এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • শাইনিং ইন্ডিয়া, কালো ভারত

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৪ অক্টোবর ২০০৯ | ১০৮৮ বার পঠিত
  • ১।
    অবস্থা উদ্বেগজনক, সন্দেহ নেই। ছত্রধর মাহাতো দিয়ে শুরু। তারপর রোজই ধরপাকড় চলছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, যে, এখন থেকে মাওবাদী বলতে শুধু জঙ্গী কার্যকলাপ নয়, জঙ্গীদের প্রতি মতাদর্শগত সমর্থনও বোঝাবে। ফলে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা মাওবাদীদের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও একই ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব এবং পুলিশ অফিসাররা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, যে, মাওবাদী বা জনসাধারণের কমিটির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য তাঁরা দেখছেন না। গ্রেপ্তারের পর ছত্রধর মাহাতোকে জেরা করে জনসাধারণের কমিটিকে সাহায্য করেছেন এরকম বহু মানুষের নাম পাওয়া গেছে। এবং সহায়তাকারী এই সমস্ত যেকোনো লোকের বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় বে আইনী কার্যকলাপ নিরোধক আইন (ইউএপিএ) মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। শুধু ঘোষণাতেই ব্যাপারটা থেমে নেই। গ্রেপ্তার চলছে। বন্ধ করা হচ্ছে ছাপাখানা। এই লেখা লিখতে লিখতেও আরও কিছু গ্রেপ্তার হয়ে যাবে, সন্দেহ নেই।

    এখানে একটা ব্যাপার রহস্যজনক। রহস্যটা এটাই, যে, শহরের লোকজনের সঙ্গে যে জনসাধারণের কমিটির যোগাযোগ আছে, সেটা জানতে পুলিশি কর্তাব্যক্তিদের কেন ছত্রধর মাহাতোর গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল, সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। লালগড়ে আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে দলে দলে শহুরে বুদ্ধিজীবীরা ওদিকপানে গেছেন। ঢাল ঢোল পিটিয়েই গেছেন। গেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। গেছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম। স্বজনের লোকজন গেছেন ছত্রধরের সঙ্গে মিটিং করতে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের রিপোর্টগুলি প্রকাশিত হয়েছে নাম ধাম দিয়ে। সর্বসমক্ষে। বুদ্ধিজীবীরা নন্দীগ্রামের মতো লালগড়ের আন্দোলনকেও সমর্থন জানিয়েছেন। প্রকাশ্যেই। এই সাতকান্ড রামায়ণের শেষে, এতদিন পরে, পুলিশি কর্তাব্যক্তিরা যদি জানান, যে, এসব সম্পর্কে এতদিন তাঁরা অন্ধকারে ছিলেন, ছত্রধরকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে জেরা-টেরা করে, তবেই তাঁরা শহরের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জনসাধারণের কমিটির যোগাযোগের ব্যাপারটি জানতে পারলেন, তবে সেটা হাস্যকর দাবী হবে। কোনো সন্দেহ নেই, যে, এই যোগাযোগগুলি কখনই খুব গোপন ছিলনা। নৈতিক সমর্থনই হোক, বা মধ্যস্থতা, সেসব প্রকাশ্যেই করা হয়েছে। পুলিশ থেকে মিডিয়া পর্যন্ত সবাই সেসব জানে ও জানত। গুরুত্ব বুঝে মিডিয়া সেসব প্রচার করেছে, বা করেনি। কিন্তু গোপনীয়তা কোথাও ছিলনা।

    তাই ব্যাপারটা এরকম নয়, যে, ছত্রধর মাহাতোর গ্রেপ্তারের পর হঠাৎ করে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জনসাধারণের কমিটির কোনো গোপন যোগাযোগের কথা দুম করে জানা গেছে। এবং জানার পর পুলিশ কর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে, এই "সাহায্যকারী' বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাপারটা আদপেই তেমন নয়। আসলে সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। "বিশৃঙ্খলা' একটি পর্যায়ে পৌঁছনোর পর রাজনৈতিক মাথারা একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে, একে আর বাড়তে দেওয়া চলেনা। যেহেতু আন্দোলন বা বিশৃঙ্খলা, যে নামেই একে ডাকা হোক, তা সিভিল সোসাইটি থেকেই সংগ্রহ করে ও করেছে তার নৈতিক সমর্থনের ভিত্তি, তাই, সেই নৈতিক সমর্থনের উপরেও আঘাত হানা দরকার। মুখ বন্ধ করা দরকার সিভিল সোসাইটির স্বঘোষিত মুখপাত্রদের। অতএব এই ফতোয়া।

    এই সরকারি ফতোয়াগুলি যদি আক্ষরিক অর্থে নিতে হয়, তবে কোনো সন্দেহ নেই, তা, এক কথায়, গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিপজ্জনক এই কারণে, যে, "রাজনৈতিক সমর্থন' বা "সহায়তা' নামক ব্যাপারগুলো এতই ধোঁয়া-ধোঁয়া, যে, তাকে টেনে টুনে যতদূর খুশি বাড়িয়ে নেওয়া চলে। বোমাবন্দুক বয়ে দেওয়াটাও সহায়তা হতে পারে, নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হওয়াটা সহায়তা হতে পারে, আবার নিষিদ্ধ নয় কিন্তু সরকারি বয়ান অনুযায়ী "মাওবাদী ঘনিষ্ঠ' কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে সেটাও রাজনৈতিক সমর্থন হিসেবে গণ্য করা যায়। এমনকি এসবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংযোগশূন্য কোনো ব্যক্তি চারটি গরম-গরম কথা বললে, সেটাও রাজনৈতিক সমর্থন হিসেবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে। প্রকৃত অর্থে, "রাজনৈতিক সমর্থন' এর জন্য কারো মুখ বন্ধ করার প্রচেষ্টার বিপজ্জনক দিকটি হল, যে, তা সমর্থন ও বিরোধিতার মধ্যবর্তী ধূসর এলাকাটির অস্তিত্ব একেবারে উড়িয়ে দিতে চায়। এখানে দুটিই পক্ষ। আমার এবং শত্রুর। হয় তুমি আমার পক্ষে। অন্যথায় শত্রুর সঙ্গে কোনোরকম ডায়ালগে যাবার চেষ্টা করেছ কি তুমি শত্রুর পক্ষে। "মধ্যস্থতা করা', কথোপকথন চালানো, ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারস্যাপারগুলি এই অভিধান অনুযায়ী একেবারে অস্তিত্বহীন। এ এক বাইনারি পৃথিবী, যেখানে, পক্ষে ও বিপক্ষের বাইরে আর অন্য কোনো পরিসর নেই। হয় তুমি "সংসদীয় গণতন্ত্র'র পক্ষে, "উন্নয়ন'এর পক্ষে, চকচকে উজ্জ্বল ধপধপে ইন্ডিয়ার পক্ষে, কিংবা তুমি উগ্রপন্থীদের পক্ষে, সন্ত্রাসের পক্ষে, অখন্ডতা ও উন্নয়নের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক এক অস্তিত্ব। এখানে সাদা আর কালোর বাইরে অন্য কোনো রঙ নেই। কালোকে ধ্বংস করে সাদাকে জিততেই হবে, যেকোনো মূল্যে। তার জন্য রাষ্ট্র ও জনসমাজের মধ্যেকার গণতান্ত্রিক পরিসরটি ধ্বংস হলে হোক, এই হল দাবী।

    ২।
    প্রকৃত পক্ষে এই সাদা-কালোর খেলাটি নতুন নয়। মোটা দাগের সাদা-কালো রঙে বাস্তবতাকে রাঙিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটিও নতুন নয়। ইরাকে-আফগানিস্তানে তো বটেই, ভারতবর্ষেও এই খেলা আগে হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে এই খেলাটি একটি অন্য মাত্রা নিয়েছে। বিগত কয়েকটি দশক ধরে সারা ভারত জুড়ে আমরা ক্রমাগত: নিও-লিবারাল মুক্ত অর্থনীতির জয়ধ্বনি শুনে আসছি। সার্ভিস সেক্টর বুমিং, জিডিপি রকেটের গতিতে বাড়ছে, আইটি আর বিপিওরা বাড়িয়ে চলেছে কর্মসংস্থান, রিয়েল এস্টেটের দাম বাড়ছে চড়চড়িয়ে, দ্রুতগতিতে তৈরি হচ্ছে গাড়ি-বাড়ি-রাস্তা-ফ্লাইওভার। ঝকঝক করছে শহুরে ইন্ডিয়া, প্রথম বিশ্বে উঠে আসার জন্য পাল্লা দিচ্ছে চিন আর ব্রাজিলের সঙ্গে। এই হল সাদা ইন্ডিয়া, ইংরিজি বলিয়ে-কইয়ে ইন্ডিয়া, কম্পিউটার লিটারেট ইন্ডিয়া, উন্নততর ইন্ডিয়া, যা জেটযুগ ছাড়িয়ে নেটযুগে প্রবেশ করছে, যা শাইনিং, নিয়ন আলোর ন্যায় সাদা ও চকচকে, যার অগ্রগতির বাণীতে আমাদের টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়া পরিপূর্ণ।

    অথচ কে না জানে, যে, যাহা চকচক করে তাহাই সোনা নয়। অতএব, এই চকচকে ইন্ডিয়ার ঠিক পাশেই আছে আরেক কালো ভারত। যা ঠিক ততটা উন্নত তো নয়ই, বরং "উন্নয়ন'এর বাধাস্বরূপ। সেই ভারত শিল্পস্থাপনের বিরোধী, তথাকথিত উন্নয়নের বিরোধী, কূপমন্ডুক এবং ডেঞ্জারাস। এই ভারত কলিঙ্গনগর-নন্দীগ্রামে জমি নিয়ে সেজ বানাতে গেলে বাধা দেয়। হাইটেক শিল্পায়নের অগ্রগতিকে বাধা দেয়। অ্যাসপিরেন্ট মধ্যবিত্তের চকচকে বাসনাকে বাধা দেয়। আইনী পথে না পারলে ছোরাছুরি বোমা-বন্দুক দিয়ে রক্তপাত ঘটায়। জঙ্গলের খনিজ সম্পত্তি, প্রাকৃতিক রিসোর্সগুলিকে ব্যক্তিমালিকানার হাতে তুলে গেলে আটকানোর চেষ্টা করে। এমনকি শিল্পায়ন তো পরের কথা, এমনকি বাঁধ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ড্যাম বানাতে গেলেও আপত্তি করে। যেকোনো "উন্নয়ন'এর প্রক্রিয়ার সামনেই জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে এই ভারত।

    কেন এই বাধা, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে ও হবে। কালো ভারতের আমজনতা কি ভাবে চিন্তা করে, সে বোঝা খুব শক্ত। এক, হতে পারে, জনতা নিজের অবস্থায় খুব খুশি। কোনো পরিবর্তন চায়না (এরকম হওয়া শক্ত যদিও)। দুই, জনতা নিজের অবস্থায় মোটেও খুশি নয়, সে উন্নয়ন অবশ্যই চায়। কিন্তু যে মডেলে উন্নয়ন, সেটা আখেরে তার অবস্থার ক্ষতি করবে। তার সর্বনাশ করবে। সেকারণে সে বাধা দিচ্ছে। তিন, জনতা এই মডেলেই উন্নয়ন চায়। কিন্তু মডেল যাই হোক না কেন, উন্নয়নের সুফল তার কাছে আদৌ পৌঁছচ্ছেনা আমলাতান্ত্রিকতা, বা পরিকল্পনা, বা রূপায়ণের গলদের জন্য। গলদ যারই হোক না কেন, জনতা অন্যের উপকার হবে বলে স্থিতাবস্থা ভাঙতে দেবে কেন, যেখানে নিজের উন্নয়নের কোনো গ্যারান্টি নেই? চার, উন্নয়নের সুফল জনতার কাছে আদতে পৌঁছবে। কিন্তু সেটা আমজনতা বুঝছেনা। তাই আপত্তি করছে।

    তা, জনতার আপত্তির এই নানাবিধ কারণ থাকতে পারে (আরও কারণও থাকতে পারে), যার কোনটা "আসল' তা আমাদের জানা নেই। কোনো সন্দেহ নেই, সরকারেরও জানা নেই। সম্ভবত: সবকটি কারণই এর মধ্যে বিভিন্ন অনুপাতে মিশে আছে। কিন্তু কারণ যাই হোক না কেন, ক্ষোভ একটা আছেই। সমস্যাটা হচ্ছে, সাদা ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে কালো ভারতের সমস্যা ও ক্ষোভ বোঝার কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছেনা। সাদা ইন্ডিয়ার বিপরীতে আনপড় ভারতকে আঁকা হচ্ছে, জাস্ট একটি রঙে। সেই রঙটি, বলাবাহুল্য, কালো। সাদা ইন্ডিয়ার মুখপত্র মিডিয়া ও সরকার দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করে আসছে, অন্য কোনো কারণ নয়, "উন্নয়ন'এর পথে বিরোধিতার একমাত্র কারণ হল, এইটা না বোঝা, যে, এতে জনতার আখেরে ভালই হবে। বলা হচ্ছে, "উন্নয়ন' এর পথে গেলে, সেজ এর পথে গেলে, খোলা বাজার ও শিল্পায়নের পথে গেলে আখেরে সক্কলেরই লাভ। সাদা ইন্ডিয়ার তো লাভ বটেই। আর সেই লাভ চুঁইয়ে পড়বে ভারতের বুকেও। এমতাবস্থায় উন্নয়নের বিরোধিতা যে বা যাঁরা করছেন, তাঁরা হয় মূর্খ, নয় উন্মাদ, কিংবা ভুল বুঝছেন ও বোঝাচ্ছেন। বিপথে চালিত হচ্ছেন ও চালনা করছেন মূর্খ ভারতবাসীকে। আর যারা ভুল বুঝছেন ও বোঝাচ্ছেন, তাঁদের সিধে করার পদ্ধতি হল ঠিকটা বোঝানো। বুঝলে ভালো, নইলে এই কালোদের জন্য একমাত্র ওষুধ হল ঠ্যাঙানো। লাঠিই একমাত্র রাস্তা। গায়ের জোরই একমাত্র পথ। যা অকাতরে প্রয়োগ করা হয়েছে সর্দার সরোবর বাঁধ নির্মানের জন্য। প্রয়োগ করা হয়েছে কলিঙ্গনগর ও নন্দীগ্রামে।

    মিডিয়ায় এসব নিয়ে হইচই হয়নি তা নয়। যথেষ্ট হয়েছে। সরকারের শিল্পস্থাপনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দমন-নীতি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। মানুষ মরলে হট্টগোল হবেই। কিন্তু তারও মূল সুর ছিল, যে, উন্নয়নের সুফল মানুষকে "বোঝানো' যায়নি। বা সরকার যথেষ্ট "সংবেদনশীল' হয়নি। কিন্তু আদতে এই "উন্নয়ন' জনতা চায় কিনা, বা না চাইলে কেন চায়না, না চাওয়ার পিছনে তাদের যুক্তিপরম্পরাটিই বা কি, সেই মৌলিক প্রশ্নগুলি আলোচনার পরিসরের বাইরেই থেকে গেছে। ধরে নেওয়াই হয়েছে, যে, "উন্নয়ন' একটি আপ্তবাক্য, যাহার উপরে আর অন্যকিছু নাই। "উন্নয়ন'ই হল ভারতের ভবিতব্য আর সেজই হল সেই সর্বরোগহর ঔষধ, যা "উন্নয়ন'এর মোক্ষে পৌঁছে দেবে (বলাবাহুল্য এখানে "উন্নয়ন' বলতে চালু মডেলটির কথাই বলা হচ্ছে)। এবং এর বিপরীতে আওয়াজ যারাই তুলেছে, তাদেরকে চিত্রিত করা হয়েছে কালো রঙে। হয় উন্নয়নবিরোধী সুবিধাবাদী। কিংবা উন্মার্গগামী বাস্তবজ্ঞানশূন্য আঁতেল। অথবা মাওবাদী। যাদেরকে বোঝানো যেতে পারে, বাবা-বাছাতে না বুঝলে লাঠিপেটা করা যেতে পারে, তাতেও না হলে জাস্ট গুলি চালানো যেতে পারে, কিন্তু তাদের কথা কন পেতে শোনা চলবেনা। কারণ তারা কালো। আর সর্বব্যাপী এই বধিরতার মধ্যে, উন্নয়নের ধামাকার মধ্যে বেড়ে গেছে কালো ভারতের এলাকা। সবার অলক্ষ্যে ক্রমশ: চওড়া হয়েছে সাদা ইন্ডিয়া আর কালো ভারতের মধ্যের ফাঁক।

    সুদীপ চক্রবর্তী তাঁর বই "রেড সান' এ দেখিয়েছেন, যে, নগরমুখী উন্নয়নের এই যে প্রক্রিয়াকে আজ ধর্মজ্ঞানে অনুসরণ করা হচ্ছে, তা অবাধে চলতে থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ২৫ কোটি গ্রামীণ "আউট-ল্যান্ড' বাসী বাস্তুচ্যুত সর্বহারা হবে। এরা "উন্নয়ন' এর "ভুলে যাওয়া' অংশ। হয় এদের "ভুলে যাওয়া' মানুষ হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করতে হবে, নয়তো স্থানচ্যুত বস্তিবাসী হয়ে শহরে এসে উঠতে হবে। এতে করে এদের অবস্থার উন্নতি না অবনতি হবে, সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। একদল মনে করেন, যে, আখেরে শহুরে উন্নতি "চুঁইয়ে পড়ে' এদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে। অন্যদল মনে করেন, শেষমেশ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জায়গা হবে ডাস্টবিনে। কিন্তু যা নিয়ে বিতর্ক থাকার কোনো অবকাশ নেই, তা হল, অবস্থার উন্নতি হোক, বা না হোক, এই বলপূর্বক স্থানচ্যুতি কালো ভারতের একটা বড়ো অংশের মানুষ পছন্দ করছেন না। কেন করছেন না, তা আমরা নিশ্চিত করে জানিনা, কারণ সাদা ভারত, তা শোনার চেষ্টাই করছেনা। আমরা তাই শুধু আন্দাজ করতে পারি, তাঁদের চিন্তনপ্রক্রিয়া। আন্দাজ করা যায়, যে, নিজের ভিটে-মাটি বা জীবিকা থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে আবার নতুন করে এবং/অথবা নতুন জায়গায় জীবন শুরু করতে কেউই পছন্দ করেন না। একদম নিম্নস্তরের গ্রামীণ মানুষজনও না। এবং ভারতবর্ষের বর্তমান উন্নয়নের মডেলে নিজ পেশায় এবং নিজ স্থানে বর্তমান থেকে এই সুবিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের উন্নতির সর্বাধুনিক মডেল হল "সেজ', যা, সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের বদলে স্থানীয় নাগরিক উন্নয়নের পকেট তৈরির কথা বলে। কিছু-কিছু পকেটে উন্নতি হলেই, বাকি এলাকার মানুষও ক্রমশ: তা থেকে উপকৃত হবেন, এই হল, তত্ত্ব। ওদিকে একেকটি বিশেষ শিল্প অঞ্চল, একেকটি শিল্পনগরী তৈরি করতে যে বিপুল পরিমান মানুষকে স্থানচ্যুত হতে হয়, উন্নয়নের এই প্রক্রিয়ায় তাদের কনসেন্ট নেবার কথা ভাবা হয়না। এবং, বলপূর্বক স্থানচ্যুত হতে, কেউই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কাছে, নিজের জমি, জীবিকা ছেড়ে, অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করা, একরকম মৃত্যুরই সামিল।

    ফলে, আন্দাজ করাই যায়, যে, এই প্রতিটি স্থানচ্যুত মানুষই একজন সম্ভাব্য বিদ্রোহী। ফলে, এটা একটুও আশ্চর্যজনক নয়, যে, নিও-লিবারাল অর্থনীতি যতই তার জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছে, ততই অলক্ষ্যে বেড়েছে ভূমিপুত্রদের ক্ষোভ। সেই ক্ষোভকে শোনেনি, শুনতে চায়নি সাদা ইন্ডিয়া। বাড়াবাড়ি করতে গলে দমন করেছে বন্দুকের ডগায়। আর এসবের মধ্যেই, শাইনিং ইন্ডিয়ার ঢক্কানিনাদের পাশাপাশিই, কালো ভারতের এলাকা ক্রমশ: বেড়ে গেছে, সবার অলক্ষ্যে। বলাবাহুল্য, আজকের মাওবাদী প্রভাবাধীন ভারত এই কালো ভারত। এবং পুরোনো ট্র্যাডিশন বজায় রেখেই, এই ভারতের কথা আজও শোনা হচ্ছেনা। ছত্রধর মাহাতোর মতো এই ভারতের মুখপাত্রদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কথা শোনার বদলে। আর হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাঁদের শহুরে সহযোগীদের।

    এসব কায়দা নতুন কিছু না। এসব আগেও হয়েছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, ভারত-চিন যুদ্ধের সময় ভারতের অবস্থান নিয়ে যাঁরা ন্যূনতম সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাঁদেরই "দেশবিরোধী' আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কালো কালিতে চিত্রিত করা হয়েছে তাঁদেরকে। চিনের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ থাক বা না থাক, "চিনের এজেন্ট' নাম দিয়ে গুছিয়ে ধরপাকড় করা হয়েছে। চিনের প্রতি "রাজনৈতিক সমর্থন'এর কারণে মুখ বন্ধ করতে হয়েছে বহু মানুষকে। নইলে স্থান হয়েছে কারান্তরালে। তখন এই সাদা-কালো বিভাজনের মাপকাঠি ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। এখনও বাইনারি বিভাজন আছে, শুধু জাতীয়তাবাদের মোড়কটি বদলে গেছে। এখন, গত দশ-পনেরো বছরে এই মাপকাঠির নাম "ইন্ডিয়া শাইনিং'। চকচকে ইন্ডিয়া। তখন কালোয় আঁকা চরিত্রটি ছিল "চিনের এজেন্ট' দের, এখন সেই জায়গা নিয়েছে, "উন্নয়নবিরোধী' এবং অধুনা "মাওবাদী'রা। গত কয়েক দশকে বোতলের মধ্যে থেকে হঠাৎই বেরিয়ে এসেছে এক ভয়ানক দৈত্য, -- মাওবাদী বিভীষিকা তাড়া করেছে ইন্ডিয়াকে। "উন্নয়নবিরোধী'রা এখন সক্কলেই তাই মাওবাদী এজেন্ট। যারা, সরাসরি সম্পর্ক থাক বা না থাক, "সহায়তা' ও "রাজনৈতিক সমর্থন' যুগিয়ে চলেছে মাওবাদী দের। চকচকে ইন্ডিয়াকে করছে কলুষিত।

    ৩।
    দৈত্য, অশুভ শক্তি, ইত্যাদিকে, কে না জানে, মূল থেকে উপড়ে ফেলতে হয়। অতএব, "দেশবিরোধী' এই মাওবাদীদের ধ্বংস করার সরকারি পদ্ধতিগুলি, ঐতিহাসিকভাবেই ধ্বংসাত্মক, মাওবাদ নয়, যা মূলত: প্রান্তিক কালো ভারতকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। যার একটি ক্লাসিক উদাহরণ হল "সালোয়া জুডুম'। সেই ১৯৯০ এর দশকেই মাওবাদীরা (মূলত: তৎকালীন জনযুদ্ধ গোষ্ঠী) দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যে জনভিত্তি বাড়িয়ে চূড়ান্ত দারিদ্র্যময় বস্তার আর দান্তেওয়াড়া আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলিকে কার্যত: একটি মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে ফেলেছিল। নকশালদের দুটি গোষ্ঠী একসঙ্গে মিলে গিয়ে সিপিআই(মাওবাদী) তৈরি হয় ২০০৪ সালে। মোটামুটি এই সময়েই ছত্তিসগড় সরকারের তরফে মাওবাদ-বিরোধী কাজকর্মে জোর দেওয়া শুরু হয়। বস্তুত: পশ্চিমবঙ্গে আজ আমরা যা দেখছি, অবিকল সেই জিনিসই সে সময় শুরু হয় ছত্তিসগড়ে। আয়োজিত হয় নকশাল-প্রভাবিত গায়ে-গায়ে লাগা রাজ্যগুলোর মন্ত্রী-আমলা- পুলিস অফিসারদের বৈঠক। বেশ কিছু কোটি টাকার বাজেট আসে। আসে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিস, নাগা ব্যাটালিয়ন, সাঁজোয়া গাড়ি, মাইন ডিটেকটর। আসে মর্টার আর হেলিকপ্টার। ততদিনে চূড়ান্ত অনুন্নত, দারিদ্রপীড়িত, আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় মাওবাদীদের শিকড় অবশ্য বহুদূরে চারিয়ে গেছে। ফলে এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পুলিশ, সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী বিশেষ কাজে আসেনা। তখন সরকার নতুন পদ্ধতি নেয়। সরকারি মদতেই ২০০৫ সালে শুরু হয় "সালোয়া জুডুম' নামক একটি মাওবাদ বিরোধী "আন্দোলন'। প্রাথমিকভাবে এর নেতৃত্ব দেন স্থানীয় কংগ্রেসী এমএলএ মহেন্দ্র কার্মা। ছত্তিসগড়ের বিজেপি সরকারও এর পিছনে মদত দেয়।

    "সালোয়া জুডুম' আদতে একটি স্থানীয় হাল্বী ভাষার শব্দ, যার অর্থ "এসো শান্তিতে থাকি'। কিন্তু বস্তুত: শান্তি নয়, এই তথাকথিত আন্দোলনটিই ছত্তিসগড়কে ঠেলে দিয়েছে গৃহযুদ্ধের দিকে। "আন্দোলন'এর নামে যা করা হয়েছে, তা ষাট-সত্তর দশকের ভিয়েতনামের কথা মনে করায়। মাওবাদী প্রভাব থেকে "মুক্ত' করার জন্য এই আন্দোলনের নামে জঙ্গলের বিস্তীর্ণ অংশ থেকে স্থানীয় আদিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। জনশূন্য করে দেওয়া হয় গ্রামের পর গ্রাম। আদিবাসীদের নিজস্ব বিচরণভূমি থেকে তাড়িয়ে তাদের ভরে দেওয়া হয় সরকারি উদ্যোগে বানানো বিভিন্ন ক্যাম্পে। ক্যাম্পের কমবয়সী যুবকদের, এমনকি নাবালক কিশোরদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অত্যাধুনিক অস্ত্র। অস্ত্রধারী এই কিশোর-যুবকদের "বিশেষ পুলিশ অফিসার' (এসপিও) আখ্যা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। সাদা ইন্ডিয়া আর কালো ভারতের মধ্যে শুরু হয় প্রায় এক গৃহযুদ্ধ।

    চকচকে ইন্ডিয়া ও কালো যে ভারতের মধ্যের যে যুদ্ধের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা কিন্তু শুধুই প্রতীকি অর্থে নয়। ছত্তিসগড় এবং তৎসংলগ্ন জঙ্গল আদিবাসী এবং মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এই যুদ্ধ অর্থনৈতিকভাবেও ভীষণ বাস্তব। মধ্যভারতের এই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এবং মান্থলি রিভিউ এর ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী, ছত্তিসগড়, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র, এবং কর্ণাটকের আদিবাসী এলাকায় তখনই সব মিলিয়ে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কথা প্রায় পাকা ছিল। এই বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই ছিল খনি এবং লোহা-ইস্পাত শিল্পে। এই শিল্পগুলি তাদের বিস্তারের জন্য দাবী করছিল জমি ও অরণ্য, যা মূলত: আদিবাসীদের বিচরণভূমি। সরকারি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে, লেখাটিতে দেখানো হয়েছে, বিভিন্ন শিল্পের কারণে সেই সময়েই ছত্তিসগড়ে প্রায় ২৪০০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। এবং অধিকতর বিনিয়োগ দাবী করছিল আরও অনেক বেশি-বেশি জমি। কেড়ে নিতে চাইছিল অরণ্যের একচেটিয়া অধিকার, যে অরণ্য ঐ এলাকার ভূমিপুত্রদের জীবনযাপনের একমাত্র অবলম্বন।

    ফলে সাদা ইন্ডিয়া ও কালো ভারতের মধ্যে যুদ্ধটি এই অঞ্চলে হয়ে ওঠে ভীষণ বাস্তব। সাদা ইন্ডিয়া চাইছিল অরণ্যের অধিকার। ভূমিপুত্রদের হটিয়ে দিতে চাইছিল তাদের বিচরণভূমি আর জীবনযাপনের অভ্যস্ততা থেকে। নির্মম ভাবে। এটা ছিল যুদ্ধের একটা পক্ষের ম্যানুভার। আর অন্যদিকে ছিল আদিবাসীরা। নিজের জীবন ও জীবিকা থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় যেকোনো মানুষই হয়ে উঠতে পারে একজন সম্ভাব্য বিদ্রোহী। সিঙ্গুরের ১০০০ একর জমি নিয়েই কি বিরাট আলোড়ন হয়ে গেল সে তো আমরা দেখেইছি। এখানে জমির পরিমান আর জীবিকা হারানোর আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি। ফলে একটা বিরাট সংখ্যক আদিবাসী রুখে দাঁড়ায় সাদা ইন্ডিয়ার "উন্নয়ন'এর মডেলের বিরোধিতা করে। কালো ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। "উন্নয়নবিরোধিতা' নামক বিভীষিকার প্রতিনিধিত্ব করে। এরা হল যুদ্ধের অন্য পক্ষ।

    এই যুদ্ধের পদ্ধতিতে যে জিনিসটি লক্ষ্যণীয়, সেটি হল, এই তথাকথিত "আন্দোলন'এর অংশ হিসেবে বানানো হয়েছিল ভিয়েতনামের কায়দায় কিছু স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট। রেডিমেড ক্যাম্প। এগুলি ছিল সরকারি নজরদারির মধ্যে থাকা "নিরাপদ' গ্রাম, যেখানে, অনেকটা বনসাই বানানোর পদ্ধতিতে অরণ্য ও মাটি থেকে তুলে আনা হয়েছিল গ্রামকে গ্রাম আদিবাসীদের। বাধ্য করা হয়েছিল সরকারি নজরদারির মধ্যে বসবাস করতে। বাধ্য করা হয়েছিল মাওবাদীদের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে নিতে। নিজের স্বভাব ও বিচরণভূমি ছেড়ে এই নজরদারির মধ্যে যারা থাকতে রাজি হয়েছে, সরকারি মতে তারাই একমাত্র শান্তির পক্ষে। চকচকে ইন্ডিয়ার পক্ষে। আর এর বাইরে যে বিস্তীর্ণ আন এক্সপ্লোরড মানবজমিন, সে সবই শত্তুরের আখড়া। মাওবাদী এলাকা। কালো ভারত।

    এই যুদ্ধ এখনও চলছে। মাওবাদী বা সালোয়া জুডুম, কারো হাতেই অস্ত্রের কমতি না থাকায়, ঐ জেলাগুলির গোটা আদিবাসী সমাজ কার্যত: আজ যুযুধান দুই ভাগে বিভক্ত, যার একদিকে সশস্ত্র মাওবাদীরা, অন্যদিকে সরকারি মদতপুষ্ট সালোয়া জুডুমের "শান্তিবাহিনী'। পুলিশের সঙ্গে অ্যামবুশে মাওবাদীরা মারা যায়, বা মাওবাদীদের মাইনে উড়ে যায় পুলিশ বাহিনী, সে খবর আমরা খবরের কাগজে পাই। কিন্তু রোজকার যে খবর পাইনা, তা হল, পুলিশ-মাওবাদীদের লড়াই নয়, আদিবাসীরা মরছে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে। গত দু-বছরে মাওবাদী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় মারা গেছেন সাধারণ মানুষ। শান্তি আন্দোলন নয়, এই ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের নাম সালোয়া জুডুম।

    ৪।
    মজা হচ্ছে এতে মাওবাদীদের দাবীটিকেই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। মাওবাদীদের ঘোষিত অবস্থান হল এই যে, ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। পার্লামেন্ট মূলত: শুয়োরের খোঁয়াড়, যেখানে জনতার চিন্তাভাবনার কোনো প্রতিফলন ঘটেনা। মজা হচ্ছে, ভারতীয় রাষ্ট্র প্রাণপণে মাওবাদীদের এই দাবীটিকে সত্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাবার্তা, সরকারি ফতোয়াগুলি অন্তত: সেইদিকেই অঙ্গুলিনর্দেশ করে। বন্দুকের নল আর গ্রেনেড বিস্ফোরণের ভাষা ছাড়াও অন্যকিছুও যে ভারতীয় রাষ্ট্রের কানে প্রবেশ করে, নিপীড়িত মানুষের বেদনা ও বিক্ষোভ যে এঁরা শোনেন, বা শুনতে ইচ্ছুক, সেরকম কোনো ইঙ্গিত এঁদের আচার-আচরণ থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা। ভারতীয় রাষ্ট্র "কালো ভারত'কে ধ্বংস করতে উদ্যোগী নয়, বরং কথোপকথনে আগ্রহী, এই ইঙ্গিতটুকু পেলেও মাওবাদীদের দাবীর বিরুদ্ধে ভারতীয় গণতন্ত্রের মাহাত্মকে, একটু হলেও, তুলে ধরা যেত। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সরকার ও রাষ্ট্র সেই পথে হাঁটতে নারাজ।

    বরং সরকার হাঁটছে ঠিক এর উল্টোপথে। বলা যায়, মাওবাদী প্রদর্শিত পথই সরকারের পথ। এই পথে সাদা-কালোর ছকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে গোটা জনসমাজকে। এখানে হয় তুমি সাদা, নয় তুমি কালো। হয় তুমি গণতান্ত্রিক নয় তুমি মাওবাদী। মধ্যবর্তী ধূসর অঞ্চলটির কোনো অস্তিত্বই নেই। তুমি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের চালু ছকটিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ মানেই তুমি অপরাধী। তুমি নৈরাজ্যবাদী, তুমি মাওবাদের এজেন্ট। তুমি কালো দিয়ে আঁকা। তোমার সঙ্গে আলোচনায় বসার, ডায়ালগে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই। তোমার স্থান হয় কারাগার কিংবা পাগলাগারদ। এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই। তৈরি করা হচ্ছে অজস্র স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট। রেডিমেড ক্যাম্প। নিজের স্বভাব ও বিচরণভূমি ছেড়ে, এই নজরদারির মধ্যে বসবাস করতে যারা রাজি, বলা হচ্ছে, তারাই একমাত্র রাষ্ট্রের পক্ষে। শান্তির পক্ষে। আর এর বাইরে যা কিছু, সবই শত্রুপক্ষের এলাকা। এই পদ্ধতির নাম সালোয়া জুডুম।

    প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য, সিপিআইএম সহ বেশ কয়েকটি বামপন্থী দল এই সালোয়া জুডুম নামক উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। একে অবৈধ ঘোষণা করে আদালতও। ফলে, অন্তত: সরকারি ভাবে, এই "আন্দোলন'কে আর মদত দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়না। স্থানীয় ভাবে সালোয়া জুডুম শেষ হোক বা না হোক, এই প্রক্রিয়াকে অন্যভাবে বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। সর্বভারতীয় চেহারা দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে, একটু অন্য ভাবে, অন্য চেহারায়। কলার খোসাকে দেখা যাচ্ছে অন্য পোশাকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিভিন্ন ঘোষণা থেকে পরিষ্কার, যে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়াটি চালু করতে চলেছে ভারতীয় রাষ্ট্র, বস্তুত: তা সালোয়া জুডুমের থেকে আলাদা কিছু নয়। একে বলা চলে বৌদ্ধিক সালোয়া জুডুম। অর্থাৎ, আমার তৈরি ক্যাম্পে খাও, থাকো, আমার শত্তুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, তবেই তুমি শান্তির পক্ষে। যদি তুমি তা না করো, যদি ক্যাম্পের মধ্যে বনসাই হয়ে টিকে থাকতে না চাও, যদি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাও, চিন্তা করতে চাও, তবে তুমি অবশ্যই শত্রুর পক্ষে। এই যুক্তিপরম্পরাতেই গ্রেপ্তার করা হয় বিনায়ক সেনকে। এই যুক্তিপদ্ধতিতেই জেলে ঢোকেন ছত্রধর মাহাতো। এঁরা সকলেই মাওবাদী। কারণ রাষ্ট্রের বিপক্ষে কথা বলার মানেই আজ মাওবাদের পক্ষে কথা বলা। যে অপরাধে বুদ্ধিজীবীরা দুষ্ট। যে অপরাধে গেপ্তারের পরেও চোখ বেঁধে ঘোরানো হয় ছত্রধর মাহাতোকে। চোখের এই বাঁধন বস্তুত: প্রতীকি। এই বাঁধন ছত্রধর মাহাতোর চোখে নয়, আসলে বাঁধা আছে ভারতীয় গণতন্ত্রের চোখে।

    ৫।
    তো বলার কথা এই, যে, সাদা-কালোর এই ছকবাঁধা বিভাজনে সত্যিই গণতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখা যায়না। সালোয়া জুডুম গণতন্ত্রের মডেল নয়, হতে পারেনা। জরুরি অবস্থার শৃঙ্খলা দিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যায়না। গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যিক একটি শর্ত হল, ভিন্নমত পোষণের অধিকার। ভারতীয় গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, এই অধিকার দিতে হবে। ভূমিপুত্রদের চিন্তনপ্রক্রিয়াকে রাষ্ট্র পরিচালনার ধরণের মধ্যে, উন্নয়নের ধারণার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটাও স্বীকার করতে হবে, যে, এটা এতদিন করা হয়নি। এই উন্নয়নের মডেল, এই গণতন্ত্রের মডেলে আসলে এক্সক্লুড করেছে একটা বড়ো অংশের মানুষকে। আর সে কারণেই কালো ভারত আকারে ক্রমশ: বেড়েছে আর বাড়ছে। দিকে-দিকে বাড়ছে স্থানীয় বিস্ফোরণগুলি। রাষ্টের বধিরতার বিরুদ্ধে যা আসলে ভূমিপুত্রদের নিজের কণ্ঠস্বরের বহি:প্রকাশ। এবং এই খামতি নতমস্তকে মেনে নিয়ে ডায়ালগে যেতে হবে এই এক্সক্লুডেড জনতার সঙ্গে। গ্রেপ্তার নয়, দমন নয়, বরং কথোপকথনের দরজাটি খুলতে হবে। নচেৎ গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই অর্থহীন।

    এই পদ্ধতি অনুসরণ না করলে ভারত ও ইন্ডিয়ার মধ্যে ফাঁকটি ক্রমশ: বাড়বে। একদা ভারতীয় মুকুটহীন রাজপুত্র সঞ্জয় গান্ধী "গরীবি হঠাও' স্লোগান তুলে দেশের রাজধানীতে বস্তি উচ্ছেদে নেমেছিলেন। গরীবি হঠাও নয়, আসলে গরীবকেই হঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজধানীর ঝকঝকে পরিমন্ডল থেকে। চকচকে রাজধানী থেকে এক্সক্লুড করা হয়েছিল অন্ত্যজদের কণ্ঠস্বরকে। সেটা গণতন্ত্র ছিলনা। আজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পর একই কায়দায় উগ্রপন্থী হঠাও স্লোগান তুলে প্রান্তিক ভূমিপুত্রদেরকেই গণতন্ত্র থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টা হলে, সেটাও গণতন্ত্র হতে পারেনা। তাই গ্রেপ্তার নয়, ছত্রধরদের প্রাপ্য সম্মান। কারণ, ইন্ডিয়া আর ভারতের মধ্যের একমাত্র যোগসূত্র এই ছত্রধররাই। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা মানে মাওবাদী অ্যাজেন্ডাকেই সত্য প্রমাণ করা। প্রমাণ করা, যে, ভারতীয় গণতন্ত্র তৃণমূলস্তরের কণ্ঠস্বর শুনতে নারাজ। এখানে বন্দুক ধরাই, বলপ্রয়োগ করাই একমাত্র পথ। নচেৎ মেনে নিতে অবদমন। মেনে নিতে হবে সালোয়া জুডুম।

    ৬।
    এখানেই লেখাটা শেষ করে দেওয়া যেত। কিন্তু এখানে একটা কথা অনিবার্যভাবে উঠে আসে, যে কথাটা কোথাও কোনোভাবেই অ্যাড্রেস করা হচ্ছেনা। সেটাও বলা ভীষণ জরুরি। কথাটা হল, যদি এটা মেনেই নেওয়া হয়, যে, ভারতীয় রাষ্ট্র আজ এতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, যে, প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে আর সে অ্যাকোমোডেট করতে চাইছেনা বা পারছেনা, যদি এমন হয়, যে, ব্রাত্যজনের প্রতিটি কণ্ঠস্বরের জবাবেই আসছে হুমকি-দমন-পীড়ন-বুলেট ও কারাগার, যদি সত্যিই এমন হয়, যে, ভারতীয় গণতন্ত্র সাদা-কালোর বাইরে ধূসর এলাকাটির অস্তিত্ব এক্কেবারে অস্বীকার করছে, গ্রাম-গঞ্জ ছেড়ে এমনকি শহুরে বুদ্ধিজীবীদেরও আজ হুমকি দিচ্ছে কারাগারে বন্ধ করে রাখার, তাহলে মাওবাদী অ্যাজেন্ডায় ভুল কি আছে? সত্যিই তো উন্নততর একটি গণতন্ত্রের সন্ধানে প্রতিটি সচেতন ভারতবাসীর হাতে তুলে নেওয়া উচিত বন্দুক। নেহাৎ বন্দুক হাতে না নিতে পারলে সমর্থন জানানো উচিত। এবং যেহেতু এটা যুদ্ধ, তাতে কিছু খুন-জখম তো হবেই। স্রেফ খুন জখম করছে বলে মাওবাদীদের, অন্তত: মতাদর্শগত পরিসরে, অচ্ছুৎ করে রাখার মানেটা কি?

    অথবা ঠিক একই প্রশ্নকে একদম উল্টোভাবেও বলা যায়। যদি সত্যিই মেনে নেওয়া হয়, যে, ভারতবর্ষে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত, কিছু কিছু জায়গায় সে প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে দমন করে বটে, কিন্তু সেগুলি শুধুই ব্যতিক্রম, যদি মেনে নেওয়া হয়, যে, সামান্য কিছু খামতি সত্ত্বেও ভারতীয় গণতন্ত্র ও তার রাজনৈতিক দলসমূহ জনতার চিন্তাভাবনার মোটামুটি যথাযথভাবেই প্রতিনিধিত্ব করে, বা এখন না করলেও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়, বিপরীত চিন্তাভাবনা নিয়ে এই ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই আওয়াজ তোলা সম্ভব, তাহলে, ঠিক উল্টোভাবে বলা উচিত নয় কি, যে, সমস্ত ক্ষোভ ও বঞ্চনা সত্ত্বেও মাওবাদীদের দ্বারা মদতপুষ্ট এই আন্দোলনগুলি এক অর্থে বিপথগামী? জনতার ক্ষোভ ও যন্ত্রণার সহানুভূতিসহকারে প্রশমন দরকার। কিন্তু তাদের বলপ্রয়োগের জবাবে পাল্টা বলপ্রয়োগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি?

    এই দুটিই দুটি চরমপন্থী মতামত, যারা দুদিকের দুটি প্রান্তে অবস্থান করে। বাস্তবতা সম্ভবত: এই দুয়ের মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায়। কিন্তু তাতে বক্তব্যটা পাল্টায়না। কথাটা হল, যে, যেহেতু আজ আদিবাসী বিদ্রোহ মাওবাদী মদপুষ্ট হয়ে একটি সংগঠিত আকার নিয়ে রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করছে, কাজেই আলোচনার পরিসর থেকে মাওবাদকে বাদ দেওয়া যায়না। সমর্থন বা বিরোধিতা করতে হবে তা নয়, কিন্তু আলোচনার পরিসর থেকেই বাদ দিলে এই আলোচনার কোনো মানেই হয়না। কিন্তু মজা হচ্ছে, এই সোজা প্রশ্নটা কোনো পরিসরে আলোচিতই হচ্ছেনা। কারণ প্রশ্ন সোজা হলেও উত্তরটা কারোরই জানা নেই। তাছাড়া এই বাজারে এটা খুব সেন্সিটিভ এবং বিপজ্জনক প্রশ্নও বটে, -- কখন পুলিশ কাকে তুলে নিয়ে যাবে ঠিক আছে? অতএব রাষ্ট্র যে সকল বুদ্ধিজীবীকে "মাওবাদীদের সহায়তা করছেন' বলে হুমকি দিচ্ছে, তাঁরাও এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। বুদ্ধিজীবীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আপনি-আমিও দিচ্ছিনা। বস্তুত: এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গেলেই আমরা কেমন একটা ফেঁসে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। আমরা সত্যিই তো শান্তিপ্রিয় লোক। খুনজখম চাইনা। ভারতের গণতন্ত্র এক্কেবারে ভোগে গেছে, তাকে আর কোনোভাবেই কাজে লাগানো যায়না, এমনটাও বিশ্বাস করিনা। ওদিকে অনুন্নত এলাকাগুলিতে রাষ্ট্র সন্ত্রাস করছে, এটা আমরা দেখেছি। ওখানকার মানুষজনের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। একই সঙ্গে ইউএপিএ জাতীয় আইনগুলোকে আমরা অপছন্দ করি। ওসব আইন যেকোনো ছুতোয় আপনার-আমার ঘাড়ের উপর নেমে আসতে পারে, এটাও আমাদের মনে হয়। অন্যপাশে মাওবাদীদের খুন-জখম, এলাকা দখলের রাজনীতিও আমাদের অপছন্দ। অগত্যা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হচ্ছে, আমরা মাওবাদীদের ব্যক্তিহত্যার পক্ষে নই। মাওবাদী মতাদর্শের পক্ষে নই। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র মাওবাদী নাম করে সাধারণ মানুষের উপর, চিন্তাশীল সিভিল সোসাইটির উপর, যে নিপীড়ন নামিয়ে আনছে, আমরা তার বিরুদ্ধে। কথাটা বিশদে ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই, এই বিষয়ে লিখতে বললে, ধরা যাক অরুন্ধতী রায় যা লিখতেন, বা সুজাত ভদ্র, এখনও পর্যন্ত এই গোটা প্রবন্ধটাই অবিকল সেই টোনেই লেখা হয়েছে। এই প্রবন্ধটা কেউ যদি কষ্ট করে এই পর্যন্ত পড়ে থাকেন, তাহলেই তাঁরা টোনটা বুঝতে পারবেন।

    তা এইরকম কথার মধ্যে ভুল কিছু নেই। কিন্তু একটা ইতি গজ আছে। ইতি গজটা এখানেই, যে, এইরকম টোনে উত্তর দিচ্ছেন মানে, অর্থাৎ, এককথায় রাষ্ট্রকে আপনি একদম কালো রঙে আঁকছেন। আবার তার বিরুদ্ধে বন্দুক ধরাটাকে বাজে বলছেন। এবং ফাঁকতালে একটি প্রশ্ন টপকে যাচ্ছেন, যে, রাষ্ট্র যদি কালোই হয়, তবে তার বিরুদ্ধে বন্দুক ধরাটা খারাপ কেন। আপনি লালগড়ে সরকারি সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করছেন। মাওবাদী পাল্টা-হামলার সময় চোখ বুজে থাকছেন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছেন, ব্যক্তিহত্যা আপনি সমর্থন করেন না, কিন্তু ব্যক্তিহত্যার অজুহাতে রাষ্ট্র জনতার উপরে যে আক্রমন নামিয়ে আনছে, তার বিরুদ্ধে আপনি। অথচ, রাষ্ট্র ওখানে যেকারণে বাহিনী নামাচ্ছে, সেই কারণটি নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। যদিও এটা খুব পরিষ্কার, যে, রাষ্ট্র দার্জিলিং এ কোনো বাহিনী নামায়নি, কিন্তু লালগড়ে নামিয়েছে, তার কারণ একটিই, যে, ওখানে মাওবাদীদের উপস্থিতি আছে। এ কারণটিকেই আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। আসলে এই অনুচ্ছেদের একদম প্রথম দুই প্যারাগ্রাফে যে প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন সেটাকেই, যেটা আসলে এড়িয়ে যাওয়া যায়না। এলটিটিই কে বাদ দিয়ে শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যা আলোচনা করা যায়না। হামাসকে বাদ দিয়ে প্যালেস্তাইনের কথা বলা যায়না। তালিবানকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা করা যায়না। একই ভাবে ভারতবর্ষের এই ডামাডোলের পরিস্থিতি, রাষ্ট্র ও তার দমননীতির আলোচনা, মাওবাদীদের রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে করা যাবেনা। তার একটা কারণ এই, যে, ভূমিপুত্রদের এই আন্দোলনকে মাওবাদীরাই একরকম করে সঙ্ঘবদ্ধ রূপ দিয়েছেন, এটা অনস্বীকার্য। দ্বিতীয়ত:, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হল, মাওবাদীদের কারণেই, এই স্থানীয় আন্দোলনগুলি, স্রেফ স্থানীয় স্বত:স্ফূর্ত বিস্ফোরণ হিসেবে আর দেখা যাচ্ছেনা। পুরোটাই এখন একটা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটা একরকম ভাবে রাষ্ট্রকে তার দমননীতি চালানোর সুযোগও তুলে দিচ্ছেও বটে। রাষ্ট্র বা সরকারের দিক থেকে এই প্রসঙ্গে যে যুক্তিটা দেওয়া হচ্ছে, সেটাও আসলে খুব ফেলনা নয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। সেখানে ধৈর্য্য ধরাও সম্ভব (যেমন হচ্ছে দার্জিলিং এ)। কিন্তু যদি কোনো গোষ্ঠী বন্দুক হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য নেমে পড়ে, তাহলে তাকে দমনের জন্য পুলিশ-সিআরপি-কোবরা-সেনাবাহিনী নামানো ছাড়া উপায়টাই বা কি? বলাবাহুল্য, এই প্রশ্নটাও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারের কাছে দাবী করা হচ্ছে সহনশীলতা। কিন্তু সরকারকে আসলে লড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার লড়াই। সেটা করতে গেলে সেনা না নামিয়ে কি উপায়? বিকল্প কোনো পদ্ধতি আছে কি?

    এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এক কথায় দিয়ে দেওয়া যাবে তা নয়। কিন্তু প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাবার মানে হল, একরকম ভাবে আরেকটি সাদা-কালো বিভাজনকে মেনে নেওয়া। এই বিভাজন অনুযায়ী মানবাধিকার কর্মীরা শুধু তেড়ে রাষ্ট্রকে গাল দেবেন। দমননীতিকে গাল দেবেন। মাওবাদী দমনের নাম করে কিভাবে প্রান্তিক মানুষকে নিপীড়ন করা হচ্ছে, কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে সিভিল সোসাইটির, তার নিন্দা করবেন (যেমন আমি করলাম এই প্রবন্ধে)। আর অন্যদিকে স্রেফ মাওবাদ-বিরোধী রাজনীতি করার জন্য লাশ হয়ে যাবেন একের পর এক মানুষ। রাষ্ট্র ও তার লাউডস্পিকাররা "মাওবাদী বিভীষিকা'র বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করবে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। তৈরি করবে বিশেষ খুনে বাহিনী, যার নাম কোবরা। কিন্তু এড়িয়ে যাবে প্রান্তিক মানুষদের গণতন্ত্র থেকে উচ্ছেদ করার কথা। আর একই ভাবে অন্যপক্ষ এড়িয়ে যাবে মাওবাদের কথা। আর এই বৌদ্ধিক লুকোচুরি খেলার মধ্যেই ক্রমশ: লাশ হয়ে যেতে থাকবে আরও আরও মানুষ। চলবে রাষ্টীয় সন্ত্রাস ও পাল্টা "জবাব'। শাইনিং ইন্ডিয়ার জবাবে আসবে রেড করিডোর। কোবরার জবাবে আসবে তৈরি থাকার চ্যালেঞ্জ। আর যাবতীয় সমবেদনা, নৈতিক সমর্থন সত্ত্বেও ছত্রধর ও সুখশান্তি পচতে থাকবেন কারান্তরালে।

    শুধু রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এই এড়িয়ে যাবার খেলার খেলোয়াড় তো আমরাই।

    ৭।
    অতএব, আমরা এখানে মাওবাদী রাজনীতি নিয়েও কটি কথা বলব। বা বলার চেষ্টা করব (যেহেতু কথা বলার মতো মাল-মশলা খুব বেশি পাওয়া যায়না)। অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করব মাওবাদী "হত্যা'র রাজনীতিকে। এ কথা অনস্বীকার্য, যে, মাওবাদী হিংসা নিয়ে সরকার এবং মিডিয়া যে বাণীগুলি বিতরণ করে চলেছে, তার অধিকাংশই হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা, যাতে মাওবাদীদের মানুষখেকো বা তার ভদ্রসভ্য প্রতিশব্দ "সন্ত্রাসবাদী' প্রমাণ করা যায়। সরকারি বা রাষ্টীয় হিংসা অনেকসময়েই প্রচারে আসছেনা, উল্টোদিকে মাওবাদী হিংসাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। বা যেকোনো হিংসাকেই মাওবাদী হিংসা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিহারের ঘটনা এর একটি উদাহরণ। বিহারের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ১৬ জন মানুষের গণহত্যা ঘটে যাবার পরেই রাষ্ট্র এবং মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাওবাদী গণহত্যা বলে চালিয়ে দিতে শুরু করল। অথচ, সংবাদপত্রের রিপোর্টেই এ কথা পরিষ্কার, যে, সরাসরি সিপিআই(মাওবাদী) কে এ ঘটনার জন্য তাঁরা দুষছেন না। মাওবাদীদের তরফেও ব্যাপারটা পরিষ্কার করেই বলে দেওয়া হয়েছে, যে, এ কীর্তি তাদের নয়। তবুও মিডিয়ার চোখে এটি মাওবাদী হিংসাই। এই জাতীয় প্রচারের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সরকার, সেনা ও কোবরা নামানোর সিদ্ধান্তকে, বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্তের সাফাই দেবার প্রয়োজনে এই জাতীয় ঘটনাকে ব্যবহার করতে চাইছে। মিডিয়ার ব্যাপারটা অবশ্য অতো সরল না। মিডিয়ার প্রয়োজন বাইট। মিডিয়ার প্রয়োজন গরম খবর। ইত্যাদি প্রভৃতি।

    কিন্তু এসবের পরেও একটা কথা সত্য, যে, মাওবাদীদের রাজনীতি, এখনও পর্যন্ত হত্যার রাজনীতি। হত্যা ছাড়াও নি:সন্দেহে সেখানে আরও কিছু আছে, কিন্তু হত্যা ও হিংসা এই রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এবং সেই হত্যা ও ধ্বংসের অস্ত্র যে শুধু রাষ্ট্র ও তার বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হচ্ছে তা নয়, বরং সাধারণ দারিদ্রপীড়িত মানুষের উপরেও নেমে আসছে। ছত্তিসগড়ের সালোয়া জুডুমের ক্যাম্পে মাওবাদীদের হামলা নতুন কিছু নয়। পশ্‌চিমবঙ্গে বিপরীত রাজনীতি করার কারণে বিগত ছয় মাসে খুন হয়েছেন অজস্র মানুষ। এঁরা কেউ বন্দুক নিয়ে সরকারের পক্ষে যুদ্ধে নামেননি। বেশিরভাগই সিপিএম করতেন। সেই সুবাদে কেউ হয়তো পার্টি, পুলিশ বা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন। এদের কেউ হয়তো হুমকির মুখে পার্টি ছেড়েছিলেন। কেউ ছাড়েননি, বা গোপনে করার চেষ্টা করেছেন। স্রেফ সেই কারণেই এঁরা লাশ হয়ে গেছেন।

    মাওবাদীদের পক্ষ থেকে এই হত্যাগুলির কারণ হিসেবে সাধারণভাবে বলা হয়েছে, যে, এঁরা ছিলেন পুলিশের চর। তাই "জনগণ' এঁদের শাস্তি দিয়েছেন। মাওবাদী সর্বভারতীয় মুখপত্র "আজাদ'র একটি লেখা সম্প্রতি ইন্টারনেটে ঘোরাফেরা করছে। সেখানে তিনি ব্যাপারটি আরও বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যে, এই হত্যার লাইনটি তাঁরা নিয়েছেন অন্ধ্র থেকে "শিক্ষা'র ফলে। অন্ধ্রপ্রদেশে মাওবাদী সংগঠনের ভেঙে পড়ার একটি বড়ো কারণ ছিল, পুলিশের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ককে গুরুত্ব না দেওয়া। সেই কারণে, পুলিশ নানাভাবে চর ইত্যাদি ঢোকাতে সক্ষম হয়েছে আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যার ফল হল অজস্র এনকাউন্টার, মৃত্যু ইত্যাদি। আজাদ জানিয়েছেন, যে, তাঁরা এর থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। এখন তাই পুলিশী চরদের যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। সাবধানবাণী না শুনলে হত্যা করতে হয় বাধ্য হয়েই। এবং এ কারণেই, ছত্তিসগড় থেকে লালগড়, মাওবাদীদের আন্দোলনে পুলিশ কোনো দাঁত ফোটাতে পারছেনা।

    বক্তব্য পরিষ্কার। ট্যাকটিক্স হিসেবেও হয়তো ফলদায়ক। কিন্তু প্রশ্নটা এই ট্যাকটিক্স নিয়েই। একটা ট্যাকটিক্স, আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার একটা কৌশল যদি এমন হয়, যে, তার জন্য বিরোধী পক্ষের লোককে দলে দলে এলাকা ছাড়া করতে হয়, খুন করে চলতে হয় পরের পর গরীব লোককে, তাহলে সেটা কি একটা মানবিক কৌশল? সরকার দমন করে, অতএব আমিও "সরকারপন্থী' দের খুন করব, মুচলেকা দিয়ে পার্টি ছাড়াব, এটা কি রাষ্টীয় সন্ত্রাসের চেয়ে খুব আলাদা কিছু, সে তাকে যতই বিপ্লবী মোড়কে মোড়া হোক না কেন? মানুষের জন্যই তো কৌশল, নাকি কৌশলকে টিকিয়ে রাখাটাই মুখ্য? মানুষের জন্য ক্ষমতা, না ক্ষমতার জন্য মানুষকে বলিদান করাটাই লক্ষ্য? মানুষ কি শুধু মতাদর্শের বোড়ে?

    প্রশ্নগুলো আরও বড়ো হয়ে আসে এই কারণে, যে, মাওবাদীরা দাবী করেছেন, যে, লড়াইটা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের। একটি উন্নততর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। এবং কিছু কিছু এলাকায় এই বিকল্প রাষ্ট্রক্ষমতার ভ্রূণ ও তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। সেটাও এই কৌশল অবলম্বন করেই। নইলে টিকে থাকাটাই অসম্ভব হত। যেটা এখানে বিপজ্জনক, সেটা হল, এই টিকে থাকার এই কৌশল, সামগ্রিকভাবে মাওবাদীদের "উন্নততর' ব্যবস্থাটিকে একটি নির্দিষ্ট আকার নিতে বাধ্য করছে। টিকে থাকার কৌশলের কারণে আপনি যদি আপনার এলাকা থেকে রাষ্ট্রের "চর'দের বহিষ্কার করেন, খুন করেন, তাড়িয়ে দেন, সেক্ষেত্রে, আপনার এলাকা, আপনার প্রস্তাবিত রাষ্ট্র, তার জন্মমুহূর্তেই সজোরে ঘোষণা করে দিল, যে, আমার এলাকায় ভিন্নমতের প্রবেশ নিষেধ। বিপরীত মত পোষণ মানেই আমি তাকে বহিষ্কার করব। ফিজিক্যালি অ্যানিহিলেট করব। থাকতে হলে জি-হুজুর হয়ে থাকো। নইলে ফোটো। এলাকা থেকে বা পৃথিবী থেকে।

    এটাকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায়না। এমনকি এটা আসলে "শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষের হাতে বাকি এক ভাগের দমন' এই জাতীয় কথাবার্তা বলেও না। ভিন্নমত পোষণ করতে দেয়না বলে বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোর নিন্দা যদি ভ্যালিড হয়, এই "বিকল্প' ক্ষমতারও সেই একই কারণে একই সমালোচনা প্রাপ্য। কারণ, শতকরা একই হোক, বা দশ, সংখ্যালঘুর অধিকার গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ। আপনার প্রস্তাবিত কাঠামো সেই অধিকারকে স্বীকার করেনা। তাছাড়াও, বলা বাহুল্য, আমার হাতে কোনো মাপকাঠি নেই, যা দিয়ে বোঝা যাবে, আপনি শতকরা নিরানব্বই জনের প্রতিনিধিত্ব করেন। এমনকি শতকরা নিরানব্বই জন আপনার পক্ষে ভোট দিলেও না। কারণ, প্রাণের ভয়ে তারা আপনার পক্ষে বলতে বাধ্য। নইলে আপনি তাদের অ্যানিহিলেট করবেন।

    ফলে আপনার কৌশল, এই মুহূর্তে হয়তো খুব কার্যকর। হয়তো, আপনার আন্দোলনে একটি দরিদ্রতম অংশের কিছু মানুষ তাঁদের ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন। ভারতীয় গণতন্ত্রের বধিরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে, এবং তাকে প্রকাশ্য রাজনীতির আলোচনার আঙিনায় টেনে আনার প্রধানতম কৃতিত্ব অবশ্যই মাওবাদীদের। মাওবাদীরা এই কান্ডকারখানা না ঘটালে কে আর ছত্তিসগড় বা উড়িষ্যার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে এসব জানতেই বা যেত কে, আলোচনাই বা হত কোথায়। কিন্তু তার পরেও, লক্ষ্য করুন, এই কৌশলই আপনাকে এক চূড়ান্ত দমনমূলক ব্যবস্থার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে বিরোধী মতের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেখানে আদালত মানে ক্যাঙারু কোর্ট। এটাকে উন্নততর গণতন্ত্র বলে মেনে নিতে আমার, এই প্রবন্ধের লেখকের, আপত্তি আছে। যেকোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষেরই থাকবে।

    এবং এটার জন্য "যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি'কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যুদ্ধ আপনার কৌশলেরই অংশ। অতএব, দোষ কিছু থাকলে তার দায় আপনার কৌশলেরও। আপনার নীতিমালা অন্যকিছু হতে পারে, কিন্তু "বাস্তব পরিস্থিতি'তে এরকম করতে হচ্ছে, এরকম বলারও কোনো মানে নেই। তাহলে বলতে হয়, "বাস্তব পরিস্থিতি'তে কৌশলই আপনার নীতির রূপরেখা তৈরি করে দিচ্ছে। আপনি আসলে কৌশল তৈরি করছেন না, বরং কৌশলের দাসত্ব করছেন। আপনার বিকল্প ক্ষমতার রূপরেখাই তৈরি হচ্ছে খুন ও অসহিষ্ণুতার কৌশলের হাত ধরে। এবং নীতিকেও শেষমেষ সেখানে স্ট্যাম্প লাগাতে হচ্ছে।

    ৮।
    ফলে শেষমেষ এই প্রশ্নটা আসলে শুধু কৌশলের নয়। সামগ্রিক ভাবে নীতিরও, যা, দূর থেকে দেখে মনে হয়, যে, আসলে কৌশলেরই দাসত্ব করছে। এই সন্দেহ আরও দানা বাধে যখন দেখা যায়, যে, মাওবাদীরা একটি "উন্নততর গণতন্ত্র', একটি "বিকল্প ব্যবস্থা' দেবেন বলে দাবী করছেন, কিন্তু সেই বিকল্পের রূপরেখাটা তাঁরা কোথাও স্পষ্ট করে বলছেননা। "রূপরেখা আছে, কিন্তু বলা যাচ্ছেনা' এ কথাও বলা যাবেনা। অন্তত: পশ্চিমবাংলায়, দীর্ঘদিন ধরে একজন মাওবাদী মুখপাত্র বক্তব্য পেশ করেছেন, তিনি এই রূপরেখাটি স্পষ্ট করেননি। ইন্টারনেটে এদিকে-সেদিক ঘুরলেই যেটুকু পাওয়া যায় মাওবাদীদের লেখাপত্র, সেখানেও কিছু স্পষ্ট করে পাওয়া যায়না। যেটুকু শোনা যায়, তা, ঐ "নয়া গণতন্ত্র' বা "উন্নততর গণতন্ত্র'এর অঙ্গীকার। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থাটা কি, সেখানে কেমন গণতন্ত্র চাই, কি হবে তার প্রতিষ্ঠান, ঠিক কেমন হবে তার চরিত্র, কেন সেই ব্যবস্থা "উন্নততর', তার কোনো হদিশ নেই। দেখেশুনে মনে হয়, আসলে ওরকম কোনো দলিল বা চিন্তাভাবনা আসলে এই নশ্বর পৃথিবীতে এখনও জন্মও নেয়নি। ফলে, যেখানেই তাঁরা "জনগণের ক্ষমতা'র ভ্রূণটিকে প্রতিষ্ঠা করছেন বা সেখানেই ফেটে বেরোয় শুধু কৌশলের দাসত্ব। চালু গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে আমরা দেখি "হিসেব চুকিয়ে দেওয়া'র পাল্টা হিংসা। চালু আদালতের বিকল্প হিসেবে দেখি তথাকথিত "জন আদালত', চরিত্রের দিক থেকে যা গণপিটুনির ন্যায়বিচারের মতো। শোনা যায়, যে, নিজের এলাকায় মাওবাদীরা কোথাও কোথাও বিকল্প শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, এমনকি উন্নয়নও করেছেন। কিন্তু তার কোনো দলিল, মাওবাদীদের পক্ষ থেকেও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

    ফলে, সব মিলিয়ে, দূর থেকে দেখে, পুরোটাই কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। কৌশলের দাসত্ব মনে হয়। নিচের তলার বাস্তবতার দাসত্ব মনে হয়। কোনো ক্রমে টিকে থাকার খেলা মনে হয়। যে খেলায় ক্ষমতাটাই লক্ষ্য, ক্ষমতা নিয়ে কি করব, জানা নেই। পুরো আন্দোলনের পদ্ধতিতেই এটা প্রকট।
    কেন, সেটা একটু খোলসা করে বলা যাক। আন্দোলনের ধরনের কথাই ধরুন। আন্দোলন বলতে এমনি আম পাবলিক যা বোঝে, তা এইরকম:

    ১। আপনি দেখলেন, যে বর্তমান ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে।
    ২। আপনি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী পেশ করলেন, সেগুলো সংশোধনের জন্য। সংশোধনের জন্য আপনার ব্লু প্রিন্ট আপনি পেশ করলেন।
    ৩। কর্তৃপক্ষ আপনার দাবী মেনে নিলে জয়োল্লাস করলেন, নইলে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিলেন।

    মাওবাদীদের আন্দোলনে, এই প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপটির অভাব ভীষণভাবে চোখে পড়ে। তাঁরা দেখাচ্ছেন, যে, বর্তমান ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে। কিন্তু উন্নততর ব্যবস্থাটা কি হতে পারে, সেই মর্মে সরকারের কাছে, রাষ্টের কাছে, তাঁরা কোনো দাবী জানাচ্ছেন না। শুধু বৃহত্তর আন্দোলনে নেমে পড়ছেন স্টেপ জাম্প করে। কেউ কেউ বলতে পারেন, কেন, অন্ধ্রপ্রদেশে তো ওঁরা আমূল ভূমিসংস্কারের দাবী জানিয়েছেন। লালগড়ে সন্ত্রাসমুক্তির দাবী জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহারের দাবী জানিয়েছেন। বিনা বিচারে বন্দীদের মুক্তির দাবী জানিয়েছেন।

    এর সবকটাই ঠিক, কিন্তু কথাটা হচ্ছে, যে, এগুলি মাওবাদীদের একমাত্র দাবী নয়। এগুলি মেনে নিলেই এই ব্যবস্থাটি সহজ সুন্দর হয়ে যাবে, এবং তাঁরা বন্দুক ছেড়ে তাতে অংশগ্রহণ করবেন তা নয়। ফলে তাঁদের সেই দাবীগুলি করা উচিত, যা আসলে তাঁদের কর্মসূচীর প্রাণকেন্দ্র। যেগুলি মেনে নিলে আর সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনটাই থাকবেনা। সরকার বা রাষ্ট্র সেই দাবী নাই মানতে পারে। কিন্তু দাবীগুলি পেশ না করেই বন্দুক হাতে নেমে পড়লাম ক্ষমতা দখলে, এরকম হলে, তার পিছনে জাস্টিফিকেশন জোটানো কঠিন। লক্ষ্য করবেন, মাওবাদীদের ব্যবস্থার ব্লু প্রিন্ট কি, কেন সেটা বিকল্প, এ নিয়ে ভারতের বহুচর্চিত "জনগণ' কিন্তু মোটামুটি অন্ধকারে। যে কারণে সন্দেহ হয়, যে, ব্লু প্রিন্টটি আদৌ আছে তো? এও লক্ষ্য করবেন, একমাত্র আজ পর্যন্ত মাওবাদীরা যা যা দাবী করেছেন প্রকাশ্যে, তার মধ্যে ভূমিসংস্কারটা বাদ দিলে কোনোটাই একটা বিকল্প ব্যবস্থার ব্লু প্রিন্ট নয় (সে ভূমি সংস্কারের দাবীও আবার বাকি বামপন্থী দলগুলোও করে থাকে)। এমন নয়, যে, যে দাবীগুলো জানানো হচ্ছে, সেগুলো অনৈতিক, বা স্থানীয় ভাবে জানানো যাবেনা, বরং জানানোই উচিত, যেমন জানান কোনো মানবাধিকার সংস্থা বা জনসাধারণের কমিটির মতো কোনো সংগঠন। কিন্তু এগুলি ছাড়াও, একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের দাবীদাওয়া আরও একটি বৃহত্তর আরও একটু বেশি রাজনৈতিক হবার কথা। নচেৎ আন্দোলনগুলি কেমন স্থানীয় বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকবে। আর বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি থেকে যাবে ফাঁকা। সেটি হয়ে দাঁড়াবে "মূলধারা'র অন্য দলগুলির বিচরণক্ষেত্র।
    কিরকম দাবীদাওয়ার কথা বলছি? শুধু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বলাবাহুল্য কল্পিত উদাহরণ। মাওবাদীরা বলে থাকেন, ভারতীয় সংসদ জালি। শুয়োরের খোঁয়াড়। এ দিয়ে কিছু হবেনা। এটা বহুল প্রচারিত। কিন্তু এর বিকল্পে তাঁরা কি উন্নততর ব্যবস্থা দেবেন, সেটা কোত্থাও বলেন না। বর্তমান সংসদ কেন অকাজের, কোন পদ্ধতিগত কারণে, সেটাও বলেন না। তাঁরা এভাবে বলতেই পারেন, আপনার সংসদ জালি, শুয়োরের খোঁয়াড়, কারণ, এক, জনপ্রতিনিধিরা এক্সিকিউটিভ নন, তাঁরা স্রেফ নীতি ঘোষণা করেই খালাস, যাকে কাজে রূপান্তরিত করবে আমলারা। দুই, এখানে জনপ্রতিনিধিদের পছন্দ না হলে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা নেই। তিন, ভোট না দেবার অধিকার নেই। চার, বিশেষ কোনো ইস্যুতে গণভোটের সুযোগ নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব আমি এমন ব্যবস্থা চাই, যেখানে এই সুবিধেগুলো থাকবে। যেখানে জনপ্রতিনিধিরা দায়ী থাকবেন কাজ এক্সিকিউট করার জন্য। আমলারা সংখ্যায় যতটা পারা যায় কম থাকবে। যেখানে কাজ না করলে জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে নেবার সুবন্দোবস্ত থাকবে। জনতার যেকোনো ইস্যুতে গণভোট চাইবার অধিকার থাকবে। ইচ্ছে হলে ভোট বয়কট করার অধিকার থাকবে।

    এটা গেল সংসদের সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সমালোচনাও এভাবে করা যায়। বা জুডিসিয়ারি সিস্টেমের। এভাবে বলা যেতে পারে, যে, আপনার যুক্তরাষ্ট্র ভুলভাল, কারণ এখানে বিচ্ছিন্ন হবার স্বাধীনতা নেই। আমি এমন রাষ্ট্র চাই, যেখানে জনজাতিরা চাইলেই বিচ্ছিন্ন হতে পারবে। অথবা, আপনার জুডিসিয়ারি জঘন্য, আমলাতান্ত্রিক। এখানে জনতার সুবিচার পাবার কোনো আশা নেই। চাই লোক আদালত। সোজা আইন, যেখানে উকিলের প্রয়োজন নেই। অথবা আপনার গণতন্ত্র বাজে, কারণ সে নিচের তলায় পৌঁছয়না। গণতন্ত্রকে কে পৌঁছতে হবে নিচের তলায়। আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনকে করতে হবে শক্তিশালী। এইরকম হবে তার স্ট্রাকচার। ইত্যাদি প্রভৃতি।

    বলাবাহুল্য, উদাহরণগুলি কল্পিত, ফলে মাওবাদীদের দাবীর সঙ্গে এগুলি না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু বক্তব্যটা পরিষ্কার। রাষ্ট্রকে বিকল্প দাবীগুলি পেশ না করে, এমনিই আপনি আন্দোলনে নেমে পড়তে পারেন না। কারণ রাষ্ট্র সেক্ষেত্রে পরিষ্কার বাংলাভাষায় বলবে, যে, এদের কোনো দাবী নেই। এরা পাতি ক্ষমতালোভী। এবং রাষ্ট্র এই কথা বলে খুব ভুল কিছু করবেনা, কারণ দাবীগুলি আপনি পেশই করেননি। জনতাও দেখবে, কোনো দাবীপত্তর পেশ না করেই আপনি লড়তে নেমে গেছেন। আসলে এই দাবীগুলি জানানো শুধু রাষ্ট্রকে জন্যই প্রয়োজন তা নয়, আসলে এগুলি জনতারও জানা উচিত। জনতা জানুক, যে রাষ্ট্রকে আপনি এই এই দাবী দিয়েছেন। রাষ্ট্র তা মেনে নিলে তো চমৎকার। না মানলে আপনি আন্দোলনে নামবেন। যদি সেই দাবীদাওয়াকে আমি যথার্থ বলে মনে করি, তবেই আমার মতো রাম-শ্যাম-যদু-মধুর কাছে সেই আন্দোলন জাস্টিফিকেশন পাবে। নচেৎ পুরো জিনিসটাই কেমন যেন হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৌশলের দাসত্ব হয়ে যাচ্ছে। যেখানে মানুষ খুন হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে নতুন দিন আসবে, কিন্তু নতুন দিন কেমন, জানা নেই। নতুন দিনের যা চেহারা দেখা যাচ্ছে বাস্তবে, তা গণতান্ত্রিক কিছু নয়।

    ৯।
    ফলে এক কথায়, রাষ্ট্র ভুগছে অসহিষ্ণুতায়। যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আছে। সেই বিক্ষোভকে সংগঠিত করছেন মাওবাদীরা। কিন্তু মাওবাদীদের কোনো বিকল্প ব্লু প্রিন্ট চোখে দেখা যাচ্ছেনা। এই লেখা শুরু করেছিলাম সাদা-কালো ছক দিয়ে। তা, এও এক ধরণের সাদা-কালো ছক। ক্ষমতা দখলের ছক। সাদার ছকে কালোর জায়গা নেই। কালোর ছকে স্থান নেই সাদার। রাষ্ট্র ও মাওবাদীরা একে অপরকে এক্সক্লুড করছেন। এবং ফাঁকতালে লাশ হচ্ছে মানুষ। কোনো সন্দেহ নেই, এই অবস্থা তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু মাওবাদীরাও এখন সর্বভারতীয়। তাই তাঁদের দায়ও আছে। তাঁরা বিকল্পের দাবী জানাচ্ছেন, কিন্তু কি সেই বিকল্প, স্পষ্ট করে বলছেন না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বিকল্প নয়, যুদ্ধটাই আজ লক্ষ্য।
    দোষ অবশ্যই অন্য বিভিন্ন পক্ষেরও আছে। আছে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির। তাদের সুবিধেবাদী রাজনীতির। সিপিআইএম যেমন, ভিন্ন রাজ্যে মাওবাদীদের নিষিদ্ধকরণের নিন্দা করে, ইউএপিএর নিন্দা করে, আবার নিজের রাজ্যে সেসবের অবাধ প্রয়োগ করে চলে। তৃণমূল যেমন, একটি সরকারের শরিক, কিন্তু সেই যৌথবাহিনী নামানোর মৌখিক নিন্দা করেই তারা কর্তব্য খালাস করে। বিষয়টা নিয়ে তারা যে আদৌ সিরিয়াস কিনা, সেটাই বোঝা যায়না। দোষ সিভিল সোসাইটিরও আছে। আপনার-আমারও আছে। আমরা যারা মাওবাদীদের খুন-জখমের প্রশ্নটা, ক্ষমতা দখলের রাজনীতির প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিন্দা করে চলি।

    সব মিলিয়ে, তৈরি হয়েছে, এবং হচ্ছে বিরাট বিরাট ফাঁক। এই ফাঁক বোজানোর দায় কারো একার নয়। দরকার ডায়ালগের। কথোপকথনের। রাষ্ট্রের অবিলম্বে কথোপকথনের সদিচ্ছা দেখানো উচিত। সেটা শুধু মৌখিক নয়, সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েই দেখানো উচিত। যাবতীয় ক্ষোভ ও বঞ্চনা সমেত এক বঞ্চিত ভারতবর্ষ তৈরি হয়েছে রাষ্টেরই কারণে এটা প্রাথমিক ভাবে মেনে নেওয়া উচিত। এবং আক্রমণ নয়, সেই ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করা উচিত। জরুরি অবস্থার কায়দায় গরীবি হঠাও মানে গরীব হঠাও, মাথায় ব্যথা হলে গোটা মাথাটাই কেটে বাদ দাও, এই জাতীয় জরুরি অবস্থাসুলভ কায়দা কানুন অবিলম্বে ছেড়ে আসা উচিত। ইউএপিএ জাতীয় আইনগুলো বাতিল করা উচিত। মুক্তি দেওয়া উচিত মাওবাদী সন্দেহে বন্দী অগণিত মানুষকে। মনে রাখা উচিত সরকারি খোপের ভিতর যারা নেই, তারাই শত্রু নয়। সে সিভিল সোসাইটিই হোক, বা জনগণের কমিটি। এদেরকে হুমকি দিয়ে, গ্রেপ্তার না করে, তাদের সমালোচনাকে নতমস্তকে মেনে নেওয়া উচিত। আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো উচিত। কারণ দলতন্ত্রের বাইরে, মানবাধিকার বা অন্যান্য সংগঠনগুলি গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। সরকার বা রাষ্ট্র যে কালো ভারতে পৌঁছতে পারেনা, তাদের সঙ্গে ডায়ালগে আসার একমাত্র যোগসূত্র এরাই। এদেরকে বাদ দিলে, আর যাই হোক গণতন্ত্র থাকেনা।

    অন্যদিকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিরও সোজা ভাষায় জানানো উচিত তাদের দাবীদাওয়া। তাদের দায়িত্ব কিছু কম না। তারা গণতন্ত্রের কিছু ফাঁক খুঁজে বার করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ফাঁকগুলি কিভাবে বোজানো যায়, কিভাবে মানুষকে গণতন্ত্রের স্বাদ দেওয়া যায়, সেটাই যদি মূল লক্ষ্য হয়, তো তার জন্য কোনো আলোচনা/আপোষ সহ কোনো পথই আনএক্সপ্লোরড রাখা উচিত না। নচেৎ মেনে নিতে হয়, যে, মানুষকে ক্ষমতা দেওয়া নয়, কোনোক্রমে নিজেরা ক্ষমতায় পৌঁছনোটাই হল লক্ষ্য। মনে রাখতে হবে, তাঁরা "সাধারণ মানুষ' এর জন্য লড়ছেন বললেই সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে যান না। তাই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিকল্প ব্যবস্থার ব্লু প্রিন্ট, সবই জনতার এবং সরকারের জানার অধিকার আছে। সেগুলি পেশ না করে হিংসায় জড়িয়ে পড়াটা, নি:সন্দেহে বিপথগামিতা। অবিলম্বে তাই তাঁদেরও নিজের অ্যাজেন্ডা প্রকাশ্যে পেশ করে আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

    মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো এবং সিভিল সোসাইটিরও অতি অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। এরা একে অপরকে একটা বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। মূল ধারার দলগুলো এই অ-রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে দেখে একটু দূর থেকে। অনেকসময়েই, প্রকাশ্যে বা গোপনে আখ্যায়িত করে সুখের পায়রা হিসেবে। বাস্তববোধহীন এলিট হিসেবে। যে কারণে নর্মদার মতো আন্দোলনে, এমনকি "প্রগতিশীল' দলগুলিও জড়ায়না। "প্রগতি' ও "উন্নয়ন' এর বিতর্ককে দেখে একটু দূর থেকে। বিদ্বেষভরে। যেন, প্রগতি উন্নয়নের ধারণাগুলি রাজনৈতিক দলগুলি সবই শিখে ফেলেছে, অন্য কারো কাছ থেকে তাদের আর কিছু শেখার নেই। অফিশিয়াল, তৃতীয় ধারা, সব ধরণের বাম দলগুলির মধ্যেও এইরকম একটা মনোভাব প্রকট। আবার ঠিক এই একই মনোভাবের উল্টোটা দেখা যায় অ-পার্টি সংগঠগুলির মধ্যেও। তাঁরাও ঠিক ততটাই বিদ্বেষ ছুঁড়ে দেন মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি, যতটা তাঁরা পান। এরা সবাই দুর্নীতির আখড়া, সিস্টেমের দাস, হরেক মাল পাঁচ সিকে, এরকম একটা ভাব।
    এই মনোভাবগুলি ছেড়ে আসা প্রয়োজন। দুর্নীতি টুর্নীতি আছে, গোঁয়ার্তুমিও আছে, কিন্তু মূলধারার রাজনীতি মানেই পাপের আখড়া নয়, অ-পার্টি সংগঠনের এটা একদিকে মনে রাখা উচিত। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলির মনে রাখা উচিত, যে, গণতন্ত্রের যে ফাঁকগুলিতে তাঁরা পৌঁছতে পারছেন না, সেখানে পৌঁছনোর একমাত্র যোগসূত্র এই অ-পার্টি সংগঠনগুলিই। গণতন্ত্রের ফাঁকফোকরগুলি জানা এবং বোঁজানোর জন্য এরা একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।

    সোজা বাংলায়, এই প্রবন্ধের লেখক, একজন নগণ্য শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে, গৃহযুদ্ধ চাইছেন না। চাইছেন ডায়ালগ। রক্তপাত, গ্রেপ্তার, গুলি, হিংসা ও পাল্টাহিংসার বদলে চাইছেন বহুপাক্ষিক এবং বহুস্তরীয় কথোপকথন। ব্যবস্থার বিভিন্ন স্থানে যে অনতিক্রম্য ফাঁকগুলো তৈরি হয়েছে (যেগুলো অন্তত: অনতিক্রম্য বলেই মনে হচ্ছে), সেগুলো বোজানোর জন্য কথোপকথনের বিস্তৃত জালই হতে পারে একটি সমাধান। তাই কথোপকথনটা শুরু হওয়া দরকার। সব পক্ষের।

    এই লেখা কে বা কারা পড়বেন জানা নেই। হয়তো একটু বেশিই চাওয়া হয়ে যাবে, তবুও, আমি, এই লেখার লেখক, ব্যক্তিগতভাবে এর জবাব আশা করব। সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষ থেকে। এ নয়, যে, এই লেখায় সব পয়েন্ট ধরা হয়ে গেছে। সেটা ডায়ালগ ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। এর সঙ্গে একমত হবারও প্রয়োজন নেই। কথোপকথন সব সময় ঐকমত্যের ভিত্তিতে চলে তা নয়। গালাগাল, ঠোঁট ফোলানো, সবই কথোপকথনের অংশ। কিন্তু সেসব পরে দেখা যাবে। কথোপকথনটা শুরু তো হোক আগে।

    অক্টোবর ৭, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৪ অক্টোবর ২০০৯ | ১০৮৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.203.7 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৩ ০৪:২৭89326
  • ১) 'সাদা ইন্ডিয়ার মুখপত্র মিডিয়া ও সরকার দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করে আসছে .. 'উন্নয়ন' এর পথে গেলে, সেজ এর পথে গেলে, খোলা বাজার ও শিল্পায়নের পথে গেলে আখেরে সক্কলেরই লাভ।'

    ২) এই চকচকে ইন্ডিয়ার ঠিক পাশেই আছে আরেক কালো ভারত .. সেই ভারত শিল্পস্থাপনের বিরোধী, তথাকথিত উন্নয়নের বিরোধী'।

    বর্তমান প্রবন্ধের বেসিক প্রেমিসই হল, ৯১ পরবর্তী সময়ের সমস্ত নীতি একটাই বিশেষ মডেলকে অনুসরণ করে এসেছে যেটাকে উন্নয়নের চালু মডেল বলে ধরা যায়। আমার মনে হয় এটা এই প্রবন্ধের দুর্বলতার জায়গা।
  • কৃশানু | 213.147.88.10 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৩ ০৫:৪০89324
  • ভালো লাগলো। শুরুর দিকে একটু রিপিটেটিভ যদিও।
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.203.7 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৩ ১২:৩৭89325
  • লেখা ভালো লেগেছে। তবে অরন্যের একচেটিয়া অধিকার কারোই হওয়া উচিত নয়। শান্তিপ্রিয় ভূমিপুত্রদেরও না। শিল্পস্থাপন করার সময় দেখতে হবে যেন সরকারের প্রণীত environmental শর্তগুলো মানা হয়।
  • কৃশানু | 213.147.88.10 (*) | ২৬ মার্চ ২০১৩ ০৬:০৬89328
  • এককদা - একদম ঠিক।
    এই সেদিন দেখে এলাম ডুয়ার্সের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে আদিবাসীরা।

    কিন্তু প্রশ্নটা হলো তাহলে অরণ্যের মানুষ কি ভাবে উন্নতি করবে? আরো দীতেইলে অন্য কোথাও এই নিয়ে কথা বলতে পারলে ভালো হয়।
  • Ekak | 69.99.230.125 (*) | ২৬ মার্চ ২০১৩ ১২:০১89327
  • অরণ্যের অধিকার অরণ্যের । কিছু বাইরের মানুষ কাঠের লোভে জঙ্গল কেটে সাফ করছে আর কিছু মানুষ জঙ্গল কেটে কোর্ এরিয়াতে ধানচাষ করে তারপর হাতি এলে তাদের দিকে পটকা ছূঁড়ছে । দুদল ই দোষী । জঙ্গলের কাছে বা জঙ্গলে থাকা মানুষ রা পশুপাখি দের প্রতি খুব অনুভূতিপ্রবণ হয় ইটা একটা আরবান মিথ ।
  • pi | 78.48.231.217 (*) | ২৭ এপ্রিল ২০১৩ ১১:৪০89329
  • জয়া মিত্রের এই লেখাটা পড়তে পড়তে এককের উপরের কমেন্টটা মনে পড়ে গেল ঃ)

    http://www.anandabazar.com/archive/1130425/25edit3.html
  • b | 135.20.82.166 (*) | ২৮ এপ্রিল ২০১৩ ০৫:৫৩89330
  • জয়া মিত্রের লেখার পরিপ্রেক্ষিতেঃ ঐ ট্রাইবগুলির মধ্যে শিশু ও জননীমৃত্যুর হার কত? সাক্ষরতা? পরিচ্ছন্ন শৌচালয় আছে? প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র কতদূর?

    "উন্নয়ন" বলতে ডান/ বাম/ মাওবাদী/মার্ক্সবাদী সম্ভবত এই প্যাকেজটি-ই বোঝে। এখন "যদি" (আমি বলছি না যে এ দুটি পরস্পরের পরিপন্থী। তাই যদি) দেখি এই প্যাকেজটি দেওয়ার একমাত্র উপায় প্রাকৃতিক সম্পদের লুন্ঠন , তবে তা গ্রাহ্য করা হবে কি?
  • pi | 233.176.8.168 (*) | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৯89331
  • ক'দিন আগে হিন্দুস্তান টাইমসে প্রফেসর নন্দিনী সুন্দরের লেখা। এখানেই থাক।

    One area in which the Modi government’s first 100 days has brought absolutely no surprises is the policy on the Naxalites. Everything is as predicted, from increased militarisation to the vitiation of environmental protections.
    What is extraordinary is not the continuity in policy between the UPA and the NDA, but how little the government has learnt from the past 10 years. Union home minister Rajnath Singh may think he can finish the Maoists in “3 years” by flooding Chhattisgarh with troops (one lakh by 2016), but he should recall that in March 2010, P Chidambaram had with equal hubris declared his government would solve the problem in “2-3 years”. Home ministry officials, who should have had a longer institutional memory than their ministers, have revived all the elements of a plan that led to the intensification of conflict in the first place, right down to community policing (the Salwa Judum and special police officers by another name, despite the Supreme Court ban) and the use of the Naga India Reserve Battalions in Chhattisgarh. Their cruelty between 2005-07 is hardly likely to ensure that villagers will now welcome them with open arms or information.
    Similarly, the invocation of the single IG/DIG command — with Punjab’s KPS Gill as a model — is like an open invitation to unchecked authority, starting with the posting of SRP Kalluri as IG Bastar range. Kalluri was posted out after a particularly egregious incident in 2011 — when 300 homes in Tadmetla and neighbouring villagers were burnt, people killed, and women raped by security forces. The fact that he has now been sent back suggests the State wants operations untrammelled by human rights, law and the Constitution. Over the past few months, villagers across Bastar have been complaining of repeated raids and arbitrary arrests, but there has been no media coverage.
    Tadmetla in south Chhattisgarh is a perfect example of everything that is wrong with the country’s Naxalite policy. On August 15, the CRPF claimed to have achieved a major success by hoisting the national flag at the village, which is close to the spot where 76 CRPF men and eight Maoists were killed in an ambush in 2010.
    They conveniently forgot that in 2011, after the attack on villagers, chief minister Raman Singh had visited the area and promised to (re)start the primary school there. He even offered the teacher’s job to one young man. Three years later, there is still no school, only a flag. The CBI has not submitted its findings on the incident to the Supreme Court despite being asked in 2011 to give a preliminary report within six weeks. As for the TP Sharma Commission set up by the state government, the malicious cross-examination of the villagers has given rise to fears that its aim is to exonerate the security forces. The villagers themselves continue to have an inexplicable faith in ‘justice’ as shown by the fact that over the past three years, they have been braving the 400 km journey back and forth from their village to Jagdalpur to depose on what happened. This year might have looked very different had we seen immediate redress instead of this attempt to destroy civilian morale; building schools instead of carpet security cover through the CRPF camps.
    On Independence Day, Prime Minister Narendra Modi exhorted the Maoists to give up violence and turn to farming instead. However, it is precisely because the government will not let people farm in peace that they turn to the Maoists in the first place. The Maoists are still out there, not just on the strength of their violent methods or because people are scared of them, as the government claims, but also because they have distributed land and built ponds. The villagers may be tiring of conflict, but when all that the government offers them is a flag instead of schools, it is hardly a serious alternative. CG-net, a phone-in news service for adivasi areas, is full of people’s complaints about not being paid for MGNREGA work, hand-pumps not working, teachers not coming to school, etc. The gap between what people want and what the government is offering — more soldiers to push through mines and industries — could not be more glaring. As for the Maoist cadre, while surrenders may have increased, it is hard to distinguish this from government propaganda, especially when officers associated with the CRPF run their own racket in fake surrenders, as was reported from Jharkhand.
    The only change from the so-called ‘security and development’ approach of the UPA regime, is the ‘securitise and communalise’ approach of the BJP and its associates, illustrated by the recent announcement that ‘non-Hindus’ would not be allowed into Bastar villages and the plan to develop Sangh parivar-scripted ‘local histories’ of adivasi areas. However, what the Congress style ‘secularists’ should remember is that they have also been culpable in destroying adivasi religion, by mining the hills and forests in which adivasi gods live.
    Adivasi communities are ‘peoples’ and not ‘backward Hindus’ — with distinctive languages spoken by millions and distinctive faiths. It is precisely because of this that the Fifth Schedule of the Constitution mandates the governor to defend their laws and customs, including control over land and resources. If the governor is reduced to a mere political appointee, this is a direct attack on the separation of powers envisioned in the Fifth Schedule.
    The saddest aspect of the current crisis is the silence with which the militarisation of adivasi areas is being received. Ultimately, what we have is not an anti-Maoist plan but an anti-adivasi plan since it is they who will bear the brunt of the government’s onslaught. The adivasis of this country have been abandoned by everybody, at least till the next major Maoist attack makes news for a couple of hours.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন