এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাস্তা

    Salil Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৪ | ১১৬৮ বার পঠিত
  • মনে পড়ে যায়, সেই কবেকার কথা ... বড়মাসীর গাড়িতে করে বালী ব্রিজ পার হওয়া, আবার ফিরে এসে আবার আবদার, চল না দিদি, আর একবার! দিদি, যিনি আমাদের আদর দিয়ে বাঁদর তৈরির চেষ্টাতে কোনো কসুর করেননি, চট করে রাজি হয়ে যেতেন, আর আবার পেরোনো হত ব্রিজ। আর যেদিন গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজে ট্রেনও ছুটতো সেদিন আমাদের আহ্লাদের আর শেষ থাকতো না। তারপরে, মন্দির চত্বরে গিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করতাম, পঞ্চমুণ্ডির আসনে কোনো একটি মুণ্ডের অধিকারীকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। অনেক পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা সদলবলে আসতাম এক বন্ধুর বাড়িতে, পড়াশুনা করব এরকম একটা সদিচ্ছা নিয়ে। ঘন্টাখানেক থাকত সদিচ্ছা, তারপর মাসীমার রান্না পড়ত পেটে, সদিচ্ছা পাল্টে যেত ঘুমে। ঘুম ভাঙত বিকেলে, তখন আবার পড়তে বসার আগে ঘুম ছাড়াবার জন্য হাঁটতে বেরিয়ে চলে আসতেই হত সেই বালী ব্রিজে। গঙ্গায় বিকেলে অনেক দিনই জোয়ার থাকত, ভেসেতআসত নাম-অজানা ডাল পাতা, ছোটো বড় কাঠের টুকরো, নানা রকম নৌকো আর লঞ্চ, মন্দিরের ঘাটে নামত উঠত নানান মানুষ। ব্রিজের উপর আসত যেত হরেক রকম লোক, জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক, আর ফুরফুরে হাওয়ায় ফুরুত ফুরুত কিশোরীর ঝাঁক, তখনো মেয়েবন্ধু-রিক্ত আমাদের কাছে যারা জাগাত অধিক আগ্রহ। যে হাওয়াটা বইত সেযুগে, সেটাও মনে হয় বেশি মিষ্টি আর শরীর-মন জুড়োনো ছিল। সত্যিই কি তাই? পরিবেশবিদরা তাই বলবেন বিজ্ঞানসম্মত কারণে, আমি তেনাদের সঙ্গে একমত হয়েও বলব, ওই উঠতি মেয়ের ঝাঁকেরও তাতে কিছু ভূমিকা ছিল।
    তারপর কয়েক যুগ কেটে গেছে ভাল-মন্দে নানান ভাবে। বালী ব্রিজের কথা মনে পড়ত কেবল যখন রাস্তায় জ্যাম হত তাকে সারাবার সময়। কালেভদ্রে কার্যসূত্রে গঙ্গা পেরোতে হলেও তার দিকে তাকাবার সময় হত না। পরে এক সময় বরং চোখ যেত ঝাঁ-চকচকে নতুন নিবেদিতা সেতুর দিকে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই-এর শেষের দিক অবধি গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করার কাজের পাশে কলকাতার কিছু প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষকে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করার সুযোগ এসেছিল, অন্য নানা রকম কাজের সঙ্গে। অনেক বছর চলেছিল সেই কাজ। এক সময় তা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হওয়ার পিছনে অনেকের মত আমারও অনঃস্বীকার্য দায় ছিল। কেন, কেমন করে, কোথায়, কবে, তা হয়েছিল, সে অন্যত্র বলার বিষয়।
    এত বছর পর হঠাৎ করেই আবার গত বছর সুযোগ হল সেই কাজে আবার হাত লাগাবার। কি করে, কবে থেকে, সেও বলা যাবে অন্য সময়। এখানে শুধু থাকবে আসা যাওয়ার পথের কথা। যদিও, গন্তব্য নয়, পথই আসল, একথা আমি মানি না। আমাদের গন্তব্য এত সুন্দর যে পথের সৌন্দর্য্য বা কষ্ট তার কাছে কিছু নয়।
    প্রথমে কথা হল, তিন মাস আমি যাব। আমাদের শিক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে কিছু মানুষকে পরিচিত করিয়ে আমার কাজ শেষ হবে। এতটা পথ যাতায়াত করার নিয়মিত ঝক্কি নিতে পারা যাবে না। শ্রীরামপুর কি এখানে নাকি! ঠিক হল আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে যাবে আমাদের এক বন্ধু, না হলে দীপাঞ্জন আর আমি নিয়মিত যেতে পারব না। প্রথমে আমাদের সঙ্কোচ হচ্ছিল, কিন্তু ওঁরাই বললেন, শ্রমজীবী বিদ্যালয়ের স্বার্থেই আমাদের গাড়িতে যাওয়া দরকার, নইলে কয়েকদিন ট্রেনে যাতায়াত করার পরে আমাদের শরীর দেবে না। আমরাও দেখলাম কথাটা ঠিক।
    অসুবিধা তো আছেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠাটা বেশ কষ্ট। গোপাল বাবুও বারে বারে ফোন করে ঝামেলা করেন। মৃত্যু আর গোপালবাবু, এই দুজনের ফোন ধরবেন না এতবড় কুলীন কেউ বিশ্বে আছে নাকি। যাই হোক, কোনো রকমে অভ্যেস হল সক্কালে বেরিয়ে পড়া। গাড়ি কোথায় আছে সে বিষয়ে বাসু-র ফোন আসে দু-তিনবার, আর সেই হিসেবে আমার তৈরি হবার গতি বাড়ে বা কমে। সময় মতো এসে যায় গাড়ি, সামনে দীপাঞ্জন, পেছনে বাসু আর অঙ্কের দিদি। ডানলপ মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরে দক্ষিনেশ্বর-মুখো হয় বাহন।
    (চলবে)
    সময়টা সাধারণত থাকে সাড়ে ন'টা। তখনো রাস্তাঘাট জ্যামজমাট হয়ে ওঠে না। পুরোনো রেল ব্রিজের নিচে দক্ষিনেশ্বর ঢোকার মুখে যা একটু ভীড়। তারপর ফাঁকা। দ্রুত চলা যায়। বাঁ দিকে নিবেদিতা সেতুর স্মার্ট আধুনিক স্তম্ভগুলোর মাঝখান দিয়ে নদী দেখা যায় বেশ, বিবেকানন্দ সেতুর পুরোনো অর্ধ-বেলনাকৃতি খাঁচা চোখ তুলনায় বেশি আটকায়। ওপারে পৌঁছোনোর আগে বাঁদিকে দুটো মন্দিরের সামনে প্রশস্ত এক ঘাট দেখে কৌতূহল জাগে। ওই মন্দিরে খুব কেউ যায় বলে শুনিনা তো! আমি অবশ্য মন্দিরের খবর বিশেষ রাখি না।
    যেতে যেতে রাস্তা দেখি আমরা ঠিকই, কিন্তু খুব খুঁটিয়ে যে দেখি তা কিন্তু নয়। আমরা যাত্রী ক'জনের মধ্যে গল্প, তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা চলতেই থাকে। কেউ কেউ থাকলে ঝগড়াও বেঁধে যায়, বলতে পারেন। শ্রমজীবী বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ, ছাত্রদের জ্ঞানার্জনের পরিস্থিতি, হাসপাতালের বর্তমান ও আগামীর সম্ভাবনা, এসব নিয়েও কথা হয় বিস্তর। যে কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (আমাদের স্কুলে পাঠদানের কাজ করতে অবশ্য নিতান্ত “শিক্ষক” হওয়া যথেষ্ট নয়) মধ্যে প্রতিদিন আদানপ্রদান খুব জরুরি, কিন্তু আমাদের সে অর্থে শিক্ষকদের নিয়মিত সাক্ষাৎ হয় না আলাদা করে বলে এই আদানপ্রদান হয় না সব সময়। সে দিক থেকে আমরা এই ক'জন একটু স্বতন্ত্র সুবিধা পাই। আমাদের মধ্যে আলোচনা হয় বিস্তর। প্রতিদিনের সাফল্য বিফলতা মজা বিরক্তি সবই রোজই আলোচনায় এসে পড়ে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কে কি করছে, কেমন করছে তার একধরণের মূল্যায়ণ নিয়মিত হয়েই চলে। ভাগ্যক্রমে, নিছক আড্ডাও কম হয় না।
    কোনো কোনো দিন অবশ্য চোখটা বাইরে যায় বেশি। কখনো কথার ফাঁকে, কখনো কথার সূত্রে। বেশির ভাগ দিন তখন তপতীদির স্মরণাপন্ন হই আমরা সকলেই। গাছপালা ফুলফল সম্পর্কে উনি আমাদের চাইতে বেশি জানেন। তাই, বিশেষ করে বসন্তের আগমনে উনি আমাদের অনেকভাবে নতুন নতুন কিছু শেখান।
    বেশি এগিয়ে যাচ্ছি। বা অনেক পিছিয়ে। কারণ স্কুলটাতে যেতে শুরু তো করেছিলাম শীতের শেষে। সেই বসন্তের শুরুতে। কিন্তু তখন থেকে তো শুরু করতে চাই না। এই শুরু করার ইচ্ছেটা হল যা দেখে সে কথা বলেই আরম্ভ করতে চাইছি।
    'অর্ধ-বেলনাকৃতি' নয়, 'হবে অর্ধ-ডিম্বাকৃতি'।
    এই তো মাস-খানেক আগে - তখনও বিশেষ গরম পড়েনি, বলতে গেলে ঠান্ডাই আছে - দেখলাম সেই তিনজন মানুষকে। কে তাঁরা জানি না, জানার প্রশ্নই নেই। তাঁদের আমি দেখেছিলাম তাঁরা জানেনও না। যদি জানতেন, আশ্চর্যই হতেন সেই তিনজন। অন্য কোনো সময় আমি তাঁদের দিকে ফিরেও তাকাতাম না, সন্দেহ নেই। সেই সকালটা কোনো অজ্ঞাত কারণে একটা আলো ফেলেছিল আমার চোখে। ব্রিজে ওঠার আগে সামান্য একটা বাঁক আছে। বাঁ দিকে নিবেদিতা-র ঢাল উঠে গেছে, ডাইনে নিচে বিবেকানন্দ-র ঢাল উঠবে, সেইখানে বেড়িবাঁধের উপর একটু আবছা ঘাসে ঢাকা মাটির একটা ফালি। প্রথমে বাঁকের শুরুতে দেখলাম দু'জন মুখোমুখি বসে আছেন, একটা ছেঁড়া-মত শতরঞ্চির উপর, মাঝখানে একটা বড় মত বাটি-গোছের, তার থেকে কিছু খাচ্ছেন। এনারা কে, কি করছেন, কেন এভাবে বসে এই সকালে রাস্তায় বসে খাচ্ছেন, বোঝার আগেই গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল। শুধু চোখে পড়ল, কাঁচাপাকা দাড়ি সম্বলিত দুটো মধ্যবয়সী প্রশান্ত মুখ। মনে হল যেন ঠিক ওইভাবে বসে প্রাতরাশ করা ওনাদের সারা জন্মের অভ্যাস। প্রায় এক মুহূর্তে গাড়ি বাঁক নিল, আর দেখলাম এক ভদ্রলোক একটা খাটো মত মাইলফলক জাতীয় কিছুর উপর বসে আছেন, কোলের উপর জড়ো করা হাত, পায়ের উপর পা তোলা, অনেকটা নিচে গঙ্গার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ, এলোমেলো চুলে রোদ পড়েছে। শীত চলে যাবার মুখে সকালের হাল্কা রোদে নদীর জল ছলাতছল করে কি গল্প বলছিল তাঁকে জানি না। অথবা এমনও হতে পারে, উনি এমন কোনো রোমান্টিক কথা ভাবছিলেনই না, নদীর জল চোখেই পড়ছিল না ওনার, হয়ত কোনো অস্থিরতা, কোনো দুঃশ্চিন্তা, কোনো বিষন্নতা, কিম্বা, নিছক হেঁটে আসার ক্লান্তি ওনাকে ওইখানে বসিয়ে রেখেছিল। এতকিছু ভাবার আগেই আমার উঠে গেছি ব্রিজে, নদী পার হচ্ছি দ্রুত। ওপাড়ের সেই মন্দির আর তার পাশের ইঁট-রঙা দুর্গ-মত দেওয়াল পেরিয়ে নেমে গেলাম বালি-র দিকে যাবার পথে।
    দেখতে দেখতে হুশ করে আমরা পৌঁছে যাই বালি খাল। দূর থেকেই দেখা যায় রাস্তার দু'পারে নানান মুখো যাত্রী-মানুষের জটলা, সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছোটো বড় নানা রকম গাড়ি, বিচিত্র চেহারার সব অটো, পথ চলতি প্রাইভেট গাড়ি, সাইকেল আর মোটরসাইকেল। দেখতে দেখতে, ডান দিকে চলে আসে উত্তরপাড়া যাবার পথ, নেমে যায় জি টি রোডের দিকে। তার পর আসে ঝিলপাড়। ডানহাতে মস্ত ঝিল, যার থেকে হয়েছে জায়গাটার নাম। ঝিলের মাঝে দেখলে মনে হয় যেন একটা দ্বীপের উপরে কিছু বাড়ি গড়ে উঠেছে। বম্বে রোডের পাশ থেকে নেমে গেছে একটা হাঁটা পথ যেটা গিয়ে মিশেছে একটা সেতুর মত রাস্তায় যেটা ঝিল পেরিয়ে পথিককে নিয়ে গেছে ওই দ্বীপের মত জায়গাটায়। আসতে যেতে দেখি নানা লোক সেতু পেরচ্ছেন পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে (একবার দেখেছি টলোমলো মোটরসাইকেলে)। আমার খুব ইচ্ছে করে একদিন ওই সেতু ধরে হাঁটি - বৃষ্টির দিনে হলে আর ভালো হয়। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠা মুশকিল। আমাদের তো সব সময় তাড়া থাকে। আর, দুপাশে জল একটা সরু রাস্তা দিয়ে শখ করে হাঁটা, আমাদের কারোরই খুব জরুরি বলে মনে হয় না। আর ওই বাড়িগুলি মোটেই কোনো দ্বীপে নয়। পিছন দিকে গেলেই দেখা যাবে, ওপাশে দিব্বি বাড়ির পর বাড়ি, তারপর হয়ত অন্য কোনো রাস্তা। খুব গদ্যময় ব্যাপার। তার চাইতে দেখতে না যাওয়াই ভালো।
    (আরও খানিক চলবে এই 'রাস্তা'-র কথা)
    ঝিলের কিছু আগে এক জায়গায় বাঁদিকে চলে যায় একটা সুড়ঙ্গপথ, বাসু বলে ওটা অমুক জায়গায় গেছে, বড় হাইওয়ের তলা দিয়ে। যদিও বেশ কৌতূহল জাগে, কিন্তু তেমন টানে না আমাকে। ঝিলের পর গাড়ি চলে বেশ দ্রুত। ফাঁকাই পাই রাস্তা। মাঝে ঘুরে যাই বাঁয়ে, দেওয়ালে লেখা থাকে রাজচন্দ্রপুর এদিকে। আন্ডারপাস দিয়ে ঢুকে একটা পথ-নিয়ম চক্রকে ঘুরে বা না ঘুরে ডান দিকে মোড় নিয়ে খানিক চলে এসে আবার মেশা যায় মূল রাস্তায়। আমরা যখন যাই আসি, খুব বেশি গাড়ি চলে না তখন। পড়ন্ত সকালের ক্রম-তেজস্বী আলোয় বাঁদিকে অথবা ডানদিকে একের পর এক দেখা যায় ছোট বড় ঝিল আর খাল। রাস্তা কখনো উঁচুতে ওঠে, নিচুতে নামে। কখনো বাঁদিকে দেখা যায় কেবল গাছের মাথা, খানিকবাদে রাস্তা নিচে নামলে আবার দৃশ্যমান হতে থাকে গোটা গাছ। ফেরার পথে বিকেলের লম্বা-ছায়া রোদ্দুরে বাঁদিকটা দেখা যায় না। ডানদিকের দৃশ্য তখন থাকে অন্য রকম। ফেরার রাস্তার কথা আপাতত থাক। পরে দেখা যাবে।
    ঋতু অনুযায়ী গাছগুলির চেহারা পাল্টায়। এখন লাল, হলুদ, হাল্কা গাঢ় বেগুনীতে ছেয়ে আছে গুঁড়ি বাদে গাছের বাকি শরীর। কৃষ্ণচূড়া (নাকি গুলঞ্চ?), রাধাচূড়া, জারুল ফুটেছে এই ভরা বসন্তে। এতদিন ছিল তরুণ বসন্তের শিমূল, আর মাঝেসাঝে এক আধটা পলাশ বা কিংশুক। এরাস্তায় অনেক ছাতিম গাছও আছে। ছাতিমের সুগন্ধ দ্রুতগতি গাড়িতে পৌঁছ্য কম। কদিনই বা থাকবে এরা! এই মধ্য-এপ্রিল থেকে আর পনের-কুড়ি দিন পর থেকেই জানান দেবে ওরা – বসন্তে শুধু ফোটা ফুলের মেলা থাকে না, একসময় সময় আসে ঝরা ফুলের খেলা দেখার।
    আমি সাধারণত বাঁদিকে বসি, ফলে হাইওয়ের বিভাজকের উপরে দুপাশের আওয়াজ আর ধূলোর ধাক্কা সওয়া সাহসী লড়াকু ফুলগুলোকে দেখি না বেশি। কিন্তু রাস্তাভাড়া দেবার খুপরিগুলো পেরোনোর আগে পর্যন্ত সেগুলো চোখে পড়ে। ঝটিতি তাদের পেরিয়ে যাই বলে স্পষ্ট চোখে পড়ে না তারা, কিন্তু তারই মধ্যে দেখি শ্বেত করবী, রক্ত করবী, ঝোপ-কৃষ্ণচূড়া (নাকি আসল), মোরগ, কলাবতী প্রভৃতি। সন্ধ্যামালতী, ছোটবেলায় যে ফুলেদের আমরা বলতাম চিনিপাঁচপাতা, এরাও থাকে। সব ফুলের নামও তো জানি না। পুরো হাইওয়ে ধরেই অল্প দূরে দূরে বিভাজক ভরে থাকে এমন সব ফুলে।
    তারপর গাড়ি আরও দ্রুতগতি। খোলা রাস্তায় চালক ছোটায় গাড়ি। দেখতে দেখতে এসে পড়ি দিল্লি রোডের মুখে। এবারে ডান দিকে ঘুরব। ঘোরার মুখে একটা পথ-নিয়মের তিন কোনা বিভাজক দ্বীপ। তার পাশে আধুনিক ধাঁচের পুলিশ চৌকি। সেখানে সব সময় কেউ না কেউ বসে থাকে। এই জায়গাটাতে বিভিন্ন রকম গাড়ির বেশ ভীড় লেগেই থাকে।
    ডান দিকে ঘোরার আগে, ওই ত্রিকোণ দ্বীপের উপর, আর এমন আরও গোটা কতক জায়গায়, নানা রঙের পাতলা কাপড়ের লম্বা ফালি, চকমকে মেকি জরির কাজ করা বিভিন্ন আকারের কি যেন সব জিনিস। জিজ্ঞেস করে জানি, ওগুলো লরি সাজানোর সরঞ্জাম। চালকরা সব কেনেন। নিজেদের বেরঙিন জীবনে একটু সৌন্দর্য আনতে এইসব সরঞ্জাম। তার সঙ্গে সঙ্গে হাইওয়ের ধূলি-ধূসরতা যেন একটু হ্রাস পায়। সারা বছরই মধ্য-এপ্রিলের ছোঁয়া লেগে থাকে বোধহয় এই রুক্ষ কঠোর মানুষগুলোর মনে। বলতে গেলে অবশ্য এঁরা গালি পাড়বেন মনে হয়।
    যে রাস্তায় পড়লাম আমরা সেটা নামেই হাইওয়ে। ভাঙাচোরা যানজট-ভারাক্রান্ত মফঃস্বলী রাস্তা, মানুষজনের যাতায়াত, এদিকে ওদিকে বাসের আসাযাওয়া, চায়ের দোকান, গাড়ি সারাবার ঠেক, এধারে ওধারে সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ‘ধর্ম’কাঁটা, দু’পাশে লরি ইত্যাদির ভিড়, চালকদের আর ‘হেলপার’দের চলাফেরা, নিয়মিত চোখে পড়া কিছু স্থানীয় ছোটো মাপের বাহুবলী মুখ, যারা মনে হয় এজায়গাটা শাসন করে। অন্য অনেক জায়গার মত। গাড়ি এগোয় ঢিমে তালে।
    একটু এগোলে ভীড় রাস্তা ছাড়ে। দ্রুততর হয় আমাদের গতি। এবারে দু’ধারে দেখা দিতে থাকে কলকারখানা। বাঁদিকে নয়ানজুলি পেরিয়ে, অন্যপারে রাস্তার ধারেই। ডানকুনি থেকে নিউটাউন ইত্যাদি যাওয়ার বাসের আড্ডা এই রাস্তাতেই একটি বৃহৎ হাউসিং এস্টেটের ফটকের সামনে। এই রাস্তার উপর বেশ ঘনঘন দেখা যায় সরাইখানা, তার মধ্যে একটি চোখ খুব টানে আমার। মাঠের মধ্যে একলষেড়ে, এটির নাম ‘মুড’। সকালে বন্ধই থাকে, ফেরার সময় দেখি খোলা। জানি, ভেতরটা হবে বেশ নোংরা-খেলো, নানান অপকর্মের ডিপো, কিন্তু তবু একবার ঢুকে দেখতে ইচ্ছে করে। স্বভাবতই, ঢোকা হয় না, কোনোদিন হবেও না।
    এই রাস্তারই একটা জায়গা ম ম করে বিস্কুটের গন্ধে। বেশ কয়েক শো মিটার জুড়ে গন্ধটা আমাদের লোভ জাগায়, কিন্তু উৎস খুঁজে পাই না। কখনো কখনো বিস্কুটের বদলে গন্ধ পাই কেক অথবা পাঁউরুটির। শেষে একদিন আবিষ্কার করলাম ওই বাঁদিকেই এক জায়গায় আছে ‘সোনা’ বিস্কুটের কারখানা। এই বিস্কুটের গন্ধ আরো পাওয়া যায় ফেরার পথে বম্বে রোডে উঠে একটু পরেই। ওখানে অবশ্য কারখানার হদিশ এখনও পাইনি।
    এই রাস্তায় চলতে চলতে খেয়াল করি, বেশ কিছু কারখানার ফটকের সামনেটা ভরে আছে প্রধানত বাগানবিলাস ফুলে, যাকে বাংলায় বলে বুগেনভিলিয়া। দু’একটা জায়গাতে মাধবীলতাও দেখেছি মনে হয়। এছাড়া অজানা নাম লতানে ফুল তো আছেই। ভাবি, কে লাগায় ওগুলো, মালিকরা, না কর্মীরা, না কি মালিকের আদেশে মালীরা। আগাছা তো নয়।
    এত ফুলের কথা বলছি, কেউ ভাবতে পারেন, সবই কি ফুল আর সুন্দর? আমরা যেন আর হাইওয়ে দেখিনি! তা নয়। হাইওয়ের যত কুৎসিত দিক সবই চোখে পড়ে যেতে যেতে, কিন্তু কী দেখব আর কী দেখব না, সেটা তো বাছাই করে আমার মস্তিষ্ক, আর এখানে লেখার সময় আমি সমুদ্রই দেখব ঠিক করেছি, বালির উপর ছড়িয়ে থাকা বিষ্ঠা নয়। বলবেন আবার কেউ কেউ, এই পলায়নী মনোবৃত্তি নিয়ে পড়াতে যাচ্ছেন? কিন্তু বন্ধু, বিষ্ঠা দেখার সময় আছে অনেক, এখন না হয় একটু ফুলই দেখলাম। আর পলায়ন? হবেও বা। স্কুলে এসে ধীরে ধীরে দেখেছি, এই ছেলেমেয়েগুলোর সংস্পর্শে এলে আমার অন্তত বিষাদ কেটে যায়, প্রাণের বন্ধ দশা কেটে গিয়ে আমার মন এই আঁধারে দিশাহারা হওয়া থেকে নিস্তার পায়। আমি তাই বুধ আর শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করি, পথের দু’ধারে আর প্রান্তে সমস্ত ফুল দু’চোখ ভরে দেখব বলে।
    দিল্লী রোড এগোয়। আমরা এসে পড়ি মীরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। এই স্কুলটা কখন খোলে আর কখন বন্ধ হয় জানি না। কখনো তো কোনো ছেলেমেয়েকে ঢুকতে বেরোতে দেখি না, সকাল বিকেল কখনই না। অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দেখি বিকেলে। বেশ বড় জায়গা বিয়ে স্কুলটার চৌহদ্দি, ভালো লাগে দেখতে, কিন্তু ... কি জানি!
    এমনি করে এক সময়ে এসে পড়ি আমরা বেলু-র মোড়ে। সোজা গেলে পৌঁছে যাব শেওড়াফুলি। আমরা ঘুরি বাঁদিকে। জনা’কতক স্বেচ্ছাসেবী (মাইনে করা) সেজ পুলিশ এখানে লাঠি হাতে যানবাহন সামলায়। তাদের অহেতুক দিক-দর্শন পেরিয়ে আমরা চলি শ্রমজীবী হাসপাতালের দিকে। পেরোই পেয়ারাপুর পুলিশ ফাঁড়ি, বড়বেলু প্রাথমিক স্কুল, দিব্য নিকোনো একটা মন্দির, সুন্দর করে বাঁধানো একটা পুষ্করিণী, এক গাছতলায় ছোট্ট পোস্ট অফিস। দু’পাশে জনবসতি দেখা যায়। দেখা যায় তৃণমূলী আর বাম পতাকার সহাবস্থান, দু’পাশে চষা জমি। রাস্তাটার দু’পাশে গুলমোহর (কৃষ্ণচূড়া) এই সময় লালে লাল। বেশ দূর থেকে দেখা যায় ইঁটের পাঁজা, এসে পড়বে হাসপাতাল। তার আগে বট পাকুর আম কাঁঠালের মধ্যে বেশ কয়েকটা শিরীষ গাছ ফুলে ছাওয়া এখন। একটা মাত্র অশোক গাছে ফুল ধরতে দেখিয়েছিলেন তপতীদি। বেশিদিন থাকবে না শুনে ফোন-ক্যামেরাতেই ছবি তুলে নিয়েছিলাম। বড় ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে পরে দেখলাম, সব ফুল শুকনো, ঝরে গেছে।
    গ্রাম বড়বেলু। বাসুর তৈরি শ্রমজীবী হাসপাতালের ম্যুরাল-শোভিত দেওয়ালের নিচ থেকে ডান দিকে নব্বই ডিগ্রী মোড় নেয় গাড়ি। আমরা এসে গেছি। স্কুল বাড়ির দোতালা থেকে ডাক শোনা যায়, স্যার-দিদিমণি, এসো।
    যে যাই বলুন, আমি বাতাসে শুনতে পাই, কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে, বল দেখি তুই মালি, হয় সে কেমন করে!

    (রাস্তা শেষ। এবার ধাপে ধাপে কথা চলবে গন্তব্য প্রসঙ্গে।)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৪ | ১১৬৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    কমলাদি - Salil Biswas
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biplob Rahman | 212.164.212.61 (*) | ২৯ মার্চ ২০১৪ ১০:২৭73667
  • তারপর?
  • π | 24.139.209.3 (*) | ৩০ মার্চ ২০১৪ ০৫:৫৭73668
  • পড়ছি। তবে শুধুই রাস্তা নয়, গন্তব্য নিয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতাও পড়তে চাই।
  • Salil Biswas | 213.147.88.10 (*) | ৩১ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫১73669
  • সবটাই লেখার ইচ্ছে আছে। যখন যতটা পারি।
  • Salil Biswas | 213.147.88.10 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:১৮73670
  • রাস্তা নিয়ে বলে চলেছি, গন্তব্যর সঙ্গে তার যোগাযোগ গভীর বলে। তবে, রাস্তা (আপাতত) শেষ হয়ে আসছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন