এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  অন্য যৌনতা

  • শিন্টুরূপেণ

    প্রতিভা সরকার লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | অন্য যৌনতা | ১২ অক্টোবর ২০১৮ | ৯৯৭ বার পঠিত
  • ইরাবান তামিল মহাভারতের বীর নায়ক, যিনি হিজড়া( আমরা শুধু নই, গোটা ভারত রূপান্তরকামীদের এই নামে ডাকে। ফলে বেশি ভণিতা করে লাভ নেই) দের রক্ষাকর্তা। তিনি প্রথম যৌনতার আনন্দ পেয়েছিলেন আর এক রূপান্তরকামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে।

    তিনটি বর লাভ করেছিলেন তিনি কৃষ্ণ সান্নিধ্যে। তার মধ্যে একটি ছিল এইরকম -যদি কুরুক্ষেত্রে তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাহলে যেন তার কৌমার্য সমাপ্ত করে তার ক্ষণিক বিবাহের ব্যবস্থা হয়। এক তো তিনি সম্ভোগ অভিলাষী, দ্বিতীয়ত কৌমার্যরক্ষাকারীকে সে যুগে চিতায় উঠবার সম্মান দেওয়া হত না। যেমন তেমন করে মাটি চাপা পড়তো সে।

    পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে অর্জুন ও নাগকন্যা উলুপীর পুত্র ইরাবান বায়না ধরলেন আগের রাতেই বিবাহবাসর বসাতে হবে। কিন্তু কোন কুমারী বৈধব্য নিশ্চিত জেনে ইরাবানকে বিবাহ করবে ?

    কৃষ্ণ নিজের দেওয়া বর বিফলে যেতে না দিয়ে নিজেই মোহিনী রূপ ধারণ করলেন। বিবাহ শেষে মিলিত হলেন তারা। তৃপ্ত ইরাবান বীরের মতো সম্মুখ সমরে হত হলেন।

    দক্ষিণ ভারতের যতো হিজড়া তাদের প্রত্যেকের স্বামী ইরাবান। তামিলনাড়ুতে ফি বছর চৈত্রমাসে টানা আঠারো দিন তাঁর নামে উৎসব চলে। হাজার হাজার হিজড়া সেদিন মহা সমারোহে ইরাবানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, আবার একরাত যেতেই মঙ্গলসূত্র ছিন্ন করে বিধবার বেশে মাটিতে আছাড়িপিছাড়ি খায়।

    এই কাহিনীর তাৎপর্য অনেকরকম হতে পারে। তবে কৃষ্ণ যে উভকামী আর আলাদা করে মোহিনী যে একজন রূপান্তরকামী সে নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। পুরুষ দেবতা মায়াবলে রমণী মূর্তি ধারণ করতে পারেন, কিন্তু শিন্টু বাগুই তো পারবে না। তাই শিন্টুদের মন যদি বলে সে পুরুষ নয় মেয়ে, তাহলে সেই দ্বৈত সত্ত্বার টানাপোড়ন মেটাবার জন্য হয় তাকে নিজের শরীরের ওপর ছুরিকাঁচি চালাতে দিতে হবে, নাহলে সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণা এবং সমাজের ছিছিক্কার সয়ে যেমন রয়েছে তেমনই থেকে যেতে হবে।

    উত্তর কলকাতার একটি কলেজে তিন চার বছর আগে একটি লম্বা চওড়া মেয়ে পড়তো । তাকে কোনদিন মেয়েলি পোশাক পড়তে দেখিনি। হাঁটাচলা, ব্যবহারে তাকে মেয়ে বলে বোঝাই যেত না। এক শুচিবাইওয়ালা অধ্যাপিকা খুব চিন্তিত ছিলেন যে এই পুরুষালি মেয়ের কি হবে ! সেদিন সিটি সেন্টারে দেখা হতেই সে ছুটে এসে প্রণাম করল, কুশল জিজ্ঞাসা করল। সেক্টর ফাইভে কাজ করছে। সঙ্গের মেয়েটির পরিচয় দিল তার বান্ধবী বলে। কোথাও তার কোন জড়তা নেই।



    কিন্তু শিন্টু বাগুই অতো ভাগ্য করে জন্মায়নি। তাই পুজো মন্ডপে ঠাকুর দেখতে গেলে আপাত-পুরুষের শরীরজোড়া অমন নারীভঙ্গিমা দেখে তার কপালে এতোদিন জুটেছে অশ্লীল রসিকতা , সিটি, দুই হাতের জোড়া চাপড়, কখনো গোপন শরীরে লালসার থাবা। সে কিছুতেই প্যান্ডেলের মস্তানকে বলতে পারেনি, দাদা, তোমার প্রেমিকা বা বোনের মতো লেহেঙ্গা বা কুর্তি পরতে আমারও ইচ্ছা হয়। নেইলপলিশ, লিপস্টিক সব দিয়ে সাজতে ইচ্ছে করে পুজোর দিনে। আর মনে হলেও যা কখনো শিন্টু বলতে পারবে না, তা হল একজন ইরাবানের সঙ্গ চাই তার। একরাতের জন্য হলেও। তারপর মরণকে শিন্টু শ্যাম সমান বলে আঁকড়ে ধরতে পারবে।

    সেক্স খুব গুরুত্বপূর্ণ। নরনারীর মধ্যেকার আকর্ষণ জীবনের তুলাদন্ডের ফাল্ক্রাম। কিন্তু শিন্টুর যদি এমনই মেয়ে হয়ে দিন কাটাতে ইচ্ছে যায় ? কাউকে চাই না, শুধু এই নারীসত্ত্বার স্বীকৃতিচাই। না, সে স্বাধীনতাও কোন হিজড়েকে সমাজ দেবে না। নারী হয়ে পুরুষালি ভাব তাও সওয়া যায়, পুরুষের দেহ আর নারীর ভঙ্গিমা নাকি বড়ই বেমানান। অসহ্য ন্যাকামো। ঋতুপর্ণ নিজের জীবন দিয়ে এইটা প্রমাণ করে যাননি কি ?

    সেদিন সোশাল মিডিয়াতে এক ডাক্তারবাবুর সরল স্বীকারোক্তি অনেক লাইক কুড়িয়ে ভাইরাল হল দেখলাম। তিনি স্কুলে মেয়েলি সহপাঠীকে যৌন নির্যাতনে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন এই ছিল সেই পোস্টের বিষয়বস্তু। বিস্তর হাততালি আর তার সারল্যের প্রশংসায় কান ঝালাপালা।

    এই সামাজিক নোংরামিগুলি তখনই নিজের ময়লা হাত সামলায় যখন এদের বিরুদ্ধতায় দানা বাঁধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। দুর্বার যৌনকর্মীদের প্রতিষ্ঠান সবাই জানে। জানে না যেটা সেটা হল এরা খুব ভালো বইও প্রকাশ করেন। সেগুলো পড়ে এবং ওদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি আগে বিনেপয়সায় ফুর্তি করতে পাড়ার গুন্ডা থেকে কাউন্সিলর কেউই বাদ পড়তো না। এখন কিন্তু সোনাগাছিতে কোন মেয়েকে প্রাপ্য পয়সা না দিয়ে চলে যাওয়ার হিম্মত কারো নেই।

    ডঃ স্মরজিত জানার নেতৃত্বে যে বিপুল পরিবর্তন সোনাগাছিতে আনতে পেরেছে যৌনকর্মীরা তাতে শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, সামাজিক অবস্থানেরও হেরফের হয়েছে। আহিরিটোলা যুববৃন্দের পক্ষ থেকে এই মেয়েদের পথজোড়া আলপনা দিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আগে যাদের মন্ডপের ত্রিসীমায় ঢুকতে দেওয়া হত না আজ তারা নিজেদের দুর্গা আরাধনা করছেন। আরো আশার কথা, এই বিপুল তরঙ্গের অভিঘাত থেকে রূপান্তরকামীরাও বঞ্চিত হয়ে নেই। মন্ডপ-জোড়া পোস্টারে যার উজ্জ্বল বিভঙ্গ সে আমাদের শিন্টু বাগুই। মুখখানা যেন সব মালিন্য থেকে মুক্তি পেয়ে দৈবীপ্রভায় ভরপুর।

    সামনের মাসে দুর্বারের সঙ্গে ইউ এস এ ট্যুরে যাচ্ছে আরো দুজন শিন্টু। ডঃ জানা বললেন, এদের নিয়ে শিগগীরই নানা প্রজেক্ট হাতে নেবে দুর্বার।

    সব মিলিয়ে শিন্টুদের কাছে সময়টা খুব অন্যরকম আশার। অন্ধকার কেটে সবে ভোর হচ্ছে যখন, সেইরকম। সদ্যজাতর মুঠির মতো কোমল আর লালচে। কি হবে জানা নেই, সামনে কঠিন সংগ্রাম, দায়িত্ব, তবু মনে হয় পাড়ি দেওয়া যাবে যদি সবাই একসাথে থাকি।

    এইসব দেখে বুঝে আমার দুর্গা এবার রূপান্তরকামী দুর্গা। ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শিন্টুরূপেণ সংস্থিতা...


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ অক্টোবর ২০১৮ | ৯৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ela | 670112.207.010112.97 (*) | ২০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৬86024
  • প্রতিভাদি, অসাধারণ, বরাবরের মতই। শিন্টুরা অনেক এগিয়ে যাক, আর আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে সাহায্য করুক।
  • hu | 3478.58.89.187 (*) | ২০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫৬86025
  • আমরা খুব ভাগ্যবান প্রজন্ম। এই উত্তরণগুলো আমাদের সমকালে ঘটছে। আমার বালিকা বিদ্যালয়ের সহপাঠী তার বান্ধবী ও সন্তানকে নিয়ে সগর্বে থাকে আমাদের পুরোনো মফস্বলেই। এই লেখাটা পড়েও খুব আনন্দ হল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন