এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  শনিবারবেলা

  • সার্টিফিকেট (৪)

    রাহুল দাশগুপ্ত
    ধারাবাহিক | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ১৯৯৯ বার পঠিত
  • দ্বিতীয় দিন

    Our modern heroes are those who knows about creative investment, yaani, those who know how to market their talents so that they’ll bear fruit.
    Ngugi wa Thiong’o


    নিমাই জানতে চেয়েছিল, অচ্যুৎ, কেন তোমার মনে হয়, ওরা সবাই পোকা, মানুষ নয়?
    অচ্যুৎ মৃদু হেসে বলেছিল, যারা বাবার কাছাকাছি থাকে, যাদের সার্টিফিকেট আছে, তারাই শুধু মানুষ। এই দেশে তাদেরই শুধু মানুষ বলে মনে করা হয়। বাকি সবাই পোকা।
    ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই নিমাই সোজা গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, বাবার কাছাকাছি এসেছি আমি! কবে সার্টিফিকেট পাব? কবে মানুষ হব?
    কথাটা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ হাসি পেল তার। নিজেকে শুনিয়েই যেন সে বলে উঠল, বুড়ো অভিনেতা কী জানেন, সারা জীবন এত পরিশ্রম করে, বই পড়ে, প্রতিভা দেখিয়ে, নতুন ছেলেমেয়েদের তৈরি করে তিনি আসলে পোকাই রয়ে গেছেন? মানুষ হতে পারেননি? আরে, তাঁর যে সার্টিফিকেটই নেই!
    গতকাল সন্ধ্যায় এসব ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু নিমাই ভুলতে পারেনি। রাতেও স্বপ্নের মধ্যে অচ্যুৎ এসেছিল। কে পোকা আর কে মানুষ, তা আলাদা করে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল। সত্যি যা ঘটেছিল স্বপ্নে অবিকল তাকেই দেখেছিল নিমাই। আর নিমাই বিছানায় শুয়ে শুয়েই ছটফট করেছিল। পরে অবশ্য নিমাইয়ের মনে হয়েছিল, কোন্‌টা সত্যি, আর কোন্‌টা স্বপ্ন, কে তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেবে? এখন যা ঘটছে তার পুরোটাই আবার স্বপ্ন নয় তো? কিন্তু আগে একবার বাবার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।




    বাবা একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। ধনুকাকার সমুদ্রের ধারে প্রাচীন দুর্গের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। এবার নিমাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, অচ্যুতের সঙ্গে তো তোমার পরিচয় হয়েই গিয়েছে। খুব বড়ো একটা অভিনয় কোম্পানিতে পার্ট টাইম কাজ পেয়েছে ও...
    বাবার ঠিক পায়ের তলায় বসে আছে অচ্যুৎ। নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নাড়ল সে। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আপনি পিছনে ছিলেন বলেই না! সবই আপনার জন্য হয়েছে। একটু থেমে সে আবার জানতে চাইল, আচ্ছা, আপনার বা পায়ের কড়ে আঙুলের ব্যথাটা কেমন আছে?
    ভালো নেই। বাবা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলেন।
    আমি একটু মালিশ করে দেব? ভালো ক্রিম এনেছি।
    তা দিতে পারো। বাবা উদাসীন হয়ে বললেন।
    অচ্যুৎ মালিশ করতে শুরু করল। একটু পরে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করল, বাবা...
    বাবা বললেন, বলো...
    আপনাকে বাবা ডাকার পর থেকে নিজের বাবাকেও আর বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না...
    বাবা গভীর আবেশে চোখ বুজে দিলেন। অচ্যুৎ বিনয়ে গদগদ হয়ে বলল, আমার বস কী বলেন জানেন? বাবা আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন অচ্যুতের দিকে। সে বলল, আপনি আমাদের কোম্পানির মাথার মুকুট। কোম্পানির ভার্লিং। আপনাকে আড়ালে ‘ডার্লিং’ বলেই ডাকেন তিনি...
    বাবা জানতে চাইলেন, কেমন আছে তোমাদের বস?
    অচ্যুতের হঠাৎ একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল। কয়েক মাস আগে একটা অনুষ্ঠানে তার কোম্পানির বসের সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছিল। এই বসটির বয়স চল্লিশের কোঠায়। বাবাকে ‘কাকামণি’ বলে ডাকেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বস গটগট করে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছেন। তার ঠিক পিছনেই বাবা জড়োসড়ো হয়ে তাকে অনুসরণ করছেন। বস হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বাবাও দাঁড়িয়ে গেলেন। বস হঠাৎ চলতে শুরু করলেন। বাবাও তাঁর পিছন পিছন চলতে শুরু করলেন। মঞ্চ থেকে নেমে বস ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। একটু পরে ঠিক তার পিছনে থাকা বাবাও একটু জড়োসড়ো ভাবেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
    বাবা সবসময়ই দাপটের সঙ্গে চলেন। তাঁকে কখনও এভাবে কাউকে খাতির করতে দেখেনি অচ্যুৎ। সবার খাতির পেতেই বরং তিনি অভ্যস্ত। একটু অবাকই হয়েছিল সে। কিন্তু নাবিকটির কথায় সব সংশয় তার দূর হয়ে গেছিল। পাশেই দাঁড়িয়েছিল নাবিকটি। সে বলেছিল, তোমাদের বস বাবার পরামর্শ ছাড়া চলতেই পারেন না। বাবাই তাঁর মগজ। আবার বাবাও তাঁকে খুব খাতির করে চলেন। এই মানুষটার যেমন পুঁজির জোর, তেমনই রাজনৈতিক ক্ষমতা, আবার সেরকমই বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ।
    অচ্যুৎ বুঝতে পেরেছিল। সে বলে চলল, বস বলেন, আমাদের কোম্পানি যে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার পিছনে আপনার অবদান অনেক। ওঁর বাবার আমল থেকে আপনি এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছেন। খুব বাধ্য ছিলেন। আর অসম্ভব পরিশ্রমী। ওপরওয়ালা যা বলত, এক বাক্যে সেই কাজ করে দিতেন। কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেননি কোম্পানির নীতি নিয়ে। কোনো আপস করেননি। দরকার হলে অনেক ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিসর্জন দিয়েছেন। বিশেষ করে কোম্পানির নীতি নিয়ে যারা কখনও কোনো প্রশ্ন তুলেছে, সে যদি আপনার বিশেষ বন্ধুও হয়, তবু তার কথা আপনি ভাবেননি। জীবন থেকে সমূলে তাকে বিদায় দিয়েছেন। বাধ্যতা, হ্যাঁ, নিঃশর্ত বাধ্যতাই আপনার সাফল্যের প্রধান শর্ত। অবশ্য প্রতিভা না থাকলে
    এই বাধ্যতাও কোনো কাজে আসত না। কী প্রতিভাবান আপনি! আর তার চেয়েও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কী সন্তর্পণে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আপনি আড়াল করতে পারেন। নিজেকে সবার চোখে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেন। বিশ্বের ইতিহাসে আপনার এই অভিনয়ের কোনো তুলনা নেই। কোম্পানিরও আজ তাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই...
    বাবা হাসলেন। তারপর বললেন, জানি। এই দ্বীপের আগের যিনি অধিকর্তা ছিলেন, তিনিই এখানে আমাকে নিয়ে আসেন। তোমাদের কোম্পানির বসের বাবা ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি যেমন তোমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছি, অধিকর্তাও তেমনই তাঁর বন্ধুর কোম্পানিতে আমাকে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বহু বছর তোমাদের কোম্পানিতে কাজ করেছি আমি। সার্টিফিকেটও পেয়েছি অনেক। কিছুদিন আগে তোমাদের কোম্পানি আমাকে কী দিয়েছে জান?
    একটি জাহাজ, তাই না? অদ্যুৎ হাসল।
    তুমি আমার আগের জাহাজটি দেখেছ? বাবা জানতে চাইলেন।
    ছবিতে দেখেছি।
    ওটার চেয়ে এটা অনেক বড়ো আর আরামের। তৃপ্তির হাসি হাসলেন বাবা। তারপর বললেন, জীবনে আমার একটা প্রধান শখ, ভ্রমণ করা। গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনোদিন একটা পয়সা খরচ হয়নি আমার। সবটাই কোম্পানি দিয়েছে। অনেক সময় কোম্পানি দিতে চাইলেও, আমি অবশ্য নিইনি। বন্ধুবান্ধবরাই তখন সব খরচ দিয়েছে। বন্ধুত্ব খুব ভেবেচিন্তে করতে হয়, বুঝলে? আমার বন্ধুরা সব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের প্রচুর অর্থ, বিরাট প্রভাব, বিপুল যোগাযোগ। পৃথিবীর যে দেশেই আমি যাই, কেউ না কেউ আমাকে আতিথ্য দেবে বলে তৈরিই থাকে৷ যেখানে লোকসান, যেখানে অপচয়, সেখানে আমি কোনোদিনই বন্ধুত্ব করিনি। বন্ধুত্ব থাকলেও সন্তর্পণে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
    নিমাই নিজেকে সামলাতে পারে না। হঠাৎ বলে বসে, শুনেছি, আপনার দান-ধ্যানও প্রচুর। অনেকের কাছে টাকা না নিয়েও অনেক কিছু করে দিয়েছেন...
    ওগুলো খুচরো দান-ধ্যান। খুচরো ত্যাগ। ওতে নাম হয় বেশি। খরচ হয় কম। যাদের কাছে টাকা নিইনি, তারা সব জায়গায় আমার গুনগান করে বেড়িয়েছে। কিন্তু, কত টাকা দিতে পারত ওরা? ওই সামান্য টাকায় আমার কী হত? ওগুলো টাকার জন্য নয়, যশের জন্য করেছি। মনে রেখো, একজন মানুষকে জীবনে বড়ো হতে গেলে অনেক হিসেব করে চলতে হয়। বেহিসেবি মানুষ শুধু ধাক্কা খায়, তার পথ কখনও মসৃণ হয় না...
    অচ্যুৎ বলল, আমার বস বলেন, কোম্পানির কাছে আপনার জন্য কোনো খরচই নাকি খরচ নয়! এই একটিমাত্র জায়গা, কোম্পানি যেখানে ঠকে যায়নি। নির্ঝঞ্ঝাটে ব্যাবসা করে গেছে...
    খুব কম কোম্পানিই এই কৃতজ্ঞতা দেখাবে, বুঝলে? বাবা তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
    আপনি নিজে অসম্ভব আনুগত্য দেখিয়েছেন বলেই এটা হয়েছে। অচ্যুৎ বলে চলে, আপনার কাছ থেকে সকলেরই শেখার আছে। অন্তত প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে আপনি ব্যবহার করে গেলেন...
    আনুগত্য তো দেখাতেই হবে! বিদ্যাসাগরের লেখা নীতিবোধ পড়নি? ‘যে ব্যক্তি আহিক, মাসিক অথবা বার্ষিক নিয়মে বেতন গ্রহণপূর্বক অন্যের কর্ম করে তাহাকে ভৃত্য কহে। ভৃত্যের কর্তব্য, স্বীয় প্রভুর কার্য সম্পাদনে সদা অবহিত থাকে ও তাহার সমুচিত সম্মান করে।’ বিদ্যাসাগরকে আমি খুব মানি। উনি ছিলেন মহান মানুষ। ভৃত্য হয়ে যারা ওদ্ধত্য দেখায়, তাদের মতো নির্বোধ আর কে আছে? তারা বোঝে না, ওসব করলে কোনোদিনই সার্টিফিকেট জুটবে না! তা ছাড়া, আমি তো প্রকাশ্যেই বলেছি...
    বলেছেন তো অন্যভাবে। আসলে তো আপনি নিজের জন্যই সারা জীবন কোম্পানিকে ব্যবহার করে গেছেন। অন্য কারও কথাই ভাবেননি। আর কোম্পানি ব্যবহার করেছে আপনাকে। সেটা হয়েছে, কোম্পানির চোখে নিজেকে আপনি অপরিহার্য করে তুলতে পেরেছেন বলেই। পরস্পরকে ব্যবহার করার এমন দৃষ্টান্ত সচরাচর দেখা যায় না। আপনারা একে অপরকে যেমন দিয়েছেন, পেয়েছেনও অনেক। অনেকেই দেয়, কিন্তু সবাই তো পায় না। অনেকের মনে নানা আক্ষেপ থাকে। অথচ গোটা জীবন ধরে আপনাদের মধ্যে যে সদ্ভাব রয়েছে, তারও কোনো তুলনা নেই।
    সত্যি কথা, খাটি কথা বলেছো। বাবা বললেন। তারপর যোগ করলেন, আসলে শুধু নিজের কাজটাই মন দিয়ে করে যেতে হয়, বুঝলে? মানে, যে কাজের জন্য তোমাকে ভাবা হয়েছে। কর্মস্থলে এটাই দীর্ঘদিন টিকে থাকার শর্ত। আর চালাকির সঙ্গে সমস্ত ঝুটঝামেলাকে এড়াতে হয়। সবাই তোমাকে নানা ঝুটঝামেলায় জড়াতে চাইবে। অনর্থক, অর্থহীন সব ঝামেলা। ওসব বেশি আমল দিতে নেই। শুধু যার হয়ে কাজ করছ, তার কাজে আসতে পারছ কী না, সেটাই হল কথা! আমি ঠিক এটাই করেছি। কোম্পানিকে বোঝাতে পেরেছি, মানুষের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কোম্পানিও তাই আমাকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি নিজের মতো কাজ করে যেতে পেরেছি। সবাই এই স্বাধীনতা পায় না। নিজের অনিচ্ছায় কোম্পানির ফাইফরমাশ খেটে যায়। আর ভিতরে ভিতরে গুমরে মরে। আমি অসম্ভব পরিশ্রম করেছি জীবনে। আর যখনই সুযোগ পেয়েছি, নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। কোম্পানি আমাকে এমনি এমনি অত স্বাধীনতা দেয়নি। তাদের আমি বোঝাতে পেরেছি, আমাকে ওই স্বাধীনতা দিলে কোম্পানিরই লাভ। আমার স্বাধীনতা কোম্পানির স্বার্থের পরিপন্থী নয়। আমি আসলে স্থিতাবস্থারই পক্ষে...
    একটু চুপ থাকলেন বাবা। তারপর যোগ করলেন, প্রতিষ্ঠানের কাছে একটু-আধটু সুযোগ পেয়েই অনেকে মাথায় চড়ে বসতে চায়। নিজেকে জাহির করতে চায়। ওসব করতে নেই। অভিনয় একটি মহৎ শিল্প। এর সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানকে কখনও বিরক্ত করতে নেই। তাদের কখনও অস্বস্তিতে ফেলতে নেই। কখনও কোনও প্রশ্ন করতে নেই। নিজের মতামত প্রকাশ করতে নেই। সবসময় মাথা নুইয়ে রাখতে হয়। বিনয়ী হতে হয়। কর্তাদের ইচ্ছায় সায় দিয়ে চলতে হয়। দেখতে হবে, নিশ্চিন্তে তাঁরা যাতে ব্যাবসাটা করতে পারেন। সংযমটা একটা বড়ো ব্যাপার। স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয়। অনেকেই স্বাধীনতা পেয়ে অপব্যবহার করে ফেলে। এটা খুব খারাপ। যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁদের কখনও চটাতে নেই। উচ্চপদে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে সবসময়ই সদ্ভাব রাখতে হয়। তাঁদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়। তাঁরাও তখন তোমার কথা ভাববেন। দশ জায়গায় তোমার কথা বলবেন। তখন দেখবে, কোম্পানিই তোমাকে সামনে নিয়ে আসছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে এগিয়ে দিচ্ছে। আসলে তারা তখন জেনে গেছে, তুমি তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ নিরাপদ...
    অচ্যুৎ হেসে ফেলল। তারপর বলল, সত্যিই আপনি একজন মহান শিক্ষক। পেশাদারিত্ব কাকে বলে, আপনি তা দেখিয়েছেন! আমাদের মতো একটা দুর্ভাগা দেশে আপনার কাছ থেকে শেখার কোনো শেষ নেই...
    বাবা মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এই দেশটা এত দুর্ভাগা কেন জান? গোটা দেশটা আসলে নির্বোধ আর মগজহীন মানুষে ভরা। এদের কোনো চিন্তাশক্তিই নেই। এরা স্রেফ শ্যাওলার মতো জলে ভেসে চলে। যুক্তি, বুদ্ধি বা বিশ্লেষণের ধার ধারে না। নানারকম মোহ ও হুজুগের বশবর্তী হয়ে চলে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, স্বাস্থহীনতা এদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। এদেশে শুধু টিকে থাকার, বেঁচে থাকার লড়াই এত প্রবল যে একে অপরকে ধাক্কা মেরে, ঠেলাঠেলি করে, চিমটি কেটে, ধুলো ছিটিয়ে কোনোমতে ভেসে থাকতে চায়। ছোট্ট জায়গা আর অনেক জীবন, ফলে কেউ কাউকে জায়গা ছাড়তে চায় না, মনগুলো হয়ে ওঠে অতি সংকীর্ণ। এখানে সামান্য একটু মনের জোর, মগজের তীক্ষতা আর পেশিশক্তি দেখাতে পারলেই অন্যদের চেয়ে উঁচুতে নিজের জায়গা করে নেওয়া যায়। এইটুকু ব্যক্তিত্ব থাকতেই হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তিত্বহীন মানুষ পছন্দ করে না। বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের জোরেই প্রতিষ্ঠানের কাছের মানুষ হওয়া যায়। তারা এমন লোক চায়, যে তাদের তকমা গায়ে এঁটে তাদেরই ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করবে না, আবার নিজের ব্যক্তিত্বকেও পুরোপুরি বিসর্জন দেবে না, আংশিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে মাত্র। অর্থাৎ দরকার হলে যাকে তারা নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করতে পারবে, মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি পারবে। মনে রেখো, এ এমন এক দেশ যেখানে বেশি মেধা দেখাতে যাওয়ার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছুই হতে পারে না। কেউ তোমাকে বুঝবে না। কেউ তোমার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে না। সবাই মিলে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তোমাকে পিষে দলে ছিবড়া করে দিতে চাইবে। তোমার এমন হাল করবে যে, তোমার নিজের প্রতিই আর কোনো আস্থা থাকবে না। পাগল বা ভিখিরি হয়ে তোমাকে গোটা জীবন কাটাতে হবে। এখানে কম মেধা নিয়ে জন্মানো আশীর্বাদের মতোই...
    অচ্যুৎ লম্বা হয়ে শুয়ে বাবার পায়ে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করল।




    নিমাই তখন ভাবছিল একটা ফোনের কথা। বুড়ো অভিনেতা করেছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, অনেকবার চেষ্টা করে তবে তোমাকে পেলাম। সত্যিই, এ এক ব্রাত্য, প্রান্তিক, পাণ্ডববর্জিত, মৃত দ্বীপ। তবু তো তুমি আমাকে মনে রেখেছ!
    কেন? নিমাই অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, একথা বলছেন কেন? আপনিই তো আমার অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। এই দেশ ও সময়ের পক্ষে আপনি এক বিরল মানুষ...
    তাহলে শোনো। গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠেছিল বুড়ো অভিনেতার। তিনি বলেছিলেন, তোমাকে ফোন করতে গিয়ে অচ্যুৎকে ফোন করে ফেলেছিলাম...
    নিমাই মনে মনে বলল, তাহলে ঠিকই ভেবেছি!
    অচ্যুতকে সে ‘কেমন আছে’, সেকথা জানতে চেয়েছিলেন বুড়ো অভিনেতা। একটু বিরক্তি নিয়েই অচ্যুৎ জবাব দিয়েছিল, আগের চেয়ে অনেক ভালো। বলতে পারেন, কোনো তুলনাই হয় না...
    একটু চোখ-কান খোলা রেখো বাবা...
    মানে?
    একটু সতর্ক থেকো...
    অচ্যুতের মেজাজ চড়ছিল। তবু শান্তভাবেই সে জানতে চেয়েছিল, কী বলতে চাইছেন?
    বৃদ্ধ বলেই চললেন, নিজেকে সামলে রেখো । ভেসে যেও না।
    এর মানে কী, আমি তো কিছুই...
    ওখানে অনেক প্রলোভন। মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলো না। ঠকে যেও না...
    হঠাৎ অচ্যুতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল সে, কোথাকার কোন্‌ হরিদাস পাল আপনি, অ্যাঁ, নিজেকে কী ভাবেন, সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেন, যত্ত সব বাজে লোক...
    বুড়ো অভিনেতা হকচকিয়ে গেছিলেন। তারপর শান্তস্বরে বলেছিলেন, এই বাজে লোকের কাছে তুমি দিনের পর দিন আসতে কেন? বাবার বিরুদ্ধে বলতে কেন? তখন তো তোমার মতো সর্বশক্তিমানের বিরোধী, গোটা দেশে আর একজনও ছিল না! আর আজ তোমার মতো তার স্তাবকও গোটা দেশ খুঁজলে পাওয়া যাবে না! আসলে সবটাই সাময়িক। তুমি তোমার সুবিধামতো পোশাক বদলাতে পার, সে তোমার স্বভাব। কিন্তু তখনও যেমন, এখনও ঠিক তেমনই, তোমার মধ্যে শুভবোধ জিইয়ে রাখতেই এই ফোনটা আমি করেছি...
    অচ্যুৎ চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, আপনার শুভবোধ আপনি নিজের কাছেই রাখুন। ওসবে এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। সারাজীবন ধরে এত শুভবোধ দেখিয়ে কী হয়েছে আপনার? কেউ চেনে আপনাকে? কেউ পাত্তা দেয়? আপনাদের দ্বীপে প্রত্যেকটা লোক সুযোগসন্ধানী। সুবিধাবাদী। ভিখারি। এখন আমার করুণা করতে ইচ্ছা হয় আপনাদের। হ্যাঁ, স্রেফ করুণারই যোগ্য আপনারা। বাবার কাছে এসে আমার চোখ খুলে গেছে। আমাকে এখানে আসতে দেখেই নানা মতলবে আপনাদের ফোন শুরু হয়ে গেছে। ওসব ফন্দিফিকির এখন আমি ভালোই বুঝি...
    তুমি একটা পাগল। বুড়ো অভিনেতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তারপর বলে উঠেছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি নির্বোধ। বোকার হদ্দ কোথাকার...
    ঠকাস করে অচ্যুৎ ফোন রেখে দিয়েছিল। কিন্তু তখনও সে হাঁপাচ্ছিল। আর নাবিকটি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল।
    অচ্যুৎ একটু শান্ত হওয়ার পর নাবিকটিই প্রথম বলেছিল, একটু জল খাবেন?
    অচ্যুৎ তখনও উত্তেজিত। ক্রুদ্ধ স্বরেই সে বলে উঠেছিল, আপনি তো সবই শুনেছেন, তাই না?
    নাবিকটি মাথা নেড়েছিল।
    এই লোকটিকে আমি একটুও প্রশ্রয় দিতে চাই না। লোকটি একটা ভণ্ড। অবশ্য আগে সেটা বুঝিনি।
    এরকমই হয়। নাবিকটি বলে উঠেছিল, এখানে এলে মানুষ নতুন করে অনেক কিছু বোঝে। তারপর প্রসঙ্গ পালটে সে হঠাৎ জানতে চেয়েছিল, জীবনে আপনি এটাই চেয়েছিলেন, তাই না? এই যে, বাবার এত কাছাকাছি আসা...
    বহুক্ষণ পর অচ্যুৎ যেন এমন একটা কথা শুনল, যা তার মনের মতো। যে কথার কোনো অর্থ আছে। তাৎপর্য আছে। নইলে, বুড়ো অভিনেতার ওই অর্থহীন প্রলাপ তার জীবনে কোন্‌ কাজে আসবে?
    সম্মতি জানিয়ে সে বলে উঠেছিল, ঠিক বলেছেন।
    কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়েও গেছিল সে। ওর অন্তঃকরণ খোলা খাতার মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই লোকটার চোখে। বুড়ো অভিনেতা বলতেন, নিজেকে কখনও পুরোপুরি মেলে ধরবে না কারও কাছে। গোপনতা জীবনের সৌন্দর্য । এই সৌন্দর্য না থাকা একটা দুর্বলতা। লোকে এই দুর্বলতার সুযোগ নেবেই।
    বুড়ো অভিনেতার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছিল। তিনি সবকথাই শুনেছিলেন। ফোনটা ঠিকমতো কাটেনি অচ্যুৎ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সেই হাসি দেখে তিনি নিজেই চমকে উঠেছিলেন। তাঁর অজান্তে, তাঁকে চমকে দিয়েই, তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই হাসিটা।
    সব শুনে নিমাই জানতে চেয়েছিল, আপনি এতবার ওকে দেখেছেন। আগে কখনও কিছুই বুঝতে পারেননি?
    বুড়ো অভিনেতা বিষণ্ণ স্বরে বলেছিলেন, ও চমৎকার অভিনেতা। আর ঠিক তোমাদের বাবার মতো। আমরা শুধু মঞ্চে অভিনয় করি। ওরা জীবনেও তাকে বাদ দেয় না।
    নিমাই সরলভাবে জানতে চেয়েছিল, এতে অসুবিধা কোথায়?
    বুড়ো অভিনেতা মর্মাহত অবস্থাতেও জোরে হেসে উঠেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, কোনো কিছুই বেশি বেশি ভালো নয়, বুঝলে? এত বেশি অভিনয় করলে, অভিনয়টাই শুধু থেকে যায়, জীবনটাই বাদ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে...
    পরে নিমাই নিজের নোটবুকে সবুজ কালিতে লিখেছিল, ‘বুড়ো অভিনেতার কথা সেদিন আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম। বাবার জীবনটাকে দেখে মনে হয়েছিল, খুব কম মানুষের ভাগ্যেই অমন জীবন জোটে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বুঝেছিলাম, খুবই দুর্ভাগা জীবন কাটিয়ে গেছেন বাবা। কারও ভালোবাসা পাননি তিনি। সবাইকে তিনি ব্যবহার করেছেন। সবাই তাঁকে ব্যবহার করেছে। লেনদেনের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না তাঁর জীবনে। নিজের পরিবারের মধ্যেও তিনি ছিলেন সম্পুর্ণ একা। তাঁর স্ত্রী এখন বেঁচে নেই। কিন্তু মেয়ে আছে। নাতনি আছে। মেয়ে তাঁকে বোঝে না, তাঁর সম্পত্তিকে বোঝে। তাঁর নাতনি কোনোদিন তাঁর কোলে ওঠেনি। তিনি নাকি দূর থেকে সেই নাতনিকে লক্ষ্ করতেন। মিটিমিটি হাসতেন। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তোলার আগ্রহ দেখাতেন না। ভয় পেতেন, যদি বেশি জড়িয়ে যান। তাঁর স্ত্রীর জীবনের শেষ কথা নাকি ছিল, ওরে, তুই আর তোর মেয়ে সবসময় মনে রাখবি, উনি আগে সেলিব্রিটি, তারপর তোদের বাবা আর দাদু। ওরা তাই মনে রেখেছে। কোনোদিন বাবার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেনি।’




    ঠিক এই সময় একটি মেয়েকে দেখা গেল। উসকো খুসকো চুল। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। জামাকাপড় ময়লা। কিন্তু অত্যন্ত সুন্দরী। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বগল পরিষ্কার করে কামানো। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাবা জানতে চাইলেন, আরে, ধ্রুপদী যে, কোত্থেকে আসছ?
    একটা প্রতিবাদ মিছিলে গেছিলাম।
    তা বেশ করেছ। কীসের প্রতিবাদ মিছিল ছিল?
    এই যে, উচ্চমেধার প্রতি অবিচার, আর নিম্নমেধার তেল মেরে মেরে উত্থান, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, এসব রুখতে হবে বলে প্রতিবাদ করছিলাম।
    কীভাবে প্রতিবাদ করছিলে?
    খুব চেঁচামেচি করেছি। মানে গলা ফাটিয়ে গালিগালাজ আর কী!
    আমি জীবনে কখনও কাউকে গালাগালি দিইনি। মৃদু স্বরে বললেন বাবা।
    কিন্তু ওতে খুব কাজ হয়। ধ্রুপদী একরোখা ভাবে বলল।
    কেন জানি, বিষণ্ণ অথচ ঠান্ডা গলায় বললেন বাবা, ওটা আমার ঠিক আসে না।
    ধ্রুপদী এবার একটু থমকে যায়।
    বাবা আবার জানতে চান, ক-জন ছিলে তোমরা?
    মোট সতেরো জন। বেশিরভাগই বয়স্ক। আমার বয়সই বোধহয় সবচেয়ে কম। মাত্র একুশ।
    তা আমার কাছে কেন? আলতো হেসে বাবা জানতে চাইলেন। খুব মিষ্টি সেই হাসি। দেখলেই মন কেমন করে ওঠে।
    আর কার কাছেই বা যাব, বলুন তো? আপনি ছাড়া এই দেশে আর একটাও প্রতিবাদী স্বর আছে? আপনার প্রচণ্ড মেজাজ, রোষ, স্পর্ধা, ঔদ্ধত্য, আবেগ আমাদের প্রেরণা। আপনার পোস্টার নিয়ে আজ আমরা মিছিল করেছি। আপনার নাম করে স্লোগান দিয়েছি। বলেছি, আপনি তারুণ্যের প্রতীক। আপনি যৌবনের প্রতীক। আপনিই আমাদের পথ দেখাতে পারেন...
    হঠাৎ সেই নিষ্ঠুর বৃদ্ধের ছবিটা নিমাইয়ের চোখে ভেসে উঠল। মনে হল, বাবা যৌবনের দূত হলে ওই বৃদ্ধটি কে ছিলেন?
    এরকম প্রতিবাদ মিছিলে জীবনে কতবারই না অংশ নিয়েছি! বিষণ্ণ স্বরে হঠাৎ বলে উঠলেন বাবা।
    জানি, আমরা সবই জানি।
    কত প্রতিবাদ সভায় গেছি!
    কে না জানে সেকথা!
    প্রতিবাদ-সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম আমি এক সময়...
    আর সেই যে চড় মেরেছিলেন একবার? ধ্রুপদী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল।
    বাবার ভুরু কুঁচকে গেল। অনেক চেষ্টা করে যেন মনে করলেন। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তাঁর। তারপর শান্তস্বরে বললেন, মেরেছিলাম না? কাকে যেন?
    আরে, ওই যে, কোথায় যেন ইন্টারভিউ দিতে গেছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল আপনাকে। তারপর উলটোপালটা প্রশ্ন শুরু করতেই প্রশ্নকর্তাকে রেগে গিয়ে এক চড়...
    হো হো করে হেসে উঠল ধ্রুপদী। তারপর বলল, আর সেই যে একবার, টিউশনি করতে গিয়ে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন ছাত্রীর বাবাকে? সেই লোকটা নাকি বলেছিল, জুতো না পরে চটি পরে এসেছেন কেন পড়াতে? আপনি সপাটে জবাব দিয়েছিলেন, এই চটির টাকায় একটা জুতো কিনে এনে আমাকে দেখান দেখি! তখন সেই লোকটি কী একটা বলতেই তারই একটা জুতো তার মুখে ছুড়ে মেরে আপনি বলে এসেছিলেন, জুতো কেনার পয়সা থাকলে এভাবেই জুতো ছুড়ে মারতাম আপনাকে, টিউত্তানি করতে আসতাম না...
    বাবার মুখ গভীর তৃপ্তিতে ভরে উঠল। কিন্তু তিনি যেন কিছুই ঠিক ধরতে পারছেন। বুঝতে পারছেন না। নিষ্পাপ মুখ তুলে তিনি জানতে চাইলেন, কোত্থেকে জানলে এসব?
    কে না জানে এসব! ধ্রুপদী বলে উঠল, আমাদের মধ্যে সবসময়ই আলোচনা হয় এসব নিয়ে। টিভিতে, নেটে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে একটু কান পাতলে, চোখ খোলা রাখলেই এসব শোনা যায়, জানা যায়।
    নাবিকটি অচ্যুতের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ফিসফিস করে অচ্যুতের কানে কানে সে বলল, ভালোই মিথ ছড়িয়েছে বাবাকে নিয়ে। ওইসব টিভি, নেট, অডিটোরিয়াম, ফাংশনের হর্তাকর্তারা সকলেই বাবার বন্ধু। তারাই ছড়িয়েছে এসব। তারাই বাবাকে মানুষের চোখে বানিয়েছে মহানায়ক। ভগবান। অবশ্য বাবারই পরামর্শে।
    নিমাই শুনতে পেল সবই। তার মনে পড়ল একটু আগের কথাবার্তা ।
    অচ্যুৎ তখন বলছিল, আসলে বাবাকে দিয়ে তাদের ভালো ব্যাবসা হয়। তাদের পক্ষে বাবা নিরাপদ। সেই কারণেই বাবাকে তারা মিথ বানিয়ে দিয়েছে আমাদের দেশে লোকে ওসবে খুব বিশ্বাস করে তো... নাবিকটি হেসে বলল, কিন্তু এই মেয়েটি যে অন্য রকম ভাবছে। অর্থাৎ, যেভাবে তাকে ভাবানো হচ্ছে, তার বাইরে সে যেতে পারছে না। অথচ উচ্চমেধার সপক্ষে সে প্রচারে নেমেছে!
    অচ্যুৎ বলল, সবটাই বেশ মজার, তাই না? মেয়েটি প্রতিবাদী। অথচ কার বিরুদ্ধে, কীসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সে জানে না। প্রতিবাদী নায়ক হিসেবে বাবাই ওর কাছে আদর্শ। বাবার নামে যেসব প্রচার চালু আছে, সেগুলোকেই ও বিশ্বাস করে বসে আছে! একবারও ভাবছে না, যে আধিপত্য ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে ওদের প্রতিবাদ, তার মাথায় কে বসে আছেন!
    নাবিকটি বলল, এরা বোধহয় খবরের কাগজও পড়ে না। এই তো কিছুদিন আগে মৌসুমীকে জড়িয়ে বাবা কাগজের হেডলাইন হয়ে গেলেন। কী কুৎসা! বাবা গায়ে মাখলেন? ওই কাগজেই পরদিন একটা বিরাট ইন্টারভিউ দিলেন। আমি পর্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, দিলেন কেন? পাত্তা না দিলেই ওরা থমকে যেত। সেটাই হত প্রতিবাদ। বাবা বললেন, যারা কুৎসা করেছে তাদের আমি চিনি না। ওখানে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। তারা চেয়েছে বলেই আমি ইন্টারভিউ দিয়েছি। বাবা এতদূর আপস করতে পারেন। কাউকে তিনি শত্রু বানাবেন না। তারপরও এরা বাবাকে প্রতিবাদী ভাবে!
    নিমাই এই মৌসুমীর দেখা পেয়েছিল পরে।
    বাবার দিকে তাকিয়ে ধ্রুপদী হঠাৎ বলে উঠল, আমরা প্রতিবাদী যুবক সমিতির তরফ থেকে আপনাকে একটা সংবর্ধনা দিতে চাই। সে কারণেই আজ আসা...
    ফিসফিস করে নাবিকটি বলল, বাবা ত্রিশ বছর আগে প্রতিবাদী ছিলেন। তাও দু-এক বারের জন্য।
    অচ্যুৎ বলল, মেয়েটি ত্রিশ বছর আগেই রয়ে গেছে। তার পরের ব্যাপারটা ও জানে না।
    অথচ ওর প্রতিবাদটা এই সময়ের সমস্যা নিয়ে।
    আরে, এখানেই তো এই প্রতিবাদীদের নিজেদের ভেতরের যত গোঁজামিল!
    হ্যাঁ, এরা শুধু প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ করে। আর কিছুই তলিয়ে দেখে না।
    এরা কখনই মাথা খাটায় না। অন্ধভাবে প্রচারগুলোকে বিশ্বাস করে। আর তার ভিত্তিতেই প্রতিবাদ করে।
    এদের প্রতিবাদ সবসময়ই ভিত্তিহীন, ফাঁপা, কোনো জোর নেই তাতে, এদের কথায় কেউ তাই কর্ণপাতও করে না, শুধু শুধু চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে এরা পচতে থাকে...
    বেশ তো! বাবা বললেন, আমার ব্যস্ততা একটু কমুক...
    আপনি আসছেন তাহলে, ঠিক তো? ধ্রুপদী বলল।
    হ্যাঁ, নিশ্চয়ই । বাবা হাসলেন, যেখানে প্রতিবাদ...
    আপনার বন্ধু, মানে চিন্তাবিদ ভক্তিচরণও এরকম ছিলেন, তাই না?
    বাবা চুপ করে আছেন। ধ্রুপদী বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহী না হয়ে বলেই চলল, ভক্তিবাবুকেও একটা সংবর্ধনা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমাদের। কিন্তু উনি যে অকালে চলে গেলেন...
    বাবার ভূরু কুঁচকে আছে। ধ্রুপদী বলে যাচ্ছে, উনিও খুব প্রতিবাদী ছিলেন, তাই না? আপনার বক্তৃতাতেই তো শুনেছি, গত বছর আমাদের দ্বীপে গিয়ে বলেছিলেন, কত কথা সেবার আপনার ওঁকে নিয়ে, সত্যিই কী মানুষ ছিলেন, আর কী প্রতিভা, অদ্ভুত অদ্ভুত সব কীর্তি, প্রকৃত বোহেমিয়ান আর কী, সেই যে একবার...
    বাবা হঠাৎ কেন জানি রেগে গিয়ে বলে উঠলেন, না, না, এসব নিছক গালগল্প, আসল কথাটা হল...
    যেভাবে শুরু করেছিলেন, সেভাবেই অতর্কিতে তিনি থেমে গেলেন। নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর বললেন, বলে যাও...
    ধ্রুপদী বলল, কী যেন বলছিলেন আপনি, আসল কথা...
    সে তো তুমি জানই। বাবা সামলে নিয়েছেন নিজেকে, তোমাদের দ্বীপে গিয়ে আমিই তো বলে এসেছিলাম...
    খুব পড়াশুনো করতেন উনি, তাই না? আর এই অভ্যাসটা ওঁর আপনার কাছ থেকেই পাওয়া...
    বাবার ভুরু আবার কুঁচকে গেছে।
    ধ্রুপদী হঠাৎ জানতে চায়, আপনি খুব বই পড়েন, তাই না?
    সারাদিনই। বাবা বললেন।
    সত্যি, এত ব্যস্ততা আপনার, অথচ দেশ-বিদেশ, ক্লাসিক-পপুলার, সাহিত্য-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন, সবই আপনার নখদর্পণে। এত পড়েন কখন?
    সবসময়ই পড়ি। মানে, যখনই সুযোগ পাই। বই ছাড়া আমি থাকতে পারি না। বাবা একটু উসখুশ করছেন এখন। দেখেই মনে হচ্ছে, অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর।
    ধ্রুপদী উঠে দাঁড়ায় এবার। তারপর বলে, তাহলে ওই কথাই রইল। আমাদের ওখানে আপনি যাচ্ছেন...
    ধ্রুপদী ঘরের চারদিকে চোখ বোলায়। একটাও বই নেই। বাবার অস্বস্তি আরও বাড়ে। ধ্রুপদী আবার জানতে চায়, আপনার বইগুলো সব কোথায় গেল বলুন তো?
    বাবা বলেন, অন্য ঘরে আছে। তোমাকে নিয়ে যাব একদিন।
    বাবা যে ঘরটির কথা বললেন, সেখানে নিমাই একবারই ঢুকেছিল। একটা ফাইল খুঁজতে যেতে হয়েছিল সেই ঘরে। খুব ভোরে। সঙ্গে নাবিকটি ছিল। এই ঘরটিকে বাবা নিজের লাইব্রেরি বলে থাকেন। কিন্তু সেখানে কোনো সিরিয়াস বই-ই ছিল না। বাবা সিরিয়াস বই পড়েন, অথচ কোথাও তার কোনো চিহ্নই নেই!
    নিমাই একটু অবাক হয়েই ভেবেছিল, যিনি প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান করেন, নতুন নতুন লেখক, বই ও চিন্তাকে আয়ত্ত করতে চান, এটা তো তাঁর লাইব্রেরি হতে পারে না। আর তখনই একটা সন্দেহ পাকিয়ে উঠেছিল তার ভেতরে। নিজেকে সে প্রশ্ন করেছিল, ওই যে বাবা সব জায়গায় বলেন, তিনি অক্লান্ত পাঠক। সবসময় বই পড়েন। তাহলে কী এখানেও অভিনয়?
    বাবা অনেকক্ষণ ধরেই উসখুশ করছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, তুমি সার্টিফিকেট পেয়ে গেছ?
    নাঃ! ধ্রুপদী গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ।
    চাও না বোধহয়, তাই না? তুমি তো প্রতিবাদী!
    দূর, কী যে বলেন! ধ্রুপদী বলল। সার্টিফিকেট ছাড়া...
    বাবা মিটিমিটি হাসছেন। তিনি ধ্রুপদীর ভরাট বুকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, এবার যখন এসেছ, ওটা নিয়েই যেও। তোমার প্রাপ্য...
    ধ্রুপদী চিন্তিতভাবে বাবার দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ হেসে উঠে বলে উঠল, ওঃ বাবা! আমি কোথায় থাকব? ওঃ নাবিক! আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলো...
    বাবা! বিস্ময় আর সারল্য মিলেমিশে নিমাইয়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
    ওঁকে বাবা ডাকতে পেরে আমি ধন্য। ধ্রুপদী বলে উঠল। নিজেকে ওঁর সন্তান ছাড়া কিছুই মনে হয় না আমার।
    ধ্রুপদী নাবিকের সঙ্গে নিজের বাংলো দেখতে চলে যাওয়ার পর বাবা যেন স্বগতোক্তি করেই বললেন, এখন কী আর ওইভাবে বই পড়ার বয়স আছে আমার? এখন ওপর ওপর দেখে যাই, গোটা একটা বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার বয়স পেরিয়ে এসেছি আমি, সেই বয়স এখন তোমাদের...
    বই পড়ার আবার বয়স আছে না কী! অচ্যুৎ ফিসফিস করে বলল নিমাইকে।
    নিমাই কিন্তু সরাসরিই জানতে চাইল, ধ্রুপদীকে সেকথা বললেন না কেন?
    একটু গম্ভীর হয়েই বাবা বললেন, সবাইকে সব কথা বলা যায় না, বুঝলে? বোঝানোও যায় না...
    সেদিন নিজের নোটবুকে সবুজ কালিতে নিমাই লিখেছিল, ‘এখানে সবটাই অভিনয়। অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে গেছি আমি। বাবা প্রতিষ্ঠানেরও কাছের মানুষ। আবার তিনি প্রতিবাদীদেরও কাছের মানুষ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবাদ তো পরস্পরের বিরোধী। ক্ষমতা বাবাকে নিজেদের লোক ভাবে। আবার ক্ষমতাহীনও বাবাকে নিজেদের লোক ভাবে। বাবা সবার কাছেই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। সবার কাছেই ‘ডার্লিং’। বুড়ো অভিনেতা সবার অপ্রিয়। তিনি কারও কাছেই নিজের লোক নন। তিনি সর্বদা সত্য কথা বলেন। কিন্তু এখানে কেউ সত্য কথা বলে না। অচ্যুৎ সুবিধাবাদী। ধ্রুপদী প্রতিবাদী। ওদের মধ্যে বেশ বনিবনা আছে। কোথাও একটা মিল আছে ওদের। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। হয়তো তার কারণ, আমি ওদের মতো নই। প্রতিবাদ আমার আসে না। সুবিধাবাদও নয়। আমি মুখের ওপর সরাসরি কথা বলি। নিজের মনের কথা। নিজের শিল্পচর্চার মধ্য দিয়েও নিজের আত্মাকেই প্রকাশ করতে চাই। কোনো আড়াল বা চাতুরি আমার পছন্দ নয়। কিন্তু আমার সার্টিফিকেট নিয়ে বাবার কোনো উৎসাহ নেই। এ নিয়ে কোনো কথাই উনি তোলেন না। আমি তুলতে চাই। আমার গলার কাছে এসে আমার আবেদন আটকে থাকে। উনি সেটা বোঝেন মনে হয়। আর বোঝেন বলেই ইচ্ছা করে যেন এড়িয়ে যান। আমাকে কোনো সুযোগ দেন না। আমি বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেছি...।”




    দুপুরবেলা নিজের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বুড়ো অভিনেতার কথা মনে পড়ল নিমাইয়ের। কয়েক মাস আগের কথা। মা তখন অসুস্থ। দুদিন ধরে জুর কিছুতেই কমছে না। মা খাটে শুয়েছিলেন, দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে। সেই দেয়ালেই ছিল বাবার একটা মস্ত পোস্টার। সোজাসুজি মা-র দিকেই তাকিয়ে আছেন।
    বুড়ো অভিনেতা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জানেন। মা-কে দেখে ওষুধ দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে, এখানে উনি কেন?
    তাঁর কথা বলার ধরনে শ্রদ্ধাবোধের বিশেষ অভাব। বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে ভক্তি আর বিরাগ, দুটোরই বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে। ইনি নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমানকে খুব একটা পছন্দ করেন না!
    নিমাই খুব শান্তস্বরে বলেছিল, ওঁর ছবি ছাড়া আর কার ছবিই বা থাকবে? উনিই তো এই সময়ের নায়ক। গোটা জাতির নায়ক। আমরা সবাই ওকে অনুসরণ করতে চাই।
    কেন? সরলভাবেই উনি জানতে চাইলেন।
    ওঁর মতো ক্ষমতাবান, ওঁর মতো চিন্তাবিদ এদেশে আর কেউ আছেন? ক্ষমতা আর চিন্তা, দুটোই যার আয়ত্তে আছে, তার সামনে এমনিই মাথা নুইয়ে আসে না?
    আমি ওঁকে অনেকদিন ধরেই চিনি। অবশ্য খুব গভীরভাবে জানি না। শুনেছি ওঁর ব্যাবসাবুদ্ধি খুব প্রখর! রাজনীতিটাও খুব ভালো বোঝেন। হাতে প্রচুর ক্ষমতা। অথচ নিজেকে সংস্কৃতি জগতের মানুষ বলেই দেখাতে পছন্দ করেন। বৃদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলেন।
    নিমাই চুপ করে রইল। বুড়ো অভিনেতার কথাটা সে ঠিক বুঝতে পারেনি।
    আমি বুঝিয়ে বলছি, বুড়ো অভিনেতা বললেন, আসলে উনি যত বড়ো চিন্তাবিদ, তার চেয়েও অনেক বেশি ব্যবসায়ী! একথা ঠিক, ওঁর অর্থ, যশ, সাফল্য, ক্ষমতার কোনো শেষ নেই। এ দেশে সবকিছুরই মাথায় বসে আছেন উনি। কিন্তু নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ওঁর মতো করে কেউ বিক্রি করতেও পারেন নি! অবশ্য এসবই আমার শোনা কথা...
    নিমাই আবারও শান্ত স্বরে বলেছিল, আমাকে আরও একটু বুঝিয়ে দিন। আপনি এমনভাবে বলছেন, যেন বিক্রয়যোগ্য মানেই সস্তা। তা তো নয়! বরং বিক্রয়যোগ্য মানে তাই, যার চাহিদা আছে। আর চাহিদা এমনি এমনি তৈরি হয় না। মানুষ অকারণে কানাকড়িও খরচ করে না। দরকার আছে বলেই লোকে ওঁর চিন্তার কাছে যায়...
    চাহিদা কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা যায়। বৃদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলেন। তারপর যোগ করলেন, আর সেটাই বেশিরভাগ সময় হয়। মৌলিক চিন্তাগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছোতে দেওয়া হয় না। ওইসব চিন্তা মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়, মানুষকে অস্থির করে তোলে, মানুষকে ভাবায়, মানুষকে বদলে দেয়। কিন্তু ক্ষমতা ও ক্ষমতার প্রতিনিধিরা তা চায় না। তারা চায়, যেমন চলছে তেমনই চলুক। সেটাই তাদের পক্ষে সুবিধেজনক। তাই মানুষকে ব্যস্ত রাখা হয় এমন সব মামুলি চিন্তায়, যাতে মগজ না খাটালেও চলে। তাদের ভাবানো হয় না। ভাবতে দেওয়া হয় না। আর এতেই তারা ভালো থাকে, স্বস্তিতে থাকে। কে আর সহজে অস্বস্তিতে পড়তে চায়? এমনিতেই মানুষের কত সমস্যা...
    বৃদ্ধের কথাগুলি মনে পড়ায় হঠাৎ নিমাইয়ের ভুরু কুঁচকে গেল।
    অন্যমনস্কভাবেই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। চমকে লক্ষ করল, পাশেই কখন এসে দাঁড়িয়েছে ধ্রুপদী। ঝলমল করছে মুখ। এলোমেলো চুল উড়ছে বাতাসে। এমন একটা গেঞ্জি পরেছে যাতে বুকের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। এমনিতেই সে অসামান্য সুন্দরী। তার ওপর ওই সামান্য নগ্নতা তাকে যেন আরও বেশি মোহময়ী করে তুলেছে।
    সৌন্দর্য দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না নিমাই। এই দুনিয়ায় সৌন্দর্যের খুব অভাব। নিমাই তাই সৌন্দর্যের কাঙাল। কোথাও সামান্য সৌন্দর্য দেখলেই সে আকৃষ্ট হয়। তাকে খুঁটে খুঁটে সংগ্রহ করে। তারপর তাকে নিজের মনের ভেতরে জমিয়ে রাখে। যখনই সে হাঁপিয়ে ওঠে, সেই সৌন্দর্য থেকে ধার নিয়ে আরাম পায়। সেই সৌন্দর্যই তাকে বাঁচায়। তার স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ফিরিয়ে আনে।
    ধ্রুপদী মৃদু হাসল। তারপর প্রায় ফিসফিস করেই বলল, তোমাকে দেখতে ঠিক গ্রিক দেবতা আ্যাপোল্লোর মতো। আমার আগে কেউ বলেছে একথা?
    নাঃ! নিমাই হাসল।
    বাবার সামনে তোমাকে চিনতে পারিনি। পরে নাবিকটির কথায় বুঝলাম। একবারই তোমার অভিনয় দেখেছি। অসামান্য।
    আমি শুধু মঞ্চেই অভিনয় করি। নিমাই বলল।
    ধ্রুপদী একটু অবাক হয়েই তাকাল। তারপর বলল, অভিনয় তো মানুষ মঞ্চেই করে!
    আমিও তাই জানতাম। কিন্তু আমার ভুল ভেঙে গেছে।
    কেন?
    যে জাত অভিনেতা, সে এক মুহূর্ত অভিনয় না করে বাঁচতে পারে না। নিজের ব্যর্থতা এখন আমি বুঝতে পারছি।
    ধ্রুপদীর মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর বলল, তুমি তো সার্টিফিকেট নিতে এসেছ। পেয়ে গেছ নাকি?
    নাঃ! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিমাই।
    তুমি তো শুনলাম, অভিনয় ছাড়া এখানে সব কাজই করছ। এক কথায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছ।
    রাতদিন ফাইল গোছাচ্ছি আমি।
    এরপর সার্টিফিকেট তোমার কোন্‌ কাজে আসবে? ধ্রুপদী তীব্র শ্লেষে বলে উঠল, অভিনয়ের চেয়ে প্রতিবাদটাই আমার ভালো আসে। তবু বলছি, তোমার অভিনয় মানুষকে ভাবায়। আর তুমি এমন একটা কাজ করছ, যেখানে মগজ ছাড়া আর সবকিছুই লাগে। এখানে কেউ তোমাকে অভিনেতা ভাবে না। সবাই ভাবে, তুমি নিছক একজন অধঃস্তন কর্মচারী। ভৃত্য। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে যে একটি জরুরি কাজ করছে! জরুরি, আর সেটাও বাবার পক্ষে। তোমাকে সবাই ফাইলের লোক বলে ডাকছে। চিনছে। তোমার কী হবে এতে? কোথায় পৌঁছোবে তুমি? এরপর সার্টিফিকেট পেলেও লোকে তোমাকে ফাইল ছাড়া চিনতেই পারবে না...
    তুমি আমার ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কী করে? একবারই তো...
    পরমাও আমাকে তোমার কথা বলেছে।
    পরমা! চমকে উঠল নিমাই।
    বাবার মেয়ে। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। ও আরও বলেছে...
    নিমাই চমকে তাকাল। জানতে চাইল, কী বলেছে?
    থাক সে কথা। একটু যেন লজ্জা পেল ধ্রুপদী।
    নিমাই বলল, না, বলতেই হবে তোমাকে...
    বলেছে, তোমার সঙ্গে আমাকে দারুণ মানায়। আমরা যেন গ্রিক দেব-দেবী। তুমি যদি অ্যাপোল্লো হও, কথাটা শেষ করেই ধ্রুপদী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।




    সন্ধে হয়ে এসেছে। নিমাই নিজের ঘরে বসে ফাইল গুছিয়ে চলেছে। নিমাইয়ের নিষ্ঠা সত্যিই দেখার মতো। সারা দুপুর ধরে ও একটার পর একটা ফাইল গুছিয়ে গেছে। একটুও দমে যায়নি, একবারও হাল ছাড়েনি। কত নতুন ভাবনা খেলে গেছে ওর মাথায়। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ও বিস্ময়কর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়ে চলেছে। এ ব্যাপারে ওর দক্ষতা কম হতে পারে। কিন্তু সৃষ্টিশীলতায় কোনো খামতি নেই। বাবার কাছে নিজের যোগ্যতা ও প্রমাণ করেই ছাড়বে। অদম্য জেদে তাই ও কাজ করে চলেছে। তার ঘরে কাগজপত্র ডাই হয়ে উঠেছে। কোন্‌ ফাইলে কোন্‌ কাগজ ঢুকবে, আলাদা আলাদা করে সে তাদের সাজিয়েছে। ফাইলগুলোকেও সে পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছে। তাদের প্রত্যেকের নাম দিয়েছে। এখন সে কাগজ বুঝে ফাইলে ঢোকাচ্ছে। ফাইল ছাড়া তার মনে অন্য কোনো ভাবনা নেই।
    এই সময় ধ্রুপদী এসে ঢুকল ওর ঘরে। প্রথমেই সে জানতে চাইল, নিজের অভিনয় নিয়ে সারাদিনে কিছু ভেবেছ?
    না, ফাইল গুছোতে গুছোতেই নিমাই বলে উঠল, সময় পেলাম কোথায়? তবে...
    তবে কী?
    এটাও ঠিক, ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
    সে তো লাগবেই। গভীর সহানুভূতির সুরে ধ্রুপদী বলল।
    কেন? বিষণ্ণ মুখে নিমাই জানতে চাইল।
    তুমি তোমার আসল কাজে ফাঁকি দিয়েছ। তাই তোমার ভেতরটাও ফাঁকা হয়ে গেছে।
    কী বলতে চাইছ তুমি? নিমাই কৌতূহলী হয়ে তাকাল।
    দ্যাখো, যা করছ ঠিক আছে, একটু দম নিয়ে সে শেষ করল, এটা কিন্তু তোমার আসল কাজ নয়...
    এটা বাবার কাজ...
    হ্যাঁ, ঠিকই...
    বাবার কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপুর্ণ আর কী হতে পারে?
    ঠিকই। ধ্রুপদী মেনে নিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
    তাহলে? হঠাৎ ফাইল গুছানো থামিয়ে নিমাই উৎসুক হয়ে ধ্রুপদীর মুখের দিকে তাকাল।
    আসলে কথাটা কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
    না, না, বলোই না। নিমাই ধ্রুপদীকে আশ্বস্ত করল।
    সে বলল, দ্যাখো, এটাই তোমার জীবনের সেরা সময়। তাই না? এই যৌবন, একবার চলে গেলে তুমি আর ফিরে পাবে? তুমি যে কাজটা সবচেয়ে ভালো পার, সেটা হল অভিনয় করা। সে ব্যাপারে তোমার প্রতিভা ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আর মানুষ যে কাজটা সবচেয়ে ভালো পারে, সেই কাজেই তার জীবনের সেরা সময়টা দেওয়া উচিত, তাই না? সময় কিন্তু কারও জন্য থেমে থাকবে না।
    কী বলতে চাও তুমি?
    তুমি সেটা ভালোই বুঝতে পারছ। জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। তোমাকেও করতে হচ্ছে। কিন্তু ফাইল গোছানো তোমার জীবনে মুখ্য কাজ নয়। আসলে কোনো কাজই নয়। তুমি যতই ভালো ফাইল গোছাও, শেষপর্যন্ত কিছুই হয়ে উঠতে পারবে না। একজন ধনুর্বিদকে যদি চাষ করতে পাঠানো হয়, একজন চিত্রকরকে যদি সাঁতার কাটতে পাঠানো হয়, একজন স্থপতিকে যদি কুস্তি করতে পাঠানো হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য হয়ে উঠবে না? তখন তাদের যা হবে, তোমারও ঠিক তাই হয়েছে। তাই বলছি, ফাইল গুছোচ্ছ, ভালো কথা, কিন্তু অভিনয়ের ব্যাপারটা মন থেকে মুছে দিও না। দিনে যখনই হোক, ওটা নিয়ে একটু ভেবো। অভ্যাসটা বজায় রেখো। গুণী মানুষকে তার সেরা প্রাপ্য
    তার সবচেয়ে বড়ো যেটা গুণ, একমাত্র সে-ই ফিরিয়ে দিতে পারে। তুমি যদি তার পিছনে সময় দাও, তবে সে তোমাকে যা দেবে, আর কেউ তা দিতে পারবে না।
    কিন্তু আমার মাথায় সব কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। একমাত্র ফাইল গুছোতে বসলেই আমার মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া আসছে। ফাইল গোছানোর সময় সবসময়ই আমার চোখের সামনে ভাসছে বাবার মুখ। বাবা যেন সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিবিষ্ট হয়ে আমাকে লক্ষ করছেন। আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর খুশি, তাঁর হাসিমুখ ছাড়া আর কিছুই আমার কাম্য নয়। আমি যদি ফাইল ছেড়ে এখন অভিনয় নিয়ে বসি, বাবার ওই হাসিমুখ হারিয়ে যাবে...
    নিমাইয়ের কথা ধ্রুপদী বুঝতে পারল। নিমাইয়ের মগজের পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন বাবা। বাবার শক্তি বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু এইসব ঘটনাতেই বোঝা যায় কেন তাঁকে ‘সর্বশক্তিমান’ বলে ডাকা হয়!
    এমন সময় ঘরের দরজায় কে টোকা মারল। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নাবিকটি উঁকি মারল। নিমাইয়ের কাছে একটু এগিয়ে এসে সে বলল, বাঃ, আপনার ফাইল গুছানো তো চমৎকার চলছে!
    সবই বাবার জন্য হয়েছে। নিমাই বলল।
    বাবার চোখই আলাদা। নাবিকটি একটু আগের প্রশস্তিটিকে আরও একটু টেনে বলল, উনি জহুরির মতো। যার ভেতরে যাই থাক, ঠিক চিনে নেবেন।
    আর তখনই চমকে উঠল নিমাই। নাবিকটির কথায় সে যেন একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেল। সে একজন অভিনেতা। একজন শিল্পী। নিজের অস্তিত্বকেই এভাবে অস্বীকার করে চলেছে সে? কেউ যেন তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই কথাগুলো তার হতে পারে না। তার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ল।
    ধ্রুপদী নিমাইয়ের মুখের দিকেই তাকিয়েছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, আজ সন্ধেবেলা তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ আবেদন নিয়ে। আমি তোমার অভিনয় দেখতে চাই...
    নিমাই খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, নাঃ, আজ আর হবে না বোধহয়।
    কেন, হবে না কেন? ধ্রুপদী জেদ করেই বলল।
    নিমাই দু’হাত দিয়ে মাথার চুল আঁকড়ে একটু যেন মরিয়া হয়েই বলে উঠল, বাবা ও বাবার কাজ ছাড়া এখন আর আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমার অস্তিত্বই যেন লুপ্ত হয়ে গেছে। বাবাই গ্রাস করে নিয়েছেন সবটুকু।
    ও। বলেই ধ্রুপদী স্তব্ধ হয়ে গেল একদম। তারপর বলল, সার্টিফিকেটটা তোমার নিতান্তই দরকার দেখছি!
    হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি। নয়তো সব বদলে যাবে। এখানকার পরিবেশই বদলে দেবে আমাকে। এখানে আসার আগে আমার মধ্যে একা আমিই ছিলাম। এখন বাবা ছাড়া আর কেউ নেই...
    তুমি? তোমার মধ্যে তুমি কোথাও নেই? ধ্রুপদী শেষ একটা চেষ্টা করতে চাইল।
    নাঃ! বিষণ্ণ গলায় জবাব দিল নিমাই।




    বুড়ো অভিনেতা এসেছিলেন নিমাইয়ের বাড়িতে। খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। তিনি বারবার মাথা নাড়ছিলেন আর উদ্‌বিগ্ন হয়ে বলছিলেন, না, না, সার্টিফিকেটটা নিমাইয়ের একান্তই দরকার!
    নিমাইয়ের মা শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন, ও কী সার্টিফিকেটটা পাবে না?
    সর্বশক্তিমান একটু বেশিই সময় নিচ্ছেন। এটা ভালো নয়। তা ছাড়া নিমাইয়ের কিছু সমস্যাও আছে।
    পুরোনো বন্ধু হলেও সর্বশক্তিমানকে ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করলেন বুড়ো অভিনেতা। এদেশের এটাই রেওয়াজ।
    সমস্যা? নিমাইয়ের মা তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালেন। একটু বুঝিয়ে বলবেন?
    তাহলে খাঁটি কথাটাই শুনুন। মেধা আর প্রতিভা সর্বশক্তিমানের দু-চোখের বিষ। কারও মধ্যে সামান্য ওসবের আভাস পেলেই উনি ভেতরে ভেতরে ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। ওঁর পছন্দ দুর্বল লোকেরাই, মানে, ওসব যাদের নেই, তাদেরই। পুরোনো বন্ধু হিসেবে জানি, শিক্ষিত ও বিদগ্ধ লোকেদের ভেতরে ভেতরে উনি একদমই পছন্দ করেন না। এরকম বহু লোককে উনি ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছেন। তাদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। যদিও বাইরে উনি কখনোই সেটা প্রকাশ করেন না। ওঁর বন্ধু ভক্তিচরণ প্রকাশ্যেই এসবের নিন্দা করতেন। জ্ঞানী মানুষদের, জ্ঞানের প্রতি আগ্রহকে সহ্য করতে পারতেন না। উনি অত কাঁচা কাজ করেন না। উনি জানেন ওসব করলে বিদেশে, বাইরের জগতে, বিদগ্ধমহলে ওঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু নিজের ডেরায় উনি এসব বিশেষ পছন্দ করেন না। শিক্ষা, জ্ঞান মানুষকে সতর্ক করে দেয়, তাদের হুঁশ বাড়িয়ে দেয়। তখন সহজে তাদের ব্যবহার করা যায় না। মগজধোলাই করা যায় না। মানুষ তখন প্রশ্ন করে। নিমাইকে ভেতরে ভেতরে অপছন্দ করার ওঁর বিশেষ কারণ রয়েছে। নিমাই জ্ঞানার্জনের প্রতি বেশি কৌতূহল দেখিয়ে ফেলেছে। আর উনি সেটা বুঝে ফেলেছেন।
    কিন্তু কেন উনি এমন করেন? অবাক হয়ে জানতে চাইলেন নিমাইয়ের মা।
    আরে, এটাই ওঁর রণকৌশল। উনি সব জায়গায় দুর্বলদেরই সুযোগ দেন, তাদেরই তুলে ধরেন, প্রশস্তি করেন, পুরস্কার পাইয়ে দেন। বড়োকে ছোটো করে রাখা আর ছোটোকে বড়ো করে তোলা, এটাই ওর নীতি। এতে বেশ নিরাপদ থাকা যায়। বড়োকে ছোটো করে রাখলে তাকে ইচ্ছামতো লেজে খেলানো যায়। ছোটোকে বড়ো করে রাখলে কোনো আশঙ্কা থাকে না, উপরি তোষামোদও জোটে বেশ। তা ছাড়া ছোটো অনেক। তারা জোট বাঁধে। ইয়েস-ম্যানও দরকার অনেক। বড়ো বেশি নেই। তা ছাড়া তারা নিজেদের মতো একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। তাই তাদের তোষামোদ করে বা লোভ দেখিয়ে বাগে আনাও সোজা।
    আমাকে আরও একটু স্পষ্টভাবে যদি বুঝিয়ে দেন! একটু বিভ্রান্ত হয়েই বলে ওঠেন নিমাইয়ের মা।
    আসলে ওঁর মনে খুব ভয়। উনি জানেন দুর্বলেরা কখনও ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না। কিন্তু মেধাবীরা পারবে। তারা ওঁর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে পারবে। কিন্তু উনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে চান। তাই উনি মেধাবীদের চেপে দেন। তাদের উঠতে দেন না। নিমাইকে উনি শেষপর্যন্ত সার্টিফিকেট দেবেন কি না, এই কারণেই তা নিয়ে আমার মনে সংশয়। নিমাইয়ের মধ্যে সত্যিই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এমন অনেকে আছে যাদের নিয়ে সেই ভয় নেই। তারা কোনোদিনই কিছু হয়ে উঠতে পারবে না। সারাজীবনই তাদের ওঁর ধামাধরা অর্থাৎ ইয়েস ম্যান হয়ে থাকতে হবে। আর এটাই উনি চান...
    আর অচ্যুৎ? ওকে উনি এতো প্রশ্রয় দেন কেন?
    অচ্যুতের ব্যাপারটা একটু আলাদা। ওর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। ও জানে ওর পুঁজি কত সীমিত। কিন্তু ও বাজারের মান জানে। সেই বাজারের চাহিদা জানে। ও জানে, এই বাজারের মান ও চাহিদা একেবারে ওর মাপ মতো। তাই নিজের মাঝারি মানটিকে বা সীমিত পুঁজিকেই ও খুব ভালোভাবে বিক্রি করতে শুরু করেছে। আর বাজারও ওকে লুফে নিয়েছে। এই বাজার উৎকৃষ্ট মগজের পক্ষে অনুপযুক্ত। অনুর্বর জমিতে তুমি উৎকৃষ্ট ফসল ফলাতে পার না। তার জন্য উর্বর জমি চাই। তেমন জমি এখানে নেই। নিমাই এখানে বাধা পাবেই। আর অদ্যুৎ সফল হবেই। উনি নিজেও এই কারণেই এদেশে এত সফল। অথচ আমি এমন অনেককে জানি, যারা অনেক বেশি সম্মান ও স্বীকৃতি পেতে পারত। কিন্তু বাজার তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তারা মাঝারি মাপের নয়, চাহিদার তুলনায় তাদের যোগ্যতা অনেক বেশি, তারা অনেক বেশি উপযুক্ত!
    নিমাইয়ের মা শুধু বললেন, আপনি যা বলছেন, অবাক লাগছে আমার...
    বুড়ো অভিনেতাকে এখন কথায় পেয়েছে। তিনি বলে চললেন, আসলে ওর মনে নিরাপত্তার খুব অভাব। যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি পেয়ে গেছেন উনি। ওঁকে যারা মহানায়ক বানিয়ে দিয়েছে, মিথে পরিণত করেছে, তারা ওঁর যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই। তাদের কাছে নিজেকে উনি সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে প্রতিপন্ন করতে পেরেছেন। তারাও বুঝতে পেরেছে, উনি থাকলে তাদের স্বার্থ অরক্ষিত থাকবে। উনি তো কোনো প্রশ্ন করবেন না! বরং কেউ প্রশ্ন তুললে মোলায়েমভাবে তাকে চেপে দেবেন। সব উঁচু-নীচুকে মসৃণ করে দেবেন। সব ফাঁক-ফোকর ঢেকে দেবেন। তাই ওঁকে কিংবদন্তি বানিয়ে দিয়ে অবিরাম প্রচার চালিয়ে গেছে তারা। আসলে বাজার তাকেই প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে, বাজারের রুচি, মান ও চাহিদা অনুযায়ী যে সাপ্লাই দিতে পারবে। আর এ ধরনের দেশে রুচি, মান, চাহিদা, সবই খুব নিম্নন্তরের। এসব দেশে খুব কম মানুষই মেধার চর্চা করে। উপনিবেশের ঘাগুলো দিনে দিনে আরও বেড়ে চলেছে। আত্মশক্তি নয়, পরনির্ভরতাই এদেশের মন্ত্র। আপনি যত মাঝারি মানের হবেন, যত বেশি নকল করতে পারবেন, নিখুঁতভাবে দাসত্ব ও আনুগত্য দেখাতে পারবেন, চালাকি করে নিজেকে আড়াল করতে পারবেন এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, চলতি ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন, চিন্তা-ভাবনায় যত দরিদ্র হবেন, নতুন কথা শুনে আঁতকে উঠবেন আর পুরোনো ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরবেন, আপনি তত সফল। কৃত্রিম, যান্ত্রিক না হয়ে নিজস্বতা দেখাতে গেলেই এ দেশে আপনি চিহ্নিৎ হয়ে যাবেন। এ দেশে প্রতিভা হয়তো অনেক আছে, কিন্তু সেগুলো বিকাশের পথ পায় না। ধাক্কা খেতে খেতে একসময় পুরোপুরি ক্ষয়ে যায়। ফলে মাঝারি মানের মেধা ও প্রতিভা নিয়েও উনি দাঁড়িয়ে গেছেন। একদম কিংবদন্তি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে ওঁকে...
    তাতে ওঁকে নিজেকে কখনও সমস্যায় পড়তে হয় নি? নিমাইয়ের মা জানতে চাইলেন।
    হয়েছে তো! লোকের চোখে উনি যতই যা হয়ে উঠুন, ওঁর ভেতরে যে ফাঁক ও ফাঁকিগুলি রয়ে গেছে, সেগুলো তো থেকেই গেছে। দিনে দিনে সেগুলো বরং আরও বেড়ে গেছে। এটা কোনো দুর্বলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একমাত্র কোনো মেধাবী লোকই এগুলো ঠিকঠাক ধরতে পারবে। উনি তাই মেধাবী লোকেদের এড়িয়ে চলেন। তাদের সহ্য করতে পারেন না। তাদের কৌশলে দাবিয়ে রাখেন। চেপে দেন। আসলে এসবই ওঁর আত্মরক্ষার নানা কৌশল। মনে রাখবেন, যে যত চালাকি করে নিজের দোষত্রুটিগুলো ঢেকে রাখতে পারে, সে তত সফল। দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা সকলেরই আছে। কিন্তু সফল মানুষেরা সেগুলোকে আড়াল করতে জানে। যারা পারে না, নিজেদের প্রকাশ করে ফেলে, তাদের ভুগতে হয় তত বেশি। ওঁর মতো মানুষেরা শুধু নিজেদের দোষ-ত্রুটি-অভাব-দুর্বলতা ঢাকতেই জানে না, যাদের চোখে সেগুলি পড়ে যায়, তাদেরও চেপে দেয় কৌশল করে আর যাদের চোখে পড়ে না, তাদেরই সামনে এগিয়ে দেয়।
    কিন্তু উনি চাইলেই এটা হবে কেন? মানুষ কী দুর্বল-সবলের তফাত বোঝে না?
    না, বোঝে না। খুব কম মানুষই আছে, যারা নিজেদের মেধা ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগায়। বাকিরা সবসময়ই গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসাতে পছন্দ করে। তাদের যা বোঝানো হয়, সেটাই তারা বোঝে। কারণ এই বোঝাতেই তাদের সুবিধা। তখন তাদের কোনো প্রশ্ন বা অস্বস্তির সামনে পড়তে হয় না। জীবনটা দিব্যি নিরাপদে, সমঝোতা করেই কেটে যায়, সবার সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে যায়, কোথাও কোনো বাধা পেতে হয় না। মনে রাখতে হবে, মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব নেয় ক্ষমতা। ওকে ক্ষমতা ছাড়া আর কী নামে ডাকা যায়? উনি যা বলবেন, সেটাই গৃহীত হবে। প্রামাণ্যতা পাবে। উনি বেড়ালকে সিংহ বলে ডাকলে, লোকে সেটাই মেনে নেবে। উনি সিংহকে বেড়াল বানিয়ে দিলে কেউ কোনো আপত্তি করবে না। বেড়ালের গুহায় ঢুকে কেউ খুঁজে দেখবে না সেখানে সত্যিই বেড়াল আছে, না, একটা সিংহ বসে আছে! অত খোঁজাখুঁজি করার সময় কারও নেই। তা ছাড়া ভিন্ন কথা বলে ক্ষমতার চোখে কেউ অপ্রিয়ও হতে চায় না। সবাই তাই চুপ করেই থাকে।
    নিমাইয়ের মা শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন, তাহলে নিমাইকে আপনি এখানে পাঠালেন কেন?
    বুড়ো অভিনেতা বিষণ্ণ গলায় বললেন, যা শুনছি, ওকে স্রেফ ব্যবহার করা হচ্ছে ওখানে। স্রেফ ব্যবহার। কুলিমজুরের মতো ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছে ওখানে। আর ওর মগজটাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কোনো কাজেই লাগানো হচ্ছে না সেটা। বা যদি লাগানো হয়, সেটা হচ্ছে অত্যন্ত মামুলি কাজে। যেন ওটা একটা আবর্জনার ঝুড়িতে পড়ে আছে। আমি জানতাম ওরা ওকে জড়াতে চাইবে। তখন ওকে মাথা ঝোঁকাতে হবে। নীচু হতে হবে। অপমান, অসম্মান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনাকে নিত্যসঙ্গী করে তুলতে হবে। নিজেকে লুকোতে হবে। চুরি বা ডাকাতির থেকেও বড়ো অপরাধ করতে হবে। আত্ম-প্রতারণা করতে হবে। এর ফল হবে ভয়াবহ। লোকে ওকে ভুল বুঝবে। ভাববে, নিজেকে ও বিক্রি করতে এসেছে। ওর নামে কুৎসা রটাবে। ওকে নানাভাবে ছোটো করতে চাইবে। বিকৃত করতে চাইবে। আর এই সমস্ত ঝড় ওকে সামলাতে হবে। কিন্তু আর কোথায় পাঠাতাম ওকে? আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে নাকি? গোটা জাতির জীবনটা একটা অন্ধ গলিতে গিয়ে ঠেকেছে। একমাত্র সার্টিফিকেট, ওটাই বাঁচাতে পারে ওকে। একটা নতুন জীবন দিতে পারে!
    নিমাইয়ের মা বাইরে জানলা দিয়ে নীল সমুদ্রের দিকে তাকালেন।




    ধ্রুপদীর কাঠের বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল নিমাই আর ধ্রুপদী। সামনে সমুদ্র। নিমাই বলছিল, তুমি সব ব্যাপারেই প্রতিবাদী। সমুদ্রের দিকে তাকাও। কী বিরাট আর মহৎ এই দুনিয়া! আর তুলনায় আমাদের জীবন কতই না তুচ্ছ! কথায় কথায় এত প্রতিবাদের কী আছে! গাইতো গাজদানোভের অসামান্য ক্লাসিক ‘দি স্পেকট্রে অফ আলেকসান্দার উলফ’ উপন্যাসে পড়েছিলাম, আমাদের তুচ্ছ জীবনে সামান্য কিছু ঘটলেই আমরা বেদনায়, অনুতাপে অভিভূত হয়ে যাই। তখন খেয়ালই রাখি না, আমরা কী বিরাট একটা জীবনের অংশ! কী ঔদাসিন্য আমাদের! কী প্রচণ্ড অজ্ঞতা!
    ধ্রুপদী মৃদু ধমকের স্বরে জানতে চাইল, কেন আমার এই আক্ষেপ, তুমি বুঝতে পারছ না?
    নাঃ, সত্যিই পারছি না। এই তো সবে এখানে এসেছি। আর এরই মধ্যে সব কেমন নিজের হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, যেন বহুদিন ধরে এখানে আছি। মুক্ত সমুদ্রের মতোই অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে আমার। আর রয়েছে অধিকারবোধ। যখন ইচ্ছে সেই অধিকারবোধ দেখাতে পারি আমি। বাবা আমার ওপর নির্ভর করেন। সবাই সংকোচ নিয়ে বাবার কাছে আসে। বাবা তাদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। আমার সিদ্ধান্তই তখন বাবার সিদ্ধান্ত। বাবা নিজের সিদ্ধান্তগুলোও আর নিজে নেন না। সেই অধিকারও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন আমাকে! যার যা ফাইল লাগবে, আমিই সেগুলো খুঁজে তার হাতে তুলে দিই। চমৎকার কাজ পেয়েছি আমি!
    নিজেকে তুমি ঠকাচ্ছ। ধ্রুপদী বলল। আমার মা খুব উঁচু পদে কাজ করতেন। ক্ষমতাকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলতেন, ক্ষমতা মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রম, একটা মোহ, একটা মিথ্যাকে জাগিয়ে রাখে। এতে মানুষের বশ্যতা পেতে সুবিধা হয়। তুমি ভাবছ, তোমার অনেক স্বাধীনতা! অধিকারবোধ! কিন্তু সত্যিই কি কোনো স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তোমাকে? তুমি যা করছ তা কি তুমি করতে চাও? তাহলে তোমার স্বাধীনতা কোথায়? বরং তোমার অধীনতাকেই পাকাপোক্ত করা হচ্ছে এভাবে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা মামুলি কাজে জড়িয়ে যাচ্ছ তুমি। আর যত বেশি জড়িয়ে যাচ্ছ, যত বেশি স্বাধীনতা হারাচ্ছ, তত নিজেকে তোমার আরও বেশি বেশি করে স্বাধীন বলে মনে হচ্ছে! এটা বিভ্রম ছাড়া আর কী! ভাবো তো, সবাই ওঁকে নিজের বাবা বলে ভাবে। উনি কী সত্যিই কারও বাবা হতে পারবেন কখনও? তবু ভাবে তো! উনি সবার মধ্যেই নিজের প্রতি এই আস্থাটা জিইয়ে রেখেছেন। কিন্তু এই আস্থা একটা বিভ্রম ছাড়া আর কী! এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হচ্ছে কার? এখনও তুমি তোমার সার্টিফিকেট পাওনি। ওতেই তোমার আসল অধিকার। এই ঠুনকো অধিকারবোধ নিয়ে তোমার কী হবে? এতে তোমার অধিকার কোথায়? এ তো যখন খুশি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায়। তোমার সার্টিফিকেট কেউ কখনও তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে? তোমার কৃতিত্বের একমাত্র স্মারক, যা করুণার দান নয়, নিজের যোগ্যতায় যা তোমার প্রাপ্য! আমার তো মনে হয়, তোমার স্বাধীনতা ঢের দূরে রয়েছে…
    নিমাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ধ্রুপদীর দিকে। তারপর বলল, তোমায় প্রথম দেখে মনেই হয়নি, এভাবে ভাবতে পার!
    সত্যিই ভাবতে পারতাম না তখন। এখানে আসার পরই... একটু থেমে ধ্রুপদী বলে, অনেক কিছু দেখতে পাই এখন। আগে যেন অন্ধই ছিলাম...


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ১৯৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন