এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • যুক্তি তক্কো (নিয়ে) গপ্পো

    অনামিকা গুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৫ জুন ২০১০ | ৮৯৩ বার পঠিত
  • নামটা ঋত্বিকবাবু আগেই দিয়ে রেখেছেন। অনেক বেশী বুদ্ধিমান লোকেদের নিয়ে মুশকিল এটাই। টুকতেই হ'ল। "যুক্তিযুদ্ধ' বা "বিতর্কসংহিতা' জাতীয় নাম দিয়ে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া করার চেয়ে এই ভাল। আসলে ছেলেবেলা থেকে আজ ইস্তক পাড়ার মোড়ে, ক্যান্টিনে, কফিহাউসে, কমনরুমে, অফিসে, অর্কুটে, গুরুচণ্ডালিতে, টিভিতে, কাগজে, লিট্‌ল ম্যাগাজিনে, পোমোপত্রিকায়, কঠিন জার্নালে, চা বা অন্যান্য নেশার আড্ডায় এত বেশী তর্কালঙ্কার তর্কচূড়ামণি দেখেছি যে নিজেকে মাঝে মাঝে হ্যাঁ-হ্যাঁ-বলা সঙ ব'লে মনে হয়। তা, এই লেখা সেই কমপ্লেক্স থেকে উদ্ধার পাবার এক ক্ষীণ প্রচেষ্টামাত্র। অতএব, দৃষ্টিকোণটা ঠিক টেবিল-চাপড়ানো তর্কযুদ্ধের মহারথীর নয়, বরং খানিকটা পাশের টেবিল থেকে কানপাতা উৎসাহী শ্রোতার।

    বিতর্ক, বাকবিতণ্ডা, তরজা, খেউড়, বা স্রেফ ঝগড়া, যে ফর্মেই ব্যাপারটা চলুক না কেন, বক্তা (অথবা লেখক) জিততে চান - কেউ রাজ্য, কেউ রাজকন্যা, কেউ আরো অন্য কিছু। শ্রোতা (বা পাঠক) কী চান? খানিক আমোদ, খানিক উত্তেজনা, আর হয়ত খানিকটা শেখা - মিশেলটা নির্ভর করে তিনি কতটা ফিচেল আর কতটা সিরিয়াস তার উপর। আমার (একান্ত ব্যক্তিগত) মুশকিলটা হ'ল, প্রায় সবসময়েই নাকের বদলে নরুণ নিয়ে ফিরতে হয় - শিক্ষার ভাঁড়ে ভবানী, উপরি পাওনা মাথাধরা, নিদেনপক্ষে ক্লান্তি, বিরক্তি।

    একই কথা, এবার একটু অন্যদিক থেকে ভেবে দেখা যাক। ধরুন, আপনি ভয়ানক লড়াই করে একটা তর্কে জিতলেন। আপনার গলার, গায়ের কিম্বা ব্যক্তিত্বের জোরে, ব্যাঙ্গের ছোবলে অথবা পরিস্থিতির চাপে প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত চুপ ক'রে গেল। মেয়েটিও হয়ত আপনার সঙ্গে একলা যেতে রাজি হ'ল। তাতে কী হ'ল? আমি, অর্থাৎ উপস্থিত শ্রোতা কি শিখলাম কিছু আপনার থেকে? আপনার আজকের প্রতিপক্ষ কি কালকে আপনার পক্ষে সওয়াল করবে? এই দুটো প্রশ্নের উত্তরই যদি না হয়, তাহ'লে কিন্তু খেলা আসলে ড্র - মায় আপনি আদতে হেরেও থাকতে পারেন। ঐ মহিলার কৃপাদৃষ্টি ছাড়া আপনার খাতায় শূণ্য, সবই পণ্ডশ্রম। (এখন সেইটুকুই যদি আপনি চেয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্য অন্য কথা - আমরা এখানে আর একটু বড় পরিসরে কথা বলব।)

    অবশ্য এখানে আগেই ব'লে নেওয়া দরকার আমরা সমস্ত বিতর্কের কথা বলছি না। যে তর্কের উদ্দেশ্য কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া - অর্থাৎ কিনা দীঘা যাওয়া হবে না পেলিঙ, শেষ পর্যন্ত জুতোটার জন্য আপনি ঠিক কত দাম দেবেন গড়িয়াহাটের ফুটপাথে, কোন স্কুলে যাবে মেয়ে, পার্টি কাকে টিকিট দেবে, এসব নিয়ে বাদানুবাদ আপাতত: বাদ থাক। বরং তাকানো যাক সেইসব প্রশ্নের দিকে, যেখানে বিতর্কের কোন প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর দায় নেই - যেমন ক্যাপিটালিজম-কমিউনিজম, শচীন-সৌরভ, শারুখ-আমির, বিটি বেগুন-গ্লোবালাইজেশান-আইপিএল ভাল কি মন্দ বস্তু, পৃথিবীটা ঠিক কতটা গোল, সূর্য পূবদিকে ওঠে কিনা, ঈশ্বর আছেন কি নেই এইরকম। এসব নিয়ে গরম গরম আড্ডা থেকে শুরু ক'রে খিস্তিখেউড় মারপিট বন্ধুবিচ্ছেদ সবই হ'তে পারে - কিন্তু তর্ক নিয়ে গল্পের খাতিরে এই সমস্ত ঝগড়া তরজা বিসংবাদ কূটকচালির পোষাকী নাম দেওয়া যাক বিশুদ্ধ বিতর্ক। "বিশুদ্ধ' শব্দটা গালভরা - আসল মানে নিছক বিতর্ক।

    যদি নেহাতই নিছক, আমরা তবু কেন এত সময়, এত আবেগ, এত উত্তেজনা, এত রাগ, এত বিশ্বাস, এত ভালবাসা নিয়ে তর্ক করি? কারণটা ঠিক কী, সেটার মনোবৈজ্ঞানিক বা সামাজিক বিশ্লেষণে না গিয়েও এটুকু নিশ্চয়ই বলা যায়, আমরা চাই অপরকে প্রভাবিত করতে। নিজের শর্তে অপরকে কাছে টানার, অন্যের মধ্যে নিজের ছায়া সৃষ্টি করার এই গভীর দায়ের বিশুদ্ধ প্রতিফলন হ'ল নিছক বিতর্ক। এই দড়ি টানাটানিতেই আমরা জেতার লড়াই করে যাই নিরন্তর। মুশকিল হ'ল, যুদ্ধের উত্তেজনায়, প্রবাহের তাৎক্ষণিকতায় আমাদের কাছে জেতার তাগিদটা বড় হয়ে ওঠে কাছে টানার চেয়ে। ফলে আমরা, যুযুধান দুই পক্ষই, আসল লক্ষ্যটা হারিয়ে ফেলি। আয়না গড়তে গিয়ে দেয়াল, বাঙ্কার গড়ি। তার আড়াল থেকে গুলি চালাই। নিজেরা বুঝতে পারি না, বোঝেন সেই পাশের টেবিলের আগ্রহী শ্রোতা, যিনি জিততে নয়, শিখতে চান। তাই আমরা আজ সেই শ্রোতাকেই খেলার রেফারি মানব, তাঁর কথা শুনব। রেফারি আমাদের বলে দেবেন সৎ যুদ্ধের কিছু সহজ নিয়মকানুন। সেগুলো আসলে সবারই জানা। কিন্তু আমরা খালি, বেমালুম ভুলে যাই।

    উল্টোদিক দিয়ে শুরু করা যাক। প্রথম প্রশ্ন, বিতর্ক কখন অসম্ভব? অর্থাৎ, কোন পরিস্থিতিতে তর্ক শুরু করাই অর্থহীন? ভাবা যাক শচীন বনাম সৌরভ, কে ভাল ক্রিকেটার এই প্রশ্ন দিয়ে। ধরুন আপনি প্রমাণ করলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে শচীনের তুলনা নেই, আর আমি বললাম, তাতে কী? সৌরভের মত ক্যাপটেন কেউ হয়নি, হবেও না। এখানে আমাদের মতের অমিল "ভাল ক্রিকেটারের' সংজ্ঞা নিয়ে। এই গাড্ডা থেকে বেরোতে হ'লে আমাদের এখন স্থির করতে হবে ভাল ক্রিকেটার কী বা কে সেকথা কিভাবে নির্ধারণ করা যায়। আপনি বললেন ভাল ক্রিকেটার তিনিই, যিনি ভাল খেলেন - রান করেন, উইকেট নেন। আমি বললাম, ক্রিকেট দলের খেলা, তাই ভাল ক্রিকেটার কে তাই দেখতে গেলে দেখতে হবে দলের সাফল্যে কার অবদান কতখানি। এবার প্রশ্ন ব্যক্তি বনাম সমষ্টির। সেখানেও আমরা হয়ত দুই মেরুর বাসিন্দা। সমস্যা হ'ল, "ভাল' কী, অথবা "ভাল'-র সংজ্ঞা কী ক'রে নির্ণয় করতে হবে, কোন বিষয়েই যদি দুজনের মত না মেলে, তাহলে তর্ক একটুও এগোতে পারবে না, বরং পেছোতে থাকবে। কাজেই তর্ক শুরুর আগে দেখে নিতে হবে, কোথাও যেন একটু জমি থাকে, যেখান দুজনে একসাথে দাঁড়াতে পারেন, সেখান থেকেই তর্কটা শুরু হতে পারে। একবার সেই জমিটুকু থেকে কথা শুরু হ'লে শচীন-সৌরভের তুলনামূলক বিচার না হোক, ভাল খেলোয়াড় বা খেলার সংজ্ঞা, কিংবা দল বড় না ব্যক্তি, এই নিয়ে কিছু সার্থক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ সেই জায়গাটুকু না খুঁজে পাওয়া যায়, ততক্ষণ একজন তামিলে আর অন্যজন ভোজপুরীতে কথা বলছেন - আলোচনা অসম্ভব।

    ঠিক এই কারণেই দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের কোন অর্থপূর্ণ বিতর্ক বা আলোচনা প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। কারণ তাঁদের জীবনদর্শন, স্বত:সিদ্ধগুলি, "ভাল'-র ধারণা, কিভাবে "ভাল' ক'রে "ভাল'কে বুঝতে হবে তার ধারণা, সমস্ত বিপরীতমুখী। এইখানেই "নড়বড়ে-বিশ্বাস', "এক-পা-ডাইনে-এক-পা-বাঁয়ে' মধ্যপন্থী মানুষের এক বিশাল সামাজিক দায় - তর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাবার। এঁরাই পারেন দুপক্ষের সাথে কথা বলতে - এঁরাই পারেন সেই জমি খুঁজে বার করতে, যেখান থেকে কঠিন, বৃহত্তর প্রশ্নগুলি নিয়ে সমাজে সার্থক আলোচনা শুরু হ'তে পারে। তা না হলে, প্রশ্নগুলির মীমাংসা হবে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্ফালনে, না হয় বন্দুকের নলে।

    সৌরভ-শচীনের গল্পটায় কিন্তু একটা ছোট্ট লুকোচুরি আছে। হয়ত বা "ভাল'-র ধারণাতে আপনার আমার সত্যিই এতটা অমিল ছিলো না। কিন্তু যেটুকু মিল, সেটুকু আমরা স্বীকার করলাম না, খোঁজার চেষ্টাও করলাম না। কারণ আপনি শচীনকে ভালবাসেন, আমি সৌরভকে। যে বিতর্ক আমাদের মুগ্ধতায়, আনুগত্যে একটুও আঘাত করতে পারে, সেই বিতর্ক আমরা এড়াতেই চাইব। রাজনৈতিক বিতর্কে ঠিক এই সমস্যা হয় বিশ্বাস বা অবস্থান নিয়ে। অবস্থানের প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে আমরা অনেকসময় বিতর্কের প্রতি আমাদের সততার দায় রক্ষা করতে পারি না।

    বিতর্কের প্রতি দায়টা কিসের? দায় একটা সদিচ্ছার। আপনি যেমন গভীর এক প্রত্যয় থেকে আপনার যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করে চলেছেন, আপনাকে মানতে হবে আপনার বিপক্ষ, এই আমিও, একইরকম খাঁটি প্রতীতি থেকে আমার কথাগুলি বলছি, অন্য কোন অভিসন্ধি নিয়ে নয়। একে অপরের প্রতি এই আস্থাটুকু সার্থক বিতর্কের প্রথম ধাপ। অর্থাৎ কিনা, বিপরীতধর্মী দুটি অবস্থানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। অবশ্যই, দুটি অবস্থান সমানভাবে বৈধ নাই হতে পারে। বিতর্কের উদ্দেশ্যই বৈধতার এই তারতম্য নির্ণয়। কিন্তু - সদিচ্ছার প্রয়োজন এখানেই - এইটা মেনে তর্কে নামতে হবে যে গলদ আমার নিজের অবস্থানেও থাকতে পারে। অবস্থান মানে ঠিক কী? কিছু স্বত:সিদ্ধে বিশ্বাস। (উদাহরণ: মূলধারার অর্থনীতিতে ব্যক্তির র‌্যাশনালিটি, মার্ক্সীয় দর্শনে দ্বান্দিক বস্তুবাদ ইত্যাদি।) এই স্বত:সিদ্ধগুলিই আমাদের পলিটিক্স, এদের মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের সমাজবোধ এবং আমাদের bias -সমূহ। স্বত:সিদ্ধ, অতএব সংজ্ঞার্থেই প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সোশ্যাল সায়েন্স যদি কিছুমাত্র বিজ্ঞান পদবাচ্য হয় - তাহলে - অবজেক্টিভ সত্য বলে কিছু থাক আর নাই থাক - যেকোন ধারার সোশ্যাল সায়েন্স আমাদের বলে ক্রমাগত আমাদের এই স্বত:সিদ্ধগুলি পরখ করে যেতে। বিশুদ্ধ বিতর্ক আমাদের সুযোগ দেয় যুক্তির বিরুদ্ধে, তথ্যের বিরুদ্ধে, অপরের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদের বিশ্বাসকে পরীক্ষা করতে, কষ্টিপাথরে শানিয়ে নিতে। বিশেষ করে নিজেদের গভীর bias চিনতে পারার একমাত্র পথ অন্য bias -এর মানুষের সাথে খোলা মনে কথা বলা। দুই মেরু কোনদিন এক হবে না, কিন্তু বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্যের দোহাই দিয়ে যদি আমরা ভিন্ন অবস্থানের মানুষের সাথে বিতর্ক শুরু করার, মত দেওয়ানেওয়ার পথ বন্ধ করে দিই, তাহলে যে যার অন্ধবিশ্বাসের চোরকুঠুরিতে বসে কথা বলব শুধু নিজের প্রতিধ্বনির সাথে।

    অবশ্যই বলা সহজ, করা কঠিন। কার্যত:, প্রতিটি বিতর্ক আমাদের কাছে আন্দোলন হয়ে ওঠে (বিশেষ করে আমরা যারা প্রত্যক্ষ আন্দোলনে নামতে পারি না তাদের কাছে)। আন্দোলন লড়তে গেলে দল গড়তে হয়। প্রয়োজন হয় সৈন্যসজ্জার, শৃঙ্খলার। তাই টেবিল চাপড়ে বলি, You are either with us, or against us । (বুশ থেকে শুরু করে প্রভাত পট্টনায়ক, যদিও নেতাদের ব্যাপারটা আলাদা..) কারো কথা শুনে, লেখা পড়ে আমরা প্রথমেই ঠিক করে নিই ইনি শত্রু না মিত্র। কোন শিবিরের বাসিন্দা? কার হাত শক্ত করছেন? অক্ষের কোনদিকে? যেকোন যুক্তি, তত্ত্ব বা তথ্যের বৈধতা, সত্যতা তখন এই একটিমাত্র নিক্তিতে বিচার করি। সেই গন্ধবিচারে পাশ করলে বিনা প্রশ্নে সমর্থন করি, আর ফেল করলে কথা শুরুর আগেই আক্রমণ শানাতে থাকি। ফলে, তর্কের শুরুতে যতটা অশিক্ষিত ছিলাম, তর্কের শেষেও ততটাই অশিক্ষিত থেকে যাই। বিপক্ষের যুক্তির গঠন ও বিন্যাসকে যথেষ্ট মন দিয়ে বুঝতে চাই না ব'লে নিজেদের অবস্থানগত, তত্ত্বগত ভুল চোখে পড়ে না। প্রকৃত আন্দোলন সবল হওয়ার সুযোগ হারায়।

    আপনি হয় মাওবাদী, মানুষের প্রাণ আপনার কাছে খোলামকুচি, নয় আপনি রাষ্ট্রের দালাল। আপনি হয় উন্নয়নবিরোধী, নয় কর্পোরেট ক্রীতদাস। এই দ্বিত্ব আমাদের রাজনৈতিক চর্যা ও চর্চায় মজ্জাগত, এবং বামপন্থী চিন্তাধারায় আরো প্রকট। আপনি যদি আমার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে কোথাও না কোথাও আপনার শ্রেণীস্বার্থ লুকিয়ে আছে - আপনার ব্যক্তিগত ইতিহাস খুঁড়ে দেখাব আপনার আসল চেহারা। আর, যদি আপনি আগে কখনো আমাদের সমর্থন করে থাকেন - তবে আপনি আজ বিশ্বাসঘাতক। নিদেনপক্ষে সুবিধাবাদী। "সুশীল' শব্দটা গালাগালি হয়ে যায়। যুক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা গিয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এই সন্ত্রাসের বলি হয় চিন্তার স্বাধীন প্রকাশ। যদি কেউ কোন নতুন কথা বলেন, তাঁকেও তৈরী করতে হয় নিজের ছোট্ট দল। সমস্ত চিন্তা, সমস্ত আলোচনা আটকে থাকে ছোট ছোট বৃত্তে। প্রশ্নের মীমাংসার জন্য হিংসা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। যাঁরা ভাবেন এভাবেই আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়, তাঁরা বোঝেন না বৃহত্তর আন্দোলনের সাফল্যের জন্যে বৃহত্তর সমাজের স্বীকৃতির প্রয়োজন, বিভাজনের রাজনীতিতে কোনদিনও তা পাওয়া যায় না।

    বাম-ডান, আপনি যে মেরুরই বাসিন্দা হোন না কেন, আপনাকে বুঝতে হবে যে যুগ যুগ ধরে এই পৃথিবীতে কিছু ধারণা, কিছু আদর্শ লড়াই করে চলেছে মান্যতা ( legitimacy ) পাওয়ার জন্য। এই মান্যতা কোনদিন যুদ্ধে বা বন্দুকের নলে বা ভোটের জয়ে আসেনা। এই মান্যতা আসে যখন সমাজের সর্বস্তরে মানুষ সেই ধারণাকে নিজের থেকে বোঝেন, মেনে নেন, মনে নেন, বিশ্বাস করেন। যদি কোন প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, সেই লড়াইও মানুষের মনে নতুন বিশ্বাস তৈরী করার লড়াই। কোন একটি গোষ্ঠীতে নয়, আসল চ্যলেঞ্জ সেই প্রত্যয় সারা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। মেরুকরণের রাজনীতির ফল হয় এর ঠিক বিপরীত - একথা আমরা খালি ভুলে যাই, বার বার সমাজের মূলস্রোতের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলি।

    তাই আমরা চাই এমন এক বিতর্ক, যা সমাজের বিভিন্ন মেরুর মধ্যে একটা চলাচলের পথ তৈরি করবে। এই আতঙ্কের আবহাওয়ায় সেটা সম্ভব নয়। অতএব, রেফারি বলছেন, সার্থক বিতর্কের পরবর্তী শর্ত - বিতর্ককে বক্তা- (বা লেখক-) নিরপেক্ষ হতে হবে। বক্তাবিশেষে একই বক্তব্যের বিভিন্ন অর্থ করা যাবে না বা হবে না। আমরা অনেকেই বক্তা দেখে বক্তব্য শুনি - দলের লোক হলে আগেই সমর্থন করে বসে থাকি, আর অন্য কেউ হলে কথা শুরুর আগেই মনে মনে আক্রমণ শানাই। এই প্রবণতা থেকে আমাদের যেকোন মূল্যে বেরোতে হবে। কী বললেন সেটাই দেখতে হবে, কে বললেন সেটা সম্পূর্ণ তাৎপর্যহীন।

    রেফারির আদর্শ পৃথিবীতে প্রত্যেক বক্তা মুখোশ প'রে থাকবেন, আর লেখা হবে নামহীন। বক্তার পরিচয় থাকবে শুধুমাত্র তাঁর বক্তব্যেই - নাম, গোত্র, জীবিকা, ডক্টরেট কী না, কোন দলের সদস্য, বিতর্কে এসব সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। অনেকে বলবেন বক্তার বক্তব্যকে বুঝতে হলে আগে তাঁর background জানতে হবে। রেফারির মতে - বোঝাবার, প্রমাণ করার, গূঢ় অর্থ উদ্‌ঘাটন করার দায় সম্পূর্ণভাবে বক্তার - শ্রোতার দায় শুধু বোঝবার সদিচ্ছার। বক্তা লাল হলে শুনব, নীল হলে শুনব না, পি এইচ ডি থাকলে বেশী গুরুত্ব দেব, এম বি এ হ'লে যৌথখামারের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই, পুরুষ হ'লে লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপারে কিছু বললে উড়িয়ে দেব - এইগুলো সব সার্থক বিতর্কের পরিপন্থী। অবশ্যই, মানুষের background , তার অভিজ্ঞতা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে - কিন্তু সেই প্রভাব তার বক্তব্যেই ফুটে উঠবে। বক্তব্যের মধ্যেই ধরা থাক বক্তার সমস্ত মনীষা, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা, প্রবণতা, bias । বক্তব্যে যে প্রভাব প্রতিফলিত হবে না, সেই প্রভাব হয় নেই না হয় অপ্রাসঙ্গিক, অতএব অবান্তর। আমরা যুক্তি দেখব, তথ্য দেখব, কথা শুনব। অভিসন্ধি খুঁজলে চরিত্রহনন হয়, বিতর্ক হয় না।

    যদি বক্তার উপর বক্তব্যের প্রাধান্য মেনে নিই, তবে বক্তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব চাপে। অমর্ত্য সেন বা অরুন্ধতী রায়কেও প্রতিটি লেখাতে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে হবে। উদ্ধৃতিকে যুক্তি বা তথ্যের পরিবর্তে ব্যবহার করা যাবে না। মার্ক্স বা রবীন্দ্রনাথ বা মহম্মদ বা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন বলেই কোন কথা বেশী গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে না - যুক্তি দিয়ে কথার বৈধতা প্রমাণের দায় বক্তার। পরিভাষার ব্যবহার চলবে না। ছোট ছোট দলের নিজস্ব আলোচনার ভাষা আছে - মূলধারার অর্থনীতিবিদ কঠিন গাণিতিক যুক্তি ব্যবহার করেন, পোমোসায়েবের ইংরিজি দূরধিগম্য। পরিভাষার ব্যবহার দলের চারধারে দেওয়াল তোলে, আর দলের লোকের কাছেও তাদের নিজেদের common bias -গুলো লুকিয়ে রাখে। অর্থনীতিবিদ অঙ্ক করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু যুক্তির পারম্পর্যটি মানুষকে মানুষের ভাষায় বোঝানোর দায় তাঁর।

    একটা কাঁটালো প্রশ্ন। তবে কি যৌনতার প্রশ্নে সমকামী ব্যক্তির কথাকে বেশী প্রাধান্য দেব না? লিঙ্গবৈষম্যের প্রশ্নে নারীর কথা? অবশ্যই দেব। সৎ বিতর্কের উদ্দেশ্যই সমস্ত প্রান্তিক মানুষের কথা শোনা এবং সমাজ জুড়ে শোনানো। প্রান্তিক স্বরকে অনেক, অনেক বেশী মন দিয়ে শুনতে হবে। কিন্তু সেটা বক্তার জোরে নয়, বক্তব্যের জোরে। নারীর বক্তব্যে নারীর প্রেক্ষিত ফুটে উঠবেই। কিন্তু একই কথা যদি কোন পুরুষ বলেন, তাহলে সেই বক্তব্যের বৈধতা কমে যাবে না। প্রশ্নটা সকলকে বিতর্কের অংশ করে তোলার, কাউকে বাদ দেওয়ার নয়।

    কাছাকাছি আর একটা প্রশ্ন। বিটি বেগুন বিতর্কে মনসান্টোর দেওয়া তথ্য আর পরিবেশবাদীদের দেওয়া তথ্য কি এক হল? এখানে একটা কিন্তু আছে। অবশ্যই, মনসান্টোর স্বার্থ আছে, তাদের তথ্য একপেশে। কিন্তু শুধুমাত্র সেইজন্য তাদের দেওয়া সমস্ত তথ্যকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ার আগে দেখতে হবে - আবার আমরা সেই একচক্ষুপনার ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি না তো? এভাবে, আগে একটা দল বেছে নিয়ে যদি বিপক্ষকে অবিশ্বাস করি, তাহলে বিতর্ক হওয়াই অসম্ভব। বরং লড়াই হোক তথ্যের সাথে তথ্যের, মনসান্টোকে সুযোগ দেওয়া হোক প্রাঞ্জল করে (সাধারণ মানুষের ভাষায়) তাদের তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে। পরিবেশবাদীরা, সংবেদনশীল বৈজ্ঞানিকরা সেই তথ্য কাটাছেঁড়া করুন, পাল্টা প্রমাণ দিন। আর আমাদের দায় দুপক্ষের বক্তব্যকে বোঝার, অন্তত: বোঝার চেষ্টা করার। এটুকু আমাদের গণতান্ত্রিক কর্তব্য।

    শেষ করার আগে একটা "বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ'। শিশুপাঠ্য বইয়ের কথা, কিন্তু আমরা তর্কের তোড়ে মাঝে মাঝে ভুলে যাই। বিচারের সময় তুলনাটা যেন হয় আমের সঙ্গে আমের, কাঁঠালের সঙ্গে কাঁঠালের। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে সিগারেটের মতই বিষয়টা সবাই জেনেও ভুল করেন, অথবা সবসময় মেনে চলেন না। ধরা যাক তর্কটা চলছে ক্যাপিটালিজম বনাম কম্যুনিজমের। আমি বললাম, ক্যাপিটালিজমে মানুষ মুক্ত, ভোট দিয়ে মানুষ জনপ্রতিনিধি নিয়োগ করেন, প্রতিনিধি প্রত্যেকের কাছে দায়বদ্ধ, খোলা বাজারে কনজিউমার রাজা, আর কম্যুনিজমে পার্টির একনায়কতন্ত্র চলে, পার্টির বিরুদ্ধে গেলেই ঘ্যাচাং ফু, সমস্ত মিডিয়া পার্টির নিয়ন্ত্রণে, সমস্ত সত্যই বিগ ব্রাদার নির্মিত, ইত্যাদি। আবার আপনি আঙুল দিয়ে দেখালেন, ক্যাপিটালিজম আসলে একটি প্রতিষ্ঠানিক মাৎস্যন্যায়। বহুজাতিক সংস্থাগুলো মানুষকে শোষণ করে, সরকার তাদের দালালি করে, বীভৎস বৈষম্যকে লালন করে। অন্যদিকে সাম্যবাদে সবাই সমান, প্রত্যেকে নিজের সাধ্যমত দেয় আর প্রয়োজনমত নেয়। এবার একটু ভেবে দেখুন, আমরা দুজনেই এখানে আমাদের নিজেদের পছন্দের সিস্টেমের আদর্শ অবস্থার সঙ্গে অন্য সিস্টেমটার বাস্তব রূপটার তুলনা করছি। ভুলযুক্তি। এভাবে সুস্থ বিতর্ক হয় না।

    নটেগাছটি মুড়োল। পাঠক, এবার আপনার একটা ছোট্ট পরীক্ষা। আপনি কি এই মুহূর্তে ভাবছেন আমি, অর্থাত লেখক ঠিক কী পন্থী? ক্যাপিটালিস্ট না কম্যুনিস্ট না নেহাতই সুবিধেবাদী? রাস্তার ডানদিক দিয়ে না বাঁদিক দিয়ে গাড়ি চালাই? এখনো যদি ক্যাম্পের কথা ভাবেন তাহলে কিছুই বোঝেননি। আবার প্রথম থেকে পড়ুন!

    ৬ই জুন, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ জুন ২০১০ | ৮৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন