এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • জানা অজানা: বটতলার বই

    Subhabrata লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১৩ মে ২০২০ | ২৬৮৯ বার পঠিত
  • সে এক সময়ের কথা। শোনা যায় বৌবাজার অঞ্চলে এক অশ্বত্থগাছের তলায় ছিল চার্ণক সাহেব ও অন্যান্য সাহেব বণিকদের আড্ডা মারার জায়গা। বাণিজ্য ছড়িয়ে ডিহি শিয়ালদহ ও আরোও কয়েকটা জায়গা নিয়ে চার্ণক সাহেব কলকাতাকে শহর ও প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বানাবার ফন্দি করেছিলেন ঐ অশ্বত্থগাছতলায়। অশ্বত্থগাছটা আজ আর নেই কিন্তু রয়ে গেছে বৈঠকখানা নামটা। বৌবাজারের ঐ অশ্বত্থগাছের মতই একটা বটগাছ ছিলো শোভাবাজার-গরানহাটা অঞ্চলে। যার গোড়ায় ছিল বাঁধানো চাতাল। সেই বাঁধানো বটতলায় বসত আড্ডা, যাত্রা, কবিগানের আসর। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল খেউড়ের তরজা। আশ্চর্য ঘটনা এই , আজ আমরা যে ঝকঝকে অফসেটে ছাপা চকচকে মলাটে বাঁধানো বই পড়ি তার আদিপুরুষ কিন্তু এই বটতলা থেকে উদয় হওয়া লেখক, চিত্রশিল্পী এবং প্রকাশকরাই। আজকের সম্ভ্রান্ত পাঠক-লেখককুল যতই 'বটতলার সাহিত্য ' বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুন না কেন - শুধু সাহিত্য বলে নয়, যে পাঁজি না থাকলে বিয়ে পৈতে মুখেভাত হয় না, সেই পাঁজিও কিন্তু বটতলার অবদান। আজ বিভিন্ন পত্রিকা(সম্ভ্রান্ত/সর্বাধিক প্রচারিত) বিজ্ঞাপন ছাড়া অচল। এই বিজ্ঞাপনের অর্থানুকূল্যে বই প্রকাশের ধারণাও কিন্তু বটতলার প্রকাশিত বই থেকেই এসেছে।

    উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু হয়েছে বটতলার সাহিত্য অভিযান। সেই সঙ্গে দেশী ছাপাখানা। প্রথম দেশী হরফের ফাউন্ড্রি চালু করেন পঞ্চানন কর্মকার। ছেনিকাটা বাংলা অক্ষরের হরফ। কিন্তু এই ফাউন্ড্রির ওপর ভরসা করেই বটতলার বই ছাপা হত। মুদ্রণযন্ত্র ছিলো কাঠের এবং প্রভূত নড়বড়ে। টাইপগুলো ছিল ভীষণ পাতলা ও পলকা। কয়েকবার ব্যবহারেই ক্ষয়ে বা ভেঙে যেত। ফলাফল হত মারাত্মক।

    'ক' ক্ষয়ে গিয়ে 'ব' হয়ে গেছে, 'র' এর ফুটকি নেই সুতরাং সেটা 'ব', 'শ' ও 'স' অপ্রতুলতার কারণে যথেচ্ছ কম্পোজ করা, 'ভ' ও 'ত' এর ফারাক করা কার্যত অসম্ভব, 'ম' যদি কম পড়ে 'ষ' দিয়ে কাজ চালানো হয়, উকার ঊকার নিয়েও সে এক মহাসমস্যা। ফলাফল- লেখক লিখেছেন
    "সকল কারণ তুমি ,তুমি সে কারণ"
    কম্পোজ করে ছাপা হল
    " শবল কাবল ভূষি ভূষি সে কাবল"
    তবুও পঞ্চানন টাইপ ফাউন্ড্রি ও এক আনায় চারপাতা কম্পোজ করার কম্পোজিটার, অন্ধকার প্রেস, নড়বড়ে যন্ত্র - এই নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল বটতলার সাহিত্যের।

    কম্পোজিটার গঙ্গাকিশোর প্রথম ছাপলেন ভরতচেন্দ্রর অন্নদামঙ্গল। বটতলার প্রথম বই। কিন্তু যা আগে বলেছি পঞ্চাশ টি কপিও ঠিকঠাক ছাপা হল কিনা সন্দেহ। তারপরই মুদ্রণ প্রমাদে ভরা বই, বাজারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পাঠক বটতলার খেউড়ের রস না পেয়ে ক্ষেপে উঠল। শেষটায় তৎকালীন বিখ্যাত পন্ডিত ভাটপাড়ার পদ্মলোচন তর্কচূড়ামণি কে দিয়ে সংশোধিত সংস্করণ আনা হল। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল কাঠখোদাই করে ছাপা রগরগে বিদ্যা ও সুন্দরের ছবি। পাঠকমহলে দারুণ সাড়া পড়ে গেল। এরপরেই এল বটতলার সাহিত্যের জোয়ার। চোরবাগানের মল্লিক পরিবার, ভবানীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ দেব প্রভৃতি তৎকালীন কলকাতার নব্য বাবুরা এগিয়ে এলেন বটতলার প্রকাশনী জগতে।

    একসঙ্গে ঘটে গেল আরেক বিপ্লব। রামনাথ গুপ্ত প্রকাশ করলেন তিথি নক্ষত্র দিনক্ষণ সংবলিত পঞ্জিকা। আগে যা যজমানদের মুখে জানাতেন গনৎকার বা পুরোহিতরা, সেটাই চলে এল দুমলাটের মধ্যে। গুপ্তপ্রেস থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকা বাংলাদেশে আলোড়ন ফেলে দিল।কিন্তু এই ব্যবসাও বেশিদিন একচেটিয়া রইল না। দু বছরের মধ্যে বেণীমাধব শীল নিয়ে এলেন সচিত্র পঞ্জিকা। তখন রামচাঁদ রায় এর কাঠ খোদাই চিত্র নিয়ে বটতলার পাঠক এবং প্রকাশকদের মধ্যে প্রভূত উন্মাদনা। বেণীমাধব শীল রামচাঁদ রায়কে দিয়ে আঁকালেন দুর্গা, শিব, জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা রাশিচক্র ইত্যাদির ছবি। সেগুলো জুড়ে দিলেন পঞ্জিকার পাতায় পাতায়।

    পঞ্জিকার এই রমরমার বাজারে এগিয়ে এল বণিককূল। আলতা সিঁদুর, সেঁকো বিষ, থেকে বৃহৎ লাল মূলা, মাথার তেল থেকে শিলাজিৎ সবরকম বিজ্ঞাপনে সেজে উঠতে লাগল পঞ্জিকার পাতা।

    এরপর ক্রমশঃ লিথোগ্রাফিক প্রেস জনপ্রিয় হতে থাকে। উন্নততর সাহিত্য ও উন্নততর ছাপার হরফে আধুনিক শিক্ষিত সমাজ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে বটতলার সাহিত্য। একসময় হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতা থেকেও....

    তথ্যসূত্র :

    কলকাতা কালচার
    বিনয় ঘোষ

    কলিকাতার ইতিবৃত্ত
    প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৪ মে ২০২০ ০৭:০৭731386
  • অনেক আগে এই নিয়ে পড়েছিলাম।  আজ আবারও জেনে ভাল লাগলো। 

    পুরনো রীতি মেনে এখনো বুঝি পঞ্জিকার মলাট পাতলা গোলাপী বা হলদে কাগজে ছাপা হয়?                  

  • Subhabrata | ১৪ মে ২০২০ ১২:৪৯731389
  • দুইমলাটের ভেতরে ছাপা সবচেয়ে কম দিন কদর থাকে এমন বই হলো পাঁজি। মাত্র একবছর। যার কোন সাহিত্য মূল্যই নেই। তাই বোধহয় পাঁজির কাগজে কেউ টাকা ইনভেস্ট করে না।

    এছাড়া আপনি যা বললেন " রীতি " - সেটাও মনে হয় অন্যতম কারণ।

    ধন্যবাদ 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন