এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ওষুধের কথা/জলধি রায়

    Jaladhi Ray
    অন্যান্য | ০৮ অক্টোবর ২০১১ | ১০৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jaladhi Ray | 119.30.38.88 | ০৮ অক্টোবর ২০১১ ২৩:৫১496032
  • ওষুধের কথা

    প্রায় সাত-আট মাস আগের কথা, তখন আমি একটা থানা হেলথ কমপ্লেক্সে কাজ করি । একিদন সকালবেলা আউটডোরে বসে রোগী দেখছি, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সিস্টার-ইন-চার্জ, অঞ্জু দিদি । হাতে একটা ওষুধের ভায়াল ।
    —দাদা, দেখেন তো, এইটা কি ইনজেকশন অ্যামক্সিসিলিন?

    একই ওষুধ বাজারে বিভিন্ন নামে পাওয়া যায় । তো সিস্টাররা মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়েন, কোন্টা কোন ওষুধ বুঝতে পারেন না; যদিও আসলে বোঝা উচিত, কারণ ওষুধের ভায়াল বা পাতার গায়ে ওষুধের মূল উপাদানটির নাম লেখা থাকে ।

    ভায়ালটা হাতে নিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম । ওটার গায়ে মূল উপাদান লেখা ছিলো ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম(Vecuronium) । স্টোর-কিপার বাবু ইনজেকশন অ্যামক্সিসিলিন ভেবে ওটা সিস্টারের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ।

    ***

    ষোল শতকের কথা । কিছু স্প্যানিশ অভিযাত্রী গিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীতীরে । ঘুরতে ঘুরতে অভিযাত্রীদের একজন হঠাৎ মাটিতে ঢলে পড়লো, তার হাতে একটা তীর এসে বিঁধেছে । বিষমাখা তীর ।

    অ্যামাজন নদীর অববাহিকার রেইন ফরেস্টে কিছু কিছু গাছ-পালা জন্মায় যেগুলো থেকে এমন প্রাণঘাতী বিষ তৈরি হয় । কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম(Chondrodendrontomentosum), স্ট্রিকনোস গিয়ানেনসিস(Strychnosguianensis), স্ট্রিকনোস টক্সিফেরা(Strychnostoxifera) এরকমই কিছু গাছের নাম । এর মধ্যে কনড্রোডেনড্রন শক্ত লতা জাতীয় গাছ, অন্য গাছের গা বেয়ে বেড়ে ওঠে । আয়ামাজন অববাহিকার স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা এসব গাছের শেকড়, বাকল বা কাণ্ডের রস থেকে এক ধরনের বিষ তৈরি করতো যার নাম দেওয়া হয়েছিলো কুরারে(Curare) । এই বিষ তীরের মাথায় মেখে ইন্ডিয়ানরা শিকার করতো । গায়ে তীর বিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শিকার নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলত । একটা বানর তীরবিদ্ধ হওয়ার পর কয়টা গাছে লাফ দিয়ে যেতে পারবে এর উপর ভিত্তি করে বিষের ক্ষমতা মাপার একটা প্রথাও তাদের ছিলো । বিষটা যদি একটু দুর্বল হয় তাহলে হতে পারে তিন গাছ । এভাবে হত্যা করা শিকারের মাংস খেতে সমস্যা হতো না কারণ এই বিষ মানুষের খাদ্যনালী থেকে রক্তের মধ্যে যেতে পারে না ।

    ১৫৯৬ সালে স্যার ওয়াল্টার রালি(SirWalterRaleigh) তাঁর লেখায় এরকম একটা বিষের উল্লেখ করেন । কিন্তু কুরারে আসলেই কী কী দিয়ে কীভাবে তৈরি হয় অনেকদিন পর্যন্ত পশ্চিমা জগতের কাছে ছিলো অজানা । ইন্ডিয়ানরা এই বিষ প্রস্তুত করতো গোপনীয়তার সঙ্গে । অনেকদিন পরে ১৮০০ সালে আলেক্সান্দার ভন হামবোল্ট(AlexandervonHumboldt) এই বিষের প্রস্তুত-প্রণালী স্বচক্ষে দেখে ইউরোপে এর বিবরণ প্রদান করেন । ১৯৩৫ সালে কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম গাছের মূল বিষাক্ত উপাদান টিউবোকুরারিন(Tubocurarine) পৃথক করা হয় । ১৯৪০ সালের দিকে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার কাজে টিউবোকুরারিন-এর ব্যবহার শুরু হয় । ওষুধ তৈরির ইতিহাসে এটা ছিলো একটা মাইলস্টোন ।

    ***

    জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ায় প্রথমেই রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় । সাধারণত যে ইনজেকশনটা দিয়ে অজ্ঞান করা হয় ওটা দিয়ে অজ্ঞান হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড । রোগীকে নাম জিজ্ঞাসা করলে ঐ নাম বলতে বলতেই রোগী অজ্ঞান—অর্জন করার মতো একটা অভিজ্ঞতা । অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর শরীরের সব মাংসপেশী প্যারালাইজড করার জন্য আরো দুইটা ইনজেকশন দেওয়া হয় যাদের একটা হলো ভিকুরোনিয়াম । শরীরের সব মাংসপেশী প্যারালাইজড মানে হলো হাত পা বুকের মাংস মুখের মাংস সব । জিভ নড়তে পারবে না, এমন কী চোখের পাতাও নড়তে পারবে না কারণ ওগুলো নড়তে হলেও মাংসপেশীকে কাজ করতে হবে । শ্বাস নিতে পারবে না কারণ শ্বাস নিতে গেলেও বুকের মাংস এবং বুকের নিচের দিকে মাংস দিয়ে তৈরি ডায়াফ্রাম নামে একটা পর্দা নড়তে হবে । ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম দেওয়ার পর মাংসপেশীগুলোর প্যারালাইসিস হতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই মিনিট । রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস কৃত্রিমভাবে চালানোর জন্য শ্বাসনালীর ভেতরে একটা নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়োজনীয় বাতাস ঐ নল দিয়ে রোগীর ফুসফুসে ঢোকে এবং ফুসফুসের ভেতরের বাতাস বেরিয়ে আসে । রোগী প্যারালাইজড হওয়ার দেড় দুই মিনিটের মধ্যেই নল ঢুকানোর কাজটি সেরে ফেলতে হয় । রোগীকে প্যারালাইজড করা হয় অপারেশনের সুবিধার জন্য, যাতে কোনো নড়াচড়া না হয় বা মাংসপেশীগুলো যেন শক্ত হয়ে না থাকে(অজ্ঞান মানুষেরও হাত পা কিন্তু নড়তে পারে!) ।

    কোনো সজ্ঞান মানুষকে যদি ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম দেওয়া হয়? দেড় থেকে দুই মিনিটের মধ্যে তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে; নড়াচড়া করার ক্ষমতা, কথা বলার ক্ষমতা এমন কী চোখের পাতা নড়ানোর ক্ষমতাও থাকবে না; অথচ সে ভেতরে থাকবে সম্পূর্ণ সজ্ঞান! এই ওষুধের কার্যকাল বিশ মিনিটের মতো ।

    এই ভিকুরোনিয়াম নামের ওষুধটা তৈরি হয়েছে টিউবোকুরারিন থেকে, যে টিউবোকুরারিন ছিলো কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম নামক গাছটির মূল উপাদান ।

    ***

    আট-নয় বছর আগের কথা, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র ভিকুরোনিয়াম দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো । করেছিলো অজ্ঞান না হয়েই ।

    ***

    আমি একটা মৃত্যুর ঘটনা জানি, যেখানে রোগীর মৃত্যু হয়েছিলো—আমাদের সন্দেহমূলক ধারণা এই-ই ছিলো—ভুলক্রমে ভিকুরোনিয়াম দিয়ে ফেলার কারণে ।

    ***

    কেন এসব ওষুধ থানা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছিলো, যেখানে এর ব্যবহার পর্যন্ত নেই? ওষুধটার দামও তো খুব একটা কম নয় । জিজ্ঞাসা করে জানলাম সদর হাসপাতালে এটা অতিরিক্ত জমে গেছে এজন্য থানা হেলথ কমপ্লেক্সে দেওয়া হয়েছে ।
    —তো ফেরত দেন ।
    —ওরা ফেরত নেবে না । কারণ ওদেরকে খরচ দেখাতে হবে...
    —তাহলে ভাঙেন । এই বিপদ রাখার দরকার নাই ।

    এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর কী মানে ।
  • achintyarup | 59.93.243.119 | ০৯ অক্টোবর ২০১১ ০৪:০০496033
  • আরও শুনতে চাই
  • aka | 75.76.118.96 | ০৯ অক্টোবর ২০১১ ০৮:০৮496034
  • আরো লিখুন।
  • I | 14.96.218.40 | ১০ অক্টোবর ২০১১ ০০:২৬496035
  • আরো।
  • i | 124.168.49.37 | ২৩ অক্টোবর ২০১১ ০৭:১০496036
  • জলধি রায়, কোথায় গেলেন? অপেক্ষা করছি।
  • aka | 117.194.5.212 | ২৩ অক্টোবর ২০১১ ১৪:০৫496037
  • আমিও।
  • | 124.168.27.96 | ২১ নভেম্বর ২০১১ ১৭:০৯496038
  • | 124.171.5.236 | ০৩ মার্চ ২০১২ ০৫:৩৯496039
  • Nishan Chatterjee | 71.167.74.194 | ০৩ মার্চ ২০১২ ০৯:২৮496040
  • আরো চাই!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন