এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jhumjhumi | 59.36.1.89 | ০৬ মে ২০১৮ ২২:৪৬375765
  • গ্রীষ্ম গাথা


    উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো জমি যেতে যেতে দিগন্তে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, ইতস্ততঃ এদিক ওদিক ছড়ানো পলাশ, খেজুর, বাবলা গাছেরা দাঁড়িয়ে থাকে কখনো একলা, কখনো স্বজন,পরিজন সমেত | রুক্ষ জমিকে বহুকষ্টে একফসলী করে তুলে আল বেঁধে সীমানা দেওয়া, অসমান ঢেউখেলানো জমিতে যা কখনো নেমে গেছে, কখনো বা উঠে গেছে ধাপকাটা সিঁড়ির মতো |`কোথাও বা শুধুই ধুধু মাঠ, ছোটবড়ো নানান পাথরের মালা পরে ,উদাসীন , কোথাও এই পাষাণশিলারা একজোট হয়ে তৈরি করেছে টিলা, পাহাড় | মালভূমি অঞ্চল, শীত, গ্রীষ্ম, সবই বড়ো তীব্র এখানে ,তবে বর্ষার করুণাধারা কিঞ্চিৎ কমই জোটে |
    ফাগুনে বনে বনে পলাশ শিমূলে আগুন লাগানো শেষ হলে চৈত্র থেকে শুরু হয় সাজ খুলে ফেলার পালা | তাপ বাড়তে থাকে, সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই রোদ্দুরে চোখ ঝলসে যায়, আরো বেলা বাড়লে বইতে থাকে গরম হাওয়া , বাইরে বেরোনোই দায় ! তাই এপ্রিল মাস পড়লেই শুরু হয়ে যেতো মর্নিং স্কুল, সকাল সাতটা- সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত,চলতো গরমের ছুটি পড়া পর্যন্ত | ভোরের ঠাণ্ডা মিঠে হাওয়ায় ঘুমটা যখন গাঢ় হয়ে আসতো,স্বপ্নলোকের চাবিটা তখন প্রায় হাতের মুঠোয় , এমন সময়ে উঠে পড়তে হতো | তারপর তৈরি হয়ে স্কুলে যাওয়া, খাওয়ার তেমন বালাই নেই, এক কাপ দুধ বা চা বিস্কুট খেয়ে, কলকল করতে করতে স্কুলে চলো সব | তখনো সূয্যিমামার মন ভালো, মেজাজ ফুরফুরে, নরম রোদ,পাখিদের কিচিরমিচির আর সেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মিঠে হাওয়া, ঘুম থেকে উঠতে যেটুকু বিরক্তি লেগেছিল সেটুকু কেটে যায় কখন যেন | স্কুলে পিরিয়ডগুলোর সময় কমিয়ে আধঘন্টার করা হলেও কম বলে মনেই হতো না | টিফিনের সময়টাও ছিল কম, খেলা শুরু হতে না হতেই শেষ | টিফিন খাওয়ার ব্যাপার ছিলো না, সে তো সবাই যে যার বাড়ি ফিরেই খাবে | গাঁয়ে ঘরের মেয়েদের অতো সকাল সকাল খাবার চল ও ছিলো না | ছুটির পর সবাই যখন বাড়ি ফিরতো, বাইরে তখন আগুন !
    আগুন শুধু বাইরেই নয়, পেটেও | বাড়ি ফিরেই স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে আসতে না আসতেই মা সামনে ধরতো ছাতুর বাটি | বাড়িতে ছোলা আর গম ভালো করে ধুয়ে ,শুকিয়ে, শুকনো খোলায় ভেজে আটাকলে পিষিয়ে আনা ছাতু আর আখের গুড় | ছাতু নাকি শরীর ঠাণ্ডা রাখে, তাই গরমকাল ভর্তি এটাই জলখাবার তাদের বাড়িতে ,তা নইলে চিঁড়ে বা মুড়ি | খেয়ে,স্নান সেরে সে এসে বসতো তাদের দুকামরার ঘরের বাইরের ঘরটিতে | তাপ থেকে বাঁচতে ততক্ষণে সব জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, শুধু দরজার একটা পাল্লা একটু খোলা , আলো আসার জন্য | স্টিরিওতে আস্তে করে গান চালিয়ে সে ঠাণ্ডা মেঝের উপরে পা ছড়িয়ে বসতো দরজার সামনেটিতে , বাইরে রোদ্দুরে ঝলসানো চরাচর !! কখনো কখনো এমন সময়ে ভেসে আসতো এক রাখালিয়া বাঁশির সুর, অদ্ভুত মেঠো সুর, উদাসী ….কোন চেনা গানের সুর নয় , যেন কেউ আপন খেয়ালে বাজিয়ে যাচ্ছে কিছু এলোমেলো সুর ! মেয়েটা মনশ্চক্ষে দেখতে পেতো ওই যে ধানক্ষেতের আলপথ ধরে চলে গেলে যেখানে মাঠের মতো ঢালু জায়গাটা, তার একপাশের বড়ো ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটার নিচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে কোন রাখাল ছেলে, গরুগুলো চরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে | ঘরেও তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুদূরের পিয়াসী হয়ে ব্যাাকুল বাঁশরীর তান ধরেছেন | ঘর, বাহির, বাঁশি ,সুর, রোদে ঝলসানো মাঠ-প্রান্তর সব মিলিয়ে মিশিয়ে কখন যেন তৈরি হয় এক অপূর্ব অলৌকিক কোলাজ, যা চিরস্থায়ী হয়ে যায় তার মনে !!

    2
    গ্রীষ্মের দুপুরগুলো বড়ো বেশি দীর্ঘ , শেষই হয় না যেন | সেই সকাল সাড়ে দশটা - এগারোটায় শুরু হয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত , যেন সরকারী আপিসের টাইমটেবল ! নামে সকাল বিকেল হলেও আসলে পুরোটাই দুপুর, তাপের চোটে বেরোনো যায় না | একান্ত কাজ না থাকলে কেউ চট করে রাস্তায় বেরোয় না এসময় | বেরোলেও মাথা মুখ সব ঢেকে রাখতে হয়, লু লেগে যাবার সম্ভাবনা প্রবল | রাস্তার পিচ ও গলে নরম হয়ে যেতো, তার উপরে সাইকেল বা গাড়ি গেলে বেশ চাকার দাগ পড়ে যেতো | আর গলে গলে পড়তো তাদের একতলা কোয়ার্টারের ছাদের পিচগুলো ! এক সময় বর্ষায় ছাদ থেকে জল পড়ছে বলে কোন আধিকারিক ছাদের উপর একটা কালো প্লাস্টিক নাকি অন্যকিছুর শিট মতো দিয়ে,তার উপরে আলকাতরা ঢেলে ছাদের ফাটল বন্ধ করতে চেয়েছিলেন | তাতে জল পড়া কতটা আটকানো গিয়েছিল ভগবান জানে, পিচ কিন্তু পড়তেই থাকতো ! ঐ আটচল্লিশ পঞ্চাশ ডিগ্রির গরমে সেই তরল আলকাতরা উপর থেকে টুপ টুপ করে পড়ে চারপাশ চিটেগুড়ের মতো চিটচিটে করে রাখতো | একটু অসাবধান হলেই জামায়, জুতোয় লেগে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ! এর মাঝেই জ্যোতিবাবু যখন তখন অন্তর্ধান করতেন | তখন ওই ফার্নেসের মতো ঘরের দরজা খুলে রাখা ছাড়া উপায় থাকতো না | দরজা দিয়ে আসা গরম লু বাতাস ও সেই ঘেমো গায়ে মলয় সমীরণ মনে হতো | এই সব দিনগুলোয় যতক্ষণ না রেডিওতে দুপুর একটার অনুরোধের আসর শুরু হতো ততক্ষণ ছিল নিজের মতো কাটাবার সময় | তখন স্টিরিওতে পছন্দের ক্যাসেট চালিয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে ঠান্ডা মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে বা শুয়ে শুয়ে বই পড়াটা ছিল তার প্রিয় অভ্যেস | লোডশেডিং হলে গান শোনা যেতো না, কিন্তু বই পড়তে তো বাধা নেই ! বইএর মধ্যে ডুব দিলেই হুশ করে পৌঁছে যায় নীলকমল লালকমলের কাছে , সেখানে প্রাণভোমরাকে মারতে না মারতেই ইভানের সঙ্গী হয়ে চলে বাবাইয়াগার মুরগীর পায়ের উপরের বাড়ির সামনে ! কখনো আন্দ্রেইর সঙ্গে অজানি দেশের নাজানি কি আনতে যাওয়া, কখনো বা ভোম্বল সর্দারের সাথে নতুন কোন পথে হারিয়ে যাওয়া ! কখনো মনে হতো অপু বুঝি তাদের পিছনের মাঠটাতেই তীরধনুক নিয়ে মহাভারতের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে | তারপর পাণ্ডব গোয়েন্দা, সন্তু কাকাবাবু কখনো বা ফেলুদা তোপসের সাথে সে যখন রহস্যের জাল খুলতো, তখন কোথায় গরম, কোথায়ই বা লু !!
    দুপুরে খাবার পর ঘর অন্ধকার করে শুয়েও অনেক সময় ঘুম আসতো না | চুপটি করে শুয়ে থাকতে থাকতে নজর পড়ে দেওয়ালে, কতরকম আলোছায়ার খেলা সেখানে ! পুরনো ,বহুকাল রঙের প্রলেপ না পড়া কাঠের জানালার ছোট্টো ছোট্টো ফুটো দিয়ে আসা আলোর কণারা খেলে বেড়ায় দেওয়ালের গায়ে, তৈরি করে কত রকম নকশা ! কখনো দেখা যায় উল্টানো গাছ,হেঁটে যাওয়া উল্টো মানুষ, বাইরের হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নড়লে দেওয়ালেও তারই ছায়াছবি ! কি মজা! বাইরে না বেরিয়েও দিব্যি দেখা যাচ্ছে বাইরেটাকে | এমনি ছায়াবাজি দেখতে দেখতে কখন যেন চোখের পাতারা জুড়ে যায়, সেও উড়ান দেয় অন্য এক কল্পলোকে |
  • | ০৭ মে ২০১৮ ০৮:২৩375768
  • বাকীগুলোও দাও।
    খুব স্নিগ্ধ।
  • Jhumjhumi | 59.36.1.115 | ০৭ মে ২০১৮ ০৯:১৪375769
  • সূর্যের তেজ কমলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সবাই খেলতে বেরিয়ে পড়তো | যদিও গরমের তাত তখনো বেশ ভালোই, কিন্তু খেলার টান অনেক বেশি | বিকেল বেলা ঘরে বসে থাকাও তো অসহ্য ! সবাই এসে জুটলে ঠিক হতো কি খেলা হবে সেদিন | যদিও সবাই বলতে সাকুল্যে হয়তো ছ’সাত জন,ছেলেমেয়ে, কুচোকাঁচা সমেত | মতভেদ থাকতোই, তবে শেষ পর্যন্ত একটা রফা হতো | লুকোচুরি খেলার সময় কোয়ার্টারগুলোর পিছনে,পোড়া গোডাউনের ভেতরে লুকোতে গিয়ে কত যে সাপের খোলস দেখতো তারা ! একবার একটা ঢোঁড়াসাপকে বড়ো একটা কোলা ব্যাঙ খেতে গিয়ে নাকাল হতে দেখেছিল | সেটা দেখেই ‘না গিলতে পারা, না ফেলতে পারা’ কাকে বলে বুঝে গিয়েছিল | কবাডি, পিট্টু, বুড়িবসন্ত, গুলিডান্ডা যাকে তারা ডাংগুলি বলতো সবই চলতো | কাঠের গুলিকে ডান্ডা মেরে শুন্যে তুলে , সেখানেই তাকে তিন ঠোক্কর মেরে দূরে পাঠানো ছিলো বেশ বাহাদুরির কাজ | আবার স্বাদবদল আনতে মাঝে মাঝে কুমীরডাঙা, রং রং ( colourman) বা পাতা পাতা খেলা হতো | পাতা পাতা খেলায় যে মোড় বা ডেনর হতো, সে কোন একটা গাছের পাতা আনতে বলতো, বাকীরা সেই গাছ খুঁজে পাতা নিয়ে আসতো তাদের গোল করে গণ্ডি কেটে রাখা কেটে রাখা ঘরে | পাতা আনতে যাওয়াটা সহজ ছিলো, কিন্তু নিয়ে ফিরতে হতো একপায়ে | এবার সেটা লুকিয়ে রাখতে হতো ঘরের মধ্যেই কোথাও | ডেনর কে প্রত্যেকের ঘরে ঢুকে দশ গোণার মধ্যে খুঁজে বের করতে হতে সেই পাতা | আর ছিল কৃষ্ণচূড়া ফুলের পুংকেশর নিয়ে মুণ্ডু কাটাকাটি খেলা, যখন দৌড়োদৌড়ি করতে ভালো লাগতো না তখন এই করে কেটে যেতো বিকেলটা |

    কোন কোনদিন খেলতে ইচ্ছে না করলে তারা হাঁটতো বড় রাস্তাটা ধরে যেটা চলে গেছে নদী পর্যন্ত | এমনি একদিন হঠাৎই কেউ একজন নদীর ধারে যাবার কথা বলতেই সবাই রাজি হয়ে গেল | নদীটা খুব একটা কাছে নয়, কিন্তু গরমের দিন, বেলা বড়ো,অনেকটা সময় হাতে আছে | ব্লকের সীমানার বাইরে একা যাবার অনুমতি ছিল না তাদের, কিন্তু নিয়মটাকে একটু নিজেদের মতো বেঁকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে চললো সবাই নদীতে | আট থেকে বারোর দল সব, দাদা দিদিরা কুচোদের তাড়া দেয়, সন্ধ্যে হবার আগে ঘরে না ঢুকলে কপালে দুঃখ আছে | নদীর ধারে এসে দেখে ঘাটে একটা নৌকো বাঁধা আছে | সারাবছর এপার থেকে ওপারে শহরপুরা, ধানবাদে প্রতিদিনই বহুলোক যাতায়াত করতো | তাদের ভরসা ছিল সাইকেল, আর নৌকা | প্রচণ্ড গরমে নদীর জল এতটাই কমে যেতো যে লোকে এমনিই হেঁটে পার হতে পারতো ! কিন্তু সেবার কি করে যেন ভালোই জল ছিল , নদী তখনো শুকিয়ে যায় নি | নৌকো ঘাটে থাকলেও মাঝিকে কাছাকাছি কোথাও দেখা গেল না | এদিকে তাদের সবারই মন উসখুস !
    “নৌকোয় চাপলে বেশ হতো বল?”
    “হ্যাঁ , কিন্তু কাউকে তো দেখছি না !”
    “ পয়সাও তো নেই আমাদের, চাপতে দেবে কেন?”
    “তাও ঠিক...”
    ব্যস মনখারাপ হয়ে যায় তাদের, ইশ্ এতটা এসেও নৌকোয় চাপা হলো না তাদের | একটু দূরেই খেলছিলো তাদেরই মতো কয়েকটি ছেলেমেয়ে , হঠাৎই ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো যে, সে এগিয়ে এলো,
    “ নৌকায় চাপবে তুমরা?”
    “চাপলে হতো, কিন্তু কেউ তো নাই , কে চালাবে?”
    “আমি চালাতে পারি, আর উ আছে” বলে একটা বছর দশ এগারোর ছেলেকে দেখায় |
    “আমাদের কিন্তু পয়সা নাই..”
    “লাগবেক নাই, যাবে তো উঠো নৌকায় |”
    ব্যস, উঠে পড়লো সব নৌকোয়, ডেকে নিলো পারে খেলতে থাকা বাকী বাচ্চাদেরও | সবাই মিলে খানিকক্ষণ নদীবক্ষে নৌকাভ্রমণ করে ফিরে এলো ঘাটে | যে মেয়েটি নৌকা চালালো সে তাদের চেয়ে হয়তো বছর দু-তিনের বড়ো হবে, ছোটোই, অখচ কি সাবলীল ভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো তাদের !
    না , ধন্যবাদ বা থ্যাঙ্ক ইউ বলার কোন অভ্যেস তাদের ছিলো না, বলেওনি, শুধু তাদের খুশিয়াল মুখগুলোর হাসিটুকুই বলে দিয়েছিলো যা বলার |
    “খুব মজা হলো”
    “হুঁ, আমাদেরও”
    হাত মিলিয়ে ফিরে আসছিলো যখন তারা, সূর্য তখন অস্ত গেছে, আকাশ জুড়ে রঙের খেলা |
  • AS | 113.56.239.13 | ০৭ মে ২০১৮ ১১:০২375770
  • বাঃ
  • Jhumjhumi | 59.36.1.137 | ০৮ মে ২০১৮ ১১:০৬375771
  • সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে দিকচক্রবালে পরপর জ্বলে উঠতো আলো, সাঁওতালডিহি, সিন্ধ্রি, ধানবাদ, শহরপুরা….অর্ধচন্দ্রাকারে মালার মতো আলোকবিন্দু সব | আর আট-দশখানি ঘরে টিমটিমে আলো নিয়ে নিঃসীম অন্ধকারে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে থাকতো ব্লকটুকু | দিনের আলোয় যে নির্জনতা উপভোগ্য, রাতে তাই বড়ো অস্বস্তিকর ! একটানা একঘেয়ে সুরে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের “হুক্কাহুয়া ,ক্যা হুয়ার” উত্তরে সারমেয়কুলের প্রত্যুত্তর , আর মাঝে মাঝে প্যাঁচার কর্কশ ডাক সেই অস্বস্তি যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিতো | রাত ন’টা মানে অনেক রাত,তার মধ্যে খাওয়া দাওয়া সারা হয়ে যেতো | তখন তো ঘরে ঘরে টি ভি ছিল না, বিনোদনের সঙ্গী বলতে রেডিও আর টেপ রেকর্ডার | পরে দুএকটা বাড়িতে টিভি এলেও খুবই সীমিত সময়ের জন্য বাছাই করা অনুষ্ঠানই দেখা হতো | সেটুকুও হতো না লোডশেডিং এর জ্বালায় | এই লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী | সারাদিনে কতবার যে হতো তার ঠিক নেই ! গরমকালে বেড়ে যেত কয়েকগুণ | বিদ্যুৎবাবু একবার গেলে আসার কোন ঠিক ঠিকানা থাকতো না, দুঘন্টা থেকে দুদিন যা খুশি হতে পারে ! হ্যারিকেনের আলোয় বাইরে বারান্দায় বসে পড়তে পড়তে তারা দেখতে পেতো দূরে সাঁওতালডিহির আলো জ্বলছে | প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকার, সে তো আর মিছে নয় ! চাঁদের আলো থাকলে ছোটরা মাঝেমাঝে সেই রাত্তিরবেলাতেই লুকোচুরি খেলতে শুরু করতো | সাপখোপের ভয়ে মায়েরা বকুনি দিলেও তাদের তেমন ভয়ডর ছিলো না | সেই ভয়ংকর গরমে ঘরের বিছানা যেন আগুণ হয়ে থাকতো, দেওয়ালগুলো তাপ ছাড়তো , রাত দশটাতেও দেওয়ালে হাত দিলে গরম বোঝা যেত ! তখন প্রতিটা কোয়ার্টারের বাইরে দড়ির খাটিয়া পেতে লোকজন বসতো বাইরের হাওয়ায় গরম লাগতো না অতো | অনেকে সারারাতই বাইরে ঘুমোতেন আর কিছু জন মাঝরাতে আলো এলে ঘরে ঢুকে পড়তো | বাবার সাথে তারা ছোটরাও বাইরে খাটিয়ায় শুয়ে পড়তো, শুধু মায়েরা পারতো না | যতক্ষণ সম্ভব হতো বাইরে হাওয়ায় বসে থাকতো, তারপর ঘরে ঢুকে মেঝেতে জল ঢেলে মুছে নিয়ে সেই ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে তাপ জুড়ানো ছাড়া উপায় ছিলো না | খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে সে দেখতো উপরে বিশাল কালো আকাশ, তারায় ভরা ; ছোট ,বড়ো ,উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল, মিটমিটে , লাল নীল হলুদ কত তারা ! ওই যে প্রশ্নচিহ্নের মতো সপ্তর্ষিমণ্ডল, নিচে বশিষ্ঠের পাশে ছোট্ট মিটমিটে অরুন্ধতী, কালপুরুষ তার লুব্ধককে নিয়ে, দূরে W এর মতো ক্যাসিওপিয়া , অসংখ্য তারার ভিড়ে ছায়াপথ….সে দেখতেো আর ভাবতো কতো তারা, কতো? সব তো সে দেখতেও পাচ্ছে না , কত বড়ো এই আকাশ? পূর্ণিমার রাতে যখন চরাচর ভেসে যেতো রুপোলী জ্যোৎস্নায়, তার মনে হতো এমনটাই থাক না ! এমন রাতে কখনো ভেসে আসতো বাঁশির সুর, বহুদূর থেকে, কে জানে কাকে ডাকতো ! শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়তো | একেকদিন যখন ঘুম আসতো না, দেখতো গোল চাঁদটা একা একাই সরে এসেছে আরো খানিকটা | সবাই ঘুমোচ্ছে, কেউ দেখছে না কি অপূর্ব দেখাচ্ছে চারিদিক ! পরীরা কি এমন সময়েই নেমে আসে? কি যে হতো, নেমে আসতো খাট থেকে. | মোরাম বিছানো পথে একা একাই হেঁটে বেড়াতো ছোট্টো একটা মেয়ে, পৃথিবীর নাকি পরীর দেশের !!!
  • Jhumjhumi | 59.36.1.233 | ০৯ মে ২০১৮ ১৬:১৭375772
  • বসন্তের দখিনা বাতাস একটু একটু করে গরম হওয়ার সাথে সাথেই খাল,বিল,পুকুর, নদী সব শুকোতে আরম্ভ করে | মালভূমির কাঁকুরে বেলেমাটি জল ধরে রাখতে পারে না | তাই চৈত্র শেষ হয়ে বৈশাখ পড়তে না পড়তেই জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যায় | ব্লকে ছিল দুটো কুয়ো , একটা অফিসের ঠিক সামনে , আরেকটা অন্য কোয়ার্টার্স গুলোর পিছনে | অফিসের সামনেরটা বেশি গভীর ছিল না, খুব তাড়াতাড়ি জল শুকিয়ে যেত, তখন অন্য কুয়োটাই একমাত্র ভরসা | তার ও যে খুব ভালো অবস্থা তাও নয় | পাঁচ-ছ’টা পরিবার এবং আরো জনা দশেক লোকের সারাদিনের ব্যবহার্য জলের জোগান দিতে সেই জল শেষ হতে সময় লাগতো না, নিচের পাথর দেখা দিতো | তবে এই কুয়োটার একটা স্রোত ছিল, ঘন্টা কয়েক সময় পেলে একটু একটু করে জল জমতো | কিন্তু মানুষের বড়ো তাড়া, প্রয়োজন ও বটে, ফলে একটু জল জমতে না জমতেই তুলে ফেলতো কেউ না কেউ | রাতের ঘুমের সময়টুকু যা জল জমতো, ভোর রাত থেকে উঠে সেটুকুও তুলে না আনলে পরেরদিন খাওয়ার জলটুকু পাওয়াও মুশকিল ছিল | এক সময় তো মাঝরাতে উঠেও জল আনতে যেতো সব, বালতি করে বয়ে এনে ভরা হতো ছোটবড়ো নানান পাত্রে | এতো কষ্ট করে যে জল পাওয়া যেতো, সেটা কিন্তু কাদাজল | কাপড়ে ফটকিরি বেঁধে সেই সব জলে বারকয়েক করে ডুবিয়ে তুলে রাখা হতো | পরদিন সকালে দেখা যেতো সব কাদা নিচে থিতিয়ে আছে, উপরে পরিষ্কার জল | সেই জল আলগোছে ঢেলে নেওয়া হতো ,পাতলা মসলিনের কাপড়ে ছেঁকে ফিল্টারে ঢালা হতো খাওয়ার জন্য | যতদিন না বর্ষা আসতো, এ ছিলো নিত্যদিনের কাজ | কাপড়চোপড় সাবানে কাচাকাচি থাকলে পুকুরে যেতে হতো | কাছের পুকুর ছোটবাঁধের ঘাটের পাথরটা যদিও তখন পিছোতে পিছোতে চলে যেতো অনেকটা | মাঝে মাঝে কালবৈশাখী হয়ে ঝড়বৃষ্টি হলে দু’একদিন রেহাই মিলতো জল যুদ্ধের থেকে | স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লেই তারা সব চলে যেতো যে যার বাড়িতে , স্কুল খোলার আগের দিন ফিরে আসতো | রয়ে যেতো শুধু অফিসবাবুরা, তাদের তো আর গরমের ছুটি পড়তো না |
  • | 144.159.168.72 | ০৯ মে ২০১৮ ১৭:১৩375773
  • এখানেও পড়ছি আবার
  • স্বাতী রায় | ১২ মে ২০১৮ ১২:৪৩375774
  • ভালো লাগল... ছবি হয়ে ফুটে উঠল যেন ...
  • Titir | 233.227.97.96 | ২৪ মে ২০১৮ ১০:৪০375775
  • গ্রীষ্মগাথা মুগ্ধ করল।
  • aranya | 83.160.123.238 | ২৪ মে ২০১৮ ১০:৫৬375766
  • সুন্দর
  • Atoz | 125612.141.5689.8 | ০৮ জুন ২০১৮ ০৩:০৫375767
  • খুব ভালো লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন