ইন্তিজার হুসেনের এই গল্প সংকলনটির - দ্য ডেথ অফ শেহেরজাদে - প্রথম গল্পটি, বৃত্ত বা চক্রাকার যার নাম হতে পারে (উর্দুতে দায়রা, ইংরেজী অনুবাদে সার্কেল), সেটির কথক চরিত্রটি হয়ত ইন্তিজার হুসেনই বা তাঁর মত একজন লেখক। গল্পের শুরুতে কেউ যেন তাকে বাধ্য করছে কেউ অতীতের ছাই সরিয়ে দেখার জন্য। আর কী দেখার আছে ভেবেও সেই অতীতকে দেখতে গিয়ে কথক চরিত্রটি দেখতে পায় কিছু ধূলো পড়া রাস্তা, কোন দোকানের সামনেটা, কিছু ভেঙে পড়া মিনার, গাছ, পাখি, ছাদের কার্নিশ, কিছু কন্ঠস্বর। বুঝতে পারে যে এই সব দৃশ্য উঠে আসছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তারই প্রথম লেখা গল্পটি থেকেই। কিন্তু সন্দেহ হয় যে সেই গল্পটি তার ঠিকভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি, বোঝে যে গল্পটিতে যেন প্রধাণ চরিত্রটিই অনুপস্থিত ছিল। সেই যে মানুষটি যে একটি দোকানের সামনে বসে ছিল আর কখন যেন উঠে গেছে সেখান থেকে, সেই মানুষটিকে গল্পে ধরা হয়নি।। তাকে কী গল্পটিকে আবার নতুন করে লিখতে হবে, সেই কাজে কি তার স্মৃতি আর স্ব্প্ন তাকে সাহায্য করবে ? স্বপ্নে বার বার আসতে থাকে রূপনগর নামে সেই জায়্গাটির ছবি যে জায়্গা থেকে সে চলে এসেছিল এক সময়ে। হিন্দুদের মিষ্টির দোকান, মুসলমানদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা, হিন্দুদের দোল খেলা বা রামচন্দ্রজীকে নিয়ে শোভাযাত্রা , মুসলমানদের মজলিস, ফেলে আসা একটি মেয়ের ছবি যে যেন তাকে 'মুসল্লা' বলে পাত্তাই দিত না, আরো অনেক কিছু। আর ছিল কারবালার প্রান্তর, রূপনগরের মধ্যেই। কিন্তু স্বপ্নে যতবারই ঐ কারবালার কাছে পৌছতে যায়, ততবারই তার স্বপ্ন ছিঁড়ে যায়। ঠিকঠাক ঐ জায়গাটিকে তার স্বপ্নেও আর দেখা হয়ে ওঠেনা। ঐ মানুষটি আর ঐ কারবালা, এই গল্পটির শেষেও ইন্তিজার বা কথক-লেখকের অধরাই থেকে যায়। স্বপ্নেও সে পায় না পুরোপুরি আর সেই প্রথম গল্প লেখার সময়ে তো পায়েইনি। তাহলে এই কী তার ভবিতব্য যে চক্রাকারে সে ঘুরে যাবে, ঐ দুটি দৃশ্যকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আজীবন - কারবালা আর ঐ মানুষটির মুখ ?
বোধ করি, ইন্তিজার হুসেনের সারা জীবনের লেখালেখির চুম্বক এই গল্পটি, যেটা লেখা হচ্ছে তাঁর লেখক জীবনের পঞ্চাশ বছর কেটে যাওয়ার পরে। ছাই-কারবালা- ব্যক্তিটি।। অতীত যা মিলিয়ে গেছে , ছাই হয়ে গেছে, ইন্তিজার হুসেন বারবার সেই ছাইয়ের কাছে ফিরে গেছেন। ১৯২৩এ জন্ম হয়ে, '৪৭ -এ পার্টিশনের পরে পাকিস্তানে চলে গেছেন কিন্তু নিয়ে গেছেন ঐ রূপনগরের মত অবিভক্ত ভারতের সেন্ট্রাল প্রভিন্সের একটি স্থান যেখানে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, তাঁর স্মৃতি। গল্পে-উপন্যাসে ফিরে ফিরে এসেছে সেসব, তারই সাথে আরো পিছিয়ে গিয়ে হিন্দু পুরাণ, মহাভারতের গল্প, সুফী গল্প-কবিতা, জাতকের গল্প এসব। আর থাকছে কারবালা। কারবালা তো শোকের ঘটনা আর স্বপ্নেও সেই কারবালা না পৌছতে পারা মানে তো সেই শোক কোনভাবেই ছুঁতে না পারা; অতীত থেকে উৎখাত হয়ে, পরিচিত জায়গা থেকে চলে যাওয়া জনিত যে শোক, সেই শোকের কাছে সারা জীবনেও পৌছতে না পারা। কিন্তু এ কার শোক, শুধু কী ইন্তিজার হুসেনেরই, নাকি তাঁরই মত আরো অনেকের ? ঐ যে লোকটি উঠে চলে গেল দোকানের সামনে থেকে, সে তো সেরকমই এক্জন ব্যক্তি, যে ঐ শোক বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু এসব কিছু হারিয়ে ফেলা মানে তো আসলে নিজেকেই, নিজের সেল্ফকেই হারিয়ে ফেলা। আর একটি গল্প আছে বইটিতে - 'যারা হারিয়ে গেছিল'. প্রায় বেকেটীয় গল্প যেটি , যেখানে চারজন লোক কোন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে কোনক্রমে বেরিয়ে এসেছে, অতীত থেকেই, ছেড়ে চলে এসেছে তাদের চেনা জায়গা আর পরিচিতদের, একজন তার মধ্যে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত, তারা যেন দূর থেকে ভেসে আসা কোন আর এক ব্যক্তির কন্ঠস্বর শুনতে পায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও লোকটিকে খুঁজে পায় না। প্রথমে মনে করেছিল যে তাদের সাথে আরও একজন ছিল, সেই হয়ত দূর থেকে তাদের ডাকছে, তারপর সন্দেহ হয় সত্যি কি অন্য আর কেউ তাদের সাথে ছিল ? নিজেদের যখন তারা প্রথম গুনেছিলা তখন কি তারা নিজেকে গুনেছিল ? নাকি প্রতি জনই নিজেকেই ভুলে যাচ্ছে গোনার সময়ে ? যে লোকটি হারিয়ে গেছে বলে তারা মনে করছে, সত্যি সে কি অন্য কেউ নাকি নিজেকেই তারা হারিয়েছে ? ফলে প্রত্যেকে যখন নিজেকে হারায়, তখন তো একটি গোষ্ঠীই নিজেকে হারায়। ফলে যা ব্যক্তির দুঃখ, সে তো গোষ্ঠীরই শোক হয়ে দাঁড়াবে, ঐ যারা পার্টিশনের পর করাচিতে স্থিতু হল, মোহাজির বলা হল যাদের, নয়া পাকিস্তানেও যারা নিজেদের পথ খুঁজে বেড়ালো আর মনে পড়তে থাকল অতীতের কথা।
অতীত আর শোক আর যাত্রা আর ব্যক্তি আর পাকিস্তানের বর্তমানের সাথে যূক্ত হয়ে কিছু মানুষের ঘোরাফেরা, পথ হারানো, পথ খোঁজা, পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেও প্রশ্ন করা, পঞ্চাশ বছর ধরে ইন্তিজার হুসেনের লেখার বিষয় হয়ে ছিল।
* দ্য ডেথ অফ শেহেরজাদে, প্রকাশক হার্পার পেরেনিয়াল, ২০১৪।
* পরের পর্ব : https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17522
বাঃ, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। এঁর লেখা পড়ব দেখি। আমার দুটো জিনিস জানতে ইচ্ছে করছেঃ
(১) যেহেতু সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইনি অতীতকে দেখছেন এবং অতীত অর্থে পার্টিশনের অতীত, ধরেই নিচ্ছি মান্টোর আখ্যানগুলিতে কন্টেম্পোরারিকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে যে লিমিটেশনগুলো আমরা দেখতে পাই, সেগুলো থেকে ইনি মুক্ত। সেক্ষেত্রে একটা বড় দায় থেকে যায় স্মৃতিকে তুখোড়ভাবে ব্যবহার করার, যেমন ধরা যাক পেদ্রো পারামো। সেটা ইনি কতটা করেছেন? একটা পয়েন্ট শুধু খেয়াল রাখতে বলব যে হারানো দেশকাল সম্পর্কে বেদনা ঠিক আছে, সেটাকে অস্ত্র বানিয়ে কন্টেম্পোরারিকে কিভাবে অ্যাড্রেস করছেন?
(২) পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে ভাবলেই মনে হয় আমাদের দেশটা তো একরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গণতন্ত্র নিয়ে চলছে, ওদিকে কিন্তু গণতান্ত্রিক স্টেবিলিটি এল না। ভারতের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধ, সামরিক শাসন ইত্যাদি সব মিলিয়ে পাকিস্তানের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। অর্থহীন যুদ্ধগুলোর ফলে ভারতের থেকে বেশিই হয়েছে, কারণ ভারত তবু বড় দেশ, বড় ইকোনমি। তো এর অসম্ভব চাপ পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। এটা লেখকের পর্যবেক্ষণে কীভাবে ধরা পড়েছে? প্লাস ধরুন ৭১য় বাংলাদেশ ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য।
বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 162.158.50.219 | ০৫ মে ২০২০ ০০:০৮
অধিকারীর থিসিস নিয়ে এঁদের মতামত জানা যায়?
বোধিদা গল্পসরণী স্টলে দাঁড়িয়ে পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়ের সাথে গল্প করে ইন্তিজার হুসেন এর বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেও স্রেফ সৈকত মুখো তখনও ইন্তিজার হুসেন বিষয়ে টই খোলেনি বলে কেনেনি, এটা আমার নোট করা আছে।
দায়রা বা সার্কল এর বাংলা করলে গণ্ডী বলব না?