্রহ্মবান্ধব প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ (‘World-Poet’) আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র প্রেম আর প্রকৃতির পূজারি কবি নন, তিনি জগতের সব রূপ রস গন্ধের এক অনুভবী কবি। তিনি আরো বলেন যে যদি কোনোদিন বিদেশিরা বাংলাভাষা শিখতে আগ্রহ দেখান, তারা শিখতে চাইবে শুধুই রবীন্দ্রনাথকে। তাই তিনি সত্যিকারের এক বিশ্বকবি। 


    ১৯০১ সালে ৩১ শে জানুয়ারি আরেকটি নতুন পত্রিকা ‘The Twentieth Century’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রকাশক কার্তিকচন্দ্র নান, যুগ্ম সম্পাদক—নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। এই কাগজে ব্রহ্মবান্ধবের দর্শন বিষয়ের প্রবন্ধগুলি ‘নরহরি দাস’-এই ছদ্মনামে এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর লেখা স্বনামে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেন ‘টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি’ নামে আরও একটি পত্রিকা। ওই বাড়িতেই স্থাপন করলেন ‘আয়তন’ নামে এক গুরুকুল। ওই সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের, পরে তা পরিণত হয় গভীর সখ্যে।


            ১৯০১-এ স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবে আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এসে ইউরোপে যান বেদান্তধর্ম প্রচার করতে। সেখান থেকে ফিরে, তিনি গেলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, ব্রহ্মচর্য আশ্রম গঠনের কাজে যুক্ত হতে। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ অভিধায় সম্বোধিত করেন। কিছুকাল সেখানে অধ্যাপনা করার পর আবার কলকাতায় ফিরে উঠলেন বেথুন রো-এর বাড়িতেই। সেই সময়ে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারা বঙ্গদেশ উত্তাল। শিক্ষকতা ছেড়ে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন ব্রহ্মবান্ধব।


     এবারে একটু নাহয় গল্পের আশ্রয় নিই। 


     সাল ১৯০১। সিমলের নরেন বিশ্ববিজয় সেরে স্বামী বিবেকানন্দ। ব্যারিস্টার উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী সবে অবসর নিয়েছেন কলকাতার হাইকোর্ট থেকে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করছেন। ওদিকে সুইডেনে নোবেল প্রাইজের খাতা খুলছে। কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী।


     তখনো মানিকতলা স্ট্রীট বলতে কাঁচা রাস্তাই। নতুন রাস্তা সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরিই হয় নি। চারদিকেই খাবলা খাবলা জংগল। পুকুর আর কাঁচা নর্দমার সুগন্ধ। যে পায়ে চলা শুঁড়ি পথে সেই যে গালিব যেতেন চীৎপুর অব্দি, সে রাস্তার জংগল কিছুটা সাফ হয়ে কিছু বাড়িঘর তৈরি হয়েছে সদ্য। মানিকতলা থেকে মানিকতলা স্ট্রীট শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ছাতুবাবুর মাঠে। বছর আট নয় হ’ল, রোজ সকালে ছাতুবাবুর ফাঁকা মাঠে আজকাল জেলেরা আর তরকারীর ফোড়েরা বসছে সকালবেলায়। দুপুরের পর থেকে আবার নিঝুম সব। 


        যাদের বাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি ছিল না, তাদের ছিল পাল্কি। বড়লোকেদের ঘোড়ার গাড়ি থাকলেও তাদের বাড়ির মেয়েরা কিন্তু ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কিতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। বাবুরা পাল্কির গদীর বিছানায় শুয়ে শুয়ে অফিস যেত। সাধে কি বাঙালি আয়েসি !  পাল্কি যে বাড়িতে থাকত তার সাথে চারজন চাকর তো থাকত’ই। তারা জল তোলা, তামাক সেজে দেওয়া, কাঠ কাটা, বাড়ি পাহারা দেওয়া ইত্যাদি বাকি কাজকর্ম করত। অনেক বাড়িতেই পাতকুয়ো ছিল। 


     তখন কিন্তু হেদুয়া থেকেও চাকরেরা বাঁকে করে জল আনত। সে জল খাওয়াও হ’ত। ওই জল নাকি উৎকৃষ্ট ছিল। সে সময় সিমলে পাড়ায় শীত পড়ত ভালোরকমই। খোলা মাঠ ঘাট জংগলের হাওয়ায় কাঁপুনি ধরত আলো পড়তেই। সবই প্রায় কাঁচা বাড়ি। 


     ওই সময়ে প্রায়ই বিকেল বেলা যুবক কবি জোড়াসাঁকো বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোম্পানী বাগানের আগের এক পায়ে চলা পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন এই বেথুন রো-তে কার্তিকচন্দ্র নানের বাড়ি। যেদিন ঘোড়ার গাড়ি করে কবি আসতেন সেদিন অবশ্য বিডন স্ট্রীট ধরতেন। বিডন স্ক্যোয়ার অব্দি চিৎপুর রোড ধরে এসে। বেশ ক বছর হ’ল তৈরি হয়েছে বিডন স্ট্রীট। যেতে যেতে পথে পড়ে প্রথমে অমৃতলাল বসুর গ্রেট ন্যাশান্যাল থিয়েটার (মিনার্ভা)। আর একটু এগোলেই ৯ নং বিডন স্ট্রিট এর বেঙ্গল থিয়েটার বন্ধ হয়েছে। আর এই ১৯০১ সালেই মালিকানা পালটে নাম নিয়েছে অরোরা থিয়েটার। ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের “দক্ষিণা” নাটক দিয়ে ১৭ আগস্ট শুরু হয়েছে। এই একটা নাট্যশালাই এখন চোখে পরে কবির আসা যাওয়ার রাস্তায়। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার বন্ধ হয়েছে গত শতাব্দীতেই। তা অনেকদিনই হ’ল। আর ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রীটের স্টার থিয়েটারে তো সেই ১৮৮৭ তেই বন্ধ হয়েছে। রমণীরসিক গুর্মুখ রায় বিনোদিনী’র নামের নাম রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু গিরীশবাবুর কথায় বিনোদিনী গুর্মুখ রায়কে রাজি করায় স্টার থিয়েটার নাম রাখতে। ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই গিরীশচন্দ্র নামালেন ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক। সেই শুরু। আর তার চার বছর বাদে ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই ‘বুদ্ধদেব-চরিত’ আর ‘বেল্লিক বাজার’ নাটক অভিনয়ের পর বন্ধ হ’ল বিনোদিনীর স্টার থিয়েটার। গিরীশ ঘোষের বিদায়ের পরে গোপাল শীল এই বাড়িতেই খুললেন এমারেল্ড থিয়েটার। কিন্তু চললো না। টিকিটঘর মাছি তাড়াতে লাগল। আবার কয়েকমাস পরে ফিরে এলেন গিরীশ। কতো যে নাটক এই রাস্তায় !  যুবক কবির মনে কি পড়ে না এসব ? নিশ্চই পড়ে। চার-পাঁচ বছর আগে এই বিডন স্ট্রিটে আলো ঝলমল করতো তিন-তিনখানা নাট্যশালায়।  এই স্টারেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং এসেছিলেন গিরীশে’র ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নাটক দেখতে। সেদিনই ঠাকুর বিনোদিনী দাসী’র মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। ঠাকুর বলতেন থ্যাটারে লোকশিক্ষে হয়। 


     কার্তিকচন্দ্র ব্রহ্মবান্ধবকে গুরুর জায়গায় বসিয়েছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব যখন কবির ডাকে শান্তিনিকেতন যান তখন তিনি কার্তিকচন্দ্রকেও সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চারুশিল্পের মাস্টারমশাই হিসেবে। কার্তিকচন্দ্র নিজের ছেলে সুধীরচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ভর্তি করিয়েছিলেন। কবি যে কয়েকজন ছাত্রকে তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে এই সুধীরচন্দ্রও ছিলেন। 


     পরে ব্রহ্মবান্ধব কোনো কারণে আশ্রম ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে এলে তাঁর সাথেই কার্তিকচন্দ্র আর সুধীরচন্দ্রও ফেরত আসেন কলকাতায়। ১৯০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার এক মামলা চলার সময়েই ব্রহ্মবান্ধব অসুস্থ হয়ে পড়েন। কার্তিকচন্দ্রের বাড়িতেই চিকিৎসা শুরু হয়। অসুস্থতা বাড়তে থাকায় ২১ অক্টোবর ক্যাম্বেল হাসপাতালে (নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ) ভর্তি হন। ২৭ অক্টোবর ব্রহ্মবান্ধব চলে যান তাঁর ঈশ্বরের কোলে। 


     রাজদ্রোহের বন্দী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সাথে এই ১৮ নম্বর বেথুন রো’র স্মৃতি চিরটাকাল জড়িয়েই থাকবে। কার না পায়ের ধুলো পড়েছিল এই বাড়িখানায় ! বাল গঙ্গাধর তিলক,  সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আরো কতো গণ্যমান্য মানুষের। এখন ও এই বাড়ির গায়ে রয়েছে – 


    “ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় স্মৃতিভবন 


    ধর্মবীর উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব।


    খ্রিস্টাব্দ ১৮৬১-১৯০৭, সন ১২৬৮-১৩১৪ 


     তাঁর প্রিয়তম ছাত্র কার্তিকচন্দ্র নান, মহাশয়ের এই বাসভবনে অবস্থানকালে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে নানারূপ ধর্ম্মালোচনাদি দ্বারা ও সন্ধ্যা স্বরাজ করালী প্রভৃতি বিখ্যাত লোকপ্রিয় পত্রিকা প্রচারের সাহায্যে স্বদেশবাসীকে সর্বদা ভগবৎ প্রেমে উদ্দীপ্ত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে রাখতেন।”



     আমার চলন্তিকা বোর্ডিং হাউস পর্ব শেষ করব এই অঞ্চলের আরেক বিখ্যাত ডাক্তারবাবুর কথা বলে। তাঁর নাম ডাক্তার নারায়ণ চন্দ্র রায়। মেডিকেল কলেজে থেকে ডাক্তার হয়ে জড়িয়ে পড়েন ড্যালহাউসি স্কোয়ার ও কলকাতা বোমার কেসে। ১৯৩০ সালেই তিনি হয়ে যান যাবজ্জীবন বন্দী। জেলে থাকতে থাকতেই মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সেলুলার জেলে থাকার সময় তিনি কমিউনিস্ট সংহতি তৈরি করেন। ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান তিনি। সিমলা অঞ্চলের এক জনদরদী ডাক্তার হিসেবে তাঁর নাম আজও মনে রেখেছেন এই অঞ্চলের আপামর অধিবাসী। বিনা ফি’তে গরীবদের সেবা করতেন অকাতরে। 


     আমি তাঁকে দেখিনি তবে ওনার দুই শিষ্যকে দেখেছি। তাঁরাও যে মূল্যবোধে সারাজীবন চিকিৎসা করেছেন তা এ সময় কল্পনা করাই যায় না। এঁরা হলেন ডাক্তার বিষ্ণুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যাঁর পৈত্রিক বাড়িও ছিল ভৈরব বিশ্বাস লেনে। ইতি ছিলেন পি. জি. কলেজের প্রফেসর। মেডিসিনের ডাক্তার। ফার্মাকোলজীতে গোল্ড মেডালিস্ট। চিকিৎসা ছাড়াও তিনি ছিলেন শিল্পের প্রবল অনুরাগী। আমার সৌভাগ্য এই যে আমি অনেকদিন পেয়েছিলাম ওনাকে পারিবারিক ডাক্তার হিসেবেই। আরেকজন হলেন চোরবাগান দত্ত বাড়ির ছেলে, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র ভাইপো ডাক্তার অম্বিকা দত্ত। ইনি ছিলেন সাইক্রিয়াটিস্ট। এঁদের কাছে শুনতাম তাঁদের শুরুর দিনগুলোর কথা। এই দুজনের চরিত্র আর আদর্শ আমি যা দেখেছি তা দেখে বুঝতে পেরেছি যে ডাক্তার নারায়ন চন্দ্র রায় কেমন চিকিৎসক ছিলেন। 


    (চলন্তিকা_বোর্ডিং সমাপ্ত)   


    ©গৌতম দত্ত


    ##


    ঋণস্বীকার :


    ১।    কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্র নাথ দত্ত।


    ২।   কলিকাতার কাহিনী – সুকুমার সেন। 


    ৩।   কলকাতার ইতিবৃত্ত – প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।


    ৪।  কলিকাতার রাজপথ সমাজ ও সংস্কৃতিতে – অজিতকুমার বসু। 


    ৫।   কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়। 


    ৬।  শুভদীপ মুখার্জী –“When Mirza Ghalib Came To Kolkata”


    ৭।   মির্জা গালিব: নিয়তির হরফে লেখা জীবন - Ahmed din Rumi – রোর ডট       


            মিডিয়া/বাংলা।


    ৮।  কলকাতায় মির্জা গালিব - আশিস ঘোষ – ক্যালকাটানিউজ ডট টিভি।


    ৯।    মির্জা গালিবের ক্যানভাসে ধরা রইল পুরনো কলকাতা - দেবদত্ত গুপ্ত – 


            বঙ্গদর্শন ডট কম।


    ১০। গালিবের শহর কলকাতা - অতনু সিংহ – ক্যানভাস ডট কম ডট বিডি। 


    ১১। মির্জা গালিবের নিন্দুকেরা – প্রথমআলো ডট কম। 


    ১২। মধুময় মধুমাস সম্রাট বাবর, মির্জা গালিব ও রবীন্দ্রনাথ - সাইফুর রহমান –


            বিডি-প্রতিদিন ডট কম। 


    ১৩। উইকিপিডিয়া এবং অবশ্যই গুগুল। 


    #####


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন