এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • জুনাই বিবির অভিযোজন

    Ishrat Tania লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১৮ এপ্রিল ২০২০ | ২৯৬২ বার পঠিত
  • পানির ওপর স্থির হালকা বেগুনী কচুরীপানার ফুল। আগে পাড়ের কাছাকাছিই ছিল। হাওয়ায় ভেসে ভেসে এখন একটু দূরে।
    বেগুনী ফুলগুলো আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখে নীলের গাঢ়তা। আগুনের একটা ফুলকি উড়ে এসে পড়ে ফুলের ওপর। হাওয়া বাড়লে পানিও বাড়ে। আগুন নিভে যায়। বেগুনী রঙও চঞ্চল হয়। কচুরীপানা ফুলের পাপড়িগুলো কাঁপে তিরতির। সবই দেখে সে ঘোলা চোখে আর ভাবে আগুন সত্যি নিভে যায় কি? আশ্বিনের মধ্যাহ্নে ঢাকের ওপর কাঠির বাড়ি পড়ল চড়াচ্চড়... চড়াচ্‌...চড়... সাথে খরতালের মৃদুল শব্দ মিশে ভেসে আসে দূর থেকে। পূজার বাদ্য ঢিল ছুঁড়ে দেয় নিস্তব্ধতার বুকে। শব্দতরঙ্গের ঢেউ জাগায়। পৃথিবীর এমন কতো চেনা শব্দই সাঁতরে বেড়ায় শ্রুতিসীমায়। সাহা পাড়া থেকে আসা এই বিশেষ শব্দের এক গভীর অর্থ অনুভব করে জুনাই বিবি। দেখা আর ভাবার সাথে সাথে তেলহীন পাকা চুলে আঙুল দিয়ে জট ছাড়ায়।
    পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে উত্তর দিকে মসজিদ আর কবরস্থান। পূব দিকে মাটির টানা হাঁটা পথে এগিয়ে গেলে সাহা পাড়া। এখন প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। কয়েকদিন আগেই শীল বাড়ির দুলালরা কলিকাতা চলে গেল। আগুনের অদৃশ্য ধোঁয়া আজতক মিটে নাই। হাওয়ায় ঠিক ঝাঁজ টের পায় জুনাই বিবি। সেই কবেকার মাংসপোড়া গন্ধ মস্তিষ্কের কোষে জানান দিয়ে যায়। শেষবারের মতো দুলাল দেখা করে গেল তার জুনাই ফুফুর সাথে। যাওয়ার আগে একটা টুকরিতে গাছের চারটা তাল দিয়ে গেল। দুলাল জানে তালের বড়া খুব স্বাদ লাগে জুনাই ফুফুর। বেসামাল মমতায় কিংবা ধোঁয়ার প্রখরতায় জুনাই বিবির চোখে জ্বালা ধরে।
    সাহা পাড়ার এদিকে ছড়ানো ছিটানো জোলাদের বাড়ি। পুরনো টিনের ঘর দেখা যায় বাঁশমুড়া আর জঙ্গলের আড়ালে। মন্দির পেরিয়ে বাঁ দিকে ননী পোদ্দার আর ডানদিকে মজাপুকুর ফেলে রমেশ সাহার বাড়ির ঝুরঝুরে দেয়াল। দেয়ালের ইট খুলে খুবলে নিয়ে গেছে। এতখানি পথ ভাঙতে কষ্ট হয় জুনাই বিবির। হাঁফ ধরে যায়। হাঁ করে শ্বাস নিলে বুকের ওপর লেপ্টে থাকা শীর্ণ সমতল দুটা স্তন সামান্য দুলে ওঠে। এছাড়া এদের অস্তিত্ব টের পাওয়া মুশকিল। আটপৌরে দিনগুলো থেকে আজকের দিনটা কেন যেন অন্যরকম লাগে। বাতে ধরা পা টেনে টেনে সে শতবর্ষ প্রাচীন দোতলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
    জুনাই বিবির আসল নাম জয়নাব বিবি। বয়সের গাছপাথর নাই। হতে পারে ষাট। গ্রামবাসীরা বলে কমে সত্তর হবেই। নাওতলী গ্রামে জয়নাব পরিচিত জুনাই বিবি নামে। জয়নাব নাম হারিয়েছে ঢের অতীতকালে। এমন কি সরকারী কোনো কাগজ পত্রেও তার ভালো নাম লেখা নাই।
    দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে একটা ছাগল বারান্দায় উঠে আসে। এক গাদা ল্যাদা ছড়িয়ে ব্যা ব্যা ডাকে। নিস্তব্ধতাটুকু উড়ে যায় চঞ্চলতায়। সাহা পাড়ায় এখন লোকজন নাই বললেই চলে। দালানের সামনে শিউলি গাছটার নাম নিশানা উধাও হয়ে গেছে কবেই। সেই শিউলিতলায় বড় বড় ঘাস। ঘাসের ডগা পা জড়িয়ে ধরে। শিরশির করে ওঠে জুনাই বিবির পায়ের চারপাশ।
    পুরো দালানই ভেঙেপড়া, নড়বড়ে। সদর দরজার কাঠের পাল্লা দুটা আটকানো। কড়া‍ দুটা ধরে আছে বিরাট কালো তালা। পাশাপাশি চারটি ঘরেই ছোট-বড় তালা দেয়া। তালারই বা এত ঝুলে থাকার গরজ কেন? ঘরের ভেতরে মূল্যবান তেমন কিছু নাই। যে যার মতো দখল নিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। জং ধরা কড়াগুলো জুনাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা সময় সেদিকেই তাকিয়ে থাকে সে। খসখসে আঙুল বুলায় তালার গায়ে। ত্বকে বেশ ঠান্ডা ছড়ায়। লোহার তালাগুলো থেকে ভারী আর শীতল অনুভব বেরিয়ে এসে জুনাই বিবিকে কাবু করে ফেলে। তার চোখের পাতা পিটপিট করে বার কয়েক। তবু ছানির পর্দা সরে না বরং চারদিকটা আরও ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে যায়। একটা গানের সুর প্রায় বধির কানে সে পরিষ্কার শুনতে পায়। সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে এসেছি ভুলে, মাটির প্রদীপ হয়ে তুলসী বনে...

    পলেস্তারা জুড়ে যায় জুনাই বিবির ভাবনার দেয়ালে। ভগ্নপ্রায় সাহাবাড়ির কাঠামোয় স্থির হয়ে থাকা ফাঁক ফোকরগুলো হঠাৎ ইট-কাঠ জুড়ে পূর্ণতা পায়। দেয়ালে শূন্যতার যে অংশটুকু ব্যথাভার হয়ে ছিল, শিখার সুরেলা গানের আনাগোনায় বালি আর চুন মিশ্রণের মায়াপ্রলেপ পড়ে সেখানে।
    জুনাইর গলায় সুর ঠিকঠাক বসে না। শিখা বেশ ভালো গাইতে পারে। ধনী ব্যবসায়ী সাহা পরিবারের মেয়ে শিখা রানী সাহা। শনি আর রবিবার দুপুর হলেই রেডিও মাথার কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে। দৌড়ে চলে আসে জুনাই। নাটক কিংবা অনুরোধের আসরের গান শোনে। ‘ও তোতা পাখিরে...’ শুরু হলে দুজনের চোখ জল থৈ থৈ দিঘী। শিখার খাতার পাতায় গানের কথা লিখে রাখে জুনাই।
    বিনি সুতার মালা বিনিময় করে প্রাণের সই পাতিয়েছে সেই ছোটবেলায়। পুকুর পাড়ে কড়ুই গাছের ডালে চিরদিনের তরে কবেই দুই সই নাম লিখেছে। ছুরি দিয়ে ডাল চিরে পাশাপাশি লিখেছে- জুনাই-শিখা। কষ শুকিয়ে গাঢ় বাদামী বর্ণ হয়ে আছে দুটা নাম। এক সেট ময়ূরকন্ঠী চিরুনী আর আয়না আছে জুনাইয়ের। নীল-বাদামী-সবুজে মীনা করা কারুকাজ। ময়ূর আর ফুলের নকশা করা চিরুনী আর আয়নায়। শিখাকে দিতেই খুশিতে জুনাইকে জড়িয়ে ধরল শিখা। কী সুন্দর বাহারী কারুকাজ! চিরুনীটা নিজের জন্য রাখল শিখা আর আয়নাটা ফিরিয়ে দিল জুনাইকে।
    -দুই জনের লাইগ্যা দুইডা। হইল নি এইবার হিসাব বরাবর?
    -হ। হইছে তোর মাতা! দুজনের উঁচুস্বরের হাসিতে দালানের কার্নিশ থেকে তিনটা নীলচে-ধূসর জালালী কবুতর উড়ে যায়।
    শিখার বাবা প্রৌঢ় আর অসুস্থ। ডান পাশ শক্তিহীন। বাবার পরিচর্যায় মা এতোই নিষ্ঠাবান যে শিখার সাথে বাড়তি আহ্লাদটুকুর সময় নাই। সারাদিন রোগী-পথ্য-ঠাকুরঘর-রসিঘর করে দিন শেষে তিনি গা ধুয়ে এলিয়ে পড়েন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রমেশ সাহা দ্বিতীয়। শিখার জ্যাঠা গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। জ্যাঠাইমা এখানেই থাকেন। একমাত্র ছেলে সমীর কলিকাতায় পড়ে। ছোট কাকা সতীশ সাহা ব্যবসা দেখেন। বিরাট সব কাপড়ের দোকান চান্দিনা বাজারে। কুমিল্লা শহর, হাজীগঞ্জেও তাদের রমরমা কাপড়ের ব্যবসা। ছোট কাকীমা মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে অলস দুপুরগুলোয় ওদের অনুরোধের আসরের সঙ্গী হন।
    জুনাইদের মতো এতো বড় গৃহস্থি নাওতলী গ্রামে আর কারো নাই। বার মাসে চারশ মনের ওপর ধান ওঠে ওদের ঘরে। এমনকি আকালের সময় পোদ্দাররা পর্যন্ত এসে এই বাড়ি থেকে বস্তা বস্তা ধান নিয়ে যায়। মৌসুমে সারা ঘর জুড়ে উপচে পড়ে ধান। ধানের কাজ শেষ হয়ে গেলে জুনাইয়ের আম্মা অবসরে আচার বানায়। বছরভর আচার, আমচুর, বড়ি, মোরোব্বা, বড়া কিছু না কিছু বানানো চলছেই। শুধু কি বানানো? নিত্য রোদে দেয়া, গাঢ় লাল শুকনা মরিচ টেলে ফোঁড়ন দেয়া। কাজের কোনো শেষ নাই। শিখা জুনাইয়ের বাড়ি আসে আচার আর আমসত্তার লোভে। জুনাইয়ের মা নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন শিখাকে। এলেই আচারের বয়োম খুলে দেন। ওই আদরটুকুর জন্য দুদিন অন্তর জুনাইদের বাড়ি আসতে হয় শিখার আর চালতার আচার খেয়ে একেকদিন জিভের ছাল উঠে যায়।
    -ওই! আর খাইছ না। শিখাকে আচার খেতে বারণ করে জুনাই।
    -খামু না? কিয়ারে খামু না? মুখ খুলতেই ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে গুড়ের রস। হাতের উল্টা পিঠে মুছে নেয় শিখা।
    -আ-লো! জিব্বা জ্বলবো।
    -কেডায় কইসে? জ্বলতো না। এমুন মিডাই দিছে জেডি।
    হি-হি করে হাসে দুই সই। জুনাইয়ের আম্মা দুজনের চুলে লক্ষ্মী বিলাস তেল দিয়ে বেণী গেঁথে দেন। পানের সাজি থেকে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে দুজন। লাল টুকটুক জিভ বের করে আয়নায় দেখে। কার জিভ বেশি লাল হলো। দুই প্রাণের সইয়ের পিঠে লম্বা বেণী হাওয়ায় দোলে। কখনও মালা বেণী কখনও কলা বেণীর প্রান্তে লাল ফিতা নয় ঠিক যেন জবা ফুলটি হাসছে।

    কাঁধ পর্যন্ত ধোঁয়ারঙা একগাছি চুল জুনাই বিবির। অশক্ত বাম হাতে শাড়ীর আঁচল বাম কাঁধে উঠিয়ে রাখে। বুক থেকে খুলে কখন কোলে পড়ে গেছিল কে জানে! এলোমেলো চুল ডানহাতের দুই আঙুলে চুল পেঁচিয়ে আঙুল টেনে বের করে আনে। গিঁট পাকিয়ে ঝুলে থাকে চুলগুলো। পুকুর পাড়ে হেলে পড়েছে কড়ুই গাছ। গোড়ার মাটি সরে ঝুঁকে আছে পুকুরে। যেন মুখ দেখছে পানির সবুজাভ প্রতিচ্ছায়ায়। পানির ওপর স্থির হালকা বেগুনী কচুরীপানার ফুল। আগে পাড়ের কাছাকাছিই ছিল। হাওয়ায় ভেসে ভেসে এখন একটু দূরে। বেগুনী ফুলগুলো আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখে নীলের গাঢ়তা।
    পুকুর পাড় থেকে ফিরে ফলভরা নিমগাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে জুনাই বিবি। হাওয়ায় গা জুড়ায়। নাকের ডগায় স্বেদবিন্দু জমেছে। বয়সের ভাঁজগুলো ঘামে ভিজে কপালে আরও গাঢ়, আরও স্পষ্ট। সাহা পাড়ায় যাওয়া আসার এতটা পথ হেঁটে পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে আসে।
    আশ্বিনের মধ্যাহ্ন বেলাটা জলদি ফুরিয়ে যেতে চায়। ঘাসে কাদাটে পায়ের গোড়ালী মুছে ঘুঘুর ডাক শোনে জুনাই বিবি। শাদা-খয়েরী হাঁসের দল হেলেদুলে পুকুর পাড়ে ওঠে আসে। দুটা ডানা তুলে গা ঝাড়া দিলে টপটপ পানির ফোঁটা ঝরে। আসমানের গুঁড়ো গুঁড়ো আলো জুনাই বিবির চোখে নেমে আসে। সে বুঝতে পারে, এইবার ঘুমের দিন ঘনিয়ে আসছে। ইস্রাফিলের শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া ইস্তক এই ঘুম আর ভাঙবে না।
    ঘুম পেলেই ঠাণ্ডা পানির জন্য তার গলা শুকিয়ে কাঠ আর বুকের ভেতরটা চৈত-বৈশাখের জমিন। টিনের গ্লাস ভরে ভরে পানি খেয়েও পিপাসা মেটে না। তাতানো গলা আরো শুকায়। একেক দিন কলসি থেকে সোহাগী পানি ঢালে। গ্লাসের পর গ্লাস। সোহাগী জুনাই বিবির নাতির ঘরের পুতির বউ। নয় মাসের পোয়াতী। বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে- আ-গো বড় আম্মা! আম্‌নের ভিত্‌রে না জানি কারবালা! এত পানি ক্যামনে খান?
    জুনাই বিবি বিড়বিড় করে- তুই মানু না। বশিররে আবার বিয়া করায়াম।
    ‘করাইয়েন’ বলে, ঠক্‌ করে টিনের গ্লাস মাটিতে রেখে হাসতে থাকে সোহাগী। তারপর বিড়বিড় করে- বুড়ির ঠাট কত!
    কানে তেমন শোনে না জুনাই বিবি। সোহাগীর ঠোঁট নাড়া দেখে কিছু বুঝে নেয়। বলে- এই বউ দিয়া আর চলতো না। বেডি খালি মুক করে।
    নাতির ঘরের একমাত্র পুতি বশিরুল্লাহ। জুনাই বিবির কথা শুনে সেও হাসে। সিগারেটে পর পর টান মারে। জানে, এইসব বড় আম্মার মুখের কথা। এক ছেলে আগেই মরে গেছে। একবার কলেরা লেগে সাতদিনে ছেলের বউ, এক নাতি, নাতির বউ তিন জন পরপারে গেল। সেই শোকে মহিলার মাথা আউলা হওয়াই স্বাভাবিক। যমের অরুচি জুনাই বিবি। আজরাইল তারে চোক্ষে দেখে না।
    সোহাগীর দিকে তাকিয়ে বশির বলে- তুমি মাতো কিয়ারে? হে বেডির মাতা ঠিক নাই।
    ভারী শরীর নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় সোহাগী। পাকঘরে চুলার ওপর পাতিলে গরুর মাংস ফুটছে। সাদা ভাতের সাথে ঝাল ঝাল কষানো গরুর মাংস বশিরের খুব পছন্দ। সাথে সবুজ টাটকা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজের ফালি। বশির মোবাইল ফোন বের করে চারাপোনার অর্ডার দেয়। পুকুরে মাছের মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা ছাড়তে হবে।
    কথা শেষ করে বশির ফোন ফ্ল্যাক্সি লোড করতে বের হয়ে গেল। ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে ডাল বাগারের রসুন আর পাঁচফোড়ন গরম তেলে পড়ল। এমন সুবাসেও পূর্ণগর্ভা সোহাগীর ওক্ আসে। মুখের ভিতর চিকন করে কাটা কয়েক কুচি সুপারি ফেলে দেয় সে।
    এক গাল ছেঁচাপান মুখে নিয়ে ঘুমে ঢোলে জুনাই বিবি। এইসব কথাবার্তায় জুনাই বিবির কিছুই আসে যায় না। বশির আর সোহাগীছাড়া দুনিয়ায় জুনাই বিবির আর কেউ নাই। দুপুরে ভাত খেয়ে প্রতিদিন খুটখুট পান ছেঁচে জুনাই বিবি। লালচে হয়ে যাওয়া পাতলা পলিথিন বের করে। সেখানে পান মুড়ে রাখে সে। এক সময় পলিথিনের রঙ ছিলো সাদা। ছেঁচুনিতে ভেজা সুপারি, দুটা পান, জর্দা আর চুন দেয় সামান্য। পাকাভিটে পাটের বস্তার এক টুকরা বিছায়। তিন ভাঁজ দিয়ে। এতে খুট খুট শব্দটা কমে। সারাদিন পান ছেঁচা আর হাঁটাহাঁটি। দাঁতহীন মাড়ি এতদিনে শক্ত হয়ে গেছে। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত মোতাবেক নামাজের পাটিতে বসে জুনাই বিবি। মিহি গলায় সুরা আর দরুদ শরীফ পড়ে। আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা... বাতাসিয়া সেই সুর শিউলির গন্ধ ছড়ায় সারা বাড়িতে।

    ভোরে উঠানের শিউলিতলায় ফুল কুড়ায় শিখা আর সাথে জুনাই। রাতের কুয়াশা কেটে আকাশ যেন আলোয় আলোয় পাগল হয়েছে। উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে মিঠেল রোদ।
    শিখার আজকাল বড়ো গুমোর হয়েছে। কলিকাতা থেকে বড়দা এসেছে। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ে সমীর সাহা। অর্থনীতিতে। খুবই কঠিন এবং জটিল বিষয়। শিখার চোখে মুখে প্রচ্ছন্ন গর্বের ভাব সমীরকে নিয়ে। বোনের এই হাবভাব দেখে সমীর মনে মনে হাসে কিন্তু জুনাইয়ের ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার ধরতে পারে না। জুনাই আর সেই চারা গাছটি নেই। লাবণ্যে টলটল করছে মুখ। ভাবলেশহীন চোখ দুটা একেক সময় তীব্রতায় হ্যাজাক বাতির চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।
    শিউলির গন্ধে চারপাশটা তখন অপূর্ব কোমলতায় পুণ্যময়। ফোঁটা ফোঁটা শিশিরে ভিজে এ ঘ্রাণ হিমেল অনুভব ছড়ায়। জুনাইয়ের বুক ঠেলে কী এক যন্ত্রণা গলা পর্যন্ত উঠে আসে। জুনাই নিজেও মনের দিকদিশা পায় না। তার আসলে হলোটা কী? গত বছর সমীর কলিকাতা ফিরে গেলে, সেই এক দশা। কী যেন নাই, জগৎ সংসার সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা অচেনা। এক প্রাচীন পুকুরের মন নিয়ে সে বসে থাকে। ভর দুপুরের রোদও সেই অতলে পৌঁছতে পারে না।
    সকাল বেলা সমীর ঘোলের শরবত খেয়ে দোতলার বারান্দায় বসে আছে। হাতের ওপর অর্থনীতির বই মেলে। থিওরী অফ মার্জিনাল ইউটিলিটি’র অক্ষর ছাড়িয়ে সমীরের চোখ চলে গেল শিউলিতলায়। সমস্ত আলো ঠিকরে পড়ছে জুনাইয়ের মুখে। পায়ে আলতা পরেছে জুনাই। ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের নম্র সাদার মাঝখানে গাঢ় লালের আভায় বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল সমীর। দুবার ওর চোখ জুনাইয়ের চোখ ছুঁয়ে গেল। রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ছে জুনাইয়ের দুগালে। তীব্র সুখে না অসুখে জুনাই জানে না। চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিল মুহূর্তেই।
    বারান্দার একপাশে সিঁড়িতে সমীরকে নিচে নামতে দেখেই বুকের ভেতর এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়ে গেল। এক ছুটে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল জুনাই। এতেই যেন বুকের ওই শিরশিরানিটুকু থেমে যাবে। কাঠের নিরপরাধ পাল্লা দুটা বাড়ি খেল সশব্দে।
    জুনাই জানে না, আজাদ পত্রিকায় পাকা খবর বের হয়েছে। ছয় দিন আগে কাশ্মীরের হযরতবাল মাজারে সংরক্ষিত রাসুলুল্লাহ্‌’র পবিত্র কেশ চুরি হয়েছে। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন মহল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। বন্দে মাতরম্‌। ২৪ পরগনার বনগাঁও দিয়ে হাজার হাজার মুসলমান সর্বস্ব হারিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকছে। রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত অর্ধউলঙ্গ নর-নারী-শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে বেনাপোল, বিঘা, সাতক্ষীরাসহ সীমান্তবর্তী স্থানে। এসব জানা থাকলেও জুনাইয়ের নরম গালের রক্তিমাভা কিছু কম হতো বলে মনে হয় না।
    রাতে শিউলিগাছের অন্ধকারে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি জ্বলে। জোনাকির দিকে তাকিয়ে সমীর ভাবে- জোনাকির আরেক নাম জুনি। জুনাইকে সে জুনি ডাকে মনে মনে। সমীর এখনও জানে না, খুলনার দৌলতপুরে মিল থেকে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক মিছিল বের করেছে। বন্ধ করে দিয়েছে ট্রেন চলাচল। আল্লাহু আকবার। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরীদের নিন্দাসূচক শ্লোগান দিতে দিতে শহরে ঢুকে পড়েছে। শহরে ঘরবাড়ি ভাঙচুর-লুটপাট শুরু করেছে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। খুলনা থেকে চালনা পর্যন্ত রাস্তার দু’দিকে থাকা প্রতিটা হিন্দু জনপদ, গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। পুলিশ আর ইপিআর মোতায়েন করা হয়েছে উপদ্রুত এলাকায়। নাওতলীর মতো সাধারণ এক গ্রামে এসব খবর এখনও এসে পৌঁছায় নাই। পৌঁছালেও সমীরের মনে জুনাই ঠিকই জ্বলত জুনি হয়ে। ঘোর অন্ধকারে আলোর ফোঁটা হয়ে।
    মেটে রাস্তার পরেই বিশাল মাঠ শীতের অস্পস্ট কুয়াশায় ভাসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমীর। দূরের মাঠে ঘন কুয়াশায় জুনাইয়ের আদল দেখে চমকে ওঠে। সে এক তেপান্তরের মাঠ। এতো বড়, পার হওয়া যায় না।

    ঢোল খরতালের শব্দ থেমে গেলে, দুপুরের নীরবতা নিম গাছের তলে নেমে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলার আন্দাজ লাগায় জুনাই বিবি। পেটে চিন চিন করে ক্ষুধা জানান দেয়। সেই বিয়ান বেলা চালের গুঁড়ার ছাতু পেটে চালান গেছে। অনেকদিন পর কলা, দুধ আর খুজুরের গুড়ে মাখিয়ে ছাতু খেল জুনাই বিবি। সেই ছাতু বহুক্ষণ আগেই বিপাকীয় পথ অনুসরণ করে শরীরে মিশে গেছে।
    পেটে আজকাল দুধ সয় না। দাঁতহীন মুখে মাছ খেতে বড় দিগদারী পোহায় জুনাই বিবি। দাঁতের মধ্যে কাঁটা চেপে ঝটপট বের করে আনতে পারে না। দুই হাতে কাঁটা বাছতে বাছতে মাছ খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না। অথচ মাছের কমতি নাই। মাছের প্রোজেক্টে তেলাপিয়া আর দেশি মাগুর চাষ করে বশির। পুব দিকের মাটির টানা পথ ধরে এক পাক হেঁটে এলেই দেখা যায় কত চাষের জমি এখন মাছের প্রোজেক্ট। পুকুর লীজ নেয়া, চারাপোনা আর মাছের খাবার কেনা এই খরচ বাদ দিলে বছরে দুইবারে লাখ টাকার ওপর মুনাফা থাকে। বশিরের গোয়ালে গরু চারটা। সদ্য একটা গাভীন হয়েছে। সকালে বিকালে হাঁড়ি ভরা দুধ জ্বাল দেয় সোহাগী। দুধ না যেন সুখ হাঁড়ি উথলিয়ে পড়ছে।
    ক্ষেতি-গিরস্তির কাজ গুটিয়ে এনেছে বশির। দুজন বাঁধা মুনী আছে গরুর দেখভাল আর চাষবাসের জন্য। দুপুরে সোহাগী তার ভরপুর শরীরটা নিয়ে যখন মুনীদের পাতে ধামা ধামা ভাত ঢেলে দেয়, অফুরন্ত ডালে মরিচ ডলে ভাত উড়িয়ে দেয় দুটা জোয়ান মুনী। কাউকে খালি হাতে ফেরায় না সোহাগী। চিনি, সরিষার তেল, থার্মোমিটার কি সোনামুখী সুঁই যে এসে যা চায়, সোহাগী দিয়ে দেয়। উঠানের একপাশে বশিরের ঝকঝকে সাইকেল পেয়ারা গাছে গা রোদ তাপায়। একটু পরই বশির বাজারে যাবে। একটা মণিহারী দোকান কিনে ভাড়া দিয়েছে। আরেকটা দোকানের ভিটা বায়না হবার কথা। উড়ে উড়ে কত কথাই কানে আসে। কিছু মনে থাকে, কিছু থাকে না। এই সময় খুটুর খুটুর পান ছেঁচে জুনাই বিবি আর সোহাগীর ভরভরন্ত সোনার সংসারের প্রাচুর্য দেখে।
    নাওতলী গ্রামে জুনাই বিবির বাপের বাড়ী। বিধবার থান জড়িয়ে দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে সেই যে হিজলপুর থেকে ফিরে এলো, বাপের ভিটাতেই তারপর বসবাস। কত ঝড় ঝাপটা দেখে, পাথর ঠেলে এই জীবন মাটি পেল, পানি পেল।
    পুকুর পাড়ে বাতাবী লেবুর ঝোপ থেকে বাতাবী লেবু টেনে ছিঁড়ে জুনাই বিবি। সোহাগী টক খেতে পছন্দ করে। লেবু ছাড়া পাতের এক নলা ভাত গলতে পারে না। দুইটা লেবু হাতে নিয়ে নিম গাছের তলায় বসে সে। আজ যেন বাড়ি ফেরার গরজ নাই। নাওয়া নাই, খাওয়াও নাই। জীবনের ভাটির দিকে তাকিয়ে আলস্যের হাই তোলে জুনাই বিবি। সাহা পাড়া থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় আবারো চড়াচ্চড়... চড়াচ... চড়...

    প্রাচীন পুকুরের ধারে জায়গাটা বড় নির্জন। পৌষের শেষেও পুকুরের জল টলটলে। মাঝে মধ্যেই খলবল করে মাছের ঝাঁক। পুকুরের তলপেট থেকে ঢেউ জাগে। কত যে গাছপালা পুকুরের ধার ঘেঁষে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ডালপালা মেলে। বাড়বাড়ন্ত জংলা। কড়ুই, নিম গাছের ছায়ার পাশেই জলে সোনালী রোদ্দুর হেলে পড়েছে। পোষা মোরগের খোঁজে ঝোপজঙ্গলে ঢুকল জুনাই। ভয়ডর তার বরাবরই কম। পায়ে হাঁটার পথ নাই। এর মধ্যেই ছুটছে। সকাল বেলা আম্মার দেয়া একবাটি ক্ষুদ আর ভাতের মিশেল সাবাড় করে ঘরছাড়া হয় চারটা মোরগ-মুরগি। আজ দুপুর গড়িয়ে গেল মোরগের দেখা নাই।
    ঠান্ডা হাওয়াটা জুনাইয়ের বেণী দুলিয়ে দিয়ে হু হু করে চাদরের ওমে ঢুকে পড়ে। শরীরের এদিক ওদিক শীতল রুক্ষ্ম আঙুল বুলিয়ে দেয়। কেঁপে ওঠে জুনাই। ভালো করে জড়িয়ে নেয় খয়েরী চাদর। জঙ্গলে সাড়া শব্দ নাই। শুধু একটা ঘুঘু ডাকে। জুনাইয়ের চোখ দুটা মোরগের সন্ধানে ব্যস্ত থাকায় সমীরকে দেখতে পায় না। গাছের মতোই স্থির হয়ে সমীর দেখছিল জুনাইয়ের কাজ কারবার। মোরগের লাল ঝুঁটি বেতঝোপের ভিতরে একবার দেখা দিয়ে হারিয়ে গেল। ঘন চুলের ফাঁকে টকটকে সিঁদুর যেমন নিজেকে একবার দেখিয়ে আবার লুকিয়ে পড়ে।
    -জুনি! জুনি!
    ডাক শুনে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে জুনাই। বিস্ময়ে অপলক তাকিয়ে দ্যাখে এক অপ্রত্যাশিত দীর্ঘকায় সুপুরুষ। একটা আশ্চর্য ছিপছিপে অর্জুন গাছের মতোই সমীর দাঁড়িয়ে। বুকের ভিতর থেকে আসা শিরশিরানি জুনাইয়ের নাভির কাছে প্রজাপতি উড়ায়।
    শ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে জুনাই বলে- তুমি! জঙ্গলে কিয়ারো?
    সমীর নিরুত্তর। ইচ্ছা করেই চুপ করে থাকে। ঝোপজঙ্গল-লতাপাতার মাঝখানে জুনাইয়ের চোখ মুখ কোমল আর স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে বিকালের সোনা রোদে। একদৃষ্টে সমীর তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আসলে এই দৃশ্য দেখার পর স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভর দিয়ে শুকনা পাতা উড়ে যায়। জুনাইয়ের মাথার ওপর সজনার হলুদ কয়েকটা পাতা লেগে থাকে। হাতের আলতো চাপড়ে ফেলে দেয় সমীর।
    - আমারে ছুঁইয়া দিলা? মৃদু কটাক্ষ ঝরে জুনাইয়ের স্বরে।
    - হ। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে সমীর।
    - এহন মাদাইন্যা বেলা স্নান করবা?! নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে জুনাই।
    এই হাসির জন্যই কিনা সজনা গাছের পাতা চুইয়ে আসা আলো আর ছায়া ওর মুখের ওপর কাঁপে। পরস্পরের এতো কাছে ওরা। অসহায়ের মতো দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মস্তিষ্কের এমন অদ্ভুত বিপন্নতা এই প্রথম। বুঝে উঠতে পারে না, চলে যাওয়া উচিত নাকি এই স্থিরতায় তাকিয়ে থাকাই অনিবার্য।
    বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি ওড়ে, গাছগুলো ফল মেলে দেয়। খেতে দেয় পাখিদের। এই জগৎ অত্যাশ্চর্যই বটে। তাই দূর দেশে যখন হিন্দুর জাত মসজিদ ভাঙে, জুনাই ভেঙ্গে পড়ে সমীরের বুকে। অচেনা স্পর্শের অনুভব কোমর ছাড়িয়ে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত নেমে যায়। তারপর পায়ের নিচে জমিন ছুঁয়ে দিলে টলে উঠে ভূপ্রকৃতি। দূর মুল্লুকে মুসলমানের জাত যখন কালী মন্দিরে আগুন দেয় আর হিন্দুর ঘরবাড়ি জ্বালায়, সমীরের সমস্ত রক্ত ঝিকমিক জ্বলতে থাকে জুনাইয়ের নরম স্তনের স্পর্শে। একটা সবুজ সরীসৃপ আরও সবুজ হয়ে লতাপাতায় মিশে যায়। আতা গাছের ডানায় ঠোঁট ঘষে নিয়ে, কী ভেবে বুলবুলি উড়ে যায় বাতাবীলেবু গাছের দিকে। সজনা গাছের তলে পা দিয়ে মাটি আঁচড়ায় লাল ঝুঁটি নীল ডানার মোরগ আর ধূলা উড়ায়। ধূলার সাথে উড়ায় যা কিছু এতদিন অজ্ঞাত ছিল। তারপর জঙ্গল পেরিয়ে মাঠের দিকে ছুটে যায়।

    চিরল বিরল নিমপাতা ছুঁয়ে হাওয়া নামে। জুনাই বিবির শীতাতুর কোঁচকানো ত্বকের ওপর খানিক জিরিয়ে নেয়। তারপর রোপকূপ দিয়ে ভিতরে ঢুকে কোনো এক কাণ্ড ঘটায়। এতেই খুব ঘুম পায়। দুরাত ধরে থেকে থেকেই গা কুটকুট করে। সকালে উঠে সোহাগীকে বলতে মনে থাকে না। ভালা তেল মালিশ করা দরকার।
    এককালে দেহ ছিল মসৃণতার রহস্যে মোড়া। তখন সময়টাই ছিল খারাপ। জুনাইয়ের আব্বা স্থির প্রকৃতির মানুষ কিন্তু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় তার মতো দূরদষ্টিসম্পন্ন মানুষও বিচলিত হলো। এমন দুর্যোগের সময় আবিয়াতী সমত্ত মেয়ে ঘরে রাখা নিরাপদ না। এই বিবেচনায় হঠাৎ করেই জুনাইর বিয়ে হয়ে গেল ইলিয়টগঞ্জের হিজলপুর নিবাসী কাশেম আলীর সাথে। সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে কাশেম আলী বিএ পাশ।
    দুই মাস পর জুনাই যখন নাইওর এলো, ছেলে জহিরুল্লাহ তখন পেটে। ঘরের পিছনে তেঁতুল গাছ থেকে বাদামী ফুল ঝরত। সেদিকে তাকিয়ে তেঁতুল খেতে মন চাইত জুনাইয়ের। হিজলপুর থাকতেই কাশেম আলীর মুখে আবছা শুনেছিল দাঙ্গা খুলনা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। দাঙ্গাবাজদের উস্কানীতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, চট্টগ্রামে লুটপাট আর খুনাখুনী শুরু হয়ে গেছে।
    পূর্ব পাকিস্তানের মাটি জনপদ রক্তে ডুবে গেছে। যেন পোঁচ বসিয়ে দেয়া গলা থেকে রক্ত ছিটকে এসে জুনাইয়ের মুখ ভরে যায়। কেঁপে ওঠে সে। ভয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পানির তৃষ্ণায় গলা শুকায়। সেই তৃষ্ণা বুঝি আজতক মিটে নাই। জুনাই নাওতলী এসে টের পায়, দুশ্চিন্তায় আম্মার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। গলার স্বর কাঁপছে। বেণী বাঁধার সময় আম্মা মানা করে দিয়েছে- দিনকাল কইলাম বালা না। সাউ গো বাড়িত যাওন লাগত না।
    কোনো জবাব দেয় না জুনাই। জানলার কপাট খুলে গাল ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে তেঁতুল গাছের দিকে। কষে ওর বেণী বেঁধেছে আম্মা। বেনীর ভেতর ডান দিকের কিছু চুল গোড়ায় টান খায়। ব্যথা লাগে তবু বেণীটা খোলে না জুনাই। গোড়ার দিকে চুল টেনে একটু আলগা করে দেয়। টান কমে ঠিকই কিন্তু অস্বস্তিটা থেকেই যায়। মীনা করা ময়ূরআয়নায় মুখ দেখে। আয়নায় ওর মুখের পাশে শিখার মুখের ছায়া পড়ে। চিরুনীটা কি সাথে করে নিয়ে যাবে শিখা? ওদের বাক্স-তোরঙ্গে এইটুকু চিরুনীর জায়গা হয়তো হয়ে যাবে।

    ননী পোদ্দাররা চলে গেল। ঘরবাড়ি, জমিজিরাত, গাই-গরু আর বড় ছেলে বীরেন্দ্রর দেহভস্ম ফেলে। আব্দুল হাই নামের এক লোক পূর্ব পাকিস্তানের সব হিন্দু আর অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছে। চান্দিনা বাজার থেকে কয়েকদিন আগে এই খবরই শুনে এসেছিল জুনাইয়ের আব্বা। সেই থেকে লুটপাট শুরু। ননী পোদ্দারের দোকানের সিন্দুক ভেঙ্গে ১৫ হাজার টাকা আর মাল-সামান নিয়ে গেছে গুণ্ডারা। গলা কেটে রেখে গেছে ননী কাকার ছেলে বীরেন্দ্রর।
    চান্দিনা বাজারে জুনাইয়ের আব্বা, জমিরুদ্দীন মাস্টার আর সতীশ সাহা বিসমিল্লাহ হোটেলে বসে আছে। টেবিলে আজাদ আর আনন্দবাজার পত্রিকা নিয়ে একদল মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। জমিরুদ্দিন মাস্টার খবর পড়ে শোনায়। নয়াদিল্লী থেকে ভারত সরকার দাঙ্গা সম্পর্কে সরকারীভাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাজ্য সরকার মনে করে, ঢাকাস্থ ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনারের অবিলম্বে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় সফর করা কর্তব্য... নদীয়ায় জেলা শাসক পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন অনুসারে নদীয়ার কয়েকটি এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করেছে... গত চারদিনে খুলনা শহর ও তার আশেপাশের এলাকায় ২৯ জন নিহত হয়েছে... খুলনা শহরে কার্ফু বলবৎ আছে... শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী ঢুকছে...
    জুনাইয়ের আব্বা অসহায়ের মতো বলেন- ননী দা আগেই কইছিল, এই দেশে আর থাকন যাইত না। আমি কিয়ারে মানা করছিলাম? আমরারে ভরসা কইরা ননী দা পুত খোয়াইল। হায় হায় হায়!
    জমির মাস্টার হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে রাখে। ভাঁজ করতে করতে ফিসফিস করে বলে- যতীনের মিষ্টির দোকানের চিহ্ন নাই। হালারা সব শ্যাষ কইরা দিছে।
    - বাড়িত যাই। এইরো থাইক্যা কাম নাই। ক্লান্ত বিষণ্ণ হয়ে আসে সতীশের গলা।
    - হ। দিনের আলো থাকতে থাকতে যাওন ভালা। মাস্টার, তুমি সতীশরে লইয়া যাও।
    - লও যাই।
    দুটা শব্দ অনেক্ষণ ধরে পাক খায়। বাজারের কাপড়ের দোকান, মুদী দোকান, ফলের দোকান সব বিধ্বস্ত। সতীশদের কাপড়ের দোকান লুট হয়ে গেছে। গতকাল রাতে চান্দিনা বাজারের কাছে হিন্দুদের সব কয়টা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে একদল জোয়ান ছেলে। এক ঘরের আগুনের ফুলকি উড়ে গিয়ে পড়েছে আরেক ঘরের ছনের চালে। রাতভর পানি ঢেলেও কিছু রক্ষা হয় নাই। চারদিকে আগুন। হাওয়ায় মাংসপোড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘৃণা আর অবিশ্বাসে সবারই এক অবস্থা। কে কাকে আশ্রয় দেয়? কে শোনে কার কথা? নাওতলীর জোলাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার। দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। শিশুরা কাঁদছে। কে কোথায় ছিটকে পড়ছে। রূপচাঁদ পালিয়ে যেতে চাইলে উন্মত্ত ছুরির ফলা ঢুকে গেল পেট বরাবর। এই নিয়ে চারটা লাশ পড়ে গেছে নাওতলীতে।
    জোলাদের মেয়ে মাধবীকে তুলে নিয়ে গেছে দাঙ্গাবাজ দুর্বৃত্তরা। আগুনের মশাল হাতে যারা এসেছিলো, অন্ধকারের অস্পষ্টতায় কারো মুখই ভালো করে চেনা যায় নাই। কেউ এর প্রতিবাদও করে না। যে মুখ খুলবে তারই বিপদ। এমনকি মুসলমান হলেও। বাঁশ কাটতে গিয়েছিল জোলাদের বাড়ির লোকজন। দেখে বাঁশমুড়ার অন্ধকারে মাধবীর লাশ পড়ে আছে।
    সাইকেলে করে জমির মাস্টার সতীশকে বাড়ির সদর দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু ভিতরে ঢুকে না। সেইদিনের পর প্রকাশ্যে কোনো হিন্দুকে রাস্তায় দেখা যায় না। দুশ্চিন্তায় ছাপ সতীশের মুখে।
    সন্ধ্যাআহ্নিকের ধুপের গন্ধ ভাসছে রমেশ সাহার ঘরে। উঁচু মতো যে খাটে রমেশ সাহা শুয়ে, সেটাকে খাট না বলে পালঙ্ক বলাই ভালো। সেগুন কাঠের ওপর বাহারী ফুল-পাতা আর কলকার সূক্ষ্ম নকশা তোলা। রমেশ সাহার বাবা বিয়ের সময় এই পালঙ্ক যৌতুক পেয়েছিল।
    মৃদু স্বরে সতীশ বলে- দাদা, দ্যাশের পরিস্থিতি সুবিদার না। পোদ্দারার মতো অবস্থা হওনের আগেই যত তাড়াতাড়ি দেশ ছাড়াইয়া পলান যায়।
    রমেশ সাহা সতীশের মুখ দেখে সবই বুঝল। শারীরিকভাবে অচল হলেও তার মাথা পরিষ্কার।
    - কী আর করন? কলিকাতায় কই গিয়া উডবা? কী করবা? খাইবা কী? ভাবনা চিন্তা কইরা দ্যাখছ?
    - হেইডা দ্যাহন যাইব। আগে তো জানে বাঁচি। এই দেশে মানসম্মান নিয়া থাকন যাইব না।
    - জায়গা জমি সবই বিক্রি কইরা দিবা? ভিডাবাড়িডা কইলাম বেইচ্চো না।
    পালঙ্কের পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে শিখার মা। আঁচলচাপা মুখ থেকে অস্ফুট কান্নার এক টুকরা ছিটকে বের হয়। এই প্রথম সে উপলব্ধি করে তার এত দিনের সংসার, এই খাট-পালং, ঠাকুরঘর, ঢেঁকিঘর, ধানের ডোলা, থালা-বাসন সব পেছনে ফেলে সত্যি সত্যিই চলে যেতে হবে।
    সমীর নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ বীরেনের গলাকাটা লাশের কথা ভেবে ওর শরীর শিউরে ওঠে। বীভৎস এই দৃশ্য কিছুক্ষণ পর পর ওর চোখে ঠোক্কর মেরে যায়। আবাল্য বন্ধুকে হারিয়ে তার মনে হয়, বাসভূমির কি জাতি ধর্ম বর্ণ হয়? হয়তো হয়। হিন্দুর জন্য এই দেশ না। হাজার বছর ধরে আঁকড়ে ধরে থাকা দেশ, মাটি, স্বজন কিছুই থাকল না। জীবনের বেশিরভাগটাই নিয়ন্ত্রণঅযোগ্য অজানা। সব কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন এই বাড়ি ঘর কড়ি বর্গা সব অতীত হয়ে যাবে। ওই যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা কুয়াশার মাঠ, শিউলিতলার আলোর ফোঁটা... মানচিত্রের এদিকে যা কিছু, আছে থেকে ছিল হয়ে যাবে, ওদিকের উদ্বাস্তু জীবনে।
    সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আগরতলা হয়ে কলিকাতা যাওয়া হবে। আগে শিখারা যাবে। সতীশের এক বন্ধুর বাড়িতে আপাতত উঠবে। সমীর আর সমীরের মা যাবে ওদের সাথে। আগরতলা পর্যন্ত ওদের দিয়ে আসবে জমির মাস্টার। একজন মুসলমান সাথে থাকলে কিছুটা নিরাপত্তা থাকে। এই বাড়িতে শিখাই শুধু কোনো কথা বলছে না। চোখ দুটা ফুলে লাল রক্তজবার মতো লাল। মাথা তুলতে পারছে না জ্বরের ঘোরে। সে ভাবছে বুকের মধ্যে শিউলি তলা আর পুকুরটা নিয়ে যাবে।
    এদিকে শরীর ভালো যাচ্ছে না জুনাইয়ের। তিন মাসের গর্ভ। এই নিত্য গা-গোলানী আর ভালো লাগে না। লেবুপাতা ছিঁড়ে নাকের সামনে ধরে জুনাই। নরম গন্ধ মস্তিষ্কের কোষে ঢুকে গেলে গা বমিভাবটা কমে। শিখারা কী সত্যি এই দেশে আর থাকবে না? ফেলে যেতে পারবে? এই কড়ুইগাছ, পুকুর পাড় ফেলে? শিউলিতলায় বুঝি আর ফুল কুড়াবে না? এমন হয়? এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই পুকুর পাড় ধরে নেমে যায় জুনাই। ঠাণ্ডা পানিতে পা ছ্যাঁত করে ওঠে। এক পা দিয়ে আরেক পা ঘষে পরিষ্কার করে। তারপর কড়ুই গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
    শিখা-জুনাই নাম দুটার ওপর হাত বুলায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এই দেশ কি আর সমীর দা’র না? ধর্ম যদি আপন হয় তবে কি ঘাসমাটি, নদীজঙ্গল, বসতবাটি পর হয়ে যায়? ফাল্গুনের ঝকঝকে আকাশ। তবু চারদিকে কেমন অন্ধকার। মত্ত হাতীর মতো এই দাঙ্গা সারা দুনিয়া চুরমার করে দিয়েছে। টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে পড়ছে আসমান। এই জনপদের শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে কোথায় যে ছিটকে পড়ছে। খণ্ডিত অংশগুলো জুনাই আর একাট্টা করতে পারে না।
    সবই কেমন যেন ম্লান। দেব-দেবীর মুখ দেখলে খোদায় পাড়াইব কবরের ভিতরে। ভুলেও যেন মুসলমানরা সাহা পাড়ার দিকে না যায়। ইদানীং হাওয়ায় এসব কথা ভাসে। ফাল্গুনের হাওয়াটাও এসব শুনে থমকে আছে। লুকিয়ে শিখার সাথে দেখা করতে যায় জুনাই। মূর্তির দিকে না তাকালেই হলো। একতলায় বৈঠক ঘরে রেডিও শুনছে সমীর। সংবাদ পাঠকের গলা শোনা যাচ্ছে- ইসলামাবাদে ফেরার প্রাক্বালে ঢাকা বিমানবন্দরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ঘোষণা করেন... শিখার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় জুনাই। অস্পষ্ট হয়ে আসে বাক্যের বাকিটা ...হজরতবাল ঘটনার কারণে পাকিস্তানের মুসলিমরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালে তার কোন দায় নাই...
    বোরখার নেকাব তুলে সোজা হেঁটে শিখার ঘরের দরজায় সামনে দাঁড়ায় জুনাই। জোরে ধাক্কা দেয়। কড়া‍ দুটা ধরে আছে বিরাট কালো তালা। হতভম্ব হয়ে অনেকটা সময় সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। মসৃণ আঙুল বুলায় তালার গায়ে। ত্বকে বেশ ঠান্ডা ছড়ায়। লোহার তালাগুলো থেকে ভারী আর শীতল অনুভব বেরিয়ে এসে জুনাইকে কাবু করে ফেলে। চোখের ভেতরটায় জ্বালা ধরিয়ে উপচায় উষ্ণ পানি। গাল ছুঁয়ে নামে চিবুকে। তালা খোলার মন্ত্র সে জানে না। কালো তালার ওপর জোছনার মিহি পর্দা নামে। ওই পর্দা চুইয়ে দৃষ্টির ধার তালা খুলতে পারে না।
    সমীর নয় শিখাদের সাথে গেছে সতীশ। গড়িয়ায় দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজের সামনে নাকি প্রায় শ’খানেক ছাত্র ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। পুলিশের গুলিতে শ্রীভূদেব সেন নামের এক ছাত্র মারা গেছে। কথা সত্য না মিথ্যা জানে না কেউ। এসব শুনেই সতীশ সমীরকে যেতে মানা করেছে। কলিকাতার পরিস্থিতি শান্ত হলে সমীর ওর মাকে নিয়ে চলে যাবে।
    বাতাসে উড়ে উড়ে কত কথাই রটে যায় দ্রুততায়। এন্টলী, বেনেপুকুর, আমহার্স্ট স্ট্রীট, বেলেঘাটা, হাওড়া সর্বত্র সকাল-সন্ধ্যা কার্ফু চলছে। সমীরের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলিকাতার রাস্তা। দমকল বাহিনী আর সেনাবাহিনীর গাড়ী ছুটছে আর জনশূন্য খাঁ খাঁ বাড়িগুলো আগুনে পুড়ছে। পশ্চিম বাংলার আগুনের হলকায় পূর্ব পাকিস্তান পুড়ে ছাই। যেন এই ভস্মের ওপরেই জনমভর দাঁড়িয়ে আছে সমীর আর জুনাই। যেন এই বর্তমান ভিন্ন কোনো অতীত, কোনো ভবিষ্যত তাদের নাই।
    সমীর এসে জুনাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। সামনে তালাবদ্ধ দরজা। সমীরের দিকে প্রখর চোখে তাকিয়ে থাকে জুনাই। অভিমানের সুঁইয়ে আক্রোশের ফোঁড় গেঁথে যায় সমীরের চোখে। সমীরের বুকের কাছে শার্ট টেনে জুনাই বলে- শিখা কই? কই গ্যাছে হ্যারা?
    যেন সমীর না বললে জুনাই জানে না, শিখারা কোথায় গেছে। আচমকা জুনাইরের মাথায় স্থির হয়ে থাকা পোকাগুলো কেঁপে ওঠে। সব দোষ যেন সমীরের। সমীরের জন্যই এই হিন্দু-মুসলমান নিধন। মানুষ কাটাকাটি চলছে। সর্বস্ব ত্যাগ করে শিখাকে চলে যেতে হয়েছে এই সমীরের জন্য। সমীরের জন্যই সাহা পাড়া উজাড় করে একে একে সবাইকে দেশান্তরী হতে হলো। এতটা অক্ষম সমীর, কিছুই আটকাতে পারল না।
    একটা কথাও বলতে পারল না জুনাই। শব্দহীন এক নিথর অবশ শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সমীরের সামনে। তেল ফিতা... আচার আয়না... গানের খাতা... একবার ওর চোখে ধরা দিয়ে, শিউলতলা হয়ে মাঠ-জঙ্গল পেরিয়ে কোন দূর মুল্লুকে মিলিয়ে যায়। মাথা টলে ওঠে জুনাইয়ের। তার ক্লান্ত ভয়ার্ত চেহারা দেখে সমীর জিজ্ঞেস করে- জল খাইবা?
    -জল?
    -হ।
    -জলই তো। এইরো পানি নাই।
    জল আর পানি। পানি আর জলের যে কী গভীর বিভেদ এই পরম সত্য উপলব্ধি করে জুনাইয়ের জ্বলতে থাকা চোখ দুটা নরম হয়ে আসে। অথচ কী আশ্চর্য, চোখ উপচে জল কিংবা পানি গড়িয়ে পড়ে না। বড় বড় ফোঁটা হয়ে নিস্ফল অভিমানে দুলতে থাকে।

    পিঁপড়ার কামড়ে জুনাই বিবির দুই রাত ঘুম হয় নাই। ঘরের এক ধারে ভুট্টার বস্তা রাখা। বারোটা একমইন্যা বস্তা। এবার আগুন মাসে আলু তুলে, জমিতে ভুট্টা করেছে বশির। ভুট্টার দাম পড়তির দিকে। সামান্য উঠলেই বাজারে তুলবে। বিক্রি করে দিবে। আকাশের আলো নিভে গেছে। চকির ওপর শুয়ে ইয়াসীন সুরা পড়ছে জুনাই বিবি। ঘর ভরা পাকা তালের মিষ্টি বাসনা তার নাকে ঝাপট মারে। তালের রস জ্বাল দিয়েছে সোহাগী। এই রকম একটা আন্দাজ লাগায় সে।
    হঠাৎ গা কুটকুট করে। শোয়া থেকে উঠে বসে জুনাই বিবি। অন্ধকারে চোখে কিছুই দেখে না। সরু গলায় ডাক ছাড়ে- ওই সোহাগী, সোহাগী।
    ঘরের জমাট অন্ধকারে চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব লালচে আলো ছড়ায়। সোহাগীর কান খাড়া। এক ডাকেই পাশের ঘর থেকে উঠে এসেছে। জুনাই বিবি জিজ্ঞেস করে- এইডা কিতা গো? দ্যাখ্‌সে। য্যামনে কামড়াইছে!
    লাল পিঁপড়া আর কী! সোহাগী উৎসস্থল খুঁজে বের করে। ভুট্টার বস্তায় পিঁপড়া ধরেছে। চকির ওপরের পিঁপড়া মারে সে টিপে টিপে। হেসে বলে- আমনে জানি মিডা। হের লাইগ্যা শইলে পিরপা উডে।
    জুনাই বিবি শাড়ি ঝাড়ে। ঘরে আলো নেই। বেশিরভাগ সময়ে কারেন্ট থাকে না। আসে মাঝে মাঝে। হাত পাখা নাড়তে নাড়তে বলে- তোর বাচ্চার লাইগ্যা কলার ডগা কাইট্যা কাজল তুইল্লাম। বাজাইর‍্যা কাজল বালা না।
    সোহাগী হাসে। হঠাৎ ডান হাত নিজের তলপেটের ওপর রাখে। শরীরের নিচটুকু ভিজে গেছে। আঁতকে ওঠে সোহাগী- পানি ভাঙ্গতাছে বড় আম্মা!
    ভাঙে তো দেশও, মন ভাঙে। মিসমার হয়ে যায় ভরন্ত সোনার ঘরসংসার, সাধের খাটপালং, শিথানপৈথান আর নাড়ি পোঁতা উঠানের মাটি। কত জন্ম কত মৃত্যু এসে মিশে গেছে জুনাই বিবির করুণ ক্লান্ত জীবনের প্রবহমানতায়। আযানের সুর আর সদ্যজাত’র কান্নায় রহস্যময় হয়ে ওঠে দিন রাত্রির মিলনক্ষণ। পোলা অইছে তোর! শত শত আলো আঁধারির জগত পেরিয়ে জুনাই বিবির অস্পষ্ট চোখ লেপটে থাকে নবজাতকের চোখে মুখে। প্রাচীন এক পুকুরের অতলে তীব্র ঘুর্ণি ওঠে আর চালধোয়া পানির মতো ঘোলাটে দৃষ্টি আচমকা স্পষ্টতা পায়। গহীন থেকে পাক খেয়ে দুটা অস্ফুট শব্দ তার শুষ্ক ঠোঁটের জমিনে নেমে আসে- সমীর দা! কিংবা কোনো শব্দই ঠোঁটে স্থির হয় না। শব্দ দুটা অনুচ্চারিত ভাবনায় রূপান্তরিত হয়।
    শিউলির গন্ধে ঘোর লাগে জুনাই বিবির। হিম আবেশে আলো ফোটে। জুনাই বিবির ভাবনা সেই নরম আলোয় ভেসে ভেসে উড়ে যায় বহুদূরের কোনো এক মুল্লুকে। পেছনে ঝাপসা হয়ে আসা পুকুড় পাড় আর কাঁটাতার ফেলে, ভূমিহীন হয়ে...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৮ এপ্রিল ২০২০ ০৭:১৬730681
  • "এই দেশ কি আর সমীর দা’র না? ধর্ম যদি আপন হয় তবে কি ঘাসমাটি, নদীজঙ্গল, বসতবাটি পর হয়ে যায়? "

    বড়ই কঠিন ধাঁধা ইশরাত!

    এতো বছর ধরে পদ্মা আর গংগায় কতই না জলপানি বয়ে গেল, তবু কী মিমাংসা হলো এই দ্বন্দ্বের?  এখনো দুইদেশে জাতের নামে বজ্জাতি, আর ধর্মের নামে অধর্ম।... 

    লক্ষীরাজ তেল, আমচুর, ময়ুরআয়না, কড়ুই বৃক্ষে শিখা-জুনাই, মাদাইন্যা বেলার স্নান,  সবুজ সরিসৃপ, হযরতবাল মসজিদ চুরি, ননী কাকার গলা কাটা ছেলে,  ঘরপোড়া ভস্মের সংগে মাংস পোড়া গন্ধ,  কবরের ভিতর  খোদার পারা,  পানি আর জলের ফারাক,  শিউলি তলা পুকুরপাড়,  সোহাগীর ভরা সংসার, কলা ডগায় কাজল,  সাউপাড়ার দেশান্তর ইত্যাদিতে কাহিনীটি খুব  জীবন্ত।  "ন হন্যেতে" জাত অতীত-বর্তমানের মিশেলে ট্রাজেডির বাঁধনও খুব পোক্ত, যেমন সিনেমায় "টাইটানিক"। রীতিমতো পাকা হাতের লেখা।

    যদিও এই সাত সকালে বুকের ভিতর কাঁঁটা বিঁধে গেল,  তবু বলবো আরও লিখুন। 

    গুরুচণ্ডা৯'তে স্বাগতম।  শুভ  

  • etao comment | 141.101.77.127 | ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৬:১৮730685
  • হরেন পক পক
  • বিপ্লব রহমান | ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৭:০৫730686
  • পুনশ্চঃ গুরুতে নিজের নাম বাংলা লিখলে দেখতে ভাল দেখবে, আর লেখায় প্রতি প্যারায় লাইন স্পেস থাকলে অনলাইন লেখায় চোখের আরাম হয়। 

    #

    অনুপ্রশ্নঃ লেখাটি কুমিল্লার চাঁদপুর -ইইলিয়টগঞ্জ অঞ্চলের হলেও কথোপকথনে বোধহয় ময়মনসিনংহ, - ঢাকা অঞ্চলের প্রভাব? নাকি বুঝতে ভুল হলো?       

  • ইশরাত তানিয়া | 172.69.33.150 | ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৩০730691
  • গল্পটিকে সময় দিলেন। অনেক ধন্যবাদ জানবেন। এমনই তো হয়। কোথাকার জলপানি কোথায় গড়ায়। সমীর দা জানলই না!  কুমিল্লার জুনাইও জানে না কলকাতা মহানগরীর কোথায় কোন অতলে হারিয়ে গেছে সমীর দা। এই তো জীবন! 

    কথোপকথন কুমিল্লার ভাষায় লেখা। কুমিল্লার সব এলাকার ভাষাও এক নয়। শব্দের ফারাক আছে। কোথাও নোয়াখালী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টান আছে। চাঁদপুর আর কুমিল্লার ভাষাও এক নয়। 'এখানে' শব্দটিকে কুমিল্লায় বলে 'এইরো'। চাঁদপুরে 'এমিক্কা'। নোয়াখালীতে 'এমি'। কাছাকাছিই। 

     ময়মনসিংহের ভাষা বুঝি কিন্তু লিখতে বলতে অপারগ। করছুইন খাছুইন এই এতোটুকুই।

    অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান।  ভালো থাকুন। সুরক্ষায় থাকুন।  

  • বিপ্লব রহমান | ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০৭:০৯730695
  • "কথোপকথন কুমিল্লার ভাষায় লেখা। কুমিল্লার সব এলাকার ভাষাও এক নয়। শব্দের ফারাক আছে। কোথাও নোয়াখালী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টান আছে। চাঁদপুর আর কুমিল্লার ভাষাও এক নয়। 'এখানে' শব্দটিকে কুমিল্লায় বলে 'এইরো'। চাঁদপুরে 'এমিক্কা'। নোয়াখালীতে 'এমি'। কাছাকাছিই। " 

    খাইছে! এইডা দেহি বিরাট দিকদারি ভাষা! লল :ডি 

    গুরুতে প্রচুর লিখুন   

  • রৌহিন | 108.162.215.37 | ১৯ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫৮730697
  • অসাধারণ! একটানে পড়লাম। চেনা মানুষের অচেনা হয়ে যাবার সেই গল্প যা আমাদের গত সত্তর বছর দংশন করেই চলেছে।
  • ইশরাত তানিয়া | 162.158.207.135 | ১৯ এপ্রিল ২০২০ ২২:০৪730699
  • আপনার মন্তব্যে প্রাণিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাই।  

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন