এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ মে ২০২০ | ১৮৪৯ বার পঠিত
  • পঁচিশ বছর আগে

    রণির স্কুল ভোরবেলায়। মর্নিং স্কুল। রণির বয়েস সাত বছর। সে গোকুলের ছোট ভাই অনিরুদ্ধের ছেলে। সকালবেলায় গোকুলের হাত ধরে স্কুলে যায়।
    রণি বলে, ‘ জেঠু তুমি একটা বোকা। কিচ্ছু মনে রাখতে পার না।’ একটা বাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘ বল তো ওটা কি ?’
    গোকুলের হাইপোথ্যালামাস ঘিরে ধোঁয়ার বৃত্ত পাক খায়। শব্দ ধরা দিতে গিয়েও পিছলে যায় কোন ভরাট আঁধারে।
    ‘ দুর, কিচ্ছু মনে রাখতে পার না। বোকা কোথাকার’— রণি অকপট বিরক্তি প্রকাশ করে।
    গোকুলের ফর্সা টকটকে রঙ। বেশ লম্বা।ইদানীং ভুঁড়িটা বড্ড বেড়েছে। অল্পেই ঘেমে নেয়ে যায়। তার মায়ের বড় দুশ্চিন্তা। তিনি গত হলে কে দেখবে গোকুলকে। ভাইয়ে ভাইয়ে এখনও পর্যন্ত খুবই মিলমিশ আছে। তবু আজীবন এ ভার টানতে কি কেউ রাজী হবে ? তারা হলেও তাদের বৌরা কি রাজি হবে ? মায়ের বড় দুশ্চিন্তা। গোকুলের ওপরে এক ভাই, নীচে এক। দুজনই বিবাহিত এবং তাদের সন্তানাদি আছে। বড় ভাই অনিমেষের দুটি ছেলে। একজন ক্লাস নাইনে, একজন ক্লাস সেভেনে পড়ে।

    পাড়ায় রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা হবে। এই এক হিড়িক হয়েছে। ভাবল অনিমেষ। ছোঁড়াগুলো এক নাগাড়ে কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে। সে ভালই জানে, অনিরুদ্ধ কক্ষনো গিয়ে দরজা খুলবে না।চাঁদা টাদার ব্যাপার থাকলে সে আগে থেকেই আন্দাজ করতেপারে। অথচ দরজাটা তারই খোলা উচিৎ।সে থাকে একতলার ঘরে। আর অনিমেষ সম্প্রতি উঠে গেছে তার স্বনির্মিত দোতলার ঘরে। অনিরুদ্ধ ঘরের ভেতর থেকেই যতক্ষণ পারল চেঁচাতে থাকল সবাইকে শুনিয়ে— ‘আ:, দরজাটা কেউ খুলতে পারছে না ! আমার যে এদিকে দু হাত জোড়া। কি আক্কেল সব...বলিহারি যাই....।’ অবশেষে গা তুলতে বাধ্য হল।
    দরজা খুলে দেখে গোটা পাঁচেক ছোকরার সঙ্গে মধুরিমা এবং ঝুকুও রয়েছে। দুজনে পালা করে আদুরে গলায় চাহিদা পেশ করতে লাগল, ‘ অনিরুদ্ধদা....কোন কথা শুনব না, উঁ উঁ.... পাঁচশো টাকার একপয়সা কম নয়... খুব রাগ করব কিন্তু.... ইত্যাদি।’
    অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু ঝুকুর ওই লীলায়িত ‘ খুব রাগ করব কিন্তু’-তে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেল।
    পকেট থেকে পাঁচশো এক টাকা গলে গেল পাড়ার মাইফেল-এর চাঁদা দিতে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায়।

    গোকুল গতকাল রাতে ঠায় বসে জলসা শুনেছে রাত দুটো পর্যন্ত। গানের লাইন তার বেশ মনে থাকে। অথছ কাগজকে কাগজ, বাক্সকে বাক্স বলে মনে থাকে না।
    সবকিছু মনে থাকলেও আবার মুশ্কিল। তারও মুশ্কিল, অন্যদেরও মুশ্কিল।তার মতো ভোলাভালাদের তো পেটে কথা থাকে না। কোথায় কখন কি বেফাঁস বলে বসবে তার ঠি ক আছে। ভাগ্যিস তার স্মৃতিতে ধরা নেই যে, সিট থেকে উঠে স্টেজের পেছনে চাপড়া ঝোপের ধারে যেতে গিয়ে সে এক ঝলক দেখেছিল, ঝুকুর ওপর ঝুঁকে আছে অনিরুদ্ধ। আর লাগোয়া জমির বাউন্ডারী ওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শরীর এলিয়ে কৌতুকভরা জুলজুলে শিকারি চোখে অপলক তাকিয়ে আছে ঝুকু। গোকুলকে নজরে পড়েনি ওদের।ওরা এত বেশি নিমগ্ন ছিল— একজন আবেগে, আর একজন কৌতুকে। ওদিকে স্টেজে তখন সুর সপ্তমে উঠেছে— ‘ চোখ গেল, চোখ গেল, চোখ গেল পাখিরে..... ‘ , আর ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণপ্রিয়.....।’ এ চলচ্ছবির কিছুই গোকুলের স্মৃতিতে নেই। অনিরুদ্ধ তনয় রণি তো দুনিয়ার এ গল্পগাথার বৃত্তই ছোঁয়ইনি এখনও। সহধর্মিনী তীর্থা বসে স্টেজের আলোর সামনে ‘পথ চলিতে’-র সুরে ডুবে। কেউ এধারে, কেউ কেউ ওধারে—আড়ালে। সুতরাং সব স্বাভাবিক।ঠি ক ঠাক চলছে।কোথাও কোন চাঞ্চল্য নেই। একের খবর অন্যে জানে না। জানলে দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যেত।
    এক সময়ে জলসা ফুরিয়ে গেল। রাতও পোহালো। ভোরের অমল হাওয়ায় পার্কের ঘাসে কৃষ্ণচূড়ার বাসি ঝুমকো দিশাহারা। রাঙা পাপড়ি ওলোটপালোট খাচ্ছে।শহর এখনও ঘুমের চাদর গোটায়নি পুরোপুরি। তেতলার ঘরের পর্দা তিরতির করছে প্রভাতী
    বায়ে। ছাদে একরাশ পায়রা ব্যস্ত পায়ে ঘুরঘুর করে। ঢ্যাক্ ঢ্যাক্ করতে করতে কর্পোরেশানের ময়লা ফেলার গাড়ি বেরল।

    রবিবারে শুধু খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বারান্দা ছেড়ে নড়ে না অনিরুদ্ধ। একটা চেয়ার পেতে খবরের কাগজ কোলে করে ঠায় বসে থাকে। তীর্থা কিছু জিজ্ঞেস টি জ্ঞেস করলে শুধু হাঁ হুঁ করে যায়। সে প্রায় এক যোগীর তন্ময়তায় বসে থাকে দিনভর। কোলের ওপর ছেলে দাপাদাপি করে যায়। কোন খেয়ালই নেই। কোনের বাড়ির দোতলায় ঝুকুর একটুকরো আভাস যদি দেখা যায় কখনও সখনও তাতেই সারাদিন বেশ হেলাফেলা করে মৌতাতে কাটে। নেশার জিনিস বটে। আপনারা যাই ভাবুন, ফ্রয়েড ট্রয়েড যে ব্যাখ্যাই দিন, অনিরুদ্ধর এই টানটা কিন্তু ঠি ক সেক্সুয়াল নয়। এটা হল, ওই যাকে বলে, কবিগুরুর ডায়লেক্টে— “দিনেকের দেখা তিলেকের সুখ/ ক্ষণিকের তরে শুধু হাসিমুখ/ পলকের তরে থাকে বুক ভরে / চিরজনমের বেদনা।”
    এ হল অনেকটা তাই। বড় ঝঞ্ঝাটের ইতিবৃত্ত।কোলের ওপর ছেলে দাপায়, বাপ ওদিকে তৃষিত দুচোখ মেলে বসে থাকে ঝুলবারান্দার চেয়ারে।

    অনিরুদ্ধর সঙ্গে ঝুকুর বয়েসের ব্যবধান কম করেও পনের। সে তার অবচেতনে ভালই আন্দাজ পায়, ঝুকু উইল সামারিলি রিফিউজ হিম। সেটা সহ্য করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাহলে কি করবে সে ? কি আবার করবে ! কিছুই করার নেই। সে একজন বিবাহিত ভদ্রলোক। এই অবস্থায় যা হয় আর কি। প্রবল মোহাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে তার দিন কাটতে লাগল। প্রয়োজনীয় সাংসারিক কাজকর্ম লাটে উঠল। মন:সংযোগ কোন কিছুতেই নেই।শুধু ওই ঝুকু ছাড়া । তবে, সব নাটকেরই অন্তিম দৃশ্য আছে। এ ঘটনাক্রমেরও এক সময়ে ইতি হল।
    ়়়়়়়়়়়়়়়়়়়

    মধুরিমা বলল, ‘ বল, কি করবি তা’লে ?’ ঝুকু বলল, ‘ চল, এক কাজ করি ।’
    গোকুল বাড়ির গেটের মুখে একধারে সিঁড়ির নীচের ধাপে বসেছিল। ঝুকু চোখের তারার টানে চাপা স্বরে ডেকে বলল, ‘ এই গোকুলদা, একটু শোন না...’ গোকুল নির্দ্বিধায় এগিয়ে এল। এসে দুজনের দিকে তাকিয়ে অসাংসারিক হাসি হাসল। ঝুকু তার হাত ধরে একটু তফাতে নিয়ে গেল।চিরকালের আপনজনের মতো। সঙ্গে মধুরিমাও আছে।
    — ‘ এই গোকুলদা, লক্ষ্মীটি আমার, একটা কাজ করে দাও না। প্লিই...জ । না বললে শুনব না.... উঁ উঁ উঁ.....সত্যি বলছি, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের সাহায্য করার মতো....’ গোকুলকে এত ভেজানোর কোন মানেই হয় না। এসব ব্রীড়া বিব্বোকের মাহাত্ম্য তার অজানা।সে এখনও দাঁত বার করে শিশুর মতো হেসে যাচ্ছে।
    তবে গোকুল পুরুষ মানুষ তো বটে । হোমকুন্ড উস্কে দিলে কি হয় কিছু বলা যায় না। এ মহীমন্ডলে কত খেলা ঘটে চলেছে অহোরাত্রি ।
    ‘ এই শোন ‘, ঝুকু তৎপর হয় । ‘এই নাও, এইটা তুমি ওই চারতলা হলুদ বাড়িটার নীচের তলায় যে ডাক্তারের চেম্বার আছে— ওখানে সুন্দর মতো দেখতে যে ডাক্তারবাবু বসে আছে তার হাতে দেবে। যদি বলে কে দিয়েছে, বলবে আপনার ঝুকু দিয়েছে। চুপিচুপি বলবে কিন্তু। কেউ শুনতে না পায়। মনে থাকবে ? খুব সাবধানে.... অন্য কেউ যেন এ চিঠি না দেখে।’ বলে, গোকুলের হাতে একটা চার ভাঁজ করা আতর লাগানো সাদা কাগজ দিল। ‘ যাও গিয়ে দিয়ে এস লক্ষ্মীটি।আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি, পরে খোঁজ নেব।’
    ঝুকু এবং মধুরিমা চলে গেল।কারণ এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা ভাল দেখায় না। চেনাজানা লোকের আনাগোনা সর্বক্ষণ।
    আজ ছুটির দিন । অনিরুদ্ধ ফিরছিল রেশান তুলে। কোনরকমে থলে দুটো রান্নাঘরে ফেলে দিয়েই বারান্দায় গিয়ে ধ্যানে বসবে।
    হঠাৎ দেখে গোকুল আসছে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে। তার হাতের চিঠি হাতেই ধরা।পকেটে রাখার কথা কি আর খেয়াল থাকে তার !
    ‘ কোথায় যাচ্ছ ? ‘ অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করে গতানুগতিক ভাবে।
    —-‘ এই যে , এইটা দিতে.... ওইখানে....’ , গোকুলের সরল জবাব।
    ‘ কি এটা ? ‘ অনিরুদ্ধের ষষ্ঠেন্দ্রিয় হঠাৎ সর্বনাশের গন্ধ পায়।
    — ‘ দেখি দেখি ‘ , প্রায় ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নেয় চিঠিটা গোকুলের হাত থেকে। রেশনের থলে দুটো রাস্তায় নামিয়ে রাখল।
    কাগজের চারভাঁজ খুলতে আঙুল কেঁপে গেল তার। বুকে হাতুড়ি পিটতে লাগল কে ! সাদা কাগজে ডট পেনের কালো অক্ষর সাজানো। রুদ্ধশ্বাস এবং স্নায়ু ফুটিফাটা হওয়া অবস্থায় অনিরুদ্ধ পংক্তির পর পংক্তি বেয়ে নামতে লাগল। ফোঁটা ফোঁটা করে গলে যেতে লাগল তার বিভ্রমের মোমবাতি। কোন পুরুষের প্রতি কোন নারীর আত্ম নিবেদনের ভাষা যে এত বেআব্রু এবং কামনাপ্রদীপ্ত হতে পারে তা তার এতকাল অজানা ছিল। ফোঁটা ফোঁটা করে গলে যেতে লাগল অনিরুদ্ধর স্নায়ুচাপের স্তম্ভ। অবশেষে সে সম্পূর্ণ মুক্ত হল।এতদিনের পুঞ্জীভূত আশা নিরাশা ও সূচীমুখ ব্যথা অনুভবের শ্বাসরোধকারী জমাট পাথরের ভার থেকে। এক লহমায় তার মনের মাঠে প্রান্তরে স্নিগ্ধ মনোরম বাতাসের ঝালর বুলিয়ে গেল কে !
    প্রায় স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে অবোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা গোকুলের চোখের দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ বলল, ‘তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ মেজদা।তুমি আমাকে ফাঁসমুক্ত করলে। আ:, কি শান্তি !’ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে। তারপর কাগজটা আবার আগের মতো চারভাঁজ করে গোকুলের জামার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘ যাও, গিয়ে দিয়ে এস গে।’
    রাস্তায় নামিয়ে রাখা থলে দুটো তুলে নিয়ে স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল অনিরুদ্ধ। রণি এবং তীর্থার জন্য তার বুক টনটন করতে লাগল।
    ****** ******* ********
    এরপর মাসের পর মাস গেল । বছর ঘুরে গিয়ে এসে গেল আর এক আশ্বিন। বিনবিনে ঘামের বিন্দু নাকে মুখে। আবার আকাশ থেকে আলোর ঝকঝকে সোনা রূপো ঝরছে। অলিতে গলিতে পথ কেটে ঢুকে যাচ্ছে কোন সুদূর মোহন পাহাড় থেকে বয়ে আসা স্নিগ্ধ শরতের বিমল বাতাস।পুজোর আর আটদিন বাকি।
    ঝিরিঝিরি বাতাস, অনাবিল
    এলানো রোদ মেখে অবিরাম লোকজন যাওয়া আসা করছে রাস্তা দিয়ে। নির্ভার নিরুদ্বেগ মুখের কত নারী, কত পুরুষ। অনিরুদ্ধ পুরনো বাড়ির পুরনো বারান্দায় ছেলে কোলে নিয়ে বসে চলমান দুনিয়া দেখতে লাগল।
    আরে ওই যে। হ্যাঁ, গোকুল আসছে। আজানুলম্বিত হাত দুলিয়ে দুলিয়ে আসছে। ঝলক ঝলক বাতাসে পাজামা লটরপটর করছে।
    শিখা উস্কে দিলে কি হয় কিছু বলা যায় না। কত কি অবিরাম ঘটে চলেছে এ মহীমন্ডলে। সে পুরুষ মানুষ তো বটে।

    মাস দুই পরে অনিমেষ অনিরুদ্ধ গোকুলদের পরিবার ভাগাভাগি হয়ে গেল। পৈত্রিক বাড়ি প্রমোটারের হাতে তুলে দিয়ে যে যার নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেল চারটে ম্যাটাডোরে মালপত্র চাপিয়ে একদিন ভোরবেলায়। পাড়ার কেউ তেমন কিছু জানতে পারল না। গোকুল গেল অনিরুদ্ধের সঙ্গে আর তাদের মায়ের ঠাঁই হল অনিমেষের ফ্ল্যাটে।
    ******* ********** ********
    পঁচিশ বছর পরে ।

    ঝুকু এখন পঁয়তাল্লিশ। মানি স্কোয়্যার মলের তিনতলায় একটা মোবাইল স্টোরে দাঁড়িয়ে ছিল। চেহারা একটু ভারী হয়েছে শুধু। মুখে তেমন বয়সের ছাপ পড়েনি। একটা সতের আঠারো বছরের ছেলে ডানদিকের কাউন্টারে মোবাইল বাছাবাছি করছে।
    এই সময়ে ওরা দুজন ঢুকল।ঢুকেই ঝুকুর মুখোমুখি। ঝুকু তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড।
    — ‘ আ-রে , অনিরুদ্ধদা না ! কতদিন পরে দেখা.... কোথায় থাকেন এখন আপনারা ? ‘
    তীর্থার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেমন আছেন বৌদি ? রণির কি খবর ? ‘
    অনিরুদ্ধ চমক সামলে নেওয়ার পর ধীর স্থির ভাবে জানায়, ‘আমরা এখন রাজারহাটে থাকি। রণি ব্যাঙ্গালোরে। একটা আই টি কোম্পানিতে আছে।’
    — ‘ তা-ই ! বা: খুব ভাল লাগল। কত ছোট দেখেছিলাম ‘ গিন্নীবান্নির স্টাইল ঝুকুর কথার সুরে।
    তীর্থা বলে, ‘ তুমি কেমন আছ ?’ ঝুকুর সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘শ্বশুরবাড়ি কোথায় ? ‘
    — ‘ ওই কুমোরটুলিতে...... আমাদের পুরনো পাড়াতেই।আমাদের বাড়ির কাছেই। রাস্তার মোড়ে ট্রামলাইনের ওপারে যে তিনতলা বাড়িটা আছে, ওরই দোতলায়। হাসব্যান্ডের স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসা।চলে যায় মোটামুটি। বাপ ঠাকুর্দার করা বাড়িটা ছিল তাই বাঁচোয়া, নইলে কি যে হত কে জানে..... আমাদের তো আর কলকাতার মধ্যে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষমতা নেই....ছেলে ক্লাস টুয়েলভ দেবে- আই এস সি বোর্ড। সায়েন্স পড়ে । মোটা খরচ ওর পেছনে। রোজগারের মানুষ তো ওই একটাই। ‘ ঝুকু অনর্গল এবং অকপট বলে যেতে থাকে বিষয়বুদ্ধিসম্পন্না সংসার-অভিজ্ঞ মহিলার মতো। অনিরুদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ছাব্বিশ বছর আগের সেই রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল। অনিরুদ্ধ এখন ষাট বছরের প্রৌঢ়। সময়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে অবিরাম— আলো এবং অন্ধকারে।
    ঝুকুর কথা চলতে থাকে। সে ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘ ওই যে, আমার ছেলে। অ্যা-ই বাবান, এদিকে আয় একটু ।’ বাবান মোবাইল ঘাঁটতে ব্যস্ত। ঈষৎ বিরক্তির স্বরে এদিকে ঘাড় না ঘুরিয়েই বলে— ‘ দাঁড়াও , যাচ্ছি
    একটু পরে। ‘
    ঝুকু তীর্থার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ দেখেছ বৌদি , আজকালকার ছেলেদের রকম সকম..... ও হ্যাঁ, গোকুলদা.... গোকুলদা কেমন আছে অনিরুদ্ধদা ?’ ঝুকু সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে আচমকা।
    — ‘ মেজদা.... মেজদা মারা গেছে ।.....এ-ই চারবছর হল ।’
    — ‘ সেকি ! কি করে ?’ ঝুকুর চোখ বিস্ময়ে এবং অকৃত্রিম অার্তিতে ব্যথাতুর হয়ে ওঠে।
    — ‘ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। টাইম পাওয়া যায়নি..... অনিরুদ্ধ জানায়। ঝুকু মাথা নীচু করে গভীর শ্বাস ফেলে।
    আবেগটা থিতিয়ে গেলে তীর্থা ঝুকুকে জিজ্ঞেস করে , ‘ হ্যাঁগো, সুরজিৎদা পারমিতা বৌদির খবর কি ? ওদের তো আর কোন ইসু হল না.....এখন কেমন....’
    —-‘ ও মা, তোমরা জান না ? ওদের একটা মেয়ে হয়েছিল তোমরা চলে যাবার আট দশ মাস বাদে। ইংলিশে এম এ । টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি পেয়েছে। কি সুন্দর দেখতে .... ঠি ক গোকুলদার মতো টকটকে ফর্সা। বাচ্চা হবার পর সুরজিৎদার সে কি আনন্দ। আমাদের সবাইকে পোলাও আর পাঁঠার মাংস খাইয়েছিল। আসুন না একদিন পুরনো পাড়ায় । কত কথা জমে আছে ...... ‘
    অনিরুদ্ধ ভাবল — জমা কথা বাসি ফুলের মতো ভেসে যায় সময়ের জলে। তাকে কি আর ধরা যায় !
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jharna Biswas | ১৪ মে ২০২০ ১৪:৩৩93314
  • দারুন একটা গল্প পড়লাম। খুব ভালো লিখেছেন। 

  • Anjan Banerjee | ১৪ মে ২০২০ ২০:১৮93322
  • ধন্যবাদ 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন