এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নৈতিক ক্ষিপ্ততার বিবর্তন: কেন নিজের স্বার্থ্য না থাকলেও মানুষ অন্যের খারাপ ব্যবহারগুলো দমনের চেষ্টা করে

    Sumit Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ৩১ মে ২০১৮ | ২৬০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sumit Roy | ৩১ মে ২০১৮ ০৭:৫৯375654
  • কী মানুষকে নৈতিক দিক থেকে অনন্য করে তোলে?

    এই প্রশ্নের একটা ভাল উত্তর হতে পারে এই যে, অন্য কেউ ক্ষতির শিকার হলে আমরা তা কেয়ার করি। যেখানে অন্যান্য প্রাণীরা কেবল তারা নিজেরা দুর্ব্যবহারের শিকার হলেই ক্ষেপে যায়, সেখানে মানুষেরা অন্য কারও প্রতি অন্যায় হলেও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। আর মানুষের এই বিশেষ রকমের ক্ষিপ্ততাই (নৈতিক ক্ষিপ্ততা বা moral outrage) তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, কোন কোম্পানিকে বয়কট করা, অনৈতিক বন্ধু বা কলিগদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার দিকে ধাবিত করে।

    বিজ্ঞানীরা এরকম আচরণকে বলে থাকেন থার্ড-পার্টি পানিশমেন্ট, আর এটা বিবর্তন ও যৌক্তিক আত্ম-লাভের দৃষ্টিতে অনেক কাল ধরেই একটি রহস্য হয়ে থেকেছে। কেন মানুষকে অন্য কাউকে শাস্তি দেবার জন্য তার সময়, শ্রম ও সম্পদ ব্যয় করতে হবে যেখানে সে নিজে সরাসরিভাবে ক্ষতির শিকার হন নি? আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে এই শাস্তিগুলো আমাদের মধ্যকার নৈতিক ক্ষিপ্ততা থেকেই আসছে, কিন্তু এটা নতুন একটি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেনই বা মানুষের মধ্যে এই নৈতিক ক্ষিপ্ততার মনস্তত্ত্বের জন্ম হল?

    কেনই বা বড় মূল্যের বিনিময়ে অন্যদেরকে শাস্তি দেবেন?

    একটি থিওরি বলছে যে, মানুষ সমাজের উপকারের জন্য এরকম শাস্তি দিয়ে থাকে। আশপাশের মানুষের থেকে আসা সামাজিক অনুমোদন-অননুমোদন ব্যক্তির অনেক খারাপ ব্যবহারকেই রহিত করতে পারে, ঠিক যেমনটা বর্তমান সমাজের আইনগত শাস্তিগুলো করে থাকে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি উদাহরণই ধরি। আমি অফিসে কাজের সময় ফেইসবুক ব্যবহার করি। এখন যদি আমার সহকর্মী আপনি আমার এই কাজকে সমালোচনা করেন, তাহলে আমি সহ কোম্পানির অনেকেই কাজের সময় শৈথিল্য না দেখিয়ে, ভাল করে কাজ করবে, কোম্পানি আরও বেশি উৎপাদনশীল হবে। এভাবে আপনি একটি সফল ওয়ার্কপ্লেস তৈরির জন্য আমাকে শাস্তি দিলেন।

    কিন্তু এই যুক্তি একটা সমস্যার জন্য খাটে না। সমস্যাটার নাম হচ্ছে “ফ্রি-রাইডার প্রবলেম”। সবাই কোন সফল কোম্পানিতেই কাজ করতে চায়, কিন্তু কেউই এর জন্য আত্মত্যাগ করতে চায় না। যদি আপনি আমাকে এভাবে শাস্তি দেন, তাহলে আগামীকাল আমি যে পার্টির আয়োজন করেছি সেটায় আমি আপনাকে ইনভাইট করব না। তাহলে কেনই বা আপনি আমাকে এভাবে শাস্তি দেবার চেষ্টা করবেন?

    একটা কারণেই ব্যক্তি খারাপ ব্যবহারকে রহিত করার জন্য শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। আর সেটা হল আমাকে সমালোচনা মাধ্যমে কোম্পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের অফিসের বস আপনাকে পুরস্কৃত করতে পারে।

    এবার আসল কথায় আসি। সম্প্রতি নেচারে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, গবেষকগণ এরকমই একটি ভিন্ন থিওরি দিয়েছেন। সেখানে ব্যক্তির এই শাস্তি প্রয়োগের কারণ সমাজের উপকার নয়, বরং তার নিজের উপকার। যে এভাবে শাস্তি প্রয়োগ করবে তার রেপুটেশনও বৃদ্ধি পাবে, আর সে তত বিশ্বস্ত হতে পারবে। কাজের সময় ফেইসবুক ব্যবহার করার জন্য যদি আপনি আমাকে সমালোচনা করার মাধ্যমে শাস্তি দেন তাহলে অফিসের কো-ওয়ার্কাররা আপনাকে আমার চেয়ে বেশি প্রোডাক্টভ, সিনসিয়ার মনে করবে, অফিসের বসের কানে এটা গেলে তিনি আপনাকে বেশি ভরসা করবে, আর এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টও আপনি পেয়ে যেতে পারেন।

    করছেন একটা কাজ, আর সিগনাল দিচ্ছেন আরেকটার

    এই গবেষণাটিতে গবেষকগণ প্রথমে এই থার্ট পার্টি পানিশমেন্টের জন্য একটি গেম থিওরি ভিত্তিক মডেল দাঁড়া করান, যেখানে এই শাস্তি প্রদান হচ্ছে বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য একটি উচ্চমূল্যের সিগনাল। উচ্চমূল্যের কেননা এই বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য দেয়া দামের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি।

    এই উচ্চমুল্যের সিগনাল বা “কস্টলি সিগনাল” এর ধারণাটির জন্ম বিখ্যাত পিককস টেইল বা ময়ূর লেজের উদাহরণটির থেকে। নারী ময়ূর বা ময়ূরী এমন ময়ূরের সাথেই সঙ্গম করতে চায় যার ভাল মানের জিন রয়েছে, কিন্তু তারা সরাসরি পুরুষ ময়ূরদের জিনের মানকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। উচ্চ মানের পুরুষ ময়ূর নারী ময়ূর বা ময়ূরীকে অন্যদের চেয়েও বিস্তৃত আকারের পেখম দিয়ে আকর্ষণ করে। তার মধ্যে ভাল মানের জিন রয়েছে, কেবল এজন্যই সে এরকম পেখম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নিম্ন মানের পুরুষ ময়ূরদের জন্য এরকম সুন্দর পেখম প্রস্তুত করতে বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় যা খুবই ব্যয়বহুল। তাদের জন্য এরকমটা করার খরচটা অনেক বেশি হবে। নিম্ন মানের ময়ূররা তাদের পেখম দিয়ে তাই ময়ুরীদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে না বলেই, সুন্দর লেজ বা পেখম উন্নত মানের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিশ্বস্ত সিগনাল বহন করে। মানুষের পুরুষ সদস্যদের বেলাতেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই, পার্থক্য শুধু এখানেই যে ময়ূরের আছে লেজ বা পেখম, আর মানুষের থাকে টাকা পয়সা, দামী ঘড়ি বা দামী গাড়ি…

    যাই হোক, যে মডেলটি তৈরি করা হল, তার ভিত্তিতে এই আইডিয়াটাই ছিল যে, ময়ূরেরা যেমন তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যভেদে বিভিন্ন হয়, বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য মানুষের বোধ করা উদ্দীপনাভেদেও মানুষ বিভিন্ন হয়। ধরুন আপনি, আর অমিত (আপনার আরেকজন কলিগ), আপনারা দুজনেই একটা কোম্পানির ইন্টার্ন হিসেবে জয়েন করেছেন। আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অফিসে স্ট্যাবল হওয়া, এই কোম্পানিতেই জব করা, অন্যদিকে অমিতের এরকম কোন উদ্দেশ্য নেই, সে আরও ভাল কোন কোম্পানি এক্সপেক্ট করে, সে এখানে শুধু তার রেজিউমে আরেকটি নতুন লাইন যোগ করতেই এই কোম্পানির ইন্টার্নশিপে এসেছে। আপনারা দুজনই চান পূর্বে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টটির জন্য নির্বাচিত হতে (নির্বাচিত হওয়া মানে বেশি স্যালারি পাওয়া)। কিন্তু সিলেক্টেড হবার পর আপনারা দুজন দুইভাবে আচরণ করবেন। আপনার মধ্যে কঠোর পরিশ্রম করার উদ্দীপনা রয়েছে, আপনার এই সপ্তাহের উইকেন্ড প্ল্যানের বিনিময়ে হলেও আপনি এটা করবেন। কারণ এটা করলে কোম্পানির কাছে আপনার কেরিয়ার প্রোস্পেক্ট অনেক ভাল অবস্থানে চলে যাবে। অন্যদিকে অমিত যেহেতু শুধু তার রেজিউমে একটা লাইন যোগ করার জন্যই এখানে আছে, তাই সে এই কোম্পানিতে ভাল কাজ করুক, আর না করুক, এতে তার তেমন কিছু আসে যাবে না। তাই কাজে সে অনেকটা কম উদ্দীপনা দেখাবে, আর কাজের ফাঁকে চিন্তা করবে সপ্তাহের শেষের উইকেন্ডটাকে কিভাবে এনজয় করা যায়…

    এরকম পরিস্থিতিতে আপনার বসের মত লোকেরা (যাদেরকে এই মডেলে চুজার বা পছন্দকারী বলা হয়) সিদ্ধান্ত নেবেন যে আপনাকে আর অমিতের মধ্যে কাকে বেঁছে নেয়া যায় (এই মডেলে এদেরকে সিগনালার বলা হয়)। আপনার বস বের করার চেষ্টা করবেন কে বিশ্বস্ত আর কে নয়। চুজাররা সরাসরি বলতে পারেন না যে কে বিশ্বস্ত হবেন। যদি আপনার বস অমিতকে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “তুমি কি এই কোম্পানির জন্য কঠোর পরিশ্রম করবে?”, তখন অবশ্যই অমিত উত্তর দেবে, “হ্যাঁ করব”। কারণ সে ওই প্রোজেক্টে সিলেক্টেড হতে চায়। তাই চুজারদেরকে অবশ্যই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কস্টলি সিগনালের উপর ভিত্তি করেই, যেখান থেকে দেখা যাবে ব্যক্তি কাজটি অর্জনের জন্য কতটা সেক্রিফাইস করতে রাজি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই থার্ড-পার্টি পানিশমেন্ট কি এরকম কোন সিগনাল তৈরি করতে পারে?

    গবেষকগণ বলছেন, হ্যাঁ পারে। পারে, কেননা বিশ্বস্ত হবার জন্য মানুষকে উদ্দীপিত করতে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে, সেগুলোকে শাস্তির মাধ্যমে অন্যের খারাপ ব্যবহারগুলো রহিত করার উদ্দীপনার সময়ও কাজ করে। কোম্পানিতে ভাল করার জন্য আপনার মধ্যে যে প্রেষণা কাজ করেছে সেটাই আপনার বসের কাছে বিশ্বস্ত হবার উদ্দীপনা তৈরি করে দেয়, আবার সেটাই আমাকে শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে বসের দ্বারা আপনাকে পুরস্কৃত করে, আপনাকে বড় বড় প্রোজেক্ট পাইয়ে দেয়। সব মিলিয়ে আপনার বসকে ইমপ্রেস করার যে সুবিধা আছে, সেই পুরস্কারটাই আমাকে শাস্তি দেয়ার মূল্য পরিশোধ করতে আপনার জন্য যথেষ্ট হয়। সেজন্য আপনি আমাকে পানিশ করলে আমি আপনাকে পার্টিতে ইনভাইট করব কিনা, এসব নিয়ে আপনার তেমন কোন মাথাব্যাথা থাকে না, কেননা বসের পুরস্কার এর সুবিধাটি আপনার হাতেই আসছে।

    অন্যদিকে অমিত যেহেতু বসের পুরস্কারকে আপনার মত মূল্য দেয় না, তাই সে বসকে ইমপ্রেস করার জন্য আমাকে সমালোচনা করা বা শাস্তি দেয়ার কথা ভাববে না। আর এর ফলে এই পানিশমেন্ট বা থার্ড পার্টি পানিশমেন্ট আপনার বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হবার সিগনাল তৈরি করবে, যার জন্য আপনার বস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

    থিওরি থেকে ডেটা: কিভাবে মানুষ শাস্তি দেয় তা নিয়ে ইকোনমিক এক্সপেরিমেন্ট

    এরপর গবেষকগণ কিছু উদ্দীপনা-আরোপিত এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে এই থিওরিটি পরীক্ষা করে দেখেন যেখানে মানুষেরা বিভিন্ন রকমের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এই পরীক্ষায় প্রথম পর্যায়ে একজন সিগনালারের নিজের অর্থের বিনিময়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তির স্বার্থপর আচরণকে শাস্তি দেবার সুযোগ দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, একজন চুজার সিগনালারকে বিশ্বাস করে কিছু অর্থ গচ্ছিত রাখেন, আর এরফলে সেই সিগনালারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে এই অর্থের কতটা ফিরিয়ে দিতে হবে।

    আর এই পরীক্ষার ফলাফল? যেমনটা আশা করা হয়েছিল... চুজাররা সেই সিগনালারদেরকেই বেশি বিশ্বাস করেছিল যারা প্রথম পর্যায়ে স্বার্থপরতার আচরণকে শাস্তি দিয়েছিল। আর তারা এই বিশ্বাস করে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছিলেন। যে সিগনালারগণ শাস্তি প্রদান করে তারা চুজারদের কাছে বেশি বিশ্বস্ত ছিল, কারণ তারা বেশি অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে যখন সিগনালাররা আরও প্রত্যক্ষ উপায়ে চুজারের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে চেয়েছেন (অর্থ শেয়ার না করার স্বার্থপর আচরণকে শাস্তি দেয়ার বদলে, সেই স্বার্থপর ব্যক্তির হয়ে অর্থ শেয়ার করার মাধ্যমে), তখন সিগনালাররা শাস্তি দেবার তেমন উদ্দীপনা বোধ করেনি, আর চুজাররাও সে কী করেছে তা খুব একটা কেয়ার করেনি।

    মানব নৈতিকতায় এর তাৎপর্য

    সুতরাং, গবেষকগণ সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে গেলেন যে স্বার্থপরতার মত খারাপ ব্যাবহারগুলোকে শাস্তি দেয়া ময়ূরের লেজের মত কাজ করে। এটা একটা পাবলিক ডিসপ্লে হিসেবে কাজ করে, যা আপনার বিশ্বস্ততার গুণটি সকলের সামনে এনে দেয়। এর মাধ্যমে মানুষের উন্নত রেপুটেশন পাবার জন্য অন্যদের শাস্তি দেবার বিষয়টা দেখিয়ে ফ্রি রাইডার সমস্যারও সমাধান করা যায়। আর এটা একই সাথে ব্যাখ্যা করতেও সাহায্য করে যে কেন মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে এই মোরাল আউটরেজ বা নৈতিক ক্ষিপ্ততার গুণটি লাভ করেছে।

    এই থিওরির এটাও বলে যে, কেন মানুষ এমন কোন ভুল কাজকে শাস্তি দেয়, যে ভুল কাজটি কখনই তার কোন ক্ষতি করবে না। যেমন, কেন পুরুষেরা সেক্সিজম বা লিঙ্গবাদকে নিন্দা জানায়? লিঙ্গবাদকে নিন্দা করে নারীর উপকার হবে, তার হয়তো সেভাবে উপকার হবে না, কিন্তু তাও অনেক পুরুষই সেক্সিজমের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, পুরুষের এই কাজটি নারীকে একটি সিগনাল দেয়। একজন নারী সেই সিগনালটি পেয়ে সেই পুরুষটিকে বিশ্বাস করতে পারে যে সে কখনও সেক্সিস্ট আচরণ করবে না। (এখানে উল্লেখ করে রাখি যে এই সিগনাল দেবার ব্যাপারটা সেই পুরুষের বা অফিসে আপনার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে হবে না, আপনি ইচ্ছা করে এরকম করছেন তেমন নয়, বিবর্তনের কারণে আপনার সাইকোলজিতেই এই ব্যাপারটা সেট হয়ে আছে, এটা আপনার একটি গুণ যা আপনার প্রজাতিকে সুবিধা দান করে, ফিটেস্ট বংশধর তৈরিতে সহায়তা করে।)

    এই সিগনালিং এর ব্যাপারটা আরেকটা বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়। সেটা হল মানুষের হিপোক্রিসি বা ভণ্ডামিকে। অনেক সময়ই মানুষ নিজে যে খারাপ আচরণগুলো করে, একই খারাপ আচরণ যদি অন্য কাউকে করতে দেখে তখন সে তাকে শাস্তি দিতে চায়। এই থিওরিটি বলছে যে কেন মানুষ এরকম ভণ্ডামি করে। এরকম থার্ড পার্টি পানিশমেন্ট এর কারণ হিসেবে যদি আপনি বলেন, সমাজের উপকারের জন্য সে এরকম পানিশমেন্ট দিচ্ছে তাহলে একে অদ্ভূত শোনাবে। কারণ সমাজের উপকারই প্রধান ইচ্ছা থাকলে সে নিজে এটা করত না। এক্ষেত্রে যদি মানুষ অন্যকে নিজেরই খারাপ ব্যবহারগুলো করতে দেখে তাহলে অন্তত সেখানে তার চুপ করে যাবার কথা ছিল, সে প্রতিবাদ করত না। কিন্তু মানুষ এরকম প্রতিবাদ করে। করে কারণ এখানে বিশ্বাস অর্জনই প্রধান লক্ষ্য। হ্যাঁ, এই হিপোক্রিসি একরকম ডিজনেস্ট সিগনাল দেয়, আপনি যা নন তাকেই এডভারটাইজ করে, কিন্তু অন্তিমে এর মাধ্যমেই আপনি অন্যের বিশ্বাস অর্জন করছেন, তা যতই অসদুপায়ে হোক।

    সবশেষে, এই তত্ত্বটি এটাও দেখানোর চেষ্টা করে যে, কখন ব্যক্তির দেয়া শাস্তি গোষ্ঠী বা সমাজের উপকার করে, আর কখন করে না। শাস্তি সাধারণত বাজে আচরণকে রোধ করার জন্য দেয়া হয়। যখন আপনি অফিসের বসকে ইমপ্রেস করে তার থেকে পুরস্কার হাসিল করার উদ্দেশ্যে আমাকে শাস্তি দেন, তখন এর মাধ্যমে আপনি আপনার কোম্পানির উৎপাদনশীলতার উন্নতি ঘটাচ্ছেন। কিন্তু মানুষ সবসময় সমাজের সর্বোত্তম স্বার্থের জন্য শাস্তি দেয় না। অফিসে আমি যদি ইতিমধ্যে অন্য কারও কাছ থেকেও শাস্তি পেয়ে থাকি, তবুও আপনি আমাকে শাস্তি দেবার একই উদ্দীপনা বোধ করতে পারেন, বা যদি আপনি জেনেই থাকেন যে আমার এই অপরাধটি ইচ্ছাকৃত, তাও আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে শাস্তি দেয়ায় সমাজের উপর সেভাবে প্রভাব পড়ে না। তাই মানুষের দেয়া এই শাস্তিগুলো একরকম ডিসপ্রোপরশনেট বা সামঞ্জস্যহীন, অথবা একে পানিশ একসিডেন্টও বলা যায়। মানুষ নিজেদের রেপুটেশন বৃদ্ধি করার জন্যই এরকম ডিসপ্রোপরশনেট পানিশমেন্ট বা পানিশ একসিডেন্টের চর্চা করে থাকে (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছি না)। এই উদাহরণগুলো আমাদেরকে দেখায় যে, যদি এমন শাস্তি মানুষের উপকারের জন্যই বিবর্তিত হত, তাহলে থার্ড পার্টি পানিশমেন্ট এর ক্ষেত্রে ডিসপ্রপরশনেট পানিশমেন্ট বা পানিশ একসিডেন্ট এর ব্যাপারগুলো এত বেশি ঘটত না, যেমনটা এখন ঘটতে দেখা যায়। ব্যক্তিগত উদ্দীপনা ও সামষ্টিক উদ্দীপনা একে অপরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই সমাজে এমনটা হয়।

    এই নৈতিক ক্ষিপ্ততা (moral outrage) এবং থার্ড পার্টি পানিশমেন্ট হচ্ছে মানব নৈতিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, আর এগুলোই প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীদের সাথে আমাদের পার্থক্য করে দেয়। এই গবেষণাটি এটাই বলে যে, অন্যদের প্রতি অপরাধের জন্য আরেকজনকে শাস্তি দেয়ায় একটি ব্যক্তিগত লাভের দিক রয়েছে। আর এর অস্তিত্বের পেছনে থাকতে পারে আমাদের নিজেদের রেপুটেশন বৃদ্ধি। কিন্তু এই উপসংহারটি আমাদের নৈতিকতাকে নিচু করে দেয় না। মানুষ দেখতে উপকারী মনে হলেও আসলে নিজের লাভটাই আসল - এরকমটা বলা এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল না। মানুষ যে কনশাসলি এই এমনটা ভেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অন্যের কথা ভাবে, নিজের স্বার্থ জড়িত না থাকলেও খারাপ ব্যবহারকে শাস্তিপ্রদান করে, এমন কোন কথা নেই। এগুলো আমাদের জিনেই প্রোথিত। এই গবেষণা কেবল আমাদের এরকম নৈতিক আচরণের উৎস্য, প্রকৃতির সন্ধান দেয়, এর ব্যাখ্যা করে।

    তথ্যসূত্র: 

    গবেষণাটির পেপারের সূত্র:

    http://nature.com/articles/doi:10.1038/nature16981

    অন্যান্য তথ্যসূত্রসমূহ:

    http://doi.org/10.1016/S1090-5138(04)00005-4

    http://doi.org/10.1007/s10683-015-9466-8

    http://doi.org/10.1073/pnas.0630443100

    http://doi.org/10.1038/415137a

    http://doi.org/10.1006/jtbi.2001.2406

    http://octavia.zoology.washington.edu/handicap/honest_biology_02.html

    http://doi.org/10.1016/j.evolhumbehav.2010.12.002
  • Sumit Roy | ৩১ মে ২০১৮ ০৮:০৪375655
  • * বানান সংশোধন - "স্বার্থ্য" এর স্থলে "স্বার্থ"
  • π | ০১ জুন ২০১৮ ০৮:৩১375656
  • তুলে রাখালাম। সময় নিয়ে পড়ব।
  • PM | 105.184.88.171 | ০১ জুন ২০১৮ ১৮:৫৬375657
  • মানুষ যা কিছু করে তা পার্ট্নার সিলেকসন আর জিন প্রোপাগেসনের জন্য , আর সারভাইভাল অফ ফিটেস্ট এই থিওরি র ওপোর বেস করে এই লেখা। পরে ভালো লাগলো। নতুন ভাবনা। কিন্তু মুল থিওরি গুলই কি এখন চ্যালেন্জ এর মুখে নয় ? সমকামীতা ইত্যাদি কি জিন প্রোপগেসন সুত্র মেনে চলে ?
  • Sumit Roy | ০২ জুন ২০১৮ ০১:৪৯375658
  • সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট তো সমাজ আর জীববিজ্ঞান উভয়ের উপরই প্রয়োগ করা হয়, সমাজেরটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু যে নেচারাল সিলেকশনের উপর ইভোল্যুশনারি বায়োলজি প্রতিষ্ঠিত তা এখন থিওরি নয়, ফ্যাক্টের মর্যাদায় ভূষিত। তবে মানুষের সমস্ত আচরণ যে জেনেটিক্সের উপর নির্ভরশীল হবে তা নয়, মানুষের অনেক আচরণে পরিবেশের প্রভাবও থাকে। এপিজেনেটিক্স এর স্টাডিগুলো দেখিয়েছেও পরিবেশ কিকরে জিনকে পরিবর্তিত করে দেয়। সমকামিতাও এদের মধ্যে একটি।।এতে পরিবেশের প্রভাব থাকে। কিন্তু এটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরুদ্ধে যায় না। এই নিবন্ধটা অনুবাদ করেছি কজন মিলে, পড়তে পারেন:
    https://bn.wikipedia.org/s/আবম
  • paps | 340112.218.673423.94 | ০৮ জুন ২০১৮ ০৩:২৯375659
  • তুললাম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন