এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • উপন্যাস

    Ankur Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ | ২৬৯২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ankur Chakraborty | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:৫২369941
  • এই বিষয়ে ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ল্যাটিন বা গ্রীকভাষায় প্রচুর লেখালিখি হলেও বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে কি না জানা নেই।
    শুরু করলাম।
    ***
    সালটা উনিশশো বিরানব্বই। টেলিভিশনের পর্দায় একদিন হঠাৎ দেখলাম খুব অন্যরকমের পোষাক পরা কিছু লোক নাটক করছে। বাবা নাট্যজগতের সাথে যুক্ত থাকায় নাটক বস্তুটির সাথে পরিচয় অনেক ছোট থেকেই। তাই নাটকের বিষয় ধরতে না পারলেও মঞ্চে অভিনেতাদের এরকম আশ্চর্য পোষাক পরে ঘুরে বেড়ানো দেখে বেশ মজাই লাগছিল। নাটকের নাম "সক্রেটিসের জবানবন্দী"। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, "এরা কারা,কোন দেশের মানুষ সেজেছে?" বাবা বললেন, "সক্রেটিস গ্রীসের মানুষ,এরা গ্রীক সেজেছে"
    "গ্রীস" নামটা শুনে ছয় বছর বয়সেই কি যেন একটা বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠেছিল। তার কারণ আজও অনুধাবন করতে পারিনি। তবে ওই বয়সেই বুঝেছিলাম যে গ্রীস নামক দেশের সাথে আমার যেন একটা কত জন্মের নাড়ির টান (এই কথাগুলো লেখা অবধি এখনো গ্রিসে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি,যারা গেছেন তারা রীতিমত আমার কাছে ঈর্ষণীয়। তবে নিশ্চয়ই যাব যাব। শিগগিরই। যাব, মানে যেতেই হবে)।
    যাই হোক, কিছুদিনের জন্য গ্রীসকে ভুলে থাকলেও ওই বছরই সাদাকালো টিভিতে দেখা আরেক আশ্চর্য লোককে। গায়ে বর্ম, খাটো স্কার্টের মত পোষাক পরা একটা লোক,ঘোড়ার ওপর বসে। পায়ে একজোড়া বেশ মজাদার ফিতেবাঁধা জুতো। মাথার হেলমেটে বেশ সুন্দর লম্বা পালক (ওই বয়সে জানতাম না যে প্লিউম বস্তুটি ঘোড়ার ল্যাজের লোম দিয়ে তৈরি হয়)। লোকটার আবির্ভাব হঠাৎই একদিন, চাণক্য সিরিয়ালে। সিরিয়াল শেষে নাম দেখে জেনেছিলাম অভিনেতার নাম শাহরুখ ইরানী(খান নয়), এবং সিরিয়ালে তাকে অলক্ষেন্দ্র বা অলীকসুন্দর বলা হলেও তার নামের উচ্চারণ হয় আলেক্সান্ডার।
    নাড়ির টানের সাথে সাথে রক্তে দোলা লাগল।
    হ্যাঁ, গুরুবাদ বা আইডল ওয়ার্শিপ প্রভৃতি নিয়ে ঘোরতর বিরোধ থাকলেও ওএকথা অনস্বীকার্য যে হাজার খারাপ থাকা সত্ত্বেও এই একটি লোকের সাথেই হয়তো নিজের সত্ত্বার মিল খুঁজে পাই।
    গত ছাব্বিশ বছর ধরে আলেক্সান্ডার সম্পর্কে পড়াশুনা করে এবং বহুবার গ্রাফিক নভেলে আলেক্সান্ডারের জীবনকে ধরতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি। চেষ্টা করব উপন্যাসের মাধ্যমে তার জীবনকে যতটা পারি তুলে ধরতে। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই লেখা শুরু করব, আবার উপন্যাসের চাহিদা বজায় রেখেই কাল্পনিক চরিত্রের অবতারণা হবে।
    বিচক্ষণ নেতা অথচ চরম সাম্রাজ্যবাদী, সর্বকালের সেরা সেনাপতি আবার ভয়ানক আবেগপ্রবণ, চূড়ান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েও দিনের শেষে ভালপ ও খারাপ মেশানো একটা মানুষ আলেক্সান্ডার কে সামনে আনতে চাই। সে মানুষকে নিয়ে লিখছি, যার সত্ত্বা হয়তো গোটা পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ এভাবে অনুধাবন করতে পারে না।
    - অঙ্কুর চক্রবর্তী
    ২৪.১১.২০১৭
  • Ankur Chakraborty | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:৫৩369952
  • ৷৷ ১ ৷৷
    মধ্য পারস্যদেশে বছরের এই সময়ে বৃষ্টি হওয়াটাই আশ্চর্যের। অথচ বলা নেই,কওয়া নেই কোত্থেকে একটা উদ্ভট বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এই তো ভোরবেলা অবধি রোজকার মতোই হালকা ঠান্ডা হওয়া বইছিল। এমনিতেই এই এলাকায় বছরের প্রায় নয় মাস তীব্র গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়, তার ওপর যবনদেশের আবহাওয়া মনোরম। গত এক বছর ধরে পারস্যের ঊষর,উষ্ণ এলাকায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গ্রীক সেনাবাহিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার জন্য।
    সেই ফিরে যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ আজ সম্মুখে,অথচ সেই সৌভাগ্য ইউমেনেস এর কপালে জুটবে বলে মনে হচ্ছে না। কাল রাত্রে হঠাৎ ধূমকেতুর মত কোত্থেকে আনতিগোনাসের সেনাবাহিনী এসে তার তাঁবুর মধ্যে ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করল। রাতের খাবারে যবের রুটিটা পর্যন্ত ওরা শেষ করতে দিলো না। বলল, আনতিগোনাসের করা নির্দেশ, ইউমেনেস কে বন্দি রাখতে হবে। এক ফোঁটা জলও যেন তার জন্য কেউ নিয়ে যেতে না পারে।
    পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ঘটনা কেউ শুনেছে বলেও ইউমেনেসের মনে পড়ল না,যেখানে একজন যুদ্ধজয়ী সেনাপতি যুদ্ধ জয় করেও কেবল তার বংশ পরিচয়ের জন্য বন্দী হয়েছে এবং বিনা বিচারে তাকে না খাইয়ে মারার হুকুম এসেছে উপরের মহল থেকে।
    ভেবেই প্রচন্ড তেষ্টার মধ্যেও ইউমেনেসের হাসি পেল। তাচ্ছিল্যের হাসি। বিধাতার পরিহাস না কি ভাগ্যের নির্মম বিচার সে জানে না। শুধুমাত্র জাতিতে গ্রীক হওয়ার জন্যই তাকে একদিন ম্যাসেডন-রাজ ফিলিপ তাকে পেল্লার রাজসভায় স্থান দিয়েছিলেন। আর আজকে সেই গ্রীক পরিচয়ই তার কাল হল। নিজের সেনাবাহিনীর লোকজনই তার বিশ্বাস ভেঙে তাকে তুলে দিল আনতিগোনাসের হাতে। অথচ এই তো মাত্র অর্ধেক যুগ আগেও সে ছিল ম্যাসেডনের মুখ্য সচিব। যুদ্ধের সামান্যতম ধারণা না থাকা সত্ত্বেও ইউমেনেস কেবল মানুষের বিশ্বস্ততায় ভর করেই কিছু আধ-বুড়ো সৈন্য নিয়ে মহা-প্রতাপশালী ক্র্যতারাস এর সেনাবাহিনী কে বিধ্বস্ত করল। সেদিন কেইই বা ভেবেছিল যে কেবল কলম পেষা সচিবের সামনে ক্র্যতারাসের ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়বে আর তার নীচে চাপা পড়ে পাহাড়-প্রমান গ্রীক সেনাপতির মৃত্যু হবে? সেদিন তো ইউমেনেস মৃত্যুর একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ এক ক্র্যতারাস এর মৃত্যুতেই তার সেনা পিঠটান দিল আর হেলেসপন্ট থেকে মধ্য পারস্যদেশ তার পদানত হবে,এরকমটা ইউমেনেস দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। অথচ এটাই হলো। কিন্তু আজকে,এই বৃষ্টি স্যাঁতসেঁতে ইস্ফাহানের প্রান্তরে তাঁবুতে বন্দী ইউমেনেস নিজের ভাগ্যের ওপর এতোটাও ভরসা রাখতে পারছে না। কেন জানি কেবলই মনে হচ্ছে অদ্য শেষ রজনী। প্রায় বারো ঘন্টা একদানা খাবার,একফোঁটা জল তার পেটে পড়েনি। সারা রাত জেগে থাকার ক্লান্তিতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসলেও সে ঘুমোতে চায় না। পাচ্ছে ঘুমন্ত অবস্থাতেই আনতিগোনাসের লোকজন এসে তার প্রাণ নিয়ে চলে যায়! আনতিগোনাসকে ভরসা করা যায় না। ফিলিপের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও ফিলিপের ছেলেই তাকে এতটা কম ভরসা করত যে ইন্ডিয়া অবধি এগিয়ে যাওয়া সামরিক অভিযানে সে আনতিগোনাসকে সঙ্গে নেয়নি। সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকা সামলানোর দায়িত্ব তার কাঁধে দিয়ে এশিয়ার অভ্যন্তরে যাত্রা শুরু হয়।
    কবে কোন এক যুদ্ধে বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অল্প বয়স থেকেই আনতিগোনাসকে দেখতে হয়ে গেছিল বীভৎস। বয়স বাড়ার সাথে এখন তাকে দেখতে অনেকটা যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত সিংহের মত দেখায়। কাল রাতে যখন সেনারা এসে ইউমেনেসকে নিয়ে গেল, কেবল একবারের জন্য সে দেখেছিল তাঁবুর সামনে আনতিগোনাস দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তার ছেলে ডিমেট্রিয়াস। মশালের আলোছায়ার আনতিগোনাসের ভাবলেশহীন মুখাবয়বের মধ্যেও যেন একটা মনস্তাত্বিক যুদ্ধজয়ের পৈশাচিক আনন্দ উপচে পড়ছিল। ইউমেনেসকে সরিয়ে দিতে পারলেই ম্যাসেডনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর সেনাবাহিনী হবে তার অধীন। এবং এই রাজনৈতিক চরম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে সমগ্র গ্রীসের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সেনাবাহিনীকে যে দখলে রাখতে পারবে,তার হাতে।
    এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ইউমেনেসের চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেই যদি মৃত্যুর দূত এসে হানা দেয়, এই ভেবেই নিজেকে কোনভাবে ব্যস্ত রাখতে সে উঠে বসল। বন্দীদশায় তাঁবুর মধ্যে তার করণীয় কিছু নেই। প্যাপীরাসের পাতা আর কলম থাকলেও না হয় রোজকার মত দিনলিপি লিখতে বসত। কিন্তু মৃত্যুর ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে লেখা আর আসবে না। লেখা অপেক্ষা পড়া সহজ,এই ভেবেই সে তার সাথে রাখা পাণ্ডুলিপি খুলে বসল। গতকাল খেতে বসেও সে এটাই পড়ছিল এবং যখন সৈন্যদের হাত তার কাঁধের মাংসপেশীগুলো খামচে ধরলেও এই বই সে হাতছাড়া করেনি। বন্ধু নিয়ার্কাস চেয়েছিল বইটা। ইউমেনেসের মত দিনলিপি না লিখলেও,নিয়ার্কাস যা দেখে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে,সেটা তার খেরোর খাতায় তুলে রাখে। ইউমেনেসের কাছে থাকা এই অর্ধসমাপ্ত বইটাকে সে বহুদিন ধরেই ভেবে এসেছে নিজের মত করে শেষ করবে। বন্ধুর কাছে এই বইটাও বোধহয় আর ফিরিয়ে দেওয়া হল না।
    "ক্ষমা করিস,ভাই" নিজের মনেই কথাগুলো বলে ফেলল ইউমেনেস। জীবনে প্রথমবার বোধহয় কাউকে দেওয়া কথা সে রাখতে পারবে না। কিছুদিন আগেই বইটা সে পেয়েছিল ক্যালিসথেনিসের সিন্দুক ঘেঁটে। নিয়ার্কাস পড়তে চাইলেও,কোন বই পেলে নিজে আগে সেই বই পড়ে শেষ করার অদম্য বাসনা ইউমেনেসকে বাধ্য করে নিজে আগে পরে দেখতে।
    আজ সেই বইটা কর্পূরের বাতির সামনে ধরে পড়তে আরম্ভ করল ইউমেনেস।
    বইটার নাম "বায়োগ্রাফিয়া তৌ মেগাস আলেকসান্দ্রস" অর্থাৎ মহান অলেক্সান্ডারের জীবনী। প্রথম পাতার নীচে লেখা লেখকের নাম 'ক্যালিসথেনিস'! বই এর লেখকের নাম দেখে ইউমেনেসের মনে হল ভাগ্যের বিড়ম্বনার কথা। যে মানুষটা ফিলিপের ছেলেকে "মহান" অখ্যায় ভূষিত করল তার জীবদ্দশায়, সেই ফিলিপের ছেলে আলেক্সান্ডারের খামখেয়ালিপনার খেসারত দিতে হল তাকে নিজের জীবনের বিনিময়ে!
    আলেক্সান্ডারের অভিশপ্ত জীবনের বোঝা হয়তো তার সব বন্ধুদেরও বয়ে বেড়াতে হবে।
  • Ankur Chakraborty | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:৫৪369962
  • থ্রেসের কার্ডিয়া অঞ্চলে ইউমেনেস এর জন্ম। 'জন্মের পর থেকেই যুদ্ধে তার বাবা নিখোঁজ', এটাই সে নিজের পিতৃপরিচয় হিসেবে জানে। কার্ডিয়া মূলত গ্রীক উপনিবেশ। গ্রীসের উত্তর পূর্বের থ্রেস রাজ্যে গ্রীকদের দখলকারী হিসেবেই দেখা হয়। এলাকায় প্রায়শই গ্রীক উপনিবেশে থাকা লোকজনদের ওপর থ্রেসীয় আক্রমন আছড়ে পড়ে। এই তো ইউমেনেসের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স,তখনই একদিন হঠাৎ ঘূর্ণি ঝড়ের মত এসে আছড়ে পড়েছিল থ্রেসীয় তীরন্দাজ বাহিনী। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ইউমেনেসের মায়ের মৃতদেহের সামনে বসে ছিল ইউমেনেস। কোত্থেকে উড়ে আসা একটা তীর তার মায়ের গলার ঠিক বাঁদিক ফুঁড়ে চলে গিয়েছিল। আপাত শান্ত থ্রেস মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়েছিল। অথচ গ্রীক উপনিবেশ থেকে মুক্তির পথ সেদিনও দেখেনি থ্রেস, কারণ একটা ঝড়ের মধ্যে আরেকটা ঝড়ের মত থ্রেসীয়দের ওপর হামলা শুরু হয়। না, এথেনিয়ান সেনাবাহিনী,যাদের কার্ডিয়া রক্ষা করার কথা ছিল,তারা নয়। বরং আরেক পাহাড়ি জাতি। ম্যাসেডনিয়ান।
    থ্রেসের পার্বত্য এলাকার পশ্চিমেই বিশাল এলাকা জুড়ে ম্যাসেডন। আয়তনে থ্রেসের প্রায় দশ গুন জুড়ে ম্যাসেডন থেসালির উত্তর থেকে প্রায় দানিউব নদীর পার অবদি বিস্তৃত। যদিও বর্তমানে এই এলাকার অনেকটাই রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে ত্রিবালিয়ান আর এগ্রিআনিয়ান জাতির দখলে থাকা প্রায় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলা চলে।
    গ্রীসের উত্তরপূর্ব অংশ যদিও ম্যাসেডনের কাছাকাছি,তবুও শিক্ষা,সামরিক শক্তি বা গ্রিকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে থ্রেস আজও মনের দিক থেকে পুরোপুরি গ্রীক নয়। ম্যাসেডন কে প্রায় দেড়শো-দুশো বছর চেষ্টা করতে হয়েছে পুরোপুরি গ্রীক হিসেবে নিজেকে গ্রহণীয় করে তুলতে। ম্যাসেডন রাজবংশের রাজা প্রথম আলেক্সান্ডার এথেন্স,থিবস,করিন্থ, স্পার্টা সবার কাছেই কোন না কোন ভাবে নিজেকে গ্রীক প্রমান করার জন্য কখনও দূতের মাধ্যমে,কখনও আবার অলিম্পিক খেলায় অংশগ্রহন করে নিজের নামের পাশে "ফিলহেলেন" তকমা জুড়ে যেতে পারেন। "ফিলহেলেন" অর্থাৎ "গ্রীসের বা গ্রীকজাতির অনুগত", সেই আনুগত্য বজায় রেখে আর বৃদ্ধি করেই তার বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারীই তার সেনাবাহিনী নিয়ে হামলা করে বসল ইউমেনেসের জন্মভূমির ওপর। এক বেলার মধ্যে গ্রীসের কবল থেকে থ্রেসের মুক্তির সংগ্রাম পর্যবসিত হল প্রতিবেশীর হাত থেকে নিজের সম্মান বাঁচানোর লড়াইতে।
    পাহাড়ে যুদ্ধ করে পারদর্শিতা পাওয়া থ্রেসীয় জাতি কার্ডিয়ার পার্বত্য পাদদেশে ম্যাসেডন-রাজ দ্বিতীয় ফিলিপের হাতে পর্যুদস্ত হল। থ্রেসের বর্বর তীরন্দাজ বাহিনী এক বেলার মধ্যেই লুটিয়ে পড়ল ম্যাসেডনীয় সেনার বর্শার মুখে। মেঘলা দিন আর সামুদ্রিক হাওয়ায় ম্যাসেডন জয় করে ফেলল কার্ডিয়া অঞ্চলকে।
    কিন্তু এমন ভাবার কোন কারন নেই যে ফিলিপ গ্রীসের প্রতি ম্যাসেডনের আনুগত্য প্রকাশ করতে এই কাজ করলেন। ফিলিপ বিচক্ষণ সেনাপতি এবং ততোধিক বিচক্ষণ প্রশাসক। তিনি জানেন যে ভবিষ্যতে পারস্য দেশ জয় করতে হলে কার্ডিয়ার অবস্থান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তাকে হাতছাড়া করলে হয় পারস্যসম্রাট হেলেসপন্ট পর হয়ে এসে আবার গ্রীসের মাটিতে তাঁর বিজয়কেতন ওড়াবেন, নয়তো থ্রেসীয় বাহিনী ম্যাসেডনের আগেই নিজের এলাকা দখল করবে এবং পারস্য সাম্রাজ্য আর ম্যাসেডনের মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য এলাকা গঠন হয়ে ফিলিপের পক্ষে পারস্যের হালহকিকত সম্পর্কে অবগত থাকার উপায়কে বাধাপ্রাপ্ত করবে। আর তাছাড়া গ্রীকরাও কার্ডিয়া সম্পর্কে আশ্চর্যরকমের উদাসীন। এই এলাকার ভৌগোলিক আর রাজনৈতিক গুরুত্ব তারা কোনদিনই অনুধাবন করতে পারেনি। সুতরাং, নিজের ঘরের কাছের এলাকা,দূরের প্রতিবেশী শাসন করার চাইতে নিজের শাসনাধীনে অনাটাই শ্রেয় বলে ফিলিপ মনে করলেন। এবং এর ফলশ্রুতি, এক দুপুরের আক্রমনেই কার্ডিয়ার ম্যাসেডন রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি।
    বিকেলে কার্ডিয়ার বণিক সম্প্রদায়ের কাছে এখানে আগেকার মতোই বাণিজ্য করার অধিকার ও ভরসা দিয়ে যখন ফিলিপ নিজের তাঁবু খাটাবেন, তিনি খেয়াল করলেন সামনের চাতালেই এক মহিলার মৃতদেহ। তার গলা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে প্রায় দেড় হাত লম্বা একটা তীরে। তার পাশেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে একটা বছর পাঁচেকের ছেলে।
    ফিলিপ এগিয়ে গেলেন তার দিকে। সঙ্গে থাকা প্রৌঢ় সেনাপতি পারমেনিওকে মৃতদেহের যথোপযুক্ত সৎকারের দায়িত্ব বাতলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন ছোট্ট ইউমেনেসের সামনে। মায়ের মৃত্যুতে একবারও না কাঁদা ইউমেনেস এবার ফিলিপের রক্তমাখা,এক চোখ অকেজো হয়ে যাওয়া দাড়িগোঁফ সম্বলিত বীভৎস মুখাবয়ব দেখে কেঁদে ফেলল।
    ফিলিপ যুদ্ধের ময়দানে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলে পরিচিত হলেও নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ একটি কাজ তিনি আজকে করলেন। শিশু ইউমেনেসকে দুহাতে করে কোলে তুলে নিলেন। এবং প্রায় স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই ছোট্ট মা-হারা শিশুর পিঠ চাপড়ে তাকে ঘুম পাড়াতে লাগলেন। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে ইউমেনেস ফিলিপের কাঁধেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
    ফিলিপ সযত্নে তাকে নিজের তাঁবুতে,নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
    মেঘলা দিন শেষে সমুদ্রের তটে তখন ম্যাসেডনিয়ার সেনাবাহিনী যুদ্ধে মৃত থ্রেসীয়দের দেহগুলি একত্রিত করতে ব্যস্ত....বৃষ্টি এলো।
  • সিকি | 158.168.40.123 | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৯:৪৯369963
  • পড়ছি।
  • Ankur Chakraborty | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ২১:১৬369964
  • ****
    পারমেনিও প্রায় কাকভেজা হয়েই তাঁবুতে ঢুকল। ফিলিপের দান চোখের ক্ষতটা এখনও সম্পুর্ন শুকোয়নি। ডাক্তারের পরামর্শ মত নিজেই নিজের চোখে একটা মলম লাগাচ্ছিলেন ফিলিপ। পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা ইউমেনেস কে দেখে পারমেনিও জিজ্ঞেস করল, "এই বাচ্চাটাকে কে ঘুম পাড়ালো?"
    "আমার কাঁধেই ঘুমিয়ে পড়ল দেখি।" রাজা উত্তর দিলেন।
    "ভালো কথা। ঘুমোচ্ছে ঘুমাক। তোমাকে যেটা বলতে এসেছিলাম..." পারমেনিও সামনের বাতিতে খানিকটা তেল দিয়ে আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "তোমার জন্য সুখবর আছে।"
    "কি রকম?" ফিলিপ জিজ্ঞেস করলেন।
    "তোমার বাছাই করা যে ঘোড়া দুটো তুমি অলিম্পিক খেলায় পাঠিয়েছিলে, এইমাত্র পেল্লা থেকে দূত এসে জানালো,সেগুলো অলিম্পিকের রথের দৌড়ে জিতেছে।"
    "বেশ ভালো কথা। যাক,এবার অন্তত গ্রীকদের শ্রেষ্ঠ শহরের লোকজন ফিলিপকে তাদের স্বজাতি বলে স্বীকার করবে।"
    "আরে,সে তো কেবল ডেমোসথেনিস ওদের উস্কে দেয় তোমার বিরুদ্ধে। এথেন্সের নিজের সাধ্য কি বলো যে ওরা তোমার গ্রীক হওয়ার বিরুদ্ধে মতামত দেয়?"
    " সেটা ঠিকই বলেছ, খুড়ো। কিন্তু ওই ডেমোসথেনিস কোন না কোন ভাবে বাগড়া দেয় আর গ্রিকদের এক করে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দিনগুলো পিছিয়ে দেয়। আমার পূর্বপুরুষ এই অলিম্পিকে জিতেই ম্যাসেডন রাজ্যকে গ্রীক হিসেবে তুলে ধরেন আর আমি চাইছি সমগ্র গ্রীসকে এক করে পারস্য অভিযানে যেতে। কিন্তু,ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো, যে এথেন্স আর স্পার্টা এতদিন এক আসনে বসত না,আজ তারাই এক হয়ে থিবসের লোকসভাকে উস্কাচ্ছে আমার বিরুদ্ধে ত্রিমুখী জোট বানাতে। ভাবতে পারো?"
    "তা,তুমি এরপর কি করবে ভাবছ?" পারমেনিও একটা গেলাসে আঙুরের রস নিঃসৃত মদ ঢেলে বলল।
    "ডেমোসথেনিস যদি ডালে ডালে চলে,তবে আমিও চলি পাতায় পাতায়। এথেন্সের উপনিবেশ দখল করে সেখানে আবার এথেন্সকেই স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দিলাম। এবার ওদের কাছে এই বার্তা যাবে যে ফিলিপ আসলে গ্রিকদের পাশেই আছে। নিজের দেশের,নিজের ভাষার মানুষের এলাকা দখল না করে কেমন ওদের এলাকা ওদেরই ফিরিয়ে দিলাম,এটা ভেবে এথেন্সের ইস্কিনেস আমার পক্ষেই রায় দেবে। আর ডেমোসথেনিস এবং ইস্কিনেসের শত্রুতার কথা তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে।" চোখে মলম লাগানো শেষ করে ফিলিপ এবার নিজের পানপাত্রে মদ ঢাললেন। "শোনো,এখন যদি কোনোভাবে এথেন্সের লোকসভা পারস্য অভিযানের স্বপক্ষে রায় দেয়,তাহলে গ্রিসে আমি ছাড়া আর কাউকেই সেনাপতি নিয়োগ করার কথা ভাববে না। এটাই সুযোগ,বুঝলে খুড়ো। এটাই সুযোগ, এই সুযোগেই আমি উত্তর গ্রীসের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেব।"
    "কিন্তু, ম্যাসেডন কি একাই পারস্য আক্রমন করতে পারে না? আমার অভিজ্ঞতা বলছে আমাদের পদাতিক বাহিনী এখন যথেষ্টই তৈরি!"
    "না, পারমেনিও। এখনো সম্পুর্ন তৈরি নয়। ভেবে দেখো,এইটুকু একটা ছোট্ট উপনিবেশ দখল করতেই আমাদের অন্তত চব্বিশজন পদাতিক শহীদ হল। আর পারস্যের সৈন্যসংখ্যা কত বলে তোমার মনে হয়?"
    "এল লাখের কাছাকাছি হবেই। আর যদি পূর্বের উপনিবেশের সেনা কাজে লাগায়,তাহলে প্রায় দেড় লাখ।"
    "তাহলেই ভেবে নাও। এক ম্যাসেডনের পক্ষে বড়জোর হাজার বিশেক সৈন্য জোগাড় করা সম্ভব। বাকি সেনা নিয়ে যদি পারস্যের অর্ধেক সেনাও জোগাড় করতে হয়, তাহলে অন্তত এথেন্স,স্পার্টা,করিন্থ,মেগারা আর থিবসের সাহায্য লাগবেই। এখনো ম্যাসেডনের সেনা ওরকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়।"
    "সেটা খুব ভুল বলোনি তুমি। কিন্তু ম্যাসেডনের সীমান্ত এলাকার সম্পর্কে কি করবে ভেবেছ?"
    "ত্রিবালিয়ান আর এগ্রিআনিয়ান দের কথা বলছ? দেখো,ওরা মূলত যাযাবর পাহাড়ি গোষ্ঠী। খুব বেশি জাতি চেতনা ওদের নেই। কিছু রসদ ঘুষ দিলেই ওরা আমাদের হয়ে লড়াই করবার জন্য হাজত দশেক সেনা দিয়ে দেবে। আর বেগড়বাই করলে ওদের এলাকায় ঢুকে ওদের কেটে ফেলতে আমার একটুও দ্বিধা হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে ওদের নিজের দলে টানা যায়,সেই দরজা খোলা রাখা এখন বেশি দরকার। ভাবছি ওখানে আনতিগোনাসকে পাঠাব সামান্য কিছু সেনা সহ। দরকার পড়লে সে কূটনীতির আশ্রয় নেবে,আবার প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলবে। ওর বুদ্ধির ওপর তোমার ভরসা না থাকলেও আমি জানি ও এইসব বিষয়ে বিচক্ষন।"

    রাজনীতি,যুদ্ধ নানা বিষয়ে আলোচনা করে যখন তুই অভিজ্ঞ সেনাপতি নিজের নিজের তাঁবুতে ফিরে গেল ততক্ষনে বৃষ্টি থেমে আকাশে একফালি চাঁদ উঠে গেছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সেই আবেশে কখন ফিলিপ নিজের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়লেন,নিজেও জানেন না।

    ****

    পেল্লা। ম্যাসেডনের রাজধানী। তবে রাজধানী বলতেই যেরকম বিশাল একটা শহরের ছবি চোখে ভেসে ওঠে,পেল্লা মোটেও সেরকম না। উত্তরে পর্বত দেখা গেলেও পেল্লা সমতলভুমিতেই অবস্থিত। আপাতত গ্রামে জলপাইয়ের চাষ হচ্ছে। তাই মাঠের রঙ সবুজ। আবার মরসুম বদলালে গম আর যবের চাষ হবে যখন,তখন এই মাঠের রঙই সোনালী হয়ে যাবে।
    বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে পেল্লার প্রাসাদের ওপারে গ্রীক রাজনীতির কেন্দ্র বদল হচ্ছে দ্রুতগতিতে। জনজীবন এখানে বেশ ঢিমেতালে চলে। বর্তমানে গ্রীসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর অধিকারী হলেও পেল্লার মানুষজন মূলতঃ চাষী, এবং গত প্রায় এক দশক ধরে ফসলের চাষ ভালো হওয়ায় এবং করের খুব বেশি চাপ না থাকায় তাদের মধ্যে অসন্তোষের কোন কারণও দেখা যায়নি।
    শহরের নিচু এলাকায় মূলত চাষ হয়,আর যেটা হয় সেটা হচ্ছে অশ্বারোহনের মহড়া। পাশেই থেসালি রাজ্য, ম্যাসেডনের করদ রাজ্য। সেখান থেকে গ্রীসের সেনাবাহিনীতে সেরা ঘোড়ার চালান হয়। ক্ষেতের পাশেই অনাবাদি জমিগুলো তাই ঘোড়ার প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আপাতত বসন্তকাল বলে এই কাজে নিযুক্ত মানুষজন একটু কম ব্যস্ত। কিন্তু গরম বাড়লেই সকাল বেলা আস্তাবল থেকে ঘোড়াকে বের করে তাকে পরিষ্কার করা,খাওয়ানো,আবার মাঠে চড়তে নিয়ে যাওয়া,আবার ফিরিয়ে এনে ধুইয়ে পরিষ্কার করে আরেকবার খাওয়ানোর পালাতেই এদের সময় কেটে যাবে। এমনিতেই ঘোড়ার যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে ম্যাসেডনের লোকজন প্রসিদ্ধ। তাই গ্রীসের অন্যান্য সেনা অপেক্ষা এদের অশ্বারোহী বাহিনী অনেক দ্রুত বলেই খ্যাতি অর্জন করেছে।
    গ্রীক শহরগুলোর সাধারণত দুটো ভাগ। শহরের নিচু এলাকা চাষবাস বা ঘোড়া বা ভেড়া পালনে ব্যবহার হয়,আর উঁচু এলাকা বা একরোপলিসে মানুষজনের বসতি। সেখানেই রাজপ্রাসাদ। ম্যাসেডনের একরোপলিস যদিও অন্যান্য গ্রীক একরোপলিস অপেক্ষা নিচু,তাই ক্ষেত থেকে সেটা সেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়না।

    এরকমই একটা অনাবাদি জমিতে আনতিগোনাস একটা বেশ বড় সাদা ঘোড়ার দেখভাল করছে। পাশে দাঁড়ানো আন্দ্রোটিমাস একসময় ঘোড়ার ব্যবসা করলেও এখন জাহাজ মেরামতের সরঞ্জাম বানায় আর বিক্রি করে। আন্দ্রোটিমাস ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দা হওয়ায় নৌবিদ্যা ওর রক্তে। ওর বছর চারেকের ছেলে নিয়ার্কাস ইতিমধ্যেই কাঠের টুকরো থেকে কিভাবে খেলনা নৌকো বানাতে হয়,শিখছে।
    ঘোড়ায় চড়ে আনতিগোনাস নিজে খুব যে সন্তুষ্ট হল তা নয়। একটু বুনো ধরনের ঘোড়া,তবে এইসব ঘোড়াকে এক সপ্তাহের মধ্যেই সে বাগে নিয়ে আসবে। এই বিষয়ে তার প্রসিদ্ধি রয়েছে। আন্দ্রোটিমাস জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার,আজকে ঘোড়াকে বাগে আনতে না পেরেও এরকম ঝিম মেরে রইলে কেন?"
    "ধুর, ঘোড়া বাদ দাও। ওদিক থেকে খবর এসেছে। ফিলিপ বলেছে ও পেল্লায় ফিরে আসলেই আমাকে হাজার তিনেক সেনা নিয়ে উত্তরে যেতে হবে। এই সেদিন ঠান্ডা কমল, আর এর মধ্যেই আবার বরফ ঠেঙিয়ে অত উঁচুতে উঠতে কারও ভালো লাগে?"
    "রাজার আদেশ,ভায়া। তুমি পাত্তা না দিয়ে পারবে?" আন্দ্রোটিমাস হেসে বলল।
    "হেসো না। এইসব কূটনীতির কাজ কি আর আমার দ্বারা হয়? ফিলিপ এতদিনেও সেটা বুঝল না। হয়তো একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব ওখানে গিয়েও। মাথা গরম করে ফেলব, কয়েকটা লাশ পড়বে। ভাবছি নিজেই দরখাস্ত করে বলব এইকাজে কোন রাজনীতি বোঝা লোককে পাঠাতে।"
    "আরে,আর কতদিন কেবল ঘোড়া নিয়ে পড়ে থাকবে? একটু রাজনীতি,কূটনীতি বুঝে নাও। বয়স তো কম হল না।"
    "দেখো ভায়া,আমি যোদ্ধা মানুষ। রাজা হওয়া আমার কম্ম না। হতে চাইও না। এই বেশ আছি।"
    " সে ভাই,তোমরা বুঝবে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার ব্যবসা করে দুটো পয়সা যোগাড় হলেই চলে যাবে। আর কয়েকটা বছর বেঁচে এই মা-মারা ছেলেটাকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়ে আবার নিজের দেশে ফিরে যাব। ব্যাস,আর কিছু আশা রাখি না জীবনের কাছ থেকে।"
    "হ্ম্ম,কিন্তু ধরো যদি তোমার ছেলে তোমার পেশায় না আসতে চায়,তাহলে?"
    "যে বয়সে বাচ্চারা নৌকোর ছবি আঁকতে পারেনা, সেই বয়সে আমার ছেলে কাঠের তক্তা চেঁছে দুয়েকটা খেলনা নৌকো বানিয়ে ফেলল,আর তুমি বলছ সে আমার পেশায় আসবে না? আমার ছেলে হয় নৌ ব্যবসায়ী হবে,নয়তো দেখো পৃথিবীর কোন নতুন প্রান্ত আবিষ্কার করবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা।" আন্দ্রোটিমাস গর্বিত ভাবেই বলল কথাগুলো।
    "মানে বলতে চাইছ, তোমার খোকা একদিন নিজের বানানো জাহাজ নিয়েই ফিলিপের পারস্য জয়ের স্বপ্ন সফল করবে হেলেসপন্ট পাড়ি দিয়ে?"
    "ঠাট্টা করছি কি না জানি না,ভায়া। তবে কেবল হেলেসপন্টের ওই ছোট্ট সাগর পাড়ি দেবে না আমি নিশ্চিত। ওর জন্য গোটা পৃথিবীকে ঘিরে রাখা মহাসমুদ্র অপেক্ষা করছে বলেই আমি মনে করি।"
    এই বার্তালাপের মধ্যেই হঠাৎ এক সৈন্য এসে খবর দিল যে ফিলিপের সেনাবাহিনী হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পেল্লায় প্রবেশ করবে। আনতিগোনাস এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল শহরের উদ্দেশ্যে।

    রাজপ্রাসাদ চত্বরেই নিজের ছোট্ট ঘরে আনতিগোনাস ঢুকেই নিজের সেনাধিনায়কের বর্ম পরে নিলো। ফিলিপ তার বাল্যবন্ধু হলেও দিনের শেষে একজন রাজা,আর রাজাকে স্বাগত জানানোর কিছু নিয়মকানুন আছে। সাধারণ একটা সাদা ক্ল্যামিস পরে রাজার সামনে যাওয়া রাজার অপমান। আর এইসব মান অপমান বিষয়ে ফিলিপ খুব কড়া। রাজপ্রাসাদের সবকিছু একদম নিয়মমাফিক হতে হবে,এটাই তাঁর অলিখিত আদেশ। এই আদেশের বাইরে বাল্যবন্ধু আনতিগোনাস বা প্রৌঢ় পারমেনিও কেউই যেতে পারে না। সম্পুর্ন প্রথামাফিক সৈন্য বাহিনীর শীর্ষনেতার পোষাক পরে রাজার সামনে হাজিরা দিতে হবে আনতিগোনাসকে। বর্ম পরে,জুতো বেঁধে একদম তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরোতেই প্রাসাদের চত্বরে একটা শোরগোল শুনে সে একটু থমকে গেল। এত সকাল সকাল কিসের গোলমাল? খোঁজ নিয়ে জানা গেল রানীর ঘর থেকে একটা মিশরীয় বিষধর কেউটে সাপ বেরিয়ে বাগানের কোন একটা ঝোপে ঢুকেছে।
    প্রহরীর দল কড়া আদেশ দিয়ে প্রাসাদের পরিচারক,পরিচারিকাদের বাগানে যাওয়া থেকে বিরত করতে ব্যস্ত। আনতিগোনাসকে দেখে যদিও কোন প্রহরী বাধা দিল না। তার সাহস সম্পর্কে সবাইই মোটামুটি অবগত। আর তার পদাধিকার বলেও সে চাইলে যে কোন প্রহরীর চাকরি বা প্রাণ নিতে পারে,সেই ভয়েই কেউ তাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না।
    বাগানের নরম ঘাসে পা দিয়েই একটা চেনা গন্ধ আনতিগোনাসের নাকে এলো। এই গন্ধের সাথে সে পরিচিত। ফিলিপের নতুন রানী অলিম্পিয়াসের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই গন্ধ সে বহুবার পেয়েছে। সাপের গায়েরও যে একটা গন্ধ থাকে সেটা মনে হয় প্রাসাদের সবাই এতদিনে জেনে গেছে। রানীর ঘরে একটা আস্ত সর্পোদ্যান তৈরি হয়ে গেছে এতদিনে। ময়াল, অজগর,কেউটে,এডার, আসপ, পৃথিবীর প্রায় সব জাতের বিষধর আর ভয়ানক সাপ রানীর পুষ্যি। প্রহরীরা কেউ তাই অলিম্পিয়াসের ঘরের ধার ঘেঁষে না। রানীর ঘরের দরজা ফিলিপের প্রবেশ করার মুহূর্ত ছাড়া সবসময়ই বন্ধ থাকে। রানীকে মোটামুটি সবাইই বিষাক্ত সাপের মতোই ভয় পায় ম্যাসেডন রাজপ্রাসাদের বাসিন্দারা। ব্যতিক্রম কেবল আনতিগোনাস।
    কেউ কিছু বোঝার আগেই আনতিগোনাস একটা জলপাই গাছের গোড়া থেকে বের করে আনলো একটা মিশরীয় কেউটে সাপ। খালি হাতে সাপের লেজটা ধরে নিজের শরীরের থেকে একটু দূরে রেখে কেউ বোঝার আগেই মার্বেলের চাতালে এক আছাড় মারতেই সাপের মাথা থেঁতলে সাদা মার্বেলে রক্তের দাগ ছড়িয়ে পড়ল।
    "রক্তের দাগটা জল দিয়ে মুছে দিস।" একজন পরিচারিকাকে আদেশ দিয়ে আনতিগোনাস এমনভাবে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল যে দেখে মনেই হলো না যে কিছুক্ষন আগেই সে মৃত্যুর দূতকে নিজের হাতে হত্যা করেছে। ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে আনতিগোনাস ফিলিপ ও তার বাহিনীকে স্বাগত জানাতে পেল্লার প্রাসাদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
    ****
  • Ankur Chakraborty | ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ১২:০৪369965
  • (....আগের পর্ব থেকে)

    ***
    সেনাবাহিনীর অভ্যর্থনা নিয়ে ফিলিপ যখন রাজপ্রাসাদে ঢুকলেন, তখনও রানী অলিম্পিয়াসকে কোথাও দেখতে পেলেন না। এমনিতেই রানী খুব একটা লোকচক্ষুর সামনে আসেন না। কিন্তু তাই বলে রাজা ফিলিপের একটা বেশ বড় সাফল্য,(এক বেলার মধ্যে একটা গোটা এলাকা দখল করে নেওয়া কম বড় ব্যাপার?) তা সত্ত্বেও রানী কি না নিজের ঘরের দরজায় খিল দিয়ে রেখেছেন!
    অলিম্পিয়াস ফিলিপের ছোট রানী। এর আগে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিবাহের ফলে ফিলিপের তিনজন রানী আছেন,কিন্তু তাদের সবার চেয়ে বংশ মর্যাদায় অলিম্পিয়াস অনেক উঁচুতে। বাকি রানীরা প্রায় সবাইই হয় স্থানীয় জমিদার বা সেনাধিনায়কের মেয়ে বা বোন। কেবল বিনা যুদ্ধে নিজের এলাকা হারিয়ে তারা ফিলিপের হাতে নিজেদের মেয়ে বা বোনকে তুলে দিয়েছে। ফিলিপ এমনিতেও গত কয়েক মাসে একবারও তাদের ঘরে গেছেন বলে মনে করতে পারেন না। কিন্তু অলিম্পিয়াস এপিরাসের রাজবংশের মেয়ে। এপিরাস ম্যাসেডনের পশ্চিমে সমুদ্রের ধারে অবস্থিত। এবং উত্তর গ্রীসের এই একটিই রাজ্য যেটা ম্যাসেডনের প্রায় সমকক্ষ। কিন্তু এপিরাসকে না ঘাঁটিয়ে যদি বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্যই তাকে দলে টানা যায়,তাহলে অসুবিধা নেই। এই ভেবেই ফিলিপ বছর দুয়েক আগে রাজকুমারী অলিম্পিয়াসকে বিয়ে করে আনেন। পাঁচ রানীর মধ্যে অলিম্পিয়াসই একমাত্র ফিলিপের প্রিয়। কিন্তু বিয়ের পরেই ফিলিপ জানতে পারেন তাঁর রানীর এই ভয়ানক সর্প-প্রেমের কথা। নিজেকে ট্রয়ের যুদ্ধের বিজয়ী বীর একিলিসের উত্তরসূরি মনে করা এপিরাস বংশের রাজকন্যা যে সারাদিন সাপ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সেটা ফিলিপ বিয়ের আগে জানতেন না। বিয়ের পর পেল্লায় বাসরের প্রথম রাতেই জানতে পারেন যে পৃথিবীর যেন সাপ নেই,যেটা অলিম্পিয়াসের পোষ্য নয়। এবং ফিলিপ এই একটি প্রাণীকেই অসম্ভব ভয় পান। ফিলিপ দেখেছিলেন অলিম্পিয়াসের গলা,হাত,পা ঘিরে থাকে সাপের অলঙ্কার। কোথায় বাসর রাতে রাজা তার রানীকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবেন,সেখানে তার আদরের স্পর্শের মাঝখানে বিষধর সাপ! গোটা বিছানা জুড়ে শুয়ে আছে একটা বিরাট ময়াল সাপ। সামনে রাখা সাপের ঝুড়িগুলি থেকে ক্রমাগত হিসহিস শব্দ আসছে। ফিলিপ মাটিতে পা ফেলতেও ভয় পেলেন, যদি আধো আলো আধ অন্ধকারে কোন সাপ হঠাৎ ছোবল দিয়ে দেয়? এমনিতেই ম্যাসেডন রাজবংশের বেশিরভাগ রাজাই অল্প বয়সে বা অপঘাতে মারা গেছেন। ফিলিপ সেই দলে নাম লেখাতে চান না। তাঁকে বাঁচতে হবে গ্রীসের ঐক্যসাধনের জন্য। পারস্য আক্রমনের ভয় নির্মূল করার জন্য।
    এহেন ফিলিপ আজ বুকে সাহস ভরে অলিম্পিয়াসের দরজায় কড়া নাড়লেন। গোটা উত্তর গ্রীস যার পদানত, সেই রাজা ফিলিপের আজ বুক কাঁপছে। এই বুঝি দরজা খুললেই তার সামনে কোন বিষধর সাপ ফোঁস করে উঠবে। প্রথমবার কড়া নেড়েও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিলিপ দ্বারস্থ হলেন লানিকির। লানিকিই রাজপ্রাসাদের একমাত্র মহিলা যাকে অলিম্পিয়াস তার ঘরে অবাধে প্রবেশ করতে অনুমতি দিয়েছেন। একেই একমাত্র প্রায় চোখ বুঁজে বিশ্বাস করেন রানী। তাই ফিলিপ লানিকিকে ডেকে বললেন রানীর ঘরের দরজা খুলে দিতে বলতে।
    এবং যাদুমন্ত্রের মত কাজ হল লানিকি একবার মাত্র দরজার কাছে গিয়ে রানীকে ডাক দেওয়ায়। দরজা খুলতেই ফিলিপ দেখলেন আলোছায়া ঘেরা বিরাট ঘরে অলিম্পিয়াস নিজেই দরজা খুলেছেন। এবং কোন এক মন্ত্রবলে যেন ঘরের সাপগুলো উধাও। বিয়ের পর থেকে এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রানীর ঘর কখনও দেখেননি ফিলিপ। ঘরের মধ্যে কর্পূর আর ধুনোর গন্ধ ভরপুর। কিন্তু তার মধ্যেও এমন আরও একটা অচেনা গন্ধ রয়েছে যেটা ঘরে ঢুকতেই ফিলিপের মাথায় ঝিম ধরিয়ে দিল। একটা মাদক, নেশার মত গন্ধ ঘর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ফিলিপ যেন এক মুহূর্তে সম্মোহিত মানুষের মত হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসলেন। ফিলিপ চোখে সব দেখছেন ঠিকই,কিন্তু মুখ থেকে যেন তার বাক্য হরে গেছে।
    প্রেমিকার মত এসে প্রেমিকের গলা জড়িয়ে না ধরে রীতিমত মহারানীর সামনে থাকা অনুগত ভৃত্যকে দেওয়া আদেশের মত অলিম্পিয়াস ফিলিপকে বললেন, "শোনো ফিলিপ, বিয়ের পর থেকে তোমার কাছে প্রায় বন্দিনীর মত রয়েছি। আমার কাছে এমনও খবর আছে যে আমার আগের রাণী ফিলিনা এখন গর্ভাবস্থায়। যদি তার মেয়ে জন্মায়,তাহলে তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু যদি সে পুত্রসন্তান প্রসব করে,তাহলে সে নিশ্চয়ই ম্যাসেডন রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। আর সেটা হলে না তোমার,না তোমার সেই ছেলের, কারও জীবনে একমুহূর্তের জন্যও শান্তি আসতে দেবো না আমি। শোনো রাজা, তোমার কাছে আমি দুটো জিনিস চাইবো।
    প্রথমতঃ, তোমায় কথা দিতে হবে যদি আমার ছেলে হয়,তবে সেইই তোমার পরে ম্যাসেডনের সিংহাসনে বসবে
    এবং
    আমার পরে যদি অন্য কোন মহিলাকে তুমি রানী হিসেবে গ্রহণ করো,তাহলে সেই মুহূর্তেই আমি তোমাকে ত্যাগ করে এপিরাসে ফিরে যাব। আর আমার ছেলে প্রয়োজনে তোমার থেকে তোমার রাজ্য ছিনিয়ে নিতে আসবে।
    অলিম্পিয়াসের কথাগুলো ফিলিপের কানে গেলেও সে যেন বাকশক্তিরহিত হয়ে পড়েছে। অলিম্পিয়াসের বড় বড় গভীর নীল চোখদুটো যেন মুহূর্তের মধ্যে সাপের চোখের মত হয়ে যাচ্ছে। ঘরের দেওয়াল গুলো যেন সরে যাচ্ছে দূরে,অনেক দূরে। পায়ের তলায় যেন মাটি নেই। ফিলিপের মাথা ভার হয়ে আসছে,কিন্তু শরীরটা যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। কোথায় অলিম্পিয়াস, এখন যেন ফিলিপের সামনে এক সর্প-মানবী দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রতি নিঃশ্বাসে বিষ আর সম্মোহন। ফিলিপ আড়ষ্ট হয়ে পড়ছেন। অলিম্পিয়াসের বাহুডোর যেন ফিলিপের গলায় নাগপাশের মত আঁকড়ে ধরছে এবং স্থান,কাল সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
    ফিলিপ অনুভব করতে পারছেন সবই,আবার কিছুই তার অনুভূতিতে দাগ কাটছে না। ফিলিপের মাথা যেন নরম বালিশে ডুবে যেতে লাগল। অলিম্পিয়াস যেন তার সমস্ত শরীরের ভার ও বিভঙ্গ নিয়ে তার ওপর ছায়া বিস্তার করছেন। কিছুক্ষন ধরে এই ঘোর চলতে চলতে ফিলিপ একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। তাঁর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। একটা অমোঘ চেতনা তার মনকে গ্রাস করছে। ঘুম, শান্তির ঘুম নেমে আসছে ফিলিপের চোখে। আশেপাশের সবকিছু যেন এখন শান্ত।
    ****

    (....ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ১৮:১২369966
  • ****
    অন্ধকারের অতল গভীর থেকে একটা হিসহিস শব্দ ভেসে আসছে। ফিলিপ যেন একটা খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কি উন্মুক্ত পারস্য? না কি থেসালির বাতাসময় প্রান্তর? জানা নেই। কেবল একটা ক্রমবর্ধমান শব্দ। হিস হিস হিস। মনে হল কেউ যেন ধীরে ধীরে তাঁর পা দুটো বাঁধনে বেঁধে ফেলছে। আবার সেই মাদক গন্ধ। নাকে ঝাঁঝা করছে এবার। ফিলিপ বুঝতে পারছেন না তিনি কোথায়!
    মাটি যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এটাই কি মৃত্যু? এভাবেই কি শেষ হয়ে যাচ্ছে জীবন? না কি...
    কেউ যেন তাকে একটা ধাক্কা দিলো। বেশ জোরে। এতক্ষণের ঘুমের আবেশ যেন এক মুহূর্তে কেটে গেল। ফিলিপ দেখলেন তাঁর হাতের উপর উঠে আসা একটা কালাজ সাপকে বিদ্যুতের মত ক্ষিপ্র গতিতে অলিম্পিয়াস এক হাতে ধরে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে। সাপটা কিছুক্ষনের মধ্যেই খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ল।
    ফিলিপ হকচকিয়ে উঠে বসলেন। যুদ্ধের প্রান্তরে এত গভীর ঘুম কোনদিনই আসেনা। আজ বহুদিন পর শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। সেখানেও দুঃস্বপ্ন, আর একটু হলেই মৃত্যু তার হাতের উপর এসে পড়েছিল।
    ফিলিপ নিজের শরীরটাকে বিছানায় একটু তুলেই পিছিয়ে গেলেন। এই সেই বিছানা, যেখানে গতকাল রাতে একটাও সাপ ছিল না? আর আজ সেখানে অন্তত দশটা সাপ এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে!!! আর,ওই তো সেই ময়াল সাপটা! এটাকে তো সবসময়েই অলিম্পিয়াস এর বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছেন ফিলিপ। কিন্তু কালকেও....না, আর ভাবতে পারছেন না ফিলিপ। তাঁর নিজের স্ত্রীই তাঁকে এভাবে মনস্তাত্বিক চাপে ফেলছেন, অথচ তিনি রাজা। চাইলেই এক আদেশে অলিম্পিয়াসকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করতে পারেন। কিন্তু অলিম্পিয়াস যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছোট রানী। কাল রাতে তাদের শারীরিক মিলনের দাগ এখনো মিলিয়ে যায়নি। সেই প্রাণাধিকা প্রিয় রানীকে কেমন করেই বা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন তিনি? আর এইমাত্র তো অলিম্পিয়াস নিজেই রাজার প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাঁর হাতে উঠে আসা সাপকে সরিয়ে দিয়ে। না না,এসব কি ভাবছেন ফিলিপ?
    আর বেশিক্ষন ভাবলে হয়তো পাগল হয়ে যাবেন। অবশেষে কোনোভাবে নিজের পোষাক একত্রিত করে ফিলিপ রানীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পিছনেই রানী দরজা বন্ধ করতে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ফিলিপ। তার মনে হচ্ছে এখনই প্রাণ বাঁচিয়ে এখন থেকে পালাই। কিন্তু রাজার সম্মান আছে। প্রাসাদের লোকজনের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করার কোন উপায় নেই। ফিলিপ জীবনে একবার যুদ্ধে গেছেন, এতবার মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখেছেন,তবুও আজকের মত ভয় তিনি পাননি। যুদ্ধ করতে গোয়ে তাঁর ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে চিরতরে,তবুও রক্তাক্ত চোখ নিয়েই লড়ে গেছেন ফিলিপ। ভয়কে তোয়াক্কা না করেই।
    অথচ আজ একজন সর্প-সম মানবীর হাতে তিনি নাজেহাল হচ্ছেন। মনে হচ্ছে যেন ট্রয় যুদ্ধের বিজয়ী বির অডিসিয়াস যাদুকরী সারসির যাদু বিদ্যায় বন্দী।
    এইসব ভাবতে ভাবতেই ফিলিপ কখন বাগানে এসে দাঁড়িয়েছেন,খেয়াল নেই। ফোয়ারার জলে মুখ ধুয়ে একটু চাঙ্গা বোধ করলেন।
    এবার আস্তে আস্তে সম্বিৎ ফিরতে লাগল। অলিম্পিয়াস কি তাকে এক ভয়ানক শর্তের জালে জড়িয়ে ফেলেছেন? সত্যিই কি আরেক রানী ফিলিনা অন্তঃস্বত্ত্বা? আর তার আর অলিম্পিয়াসের দুজনের পুত্র সন্তান হলেই বা, যে যোগ্য সেইই ফিলিপের পরে সিংহাসনে বসবে। এমনিতেই ফিলিপ নিজেই নিজের দাদাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ম্যাসেডন রাজবংশে এরকম কোন নিয়ম নেই যে কেবল রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজা হবে। যে যোগ্য,সেইই সিংহাসন পাবে। তাহলে অলিম্পিয়াস কেন এত নিজের কথা ভাবছেন? কেবল ঈর্ষা? কেবল স্বার্থ?
    না, এসব ভেবে ফিলিপ নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করতে চান না। যা হবে দেখা যাবে। এমনিতেও কবে কোন ম্যাসেডনিয়ান রাজা ভবিষ্যৎ বিষয়ে এত ভেবেছেন? আগে নিজের সেনাবাহিনী গুছিয়ে গ্রীসের সব শহরের সাথে আঁতাত গড়ে পারস্য জয় করতে পারলে তখন পরের কথা ভাবা যাবে। এখন নয়।
    ৶৶৶৶
  • avi | 57.11.7.214 | ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ১৮:২৬369967
  • পড়ে চলেছি।
  • pi | 57.29.254.25 | ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ১৮:২৯369968
  • আমি শনি রবিবার পড়ব বলে জমিয়ে রাখলাম। একসাথে পড়ব।
  • শঙ্খ | 52.110.200.110 | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১১:২৭369942
  • সো ফার সো গুড। দেখবেন দাদা যেন আরেকটা ম্যানফ্রেডি না হয়ে যায়। টাচ উড।
  • Ankur Chakraborty | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৪১369943
  • (....আগের পর্ব থেকে)

    ।। ২ ।।

    এথেন্স নগরী! গ্রীসের মুকুটে শিক্ষা,শিল্প,স্থাপত্য,রাজনীতির উজ্জ্বলতম পালক। গণতন্ত্রের প্রসূতিগৃহ। সভ্যতার সূতিকাগার।
    এথেন্স। পার্থেনন মন্দির তার চূড়ামনি। গোটা শহরের সর্বোচ্চ শিখরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী এথিনার গৃহ।
    উত্তর গ্রীসের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি আঁচ পোহাতে হচ্ছে এই শহরকেই। ইতিমধ্যেই কার্ডিয়া ম্যাসেডনের হস্তগত হয়েছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতোই এখন এথেন্সের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারছেন কার্ডিয়া হাতছাড়া হওয়ায় ম্যাসেডন অনেকটাই পারস্য সাম্রাজ্যের সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাছাড়া,এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে এথেন্স ফিলিপকে সেনা দিতে অস্বীকার করলে ফিলিপ তাঁর সেনাবাহিনী এথেন্সের ওপরে ছেড়ে দেবেন না। ফিলিপকে এখন শুধু সমীহ নয়, এথেন্সের রাজনৈতিক মহল রীতিমত ভয় পেতে শুরু করেছে।
    এথেন্সের কাছে এই মুহূর্তে একমাত্র একটাই আশ্বাস যে ম্যাসেডন পারস্য আক্রমন করতে চাইলেও পারবে না। কারন প্রথমতঃ, পারস্য সম্রাটের সেনাবাহিনীর বিশাল সংখ্যা, আর দ্বিতীয়তঃ ম্যাসেডনের নৌবহর প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে হেলেসপন্ট পাড়ি দিতে হলে যে জাহাজ দরকার,সেটা চাইতে এথেন্সের কাছেই দ্বারস্থ হতে হবে। আবার এটাও ঠিক যে ফিলিপ মনে করলে কেবল এক বেলায় কার্ডিয়া দখল করার মতোই এক রাতের মধ্যেই ইজিয়ান সাগরে ঘুরে বেড়ানো এথেনীয় টহলদার জাহাজগুলি কুক্ষিগত করতে পারেন। এখন ফিলিপ শান্ত ভাবে চুক্তির মাধ্যমে এই কাজে এথেন্সের অনুমতি চাইবেন, না কি উগ্র আক্রমনের পথ বেছে নেবেন,বলা মুশকিল!
    দৈবাৎ ফিলিপ এথেন্স আক্রমন করে দিলে এখন এথেন্সের সেই একশো,দেড়শো বছর আগের মত শক্তি নেই,যা দিয়ে ম্যারাথন আর সালামিসের যুদ্ধের মত লড়াই করে ম্যাসেডন সেনাবাহিনীর পথ আটকাতে পারবে। না তাদের মিলটিয়াদিস বা থেমিস্টোক্লিস এর মত সেনাপতি আছে, না আছে প্রয়োজনে কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত নেতৃবর্গ। আছে কেবল দুজন বক্তা। ইস্কিনেস আর ডেমোসথেনিস। ইতিমধ্যেই ম্যাসেডনের স্বপক্ষে বলে ইস্কিনেস যথেষ্ট বদনাম কুড়িয়েছে, আর ডেমোসথেনিস সম্পুর্ন উল্টো মেরুর বাসিন্দা। ম্যাসেডন আর ফিলিপের নাম শুনলেই তার মুখে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
    প্রথম জীবনে হঠাৎ হঠাৎ ভয়ানক বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ার প্রবণতা কাটিয়ে উঠে ডেমোসথেনিস আজ এথেন্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তা। এথেন্সের অস্ত্রের জোর কমে যাওয়ায় বাক্যের জোর বেড়েছে। যুদ্ধের সময় বক্তৃতা দেওয়া হয় না। এখন যুদ্ধ নেই,তাই কথা বলেই মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজ করে ডেমোসথেনিস।
    কিন্তু কেবল কথা বলে হয়তো ফিলিপের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা সম্ভব,সেনাবাহিনী গঠন না করলে ম্যাসেডনীয় সেনার সামনে হয়তো গ্রীসের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ভূলুণ্ঠিত হবে।
    তবে এটা বাস্তব যে ডেমোসথেনিস রাজনৈতিক কারণে প্রচুর বাক্য ব্যয় করলেও গৃহস্থ জীবনে সে ভয়ানক চুপচাপ। বক্তৃতা লেখা এবং কিছু গুপ্তচর পুষে অন্যান্য নগর রাষ্ট্রের খবর জোগাড় করতে সে সিদ্ধহস্ত।
    এরকমই একদিন ডেমোসথেনিস তার উঠোনে বসে একটা ছোট টেবিলে তার বক্তৃতার খসড়া তৈরি করছে, হঠাৎ দরজার আস্তে করে টোকা পড়ল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল ময়লা একটা ক্ল্যামিস পরা একটা বছর পঁচিশের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
    "বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভিতরে এসো। বাইরে এভাবে দাঁড়াতে দেখে লোকে সন্দেহ করতে পারে।" বলে ডেমোসথেনিস ছেলেটিকে ঘরে ডেকে আনলো।
    একটা কালো মাটির পাত্রে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে,মুখ মুছে ছেলেটি একটা চেয়ারে বসল। ডেমোসথেনিস তার বিপরীতে আরেকটা চেয়ারে বসে বলল, "কি খবর পেলে?"
    ছেলেটি বলল, "খবর যেটুকু পেয়েছি,সেটা যথেষ্ট চিন্তার।"
    "দার্শনিক কথাবার্তা বলতে তোমায় পয়সা দিইনা। সোজাসুজি বলো কি বিষয়?"
    "ম্যাসেডনের নৌবাহিনী তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।" একটু থেমে ডেমোসথেনিসের প্ৰতিক্রিয়া জানার জন্য উৎসুক হল গুপ্তচর ছেলেটি। কিন্তু তার ভাবলেশহীন মুখ দেখে সে আবার বলতে লাগল, "ফিলিপ ক্রিট থেকে আন্দ্রোটিমাস বলে একজনকে জোগাড় করেছে। সে গোপনে পেল্লা থেকে একটু দূরে স্ট্যাজিরায় একটা বিরাট পাথরের আড়ালে অন্তত গোটা ত্রিশেক জাহাজ নির্মাণ করছে। ফিলিপ তাকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। পাথরের আড়ালে কাজ চলায় কেউ সেভাবে জানতে পারছে না সেখানে কি ঘটছে। এমনিতেই এলাকাটা প্রায় জনমানবহীন। আমি অনেক কষ্টে খবর এনেছি।"
    ডেমোসথেনিসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে জিজ্ঞেস করল, "খবরটা কি ম্যাসেডনের সবাই জানে?"
    "না,কাজটা খুব গোপনে হচ্ছে। খনি থেকে ধরে আনা ক্রীতদাস দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। কাজটা আপাতত এতটাই গোপন যে প্রাসাদে কেবলমাত্র পারমেনিও এই খবর জানে। আনতিগোনাসও এটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।"
    "গুরুতর সমস্যা!"
    ছেলেটিকে কিছু টাকা দিয়ে ওকে বলল, "আরেকবার পেল্লায় যেতে হবে তোমায়। কি করতে হবে সেটা আমি বলে দিচ্ছি। কাজটা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে। না হলে তোমার এবং আমার দুজনেরই বিপদ"
    "কাজ মানে? এবার কি আপনি ফিলিপকে মারবার পরিকল্পনা করছেন না কি?"
    "তোমাকে যেটুকু করতে বলা হয়েছে,সেটুকু করলেই হবে। অতিরিক্ত ঔৎসুক্য ভালো না। কাজ করো,টাকা পাবে সেই অনুযায়ী। এখন এসো।" আগাম কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে ডেমোসথেনিস ছেলেটিকে বিদায় করল।
    ছেলেটি বেরিয়ে যেতেই ডেমোসথেনিস অব বক্তৃতা লিখতে বসে গেল।
    আপাতত এথেন্সের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে ডেমোসথেনিস এই ঝুঁকি নিচ্ছে। জানা নেই এর পর কি হবে। তবে ফিলিপকে রুখতে সে বদ্ধপরিকর।
    ****

    (...ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৪৩369944
  • @শঙ্খ

    ম্যানফ্রেডি বেশ ভালো লেগেছিল। গ্রাফিক নভেলও বানিয়েছিলাম সেই অনুযায়ী। 2010 সালে।
    তবে মেরি রেনো বেশি ভালো।
    ফিউনেরাল গেমস তো অসাধারন।
  • শঙ্খ | 52.110.200.110 | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:২৫369945
  • জিও! আছে নাকি সিবিআর বা সিবিজি? ☺☺
  • শঙ্খ | 52.110.200.110 | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৩৪369946
  • ম্যানফ্রেডি আমার আবার প্রথম দুটো পার্ট ঠিকঠাক লাগলেও লাস্ট পার্টটা খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা লেগেছিল। ভারতে আসার পর কি হল, সেটা আর গুছিয়ে বলা নেই। অন্যদিকে যেখানে একেবারে ভাটের জায়গায় প্রচুর ডায়ালগবাজি রেখেছে।
  • Ankur Chakraborty | ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ২২:৩৬369947
  • হ্যাঁ
    একদম ঠিক।
    তবে সিবিআর সিবিজি বুঝলুম না :/
  • Ankur Chakraborty | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:৫৯369948
  • ***
    প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ উত্তর এথেন্সে প্লেটোর আকাদেমি মেধাবৃত্তির চর্চা করে এসেছে। আজ প্লেটোর আকাদেমির এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। প্লেটোর আকাদেমির সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্রকে আজ আকাদেমির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্ণধার হিসেবে অভিষিক্ত করা হবে। ছাত্রের নাম এরিস্টটল।
    প্লেটো ইদানিং একটু অসুস্থ। তাই সংস্থার সব কার্যকলাপ একসাথে দেখা সম্ভবপর হচ্ছে না তাঁর পক্ষে। সেক্ষেত্রে এরিস্টটলের চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি আর কেউ নেই। যদিও এই নিয়ে অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ আছে। প্লেটোর ভাগ্নে স্পিউসিপাস এই নিয়ে কিছুদিন আগওই প্লেটোর কাছে অভিযোগ জানান। তাঁর কথা অনুযায়ী, তাঁর থেকে বয়সে যথেষ্ট ছোট হওয়া সত্ত্বেও এরিস্টটলের হাতে কেন দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে? তাছাড়া এরিস্টটল এথেনীয় নন,ম্যাসেডনিয়ার মানুষ। যথারীতি, বিজ্ঞ দার্শনিক প্লেটো এই বিষয়ে সম্পুর্ন চুপ থাকেন এবং আজ দায়িত্ব হস্তান্তরের দিন সমাগত। এবং তিনি এই কর্নধারের দায়িত্ব কোনমতেই এরিস্টটল ব্যতীত আর কাউকে দিতে রাজী নন। স্পিউসিপাস যাইই বলুন না কেন।
    আকাদেমির চত্বর আজ উৎসবের আমেজ নিয়ে সেজেছে। অলিভ পাতার মুকুট দিয়ে এরিস্টটলের বরণের আয়োজন তুঙ্গে। একে একে আকাদেমির ছাত্ররা এসে পৌঁছচ্ছে। দুজন ছাত্রীও এখানে বর্তমান। এক্সিওথিয়া ও ল্যাক্সেনিয়া। আজ কার্যভার গ্রহণ করে এরিস্টটল এক সপ্তাহের জন্য ম্যাসেডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন।
    হঠাৎ ছাত্রাবাসে এরিস্টটলের ঘরের দরজায় ধাক্কা! এরিস্টটল নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন তার বক্তৃতার জন্য। আচমকা এরকম দরজা ধাক্কানোর শব্দে তাঁর মনোযোগ ভঙ্গ হল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই তিনি দরজা খুললেন। দরজা খুলে দেখলেন সামনে সেই ডেমোসথেনিসের বাড়ির গুপ্তচর ছেলেটি দাঁড়িয়ে।
    "এ কি? ইউডেমাস,তুমি এখানে? কি ব্যাপার?" আশ্চর্য হয়ে এরিস্টটল প্রশ্ন করলেন।
    "না, শুনলাম যে আপনি না কি ম্যাসেডন যাচ্ছেন দিন কয়েকের জন্য। আমিও আজকেই ওই পথে যাচ্ছিলাম। গাড়ির ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। তাই ভাবলাম একবার আপনাকে জিজ্ঞেস করে যাই। গেলে আপনার সাথেই চলে যেতাম।"
    "ঠিক আছে। ঘন্টাখানেক পরে এসো। এখন না। আপাতত ব্যস্ত আছি। দুপুরে আকাদেমির বাইরে এসে একবার খোঁজ করে যেও।" বিরক্ত এরিস্টটল কোনভাবে ইউডেমাসকে ফিরিয়ে দিলেন।
    ইউডেমাসের জন্ম ম্যাসেডনে হলেও সে বড় হয়েছে এথেন্সেই। দুই দিকেই তার অবাধ প্রবেশ থাকায় গুপ্তচর বৃত্তিতে তার জুড়ি মেলা ভার। দুই অঞ্চলের উপভাষায় কথা বলে সে সিদ্ধহস্ত। ফলে এথেনীয়দের কাছে সে এথেনীয় সেজে যায়,আবার ম্যাসেডনীয়দের কাছে ম্যাসেডনীয়। তবে,যারা এর আসল পরিচয় জানে, যেমন ডেমোসথেনিস বা এরিস্টটল, একে কাজ ছাড়া খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দেয়না। তবে দরকার পড়লে তার কাছ থেকে নিশ্চিত খবর পাওয়া যায় বলেই একে টাকাপয়সা দিয়ে এথেন্সের রাজনীতির লোকজন নানান কাজে নিয়োগ করে।
    আকাদেমির বাইরে বেরিয়েও কিন্তু ইউডেমাস ফেরত গেল না। বরং খচ্চরে টানা গাড়ির খচ্চরগুলোকে ঘাসপাতা খেতে দিয়ে এখন থেকেই এরিস্টটলের অপেক্ষায় বসে রইল।
    ****
    এরিস্টটলের সম্মান জ্ঞাপনের পর নিজস্ব জিনিসপত্তর গুছিয়ে আসতে একটু দেরিই হয়ে গেল। সূর্য এখন মধ্যগগন ছাড়িয়ে গেছে। শরতের পড়ন্ত বেলায় ইউডেমাস তার গাড়িতে এরিস্টটলকে তুলে নিলো আর গাড়ি বেশ হালকা চালেই চলতে লাগল এথেন্সের পথ পেরিয়ে গ্রামের দিকে। বিকেলের মধ্যে ইলিউসিস এর কাছে পৌঁছতেই এরিস্টটল দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে একজন বেশ রোগা, শিরিঙেপনা একজন অপেক্ষা করছে। এই চেহারা দেখে এরিস্টটলের ভুল হওয়ার কথাই নয়। ডেমাডেস। অসম্ভব বুদ্ধিমান একটি লোক,অসম্ভব ভালো বক্তৃতা লেখার ও বলার ক্ষমতা ট্যাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র দুই নৌকোয় পা রেখে চলার প্রবণতার জন্য তার দারিদ্র্য আজও ঘোচেনি। বয়সে এরিস্টটলের থেকে ছোট হলেও চেহারায় দারিদ্র্যের ছাপ দেখে তাকে বেশ বয়স্ক বলে মনে হয়।
    "কি হে, নিকোম্যাকাসের পুত্র, কই চললে?" ডেমাডেস দেখা হলেই এভাবে এরিস্টটলকে সম্বোধন করে, যদিও এরিস্টটলের নিজের নামে সেভাবে তাঁর পিতৃপরিচয় দিতে নারাজ। এভাবে ডাকলে তিনি একটু বিরক্তই হন।
    "দেশের দিকে যাচ্ছি। তোমার কি খবর?"
    গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে উঠে বসেই ডেমাডেস উত্তর দিল, "আর বোলো না! গতমাসেই তো একটু এবাড়ি-ওবাড়ির হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে গিয়ে এথেন্স সরকার আমার নতুন চাকরিটা খেল। তার ওপর এখন শহর থেকে নির্বাসিত। কিছুদিন ইলিউসিসে কাটিয়ে লাভ হলনা দেখে ভাবছিলাম যদি ফিলিপের কাছে হত্যে দেওয়া যায়। শুনলাম,তার নাকি এখন বেশ পসার। একটু যদি ওখানে কাজ করে কিছু টাকা কমানো যায়,তাহলে অন্তত বউ বাচ্চা নিয়ে স্থায়ী সংসার পাততে পারি।"
    "শুভেচ্ছা রইল" এরিস্টটল খুব নিস্পৃহভাবে বললেন।
    "তুমি বলো,তোমার কি খবর? তুমিও কি একই পথের পথিক?"
    "পথটা একই। তবে আক্ষরিক অর্থে।" বলেই এরিস্টটল বাইরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করলেন।
    রাত হতে হতে ডেমাডেস এর গাড়ি এসে দাড়ালো থিবস পেরিয়ে ডেলফিতে। সেই ডেলফি, পবিত্র ডেলফি। এপোলোর মন্দিরের জন্য বিখ্যাত হওয়া পাহাড়ি ছোট্ট নগরী। ধর্মের আড়ালে রাজনীতি করার মোক্ষম কেন্দ্র এই নগরী। এখানে শহুরে মানুষ কম। মন্দিরবাসী পুরোহিত আর ডেলফিক লীগের দন্ডমুন্ডের কর্তারাই বেশি থাকেন। ডেমাডেস আর ইউডেমাস এর সাথে থাকাটা সমীচীন হবে না বুঝে এরিস্টটল ঠিক করলেন,রাতে যখন এই দুজন সরাইখানায় আশ্রয় নেবে,তখনই নিজের পথ খুঁজে নিতে হবে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে যদি এর চেয়ে ইউবোইয়া দ্বীপের পথে যেতেন,তাহলে অন্তত নৌকো বা জাহাজ ধরে সহজে এবং অনেক আগেই নিজের গ্রাম স্ট্যাজিরায় পৌঁছে যেতেন। যাক,ফেরার পথে সেটাই করবেন। আজ রাতের ঘুমের বারোটা বেজেছে ঠিকই। কিন্তু এই দুই ধূর্ত শেয়ালের সঙ্গে থাকার চাইতে এক রাত্রের ঘুম নষ্ট করাটাও শ্রেয়।
    সরাইখানায় গাড়ি লাগিয়ে খচ্চর দুটোর খাবার আনতে ইউডেমাস ভিতরে গেল। এবং ডেমাডেস ডেলফি মন্দিরের এক কর্তাব্যক্তির সাথে গল্পে জমে গেল এরিস্টটল অন্ধকারের মধ্যেই পিঠটান দিলেন। পিঠে একটা মাঝারি মাপের পুটুলী নিয়ে হাঁটা লাগালেন কোপাই গ্রামের উদ্দেশ্যে। সেখানে একটা ছোট জেলেদের গ্রামের পাশে একটা বন্দর আছে। ছোটছোট জাহাজ ম্যাসেডন যাওয়ার পথে ওখানে দাঁড়ায়।কপাল ভালো হলে কাল ওখান থেকেই জাহাজ ধরে নেওয়া যাবে।
    আপাতত এই দুটি রতনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে।
    ***
    "যাহ বাবা,লোকটা এরকম করে হাওয়ায় উবে গেল!" আশ্চর্য ইউডেমাস ডেমাডেসকে বলল।
    "ছাড়, বাদ দাও। এখন সকাল হয়ে গেছে। ও নিজের পথে ঠিক পৌঁছে যাবে। তুমি বরং গাড়ির জোর বাড়াও। কাল সকালের আগে পেল্লায় পৌঁছতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না যেভাবে চালাচ্ছ।"
    "হ্যাঁ, হ্যাঁ, চালাচ্ছি। তুমি বকবক না করে চুপ করে বসো!"
    "চুপ থাকলে চলবে না ভাই। বকবক করেই আমাকে সংসারের পেট চালাতে হয়,বুঝলে?"
    এইসব কথা বলতে বলতে ইউডেমাসের খচ্চরে টানা গাড়ি কখন ফারসালার গঞ্জ পেরিয়ে গেল।
    ওদিকে এরিস্টটল দুপুর অবধি অপেক্ষা করে থেকে অবশেষে একটা ছোট জাহাজ পেলেন। বিষয়টা এখন এমন হয়ে দাঁড়ালো, ইউডেমাস আর এরিস্টটল,দুজনের গন্তব্যই এক, স্ট্যাজিরা। একজন স্থলপথে,আরেকজন জলপথে যাত্রা করেছে। এ যেন দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলতে লাগলো কে আগে স্ট্যাজিরায় পৌঁছবে,তা নিয়ে। কিন্তু এরিস্টটল এই প্রতিযোগিতায় মানসিকভাবে সামিল নন। তিনি যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে ছুটি কাটাতে এবং কিছু জমিজমা সংক্রান্ত কাজকর্ম সেরে ফেলতে। ওদিকে ইউডেমাসের উদ্দেশ্য ডেমোসথেনিসের গোপন কার্য সম্পাদন।
    রাত হতে হতে ডেমাডেস আর ইউডেমাসের গাড়ি এসে পৌঁছল পেল্লার সম্মুখে। এখন থেকে রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা চলে গেছে উত্তরে পেল্লার দিকে,আরেকটা গেছে দক্ষিণ পূর্বে স্ট্যাজিরায়। ডেমাডেসকে এখানেই নামিয়ে দিয়ে ইউডেমাস এগিয়ে চলল স্ট্যাজিরার পথে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে পৌঁছনো গেল স্ট্যাজিরায়। যদিও যে বন্দরে বড় পাথরের আড়ালে ম্যাসেডনীয় যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের কাজ চলছে,সেটা এখন থেকে আরেকটু দূরে। কিন্তু এখন থেকেই ইউডেমাস কে তার কাজ সেরে এথেন্স ফিরে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।
    স্থানীয় একটা অশ্ব-শালা থেকে একটা ঘোড়া ভাড়া করে ইউডেমাস চলে এলো এক স্থানীয় জ্বালানী ব্যবসায়ীর কাছে।
    রাতের বেলা ব্যবসায়ী ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই দরজায় বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ার পরে সে আধো-ঘুমে এসে দরজা খুলল।
    "আরে ভাই,কি চাই এত রাত্রে?"
    "বলছিলাম, বাড়িতে জ্বালানি নেই। একটু কর্পূর আর কাঠ যদি পেতাম।" ইউডেমাস তার আসল প্রয়োজনীয় জিনিসের নামগুলো এড়িয়ে গেল।
    "দাঁড়ান,দিচ্ছি!" বলে ব্যবসায়ী তার গুদাম ঘরের দিকে পা বাড়াতেই,ইউডেমাস দরজার কাছ থেকে সরে পড়ল। তার আসল উদ্দেশ্য জ্বালানী ব্যবসায়ীর বাড়ির আস্তাবলের পিছনে রাখা কয়েকটা ন্যাপথা আর বিটুমেন এর পিপে নিয়ে সরে পড়া। ব্যবসায়ীর চোখের আড়ালে সে তার কাজ ঠিক সেরে ফেলল এবং দুটো ছোট আকারের পিপে ঘোড়ার পিঠে তুলে চম্পট দিল।
    যতক্ষণে ব্যবসায়ী কর্পূর আর কাঠ নিয়ে দরজার কাছে এসে দাড়ালো,ততক্ষনে দিগন্তে কেবলমাত্র ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে এলো। ইউডেমাসের সামান্যতম চিহ্ন দেখা গেল না।
    ****
    বড় পাথরের সামনে এসে ঘোড়া একটা গাছের সাথে বাঁধল ইউডেমাস। খুব সন্তর্পনে আর সাবধানে পিপে দুটো নামালো মাটিতে। ডিরে কয়েকটা আলো জ্বলছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ওগুলো আসলে ম্যাসেডনীয় তাঁবু। তার পিছনেই অন্ধকারে দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে অন্তত গোটা দশেক ট্রাইরিম। তিন-তলা যুদ্ধ জাহাজ। যার সামনে শত্রুর জাহাজকে গুঁড়িয়ে এবং ডুবিয়ে দেয়ার মত পিতলের অংশ লাগানো। অন্ধকারে কেবল তাঁবুর ভিতরে জ্বলা মশালগুলো ছাড়া আর সেরকম কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে শুনে বোঝা যাচ্ছে যে সেনাবাহিনীর লোকজন আপাতত মজা ঠাট্টা আর মদ্যপানে ব্যস্ত। এরকম এলাকায় কোন বিপদ আসতে পারে,এটা এদের ধারণার বাইরে। জাহাজগুলিতেও বিকেলের পর থেকে কোন কাজ হচ্ছে না। করাতের আওয়াজ বা পেরেক ঠোকার শব্দ,সবই এখন স্তব্ধ। আপাতত এই চুপচাপ হয়ে থাকা বন্দরের শান্তি কিছুক্ষনের মধ্যেই বিঘ্নিত হতে চলেছে। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কোন আঁচ মরতে পারছে না।
    ইউডেমাস তার কাঁধে দুটো দুটো করে পিপে ঝুলিয়ে নিলো। খুব ভারী না হওয়ায় পিপেগুলো বইতে তার কোন কষ্ট হচ্ছে না। জাহাজগুলো যেদিকে আছে,সেই অবধি পৌঁছতে পারলেই হবে। আপাতত সেখানে ভাঁটা চলছে,তাই জল বড়জোর বুক অবধি। কিন্তু যাওয়ার আগে পথ দেখবার জন্য একটা আলো চাই।
    সামনের গাছে বেঁধে রাখা মশালটা হাতে তুলে নিলো ইউডেমাস। সমুদ্রের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তত জলে নামার শব্দ কারও কানে গেল না।
    এদিকে তাঁবুর মধ্যে থেকে বেশ লম্বাচওড়া একজন বেরিয়ে এসেছে। গাছে বাঁধা মশাল হাওয়ায় নিভে গেছে ভেবে দেখতে এসে সে দেখতে পেল যে গাছে বেঁধে রাখা মশাল উধাও।
    "কে আছো??? তাড়াতাড়ি একটা মশাল নিয়ে এসো!" লোকটা চেঁচিয়ে তাঁবু উদ্দেশ্য করে ডাক পাড়ল। কয়েক মুহূর্ত পরে এক সৈন্য একটা মশাল নিয়ে আসতেই দেখা গেল দূরে জাহাজের গা বেয়ে একটা ছোট্ট মশাল ওপর দিকে উঠছে।
    সৈন্যের এনে দেওয়া নতুন মশালের আলোয় বোঝা গেল লোকটি আসলে আন্দ্রোটিমাস। জাহাজগুলির প্রকৃত নির্মাতা সেই ক্রেটান নৌ-ব্যবসায়ী।
    "জাহাজে কি আজ কারও পাহারা দেওয়ার কথা আছে?" আন্দ্রোটিমাস সৈনিককে জিজ্ঞেস করল।
    "না তো!"
    আন্দ্রোটিমাস আর কিছু শুনবার অপেক্ষা করলো না। আগত বিপদের আশঙ্কায় সমুদ্রের দিকে দৌড় লাগালো। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে,ঢেউ ভেঙে কোনভাবে একটা মালটা দড়ি ধরে নিজের ভিজে যাওয়া দেহটাকে আন্দ্রোটিমাস তুলতে লাগল জাহাজের ডেকে। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। দিকের কাছাকাছি পৌঁছতেই নাকে আসতে লাগল ন্যাপথা আর বিটুমেনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। ইউডেমাস তার পিপে গুলো থেকে এই দাহ্য বস্তুগুলি জাহাজ থেকে কিছুটা সমুদ্রের জলে ঢেলে বাকিটা ঢালতে আরম্ভ করে দিয়েছে জাহাজের ডেকে।
    তাঁবুর কাছে থাকা সৈনিকের বার্তা পেয়ে এদিকে অন্যান্য সৈনিকরাও ঢেউ ভেঙে জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ইউডেমাস যেন কোনকিছুর তোয়াক্কা করছে না। ডেমোসথেনিসের কাজ সম্পুর্ন করতে পারলে মোটা টাকা হাতে আসবে। সে এথেন্স বা গ্রীসের কোন প্রত্যন্ত প্রান্তে পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যদি ম্যাসেডনীয় সেনা জাহাজে উঠে আসতে সক্ষম হয়? যদি তাকে ধরে ফেলে? তাহলে বাঁচার আশা নেই। তার বছর তিনেকের ছেলে মুহূর্তে অনাথ হবে। নাহ,আর ভাবার অবকাশ নেই। ইউডেমাস তার পিপেতে থাকা বাকি দাহ্য তরল ছুড়ে জলে ফেলে দিল।
    ইতিমধ্যে আন্দ্রোটিমাস জাহাজে উঠে এসেছে। ইউডেমাস কে দেখতে পেয়ে সে তেড়ে গেল তাকে আটকাতে। কিন্তু,দুজনের হাতেই জ্বলন্ত মশাল। কোনোরকম ভুলচুক করে ফেললেই এই মশালের আগুনের একটা ফুলকি লেগে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। তাকে এখন সাবধানে এগোতে হবে। একটা ভুল পদক্ষেপ সব শেষ করে দেবে। কিন্তু জাহাজ বেয়ে উঠে আসছে ম্যাসেডনের সৈনিকদল। নীচে কয়েকজন এখনো সমুদ্রে। সমুদ্রের জলেও বিটুমেন ভাসছে। এক হাতে মশাল ধরে চিৎকার করে আন্দ্রোটিমাস তাদের বলতে লাগল "সমুদ্র থেকে দূরে যাও!! দূরে যাও!!" কিন্তু ঢেউয়ের তীব্র আওয়াজে নীচে সাঁতরে আসা সৌনিকরা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। এদিকে জোয়ারের জল বাড়ছে।
    আন্দ্রোটিমাস পিছনে তাকিয়ে ইউডেমাসকে দেখতে পেল না। সে কোথায়? জাহাজের পিছন দিক দিয়ে কি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে? কিন্তু তার হাতেও তো মশাল। সব ধ্বংস হলে তার মৃত্যুও অবধারিত।
    মশালের আবছা আলো অন্ধকারে একবার মাত্র চোখে পড়ল জাহাজের ঝুলন্ত দড়িগুলো ধরে ধরে ইউডেমাস তার হালকা শরীরটাকে প্রায় হাওয়ায় ভাসিয়ে একের পর এক জাহাজ পেরিয়ে আন্দ্রোটিমাসের নাগালোর বাইরে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আর ইউডেমাসের হাতের মশালের আলো দৃষ্টিগোচর হলো না।
    কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল বড় পাথরের কোনাকুনি কোনভাবে মশালটাকে এক হাতে মাথার উপরে তুলে ইউডেমাস সমুদ্রের তটে পৌঁছে গেল।
    অন্ধকারের মধ্যে দোদুল্যমান অগ্নিশিখা দেখেই মনে হল মশালের আলো যেন আন্দ্রোটিমাসের প্রতি বিদ্রুপ করছে। হঠাৎ বলা নেই,কওয়া নেই,ইউডেমাসের হাতের মশাল হাওয়ায় নিক্ষিপ্ত হল।
    "সব শেষ!" কেবল এটুকুই আন্দ্রোটিমাসের মুখ থেকে বেরোলো। মশালটা সমুদ্রের জলে মিশে থাকা ন্যাপথা আর বিটুমেনের সংস্পর্শে আসতেই ম্যাসেডনীয় সৈনিকদের চারিপাশে আগুনের বলয় তাদের ঘিরে ফেলল। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে সেই আগুন পৌঁছে গেল জাহাজের সারিতে। আন্দ্রোটিমাস বা ম্যাসেডনীয় সৈন্যদল কিছু বুঝবার আগেই মৃত্যুর করাল গ্রাস ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের রূপে ধুয়ে মুছে দিয়ে গেল আন্দ্রোটিমাস,ম্যাসেডনীয় সেনার একাংশ এবং ম্যাসেডনিয়ার নির্মিয়মান জাহাজের সারিকে। সেই সাথে ফিলিপের পারস্য অভিযানের স্বপ্নও!
    দূরে, অন্ধকারে একটা ছোট্ট জেলেদের মাছ ধরার জাহাজের জানলায় বসে দিগন্তরেখায় একটা বড়সড় আগুনের লীলা প্রত্যক্ষ করলেন স্ট্যাজিরার পথে থাকা এরিস্টটল।
    ****
  • শঙ্খ | 126.206.220.155 | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ২২:১৭369949
  • সেকি! সারা বিশ্বে ডিজিটাল গ্রাফিক নভেল পড়বার দুটিই তো ফরম্যাট, cbr ইয়ানে কি comic book rar আর cbz বোলে তো comic book zip. ব্যাপারটা আর কিছুই না, ইমেজগুলোকে কমপ্রেস করে একটা ফাইলে রাখে। আর সেটা পড়ার জন্য আলাদা সফটওয়্যার ও পাওয়া যায়।
    তো আপনি যেহেতু বলছেন গ্রাফিক নভেল বানিয়েছেন, তাই জানতে চাইছিলুম ডিজিটাল কপি আছে নাকি।
  • Ankur Chakraborty | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৮:৪১369951
  • (....আগের পর্ব থেকে)
    ****
    "বল!! কে এসেছিল তোর কাছ থেকে জ্বালানি নিতে???" আনতিগোনাস সরাসরি জ্বালানি বিক্রেতার ক্ল্যামিস গলা অবধি চেপে জিজ্ঞেস করল। ব্যবসায়ীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। সে যতই বনহাতে চাইছে যে সে ইউডেমাসকে জ্বালানি বিক্রি করেনি, আনতিগোনাস সেসব বিশ্বাস করার পাত্র নয়।
    অনেকক্ষণ ধরে ঘোড়ার পিঠে বসে ফিলিপ এইসব জিজ্ঞাসাবাদ লক্ষ্য করছিলেন। অবশেষে নেমে এসে আনতিগোনাসকে বিরত করে বললেন, "কাল রাতে তোমার কাছে জ্বালানি চাইতে যে এসেছিল,যার চেহারার বিবরণ দিতে পারবে?"
    "বিশ্বাস করুন,মহারাজ, আমি ঘুমের চোখে অন্ধকারে খুব স্পষ্ট কিছু দেখিনি।" কাতর কন্ঠে ব্যবসায়ী বলতে লাগল।
    ফিলিপ দেখলেন,এভাবে কোন সদুত্তর পাওয়া যাবে না। পারমেনিও কে হাতের ইশারায় ডাকলেন তিনি।
    "পারমেনিও, একে বন্দী করে পেল্লায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার দায়িত্ব তোমার!"
    আনতিগোনাসের আগ্রাসী জিজ্ঞাসাবাদের থেকেও ম্যাসেডনের বন্দীরা ভয় পায় পারমেনিওর ঠান্ডা মাথায় করার যাওয়া জিজ্ঞাসাবাদকে। পারমেনিও গায়ে হাত তোলেন না। গলা চড়ান না। কিন্তু তাতেই যা কাজ হওয়ার হয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে আসা ব্যক্তির ঘটিবাটি চাঁটি হবে ওই সময়ের মধ্যেই।

    এতক্ষন এইসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে না চাইলেও জ্বালানি ব্যবসায়ী এবার বুঝল বিপদ তার মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে,নিজের পরিবার এবং ব্যবসাকে বাঁচাতে এবার সে অসহায়ভাবে বলল, "মহারাজ,দয়া করুন!!! আমি যেটুকু জানি,সব বলছি।"
    সব জানবার পরে ফিলিপ সেনাবাহিনী কে আদেশ দিলেন, "যতক্ষন না এই অগ্নিকান্ডে এর কোন যোগাযোগ আছে প্রমাণিত হচ্ছে,ততক্ষন এর বাড়ির সামনে সেনার প্রহরা থাকবে। যদি নির্দোষ প্রমাণিত হও,তাহলে তোমার ব্যবসা যেমন চলার চলবে। আর যদি তোমার যোগসাজশ প্রমাণিত হয়, তার জন্য চরম শাস্তি অপেক্ষা করবে।"
    সেনাবাহিনীর পাঁচজনকে এখানে পাহারায় রেখে ফিলিপ,পারমেনিও,আনতিগোনাস বেরিয়ে পড়লেন ইউডেমাসের খোঁজে।

    এদিকে ইউডেমাস পেল্লা থেকে একটু দূরে এম্ফিপলিস নগরে এসে পৌঁছেছে। এখানেই তার পরিবার থাকে। একটা টালির চালা দেওয়া ঘরে তার বৃদ্ধ বাবা,বছর তিনেকের ছেলে (তার নামও ইউডেমাস) আর স্ত্রী।
    দুপুরের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে সে তার স্ত্রীকে ডেকে বলল, "একটা বড় কাজ সফল হয়েছে। আমি এই কাজের জন্য বেশ ভালো টাকা পাব। ডেমোসথেনিস সেই রকমই কথা দিয়েছে। আমাকে আজকে রাতেই এথেন্স এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কিন্তু এই কাজের ফলে তোমাদের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। রাজার বাহিনী শুনছি ইতিমধ্যেই আমায় খুঁজছে!"
    "কি করে এসেছ, তুমি? এখন রাজার সেনা যদি এখানে হানা দেয়,তাহলে আমরা কোথায় যাব?" ইউডেমাসের স্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলল।
    "ভয় নেই,তোমাদের একটা থাকবার জায়গার বন্দোবস্ত আমি করে এসেছি। কিছুক্ষন পরে খচ্চরের পিঠে করে তোমাদের ওই পথে পাঠিয়ে দিয়েই আমি রওনা দেব। এথেন্স পৌঁছে টাকাপয়সা পেয়ে গেলেই চিঠি দিয়ে তোমাদের এথেন্সে ডেকে নেব। আপাতত কয়েকটা দিন সাবধানে চলাই ভালো!"
    এইসব বলে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে ইউডেমাস ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল তাদের পালানোর ব্যবস্থা করতে।

    ইতিমধ্যেই ইউডেমাসের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর করে দিয়েছেন ফিলিপ। যেখানেই শারীরিক বর্ননা মিলিয়ে ইউডেমাসকে পাওয়া যাবে,সেখানেই তাকে হত্যার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তলোয়ার, বর্শা,পাথর,আগুন যেকোন ভাবে ইউডেমাসকে মেরে ফেলতেই হবে। যদিও ফিলিপের হাতে পড়লে তিনি ইউডেমাসকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবেন। তার কৃতকর্মের জন্য এই একটি শাস্তিই উপযুক্ত। কিন্তু হত্যার আগে তিনি জেনে নেবেন কার নির্দেশে সে ম্যাসেডনিয়ার নৌবাহিনীকে একা হাতে ধ্বংস করল।
    তৎক্ষনাৎ ফিলিপ সিদ্ধান্ত বদলালেন। আনতিগোনাসকে বললেন, "এখুনি খবর পাঠাও যদি ঐ লোকটাকে কেউ খুঁজে পায়,সাথে সাথে না মেরে আমার হাতে ওকে তুলে দিক। ওর একার পক্ষে এই কাজ সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। পিছনে কারও হাত নিশ্চিতরূপে আছে। সেই হাত কার,সেটা আগে জানতে হবে। ঝটপট দৌড় লাগাও!"
    আনতিগোনাস বিদায় নিতেই পারমেনিও বলল, "শোনো ফিলিপ,সামান্য রসদ নিয়ে এতবড় কাজ করেছে যখন,আমার মনে হয় না যে তুমি যেটা ভাবছ সেটা ঠিক।"
    "আমি কি ভাবছি,কি করে জানলে?"
    "জানি। তুমি ভাবছ পারস্যের শাহেনশাহ এই নৌবহর নির্মাণের খবর জেনে ফেলেছে,আর তাই লোক লাগিয়েছে। তাই না?"
    "ঠিক!"
    "না,ঠিক নয়। পারস্যরাজের অনেক টাকা। সে চাইলে সোজাসুজি টাকা দিয়ে সেনাবাহিনীর একাংশ কিনে নিতে পারে। তা দিয়েই আক্রমন করানো সহজ। এমনিতেও ভিতরের খবর এই যে শাহেনশাহ আর্তাজার্ক্সেস অন্তরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বে জর্জরিত। আপাতত সে নিজের ঘর সামলাচ্ছে। ম্যাসেডন তার ধর্তব্যের বাইরে। এটা করিয়ে থাকলে হয় খুব কাছের কেউ করিয়েছে সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে, নয়তো গ্রীসেই আমাদের বিরোধী থ্রেসীয় বা এথেনীয়রা,আর নয়তো এটা পাগলের কাজ।"
    "তোমার কথাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না,খুড়ো। তবে যেইই এই কাজ করুক না কেন,একে ধরতে পারলেই সব খবর বেরিয়ে আসবে। আর এই কাজে তোমার থেকে ভালো কোন লোক নেই!"
    ঘোড়া ছুটিয়ে যতক্ষনে ম্যাসেডনীয় সেনাবাহিনী বেরিয়ে চলে গেল, তারপরেই সেই পথেই দুটো খচ্চরের পিঠের একটিতে ইউডেমাসের স্ত্রী আর পুত্র আর আরেকটিতে তার বৃদ্ধ বাবা পেরিয়ে গেল। ফিলিপের সেনার সামনে ফয়ে গেলেও অসহায় কয়েকটা মানুষের গমনাগমনকে ফিলিপ কোন গুরুত্বই দিলেন না।

    সন্ধ্যে নামার আগেই স্ট্যাজিরায় পৌঁছে গেল ম্যাসেডনীয় অশ্বারোহী দল। চারপাশে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। পুড়ে যাওয়া জাহাজের কঙ্কাল থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। পুড়ে যাওয়া মানুষের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।
    "এত বড় একটা কাজ তুমি আমাকে না জানিয়েই করছিলে,ফিলিপ। অথচ আমাকে জানালে এখানে নিশ্ছিদ্র পাহারার ব্যবস্থা করতাম নিজে দাঁড়িয়ে!" আক্ষেপের স্বরে বলল আনতিগোনাস।
    "আমার ভুল,ভাই। এর খেসারত যে যেভাবে দিতে হবে ভাবিনি। আমাদের সমুদ্রিক প্রস্তুতি অন্তত দশ বছর পিছিয়ে গেল।"
    "ছাড়ো, বাদ দাও। এইসব নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। আগে লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে।।
    সেনাবাহিনীর কয়েকজনকে এলাকায় পাহারায় বসিয়ে রেখে একটা গাছের তলায় দাঁড়াতেই পারমেনিও ঘোড়া থেকে এসে ফিলিপ আর আনতিগোনাসের সামনে নামলেন।
    "চলো, সেই ব্যাটা ধরা পড়েছে।"
    "কোথায়?"
    "এম্ফিপলিসের থেকে একটু দূরেই।"
    "যারা ধরেছে,তাদের কাছে ওকে মেরে না ফেলার আদেশ পৌঁছেছে?"
    "কোন দল ধরেছে জানি না। যে দশটা দলকে ওকে খুঁজতে পাঠিয়েছিলে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা দলের কাছেই তোমার নির্দেশ পৌঁছেছিল। এম্ফিপলিসের দুটো দলের মধ্যে একটাও কিন্তু তোমার নির্দেশ পেয়েছে বলে মনে হয় না!"
    "আর কথা নয়, চলো,এখুনি। গিয়ে দেখতে হবে কি অবস্থা!" যতক্ষণে ফিলিপ এম্ফিপলিস পৌঁছলেন ততক্ষনে ইউডেমাসকে ম্যাসেডনীয় বাহিনীর সেনারা তাদের ষোল ফিট লম্বা বর্শায় গেঁথে ফেলেছে। কেবলমাত্র যোগ্য বার্তাবাহকের অভাবে আজ ফিলিপের হাত থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্য নায়কের নামটা অগোচরে থেকে গেল। ফিলিপ আফসোস করলেন। কিন্তু আফসোস করে কোন লাভ নেই। ইউডেমাসের মৃতদেহটা সামনের মাঠে ক্রুশকাঠে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দিয়ে ফিরে গেলেন ফিলিপ।

    সদ্যমৃত ইউডেমাসের দেহটা এই ক্রুশকাঠে ঝুলতে দেখবে পথচলতি লোকজন। তাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হবে। মৰতদেহের পচা গন্ধে পথে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়বে,কিন্তু ওই পচনের গন্ধই মানুষকে জানান দেবে ফিলিপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ফিলিপ তার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিতে পারেন। রাজ্যবাসীর প্রয়োজনে রাজা যেমন কর মকুব করেন, তেমনিই আতঙ্ক জাগিয়ে না রাখলেও রাজাকে কেউ মানবে না। ফিলিপ আজ বুঝলেন, রাজত্ব করতে হলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা কতটা প্রয়োজনীয়।
    আগামী দিনে দরকার পড়লে আরও কঠোর হতে হবে তাঁকে। ফিলিপ এটাও বুঝলেন যে পারস্য নয়,তার সবচেয়ে বড় শত্রু তাঁর দেশেই বর্তমান। আগে নিজের দেশের মধ্যেকার শত্রু নিকেশ করে তবেই বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে হবে।
    নইলে তাঁর রাজত্বের স্থায়িত্বকালও সংক্ষিপ্ত হতে দেরি নেই।
    ****
    (....ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৮:৪১369950
  • না না। হতে এঁকে বানানো। শেষ করতে পারিনি।
  • Ankur Chakraborty | ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৭:৩৬369953
  • পর্ব ১০

    (....আগের পর্ব থেকে)

    ।। ৩ ।।

    সময় খারাপ গেলে কোনকিছুই যেন ঠিক যেতে চায় না। শরৎকাল শেষ হতে না হতেই পিডনা বন্দরটি ফিলিপের হাতছাড়া হয়ে গেল। স্ট্যাজিরায় নৌবহরের অগ্নিকান্ডের এক মাস যেতে না যেতেই এথেন্স অসম্ভব চতুর পদ্ধতিতে একজন ভাড়াটে সেনাপতি ক্যারেসকে দিয়ে ওই বন্দরের দখল নিজেদের হাতে তুলে নিল। নিজের ক্ষমতায় হঠাৎ এরকম পরপর দুটো আঘাত ফিলিপকে বুঝিয়ে দিলো যে এথেন্স যতই দুর্বল হয়ে পড়ুক না কেন, তার নৌবাহিনী এখনো গ্রীসের যে কোন বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

    পেল্লার রাজপ্রাসাদ থেকে ফিলিপ তাঁর সৈন্যশিবির সরিয়ে আনলেন এম্ফিপলিস নগরীতে। আপাতত আনতিগোনাস এই শহরেই ফিলিপের প্রতিনিধি হিসেবে ঘাঁটি আগলে রেখেছিলেন। ফিলিপ যখন আনতিগোনাসের তাঁবুতে ঢুকলেন,তিনি দেখলেন এহেন নিষ্ঠুর এবং ক্রুর হিসেবে পরিচিত আনতিগোনাস একটা বছর তিন চারেকের বাচ্চা ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে যবের রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার মুখে তুলে দিচ্ছে।

    "বাচ্চাটা কার?" কোন ভণিতা না করেই ফিলিপ জিজ্ঞেস করলেন।
    "আন্দ্রোটিমাসের ছেলে। নিয়ার্কাস।" আনতিগোনাস জবাব দিল।
    "আমি ভাবলাম এখানে রেখে যাওয়া তোমার কোন এক রক্ষিতার সন্তান।"
    "না না। আন্দ্রোটিমাস তো আমার বেশ সুপরিচিত ছিল। সে যেভাবে মারা গেল, তারপর তার অনাথ ছেলের কি হবে? এই ভেবে ওকে আমার সাথেই নিয়ে চলে এলাম।"
    "বাপরে,তুমি আজকাল এত দয়াবান হয়ে পড়ছ, ভেবে অবাকও হচ্ছি আবার চিন্তিতও হচ্ছি."
    "অবাক তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু চিন্তিত কেন?"
    "পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এখন মনের মধ্যে দয়া মায়া রাখলে যুদ্ধের ময়দানে হাত কাঁপবে না তো?"
    "আমি তো বরং উল্টোটা বলব। যদি বলি আমার এই পোষ্যপুত্রের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে,আর বাঁচার জন্যই প্রানপন লড়তে হবে?"
    "বুঝলাম। যাই হোক। শোনো,আনতিগোনাস। আমি এথেন্সের নৌবাহিনীর কর্তা ক্যারেসকে চিঠি পাঠিয়েছি।"
    "কি বিষয়ে?"
    "বলেছি,যাতে লোকজনের প্রাণ যাওয়া আটকানো যায়,তার জন্য বরং পিডনা বন্দর আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এমনিতেই এথেন্স থ্রেস, ইউবোইয়া, এইসব জায়গায় বেশ কয়েকটা বন্দর দখল করে রেখেছে। পিডনা ছেড়ে দিলেও খুব একটা ক্ষতি ওদের হবে না। কিন্তু ক্ষতি আমাদের। তার বদলে এম্ফিপলিস ওদের হেফাজতে দিতে রাজী হয়েছি। বলো, প্রস্তাবটা কেমন?"
    "মন্দ নয়। কিন্তু এম্ফিপলিস চলে গেলে কিন্তু থ্রেসের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই যে সেদিন কার্ডিয়া দখল করলাম,সেটাও বকলমে বেদখল হয়ে যাবে!"
    "তুমি কি আমাকে এতোটাই কাঁচা ভাবলে, আনতিগোনাস? ফিলিপ অন্য পদ্ধতিতে কাজ করে। তাহলে বলি শোনো, আমি পাশাপাশি বাইজেন্টিয়াম এলাকার স্থানীয় নেতৃবর্গের কাছেও গোপন চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি এই মর্মে যে ওখানকার মানুষজন যদি এথেন্সের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে,তাহলে ম্যাসেডন তাদের সাহায্য করতে সেনা পাঠাবে। আমি স্বয়ং যাব সেখানে। আর বিদ্রোহ হলে এথেন্স নৌবাহিনী পাঠাতে বাধ্য। আর সেই সুযোগে তুমি এম্ফিপলিস থেকে কয়েকটা দলে সেনা নিয়ে পিডনা দখল করে নেবে। এই হিসেবে চললে বাইজেন্টিয়াম, থ্রেস, পিডনা, এম্ফিপলিস সবই ম্যাসেডনের দখলে এসে যাবে আর সমগ্র উত্তর গ্রীস এথেন্সের হাতছাড়া হবে।"
    "আর ধরো যদি এই পরিকল্পনা সফল না হয়,তাহলে?"
    "একটু ঝুঁকি নিতেই হবে, আনতিগোনাস। এছাড়া হবে না।"
    এইসব কথাবার্তা সেরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে ফিলিপ বেশ খানিকটা ইতিবাচক অনুভব করলেন। এই সময়ে নেতিবাচক মনোভাব খুব বিপদজনক।

    ****
    বাইজেন্টিয়াম থেকে বিদ্রোহের খবর জানিয়ে এথেন্সের নৌসেনাপতি ক্যারেস চিঠি পেতেই পড়ল এক মহা ফাঁপরে। এখন যদি সে পিডনা বন্দর ছেড়ে চলে যায়,তাহলে বন্দর অনেকটাই অরক্ষিত হয়ে থাকবে। অন্যদিকে আবার যদি বাইজেন্টিয়াম নগরীতে নৌবাহিনী পাঠাতে হয়,তাহলে এথেন্স থেকে আরও নৌসেনা ডেকে আনতে হবে। আপাতত যা রসদ রয়েছে, তা দিয়ে পিডনা সামলানো গেলেও বাইজেন্টাইন বিদ্রোহ দমন অসম্ভব। এমতাবস্থায় এথেন্স শহরে চিঠি পাঠানো উচিত হবে?না কি ফিলিপের প্রস্তাব অনুযায়ী এম্ফিপলিস শহরের কার্যভার গ্রহণ করে বন্দর ম্যাসেডনের হাতেই ছেড়ে দেওয়া সমীচীন হবে, ক্যারেস বুঝতে পারল না। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে যদি দেরি হয়ে যায়,তাহলে কিন্তু বাইজেন্টিয়াম হাতছাড়া হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
    এখন কি করা উচিত?
    সারা রাত ধরে বিচার বিবেচনা করে আপাতত ফিলিপের হাতে পিডনা বন্দর তুলে দিয়ে নৌবহর বাইজেন্টিয়ামের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল ক্যারেস। এথেন্সে চিঠি পাঠিয়েও এখনও কোন জবাব আসেনি। এথেন্সের নেতৃবর্গের দায়বদ্ধতা নিয়েও ক্যারেস সন্দেহ করতে লাগল। এখন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতোই এথেন্সের নেতৃবর্গের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। হঠকারিতা হলেও সই। একটা গণবিদ্রোহ কিন্তু ফিলিপের সেনার থেকেও বেশি ধ্বংসাত্মক।
    অতএব, ঈজিয়ান সাগরে পাল তুলে নোঙর উঠালো এথেনীয় ট্রাইরিম। গন্তব্য বাইজেন্টিয়াম নগরী।
    ইতিমধ্যে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হয়ে শীতের আগমন বার্তা ঘোষণা করে দিয়েছে। আর উত্তর গ্রীসের শীতকাল দক্ষিণের তুলনায় এমনিতেই অনেকটা বেশি কড়া। এই শৈত্য প্রবাহের সাথে ম্যাসেডনীয় সেনা পরিচিত হলেও এথেনীয় সেনার কাছে এটা শাস্তি স্বরূপ। ক্যারেসের নৌবহর বাইজেন্টিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল শীতের প্রকোপের পাশাপাশি বৃষ্টি। এমনিতেই ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে শীতকালেই বর্ষা নামে। আর উত্তরের ঠান্ডার সাথে এলো তুষার ঝড়। প্রবল ঝড়ে ক্যারেসের নৌবাহিনীর গোটা পনেরো জাহাজ বিধ্বস্ত হল।

    হঠাৎ করে ভাগ্যের এমন সহায়তা পাবেন,ফিলিপ স্বপ্নেও ভাবেননি। পিডনায় পৌঁছে দেখলেন এ যেন ট্রয়ের উপকূল থেকে এক রাত্রে গ্রীক জাহাজ বিদায় নেওয়ার মতো দৃশ্য। এ যাবৎ এই বন্দরে এথেনীয় নৌবহরের পাহারা যেন এক নিমেষে উধাও। কিন্তু ট্রয়ের ঘোড়ার মত কোন ফাঁদ পাতা আছে কি না,এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই ফিলিপ এই বন্দর শহরে নিজের সেনাবাহিনীকে প্রবেশ করতে বললেন। যদিও ভাগ্য নামক বিষয়ে ফিলিপের বিশ্বাস নেই,কিন্তু এরকম সুযোগ পেলে কেউ হাতছাড়া করে? বিনাযুদ্ধে নিজের বন্দর ফেরত পাওয়া, এবং তার বদলে এম্ফিপলিস নগর হাতছাড়া না হওয়া। এ তো সোনায় সোহাগা!
    ফিলিপ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ম্যাসেডনের প্রায় বেশিরভাগ এলাকা থেকেই এথেন্সের কর্তৃত্ব সম্পুর্ন নির্মূল করলেন। এই খবর এবং বাইজেন্টিয়ামে সামুদ্রিক ঝড় আর তুষারপাতে এথেনীয় নৌবাহিনীর পর্যুদস্ত হওয়ার খবর এথেন্সের গণপরিষদে উঠলে ডেমোসথেনিস বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল ইস্কিনেস।

    "সুধী নেতৃবর্গ, আমি আগেই বলেছিলাম এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিতে। আমি বলেছিলাম আমার মাননীয় 'বন্ধু' ডেমোসথেনিসকে যে পিডনা দখল করার মত এরকম একটা অভিযানে ক্যারেসকে না পাঠাতে। কিন্তু দেখুন, মাননীয়রা সকলেই ডেমোসথেনিসের বাকচাতুর্যে মুগধ হয়ে ক্যারেসের মত একজন নবিশ এবং ভাড়াটে নৌসেনাপতিকে পাঠিয়ে দিলেন এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তাও ক্যারেসের বা ডেমোসথেনিসের ভুলভ্রান্তি মেনে নিতাম,তদুপরি,আপনারা ক্যারেসের চিঠির জবাব দিলেন অতিরিক্ত আলাপ আলোচনার পর। যেখানে আলোচনার বদলে তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত, ঠিক বা ভুল, নিলে কাজ হত। সেটা আপনারা করলেন না। তার ফলস্বরূপ, ক্যারেস নিজে একটা অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিলো। যার ফলাফল আপনাদের চোখের সামনে।"

    এথেনীয় নেতৃবর্গের মাথা হেঁট হয়ে যেতে দেখে ইস্কিনেস আবার বলল, "ফিলিপ যখন এম্ফিপলিস ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেটাও আপনারা নিতে সাহস দেখালেন না। আর আজ দেখুন,আপনাদের এই সিদ্ধান্তের দরুন গ্রীসের ভবিষ্যতের রাশ কিন্তু এথেন্সের হাত থেকে উত্তরে ম্যাসেডনে চলে গেছে। এবার ভাবুন আপনাদের কি করনীয়? বা আদৌ কিছু করার মত আপনাদের হাতে আছে কি না!!!"

    ডেমোসথেনিস গণপরিষদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে গেলেই ইস্কিনেস বাধা দিল।
    "দাঁড়াও,দাঁড়াও। ম্যাসেডনের বিরুদ্ধে বলে বলে আজকে তুমি এথেন্স কে ম্যাসেডনের একদম বিপরীত মেরুতে এনে দাঁড় করিয়েছ। এখন এভাবে চলে গেলে তো চলবে না? ফিলিপ যদি এখন ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ হয়ে এথেন্স দখল করতে এগিয়ে আসে,তার দায় কি তুমি নেবে?"

    ডেমোসথেনিস সম্পুর্ন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইস্কিনেসের মুখ আজ তলোয়ারের মত ঝকসে উঠছে। তার ধারে ডেমোসথেনিসের সব যুক্তি কেটে খন্ড খন্ড হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং সময় এবং পরিস্থিতিকেই সব উত্তর দিতে দেওয়া উচিত। যেরকম হঠাৎই ফিলিপের ভাগ্য ফিরে গেছে,একদিন সেরকমই আম্বার ফিলিপের ভাগ্য অস্তাচলে যাবে। আর তখনই ডেমোসথেনিস আবার উঠে কামড় দেবে।
    ততদিন কেবল চুপ করে অপেক্ষা।
    ****

    (....ক্রমশ)
  • amit | 213.0.3.2 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৩৮369954
  • ভালোই চলছিল, কিন্তু দশ দশটা জাহাজ (যতই ছোট হোক না কেন ), মাত্র একটা পিপে ন্যাপথা আর এক পিপে বিটুমেন দিয়ে অতগুলো জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেয়া, প্লাস সমুদ্র্রের জলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না ? কত বড়ো সাইজের পিপে রে বাবা -?

    আর ওরকম পাহাড়প্রমাণ দুটো পিপে পিঠে বয়ে নিয়ে (পিঠেই ধরছি, কারণ দু হাতে দুটো পিপে আর একহাতে দড়ি বেয়ে ওঠা একেবারে পাকড়াশী গোয়েন্দা হয়ে যেত ) জাহাজে ঝুলে দড়ি বেয়ে ওঠাটাও একটু রজনীকান্ত টাইপ হয়ে গেলো যে।

    যাই হোক গত কাল আন্না রজনীর জন্মদিন ছিল। ভক্তের শ্রদ্ধার্ঘ হবে হয়তো।
  • Ankur Chakraborty | ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ১১:১৫369955
  • পর্ব ১১

    (...আগের পর্ব থেকে)

    ****
    শীতকালীন বর্ষা পেরিয়ে ম্যাসেডনে বসন্তের আগমন হতে না হতেই পেল্লার রাজপ্রাসাদে দুটো সুখবরের আগমন হল।
    প্রথমত: রানী ফিলিনা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যদিও অল্প বয়সে মা হওয়ার কারনে ফিলিনার ছেলেটা একটু দুর্বল। ক্ষীণজীবীও বটে। তবে রাজপ্রাসাদে প্রথম পুত্র সন্তানের আগমনে ফিলিপ খুব খুশি। ছেলের নামকরণ করলেন এরিডিয়াস। অন্যদিকে ফিলিপের কাছে খবর এসে পৌঁছল মহারানী অলিম্পিয়াসও অন্তঃস্বত্ত্বা। এবার এদিকে ইতিমধ্যেই এক পুত্রের জন্মানোর ফলে ফিলিপের উত্তরাধিকারী এসে গেছে, অন্য দিকে অলিম্পিয়াসও পুত্রসন্তান প্রসব করলে কি ভবিষ্যৎ গৃহযুদ্ধের বীজ বপন হবে ম্যাসেডনের রাজ-অন্তঃপুরে? ফিলিপ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান না। যা হবে,দেখা যাবে। এরকম ভেবে নিয়ে তিনি বসন্তকালের মাঝামাঝি ক্যালসিডাইস এলাকার পটিডিয়া নামক ছোট্ট জনবসতি দখল করার জন্য রওনা হলেন।

    যদিও রাজনৈতিক দিক থেকে পটিডিয়া একটি গুরুত্বহীন এলাকা,কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে এই এলাকা দখলের অর্থ হবে ক্যালসিডাইস এলাকার পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্ত দখল করে ম্যাসেডন-রাজ থেসালির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। যদিও থেসালি মিত্রপক্ষ। তবুও ফিলিপ কোন ফাঁকফোকর রাখতে নারাজ। চরম সাম্রাজ্যবাদ এইমুহূর্তে গ্রীসকে আবার তার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে,ফিলিপ এটাই মনে করেন। এথেনীয় গণতন্ত্র দিয়ে পারস্যকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে না। তাই সেনাবাহিনীকে সচল রাখার প্ৰয়োজনও যথেষ্ট। সেনাবাহিনী যদি বেশিদিন সুখের মুখ দেখে নেয়, তাহলে ।এড জমতে সময় নেবে না। তাই এইসব ছোটখাটো অভিযান সেনার মনোবল এবং অস্ত্রবল যাচাই করে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ।

    যাই হোক, এই অভিযান যতটা সহজ হবে বলে ফিলিপ ভেবেছিলেন, ততটা সহজ হল না। প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি পটিডিয়া নগরী ঘেরাও করে রেখেও খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখলেন না ফিলিপ। উল্টে,তাঁর ডান চোখের ক্ষতটা অনেকটাই সেরে এসেছিল, এখানে আক্রমন চলাকালীন উড়ন্ত তীরের খোঁচায় সেই চোখের মণি অবধি ঠিকরে বেরিয়ে এলো। প্রচন্ড রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়ে তাঁকে তাঁবুতে নিয়ে আসা হল। রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাস কয়েকজন সহচরকে নিয়ে ফিলিপের চোখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বসলেন। আপাতত ফিলিপকে অজ্ঞান করে তাঁর চোখের উন্মুক্ত কোটর থেকে দূষিত রক্ত বের করা রাজবৈদ্যের প্রথম কাজ।
    গরম জলে তুল ভিজিয়ে প্রথমে জায়গাটা পরিষ্কার করে নিলেন নিকোম্যাকাস। ইতিমধ্যে আনতিগোনাস এসে জানিয়ে গেছে যুদ্ধবিরতির কথা। ফিলিপের সুস্থতার খবর না পাওয়া পর্যন্ত ম্যাসেডনীয় সেনা আক্রমন করবে না। এমনটাই ঘোষণা হয়েছে। আপাতত,ফিলিপের চোখের আরও ক্ষতি হওয়া থেকে আটকাতে হবে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক সমস্যা নিয়ে রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাস ফিলিপের ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হলেন। তারপর চোখের কোটরে তুলো এবং ওষুধ দিয়ে চোখের পাতা দুটো সেলাই করে দিলেন। এভাবে অন্তত এক সপ্তাহ রাখার পরে সেলাই খুলে তুলো বের করে চোখের ফাঁকা কোটর পরিষ্কার করে সেটা বরাবরের জন্য সেলাই করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বছরখানেক আগে আনতিগোনাসের বাঁ চোখেও এরকমই ক্ষত হয়েছিল এবং সেই অস্ত্রোপচারের কৃতিত্বও এরিস্টটলের বাবা নিকোম্যাকাসের।
    এক সপ্তাহ ঘুরে ফিলিপের চোখের ক্ষত পরিষ্কার করে পুরোপুরিভাবে সেলাই করবার দিনেই পটিডিয়ার সেনাছাউনিতে খবর এলো পেল্লার রাজপ্রাসাদে মহারানী অলিম্পিয়াস হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
    "নিকোম্যাকাস, আমার একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।" ফিলিপ রাজবৈদ্যের হাত চেপে ধরে বললেন।
    "আপনি জানেন যে অলিম্পিয়াস হচ্ছেন আমার রানীদের মধ্যে মুখ্য। আমার শরীরের অবস্থা ভালো থাকলে আমি এখুনি পেল্লায় ছুটে যেতাম তার কাছে। আপনাকে অনুরোধ,আপনি ওর চিকিৎসার দায়িত্ব নিন। আপনার কোন একজন ছাত্র আমার দেখাশুনা করে নিতে পারবে। আমার কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু এটা আমার অনুরোধ।"
    রাজার অনুরোধ আর এদেশের মধ্যে পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। তার ওপর রাজা যদি ফিলিপ হন। নিকোম্যাকাসের কাছে গত্যন্তর নেই। তাছাড়া ছাব্বিশ বছর আগে ফিলিপের জন্মও হয়েছিল নিকোম্যাকাসের হাতেই। গ্রীক সমাজে জন্ম দিয়েছেন যিনি,তিনি প্রায় বাবার সম্মানের অধিকারী হন। তবুও ফিলিপকে ঠিক ভরসা করা যায় না। কি করতে কি করে বসেন। অগত্যা মহারানী অলিম্পিয়াসের চিকিৎসার দায়িত্ব নিকোম্যাকাসকেই নিতে হল।

    পেল্লার প্রাসাদে নিকোম্যাকাসের আনাগোনা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে রানীর প্রাসাদে তার যাতায়াত নেই। সাধারণত প্রাসাদের পুরুষদের চিকিৎসা করেন রাজবৈদ্য। প্রাসাদের রানীরা ধাত্রীদের চিকিৎসার অধীন।
    রানীর প্রাসাদে ঢুকতেই অলিম্পিয়াসের বিশ্বস্ত সহচরী এবং ধাত্রী ল্যানিকে এসে নিকোম্যাকাসকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অন্তঃপুরে নিয়ে এলেন।
    "রানীর অবস্থা এখন কেমন?" রাজবৈদ্য ল্যানিকেকে জিজ্ঞেস করলেন।
    "জ্বর নেই। তবে কাল রাত থেকেই প্রলাপ বকছেন।"
    "কিছু বোঝা যাচ্ছে, উনি কি বলছেন?"
    "মাঝে মধ্যেই বলছেন, 'আমার পেটের মধ্যে যেন ঝড় চলছে। বজ্রপাত হচ্ছে।' আবার বলছেন 'পেটের ভিতরটা সিংহ ছিঁড়ে খাচ্ছে,সে বেরিয়ে আসতে চায়' এইসব!"
    "এর অর্থ আমারও বোধগম্য হচ্ছে না। যা হোক, তুমি আমাকে রানীর ঘরে নিয়ে চলো। আমি গিয়ে দেখতে চাই। প্রসবের সময় সমাগত।"
    "ওহ, হ্যাঁ, আরেকটা কথাও বলছিলেন রানী!" ল্যানিকে নিকোম্যাকাসকে থামিয়ে বলল।
    "কি কথা?"
    "রানী দু' তিনবার বলেছেন, 'ফিলিপ যে চোখ দিয়ে আমার ঘরে উঁকি দিত, সেই চোখ আমি উপড়ে ফেলেছি!"
    এবাট নিকোম্যাকাসের অবাক হওয়ার পালা। এই কথার অর্থ কি? ফিলিপের চোখ উপড়ে যাওয়ার খবর তো পেল্লায় পৌঁছয়নি। তাহলে রানী এটা কি বলছেন! আর একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীর ঘরে উঁকি দেবেনই বা কেন? ফিলিপ তো অলিম্পিয়াস কে অসম্ভব ভালোবাসেন বলেই সবাই জানে। সন্দেহ করার কথা কেউ শোনেনি কোনোদিন। তাহলে কি যে কানাঘুষো শোনা যায় রানীর সম্পর্কে, রানী নাকি জাদুকরী, রানী নাকি সাপের সঙ্গে সম্ভোগ করেন, সেসব কথা কি সত্যি? নিকোম্যাকাসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কিন্তু পরের ঘরের খবর জেনে রাজবৈদ্যের কাজ কি? এইসব ভেবেই এই চিন্তা দূর করে দিলেন মন থেকে।

    এদিকে পটিডিয়ার সৈনিশিবিরে ফিলিপ ওষুধের প্রভাবে দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঝিমোচ্ছেন। শরীরের তাপমাত্রাও বেশি। তার ওপর শুরু হয়েছে অকাল বর্ষণ। গতকাল রাত থেকেই বৃষ্টির জন্য ম্যাসেডন সেনার প্রস্তুতি অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। আনতিগোনাস তার তাঁবুতে বসেই যুদ্ধের পরবর্তী পরিকল্পনা সাজিয়ে নিচ্ছেন। ছয় ঘন্টা অন্তর অন্তর জরুরি অবস্থার দৌত্য মাধ্যমে পেল্লার রাজপ্রাসাদ থেকে কার্যনির্বাহী শাসক আন্টিপেটার রানীর শরীরের হালহকিকত পাঠিয়ে চলেছেন। এপিরাসের উত্তরপূর্বের সীমান্তে পারমেনিওর সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবরও আসছে। কিন্তু ফিলিপ অসুস্থ থাকায়,খবর জোগাড়ের ভার আনতিগোনাসের। তার মধ্যে ঘটেছে আরেক অঘটন। আনতিগোনাস যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বে অবস্থিত তার তাঁবু থেকে পশ্চিমে ফিলিপের তাঁবুর দিকে ঘোড়ায় চেপে খবর জানাতে যাচ্ছিলেন। এমন সময়, বলা নেই,কওয়া নেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই আনতিগোনাসের ঘোড়ার মাত্র কয়েক হাত দূরেই মারাত্মক বাজ পড়ল। ঘোড়া ভয় পেয়ে আর এগোতে চাইলো না। আনতিগোনাস ফিরে এলেন নিজের তাঁবুতে। তিনিও একটু ভীত হয়েছেন। এটা কি কোন অশুভ অশনি সঙ্কেত? দেবরাজ জিউস তার বজ্রের আঘাতে কিছু বোঝাতে চাইছেন?

    নিজের তাঁবুতে ঘুমের মধ্যেই ফিলিপ বিড়বিড় করে উঠলেন, "না না, এটা কি?" অন্ধকারের অন্তরালে ফিলিপ দেখতে পাচ্ছেন অলিম্পিয়াসকে। অলিম্পিয়াস গর্ভবতী। তাঁর শরীরে পোষাকের বদলে কেবলমাত্র সাপ জড়িয়ে রয়েছে। অলিম্পিয়াস ফিলিপের কাছে আসছেন। ফিলিপ তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন সম্ভোগের আশায়। অলিম্পিয়াস আজ তাঁকে নিরস্ত করছেন না। ফিলিপ যেন হাওয়ায় ভেসে রয়েছেন। অলিম্পিয়াস তাঁর শরীরের নীচে নিজের জায়গা বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু, এ কি??? সম্ভোগের পথ বন্ধ কেন??? অলিম্পিয়াসের যোনিপথ কেউ যেন বন্ধ করে দিয়েছে!! সিলমোহর??? ঠিক যেমন রাজার গোপন চিঠিপত্রে থাকে,সেরকম। গালা দিয়ে ছাপ দেওয়া সীলমোহর। কিন্তু কোথায় সেই ম্যাসেডনের আর্গিয়াদ বংশের ষোড়শ-ভূজ নক্ষত্রের ছাপ? এ যে অচেনা সিলমোহর। সিংহের ছাপ কেন এই সিলমোহরে? চূড়ান্ত চেষ্টা করেও ফিলিপ ব্যর্থ হচ্ছেন অলিম্পিয়াসের যোনিমুখ থেকে এই সিলমোহর খুলে নিতে। অলিম্পিয়াস ফিলিপকে উৎসাহিত করছেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হচ্ছেন। অলিম্পিয়াস চেঁচিয়ে বলছেন, "পেটের ভিতরটা সিংহ ছিঁড়ে খাচ্ছে,সে বেরিয়ে আসতে চায়!" এইসব বলতে বলতেই যেন সেই সিলমোহরের গালায় চিড় ধরল। ফিলিপ দূরে সরে যেতেই অলিম্পিয়াসের পেট চিরে বেরিয়ে এলো একটা ভয়ানক সিংহ। তার মুখের গড়ন অনেকটা দাড়িগোঁফওয়ালা ফিলিপের মতোই। মুখ তার ক্ষতবিক্ষত। বেরিয়ে এসে একটা গগনভেদী গর্জন করে সে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। সে মিলিয়ে যাওয়ার পরে শুরু হল ভূমিকম্প। ফিলিপ,অলিম্পিয়াস সবাই সেই ভূমিকম্পের ফাটলে তলিয়ে যাচ্ছেন।
    ফিলিপের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘামছেন দরদর করে!

    এটা আমি কি স্বপ্ন দেখলাম?? এর অর্থ কি???
    এই দুর্যোগের মধ্যেও ফিলিপ আনতিগোনাসকে ডেকে বললেন ডেলফির এপোলো মন্দিরে দূত পাঠাতে। কাল সকালের মধ্যেই যেন সেই দূত ফিরে এসে জানায়,ডেলফির মন্দিরে এই স্বপ্নের অর্থ বিষয়ে কি নিদান দিয়েছে!! যতক্ষন না এই স্বপ্নের সুরাহা হচ্ছে, ফিলিপ নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না।
    ****

    (....ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৩৫369956
  • পর্ব ১২

    ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের মধ্যে ম্যাসেডনের দূত এসে পৌঁছল আনতিগোনাসের শিবিরে। আপাতত রাজার সাথে সরাসরি দেখা না করে আনতিগোনাসের সাথে দেখা করার আদেশ জারি হয়েছে। শিবিরে ঢুকে জল খেয়ে দূত জানালো, "দুটো বড় খবর এনেছি।"
    "বলে ফেলো!" আনতিগোনাস মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে জানতে চাইল।
    "প্রথমত, রানী সম্ভবত আজ রাতের মধ্যেই সন্তান প্রসব করবেন। রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাসের সেরকমই ধারণা। রাজ-পুরোহিত এরিস্ট্যান্ডারও আজ মধ্যরাত্রের সময়কেই শুভক্ষন বলে বিবেচনা করেছেন।"
    "বেশ। আরেকটা খবর কি?"
    "কাল রাত্রে এফেসাসের আর্টেমিসের মন্দির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে!"
    "এফেসাসের মন্দির পুড়ে গেছে??? কি বলছ? কিভাবে?"
    "কেউ বলছে মন্দিরের ওপর বাজ পড়েছিল,আবার কেউ বলছে হিরোস্ট্রেটাস নামের একজন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এফেসাসে ইতিমধ্যেই তাকে খোঁজার ধুম পড়ে গেছে!"
    "আবার বজ্রপাত! কাল রাতে আমার সামনেই একবার হলো, এফেসাসেও হয়েছে! বছরের এই সময়ে এই আবহাওয়া তো একদম অস্বাভাবিক। এটা কি দেবতাদের কোন চক্রান্ত বা বার্তা?" আনতিগোনাস মনে মনে ভাবল।

    প্রথম দূত তাঁবু থেকে বেরিয়ে যেতেই আরেকজন দূত তাঁবুতে প্রবেশ করল। প্রথমজনের তুলনায় অনেকটা দূরে গিয়ে তাকে আসতে হয়েছে বলে সে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ক্লান্ত। আনতিগোনাস এই দূতের খবরের মূল্য অনুধাবন করেই তাকে প্রথমে বসতে অনুরোধ করল এবং এক পাত্র আঙুরের রসে তৈরি মদ খেতে দিল।
    এই দূত সরাসরি ডেলফির এপোলো মন্দির থেকে আসছে। ভোরবেলায় বেরিয়ে গিয়ে ডেলফি পৌঁছে আবার পটিডিয়ায় ফিরে আসতে তাকে অন্তত পাঁচবার ঘোড়া বদল করতে হয়েছে। তার পরেও সে দুর্যোগের রাতে ঠিকঠাক ম্যাসেডনের শিবিরে ফিরে এসেছে।
    "আমি জানি তুমি অনেক ক্লান্ত। আর একটু কষ্ট সয়ে নাও। তোমার আনা খবরটা আমার সাথে ফিলিপের তাঁবুতে গিয়ে ফিলিপিকেই শোনাবে। আমাদের রাজা কিন্তু দুশ্চিন্তায় আছে।

    দূত মদ খেয়ে নিজের স্নায়ুগুলোকে কিছুটা স্থির করে নিলো। আনতিগোনাসের সঙ্গে ফিলিপের তাঁবুতে পৌঁছতে দেখা গেল ফিলিপ খাঁচাবন্দি সিংহের মত এদিক ওদিক পায়চারী করছেন। গায়ের জ্বর এখনো কমেনি, চোখের ক্ষত এখনও কাঁচা,কিন্তু বিছানায় বা বালিশে এক মুহূর্তের জন্যও শরীর ফেলেননি সকাল থেকে। ওই স্বপ্নের অর্থ উদ্ধার না করে তার শান্তি হবে না। শরীর সুস্থ থাকলে তিনি নিজেই ঘোড়া ছুটিয়ে ডেলফিতে গিয়ে এরকম স্বপ্নের অর্থ জেনে নিতেন।
    দূতকে তাঁবুতে ঢুকতে দেখে তাঁর মনে আশা এবং নিরাশার মিলিত অনুভূতি জেগে উঠল। কিন্তু উতলা হওয়া রাজার শোভনীয় নয়,বিবেচনা করেই ফিলিপ নিজেকে সংযত করলেন।
    "কিছু খবর পাওয়া গেল?" রাজার আদেশে ধর্মীয় মন্দিরের প্রধান কোন খবর দেবেন না,এটা অসম্ভব, জেনেও ফিলিপ দূতকে প্রশ্ন করলেন।
    "হ্যাঁ, মহারাজ।"
    "তার আগে আমি একটু বলে নিই!" আনতিগোনাস মাঝখানে বলে উঠল।
    "বলো"
    "সম্ভবত আজ রাতেই মহারানীর সন্তান প্রসবের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।"
    "বেশ! আর ডেলফির খবর!"

    "মহারাজ", দূত বলা শুরু করল, "ডেলফির প্রধান পুরোহিত নিজে গিয়ে পাইথিয়ার কাছ থেকে খবর এনে আমাকে বললেন যে আপনি যে স্বপ্ন দেখেছেন, তার অর্থ ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওনার কথা মতো, 'রাজা ফিলিপ যে স্বপ্ন দেখছেন, তার অর্থ হল এই যে,মহারানী অলিম্পিয়াসের গর্ভে এক সিংহ-সম শিশুর জন্ম হবে। ম্যাসেডনের রাজবংশে এরকম শিশু অতীতেও জন্মায়নি, ভবিষ্যতেও জন্মাবে না। আর্গিয়াদ বংশের শ্রেষ্ঠ বীরের জন্ম হবে অলিম্পিয়াসের গর্ভ থেকে। সিংহের সিলমোহর সেই বার্তাই বহন করছে। জন্মের পরমুহূর্তেই সেই সিংহের গর্জন এবং অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ন। সিংহের গর্জন অর্থাৎ এই পুত্র সন্তান কেবল ম্যাসেডনিয়া নয়, সমগ্র বিশ্ব জয় করবে। কিন্তু বেশিদিনের জন্য পৃথিবীতে তার বা তার সাম্রাজ্য স্থায়ী হবে না। সিংহের অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার পরের ভূমিকম্প আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সিংহের অন্তর্ধান অর্থাৎ দিগ্বিজয়ের পর রাজপুত্রের মৃত্যু এবং তার প্রভাবে গোটা গ্রীক সাম্রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে পতন।' ঠিক এই কথাই পাইথিয়া তার বিবরণে জানিয়েছেন।"

    স্বপ্নের ব্যাখ্যা পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ফিলিপ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। যদি ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়, তবে কি ফিলিপের এই পুত্রের হাতেই গ্রীক সাম্রাজ্য শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পারস্য তথা গোটা বিশ্বজয়ের কথাও তো বলা হয়েছে! কোনটা ঠিক? না কি দুটোই?

    পরমুহূর্তেই এইসব চিন্তা ফিলিপ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন এই ভেবে, যে ভবিষ্যতের এতটা দূর অবধি এখন না ভাবাই ভালো। পুত্র বা কন্যা কোনো সন্তানই অলিম্পিয়াস এখনও প্রসব করেননি। তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নিয়ে ভাবা কি খুব সঙ্গত হবে?

    এইসব দুশ্চিন্তার দোলাচলে যখন ফিলিপ দুলছেন তখনই দিনের তৃতীয় খবরটা এলো। এই খবরকে সুখবর বলাই যায়,কারন এপিরাসের সীমান্তে পারমেনিও মাত্র এক রাত্রের প্রচেষ্টায় ইলিরীয় সেনাবাহিনীকে সম্পুর্ন বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

    থ্রেস আগেই ম্যাসেডনের দখলে এসে গেছিল, থেসালির ঘাড়ে ইতিমধ্যেই ম্যাসেডন নিঃশ্বাস ফেলছে। আর এখন এপিরাসের সীমান্ত দখল করতে সক্ষম হওয়ায়, বকলমে এপিরাসেও ম্যাসেডনের আধিপত্য বিস্তার হল। গ্রীসের ঐক্যের প্রথম ধাপে পা ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন ফিলিপ। কিন্তু এক সাম্রাজ্যকে গ্রীসের বাইরে বিস্তারিত করবে যে,তার জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী কিছুক্ষন আগেই জানতে পেরেছেন ফিলিপ। তবে কি গ্রীসের সাম্রাজ্য বহির্বিশ্বে বিস্তার করার ফিলিপের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে? এই গৌরবের সামান্য ভাগও কি তাঁর কপালে জুটবে না? ভবিষ্যতের ওপর রি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন ম্যাসেডন-অধিপতি।

    এদিকে বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। আবহাওয়ার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। মুহূর্মুহু বজ্রপাতের পটিডিয়ার সমুদ্রতট রাতের অন্ধকারে একবার দৃশ্যমান হয়েই আবার ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। এরই মধ্যে একটা বিদ্যুতের ঝলকে ম্যাসেডনের সেনাবাহিনীর একটা তাঁবু সম্পুর্ন ভস্মীভূত হল। ম্যাসেডনের সেনাবাহিনীর একাংশে হাহাকার। এরকম দুর্যোগের মধ্যেই কি ম্যাসেডন তথা গ্রীসের ভবিষ্যৎ ভাগ্যবিধাতার জন্ম হবে?

    ফিলিপ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন তাঁর চোখের সামনে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ম্যাসেডন শিবিরের একাংশকে। শরীরে জ্বর নিয়েও তিনি বজ্রাহত সৈন্যদের সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন। এদিকে বৃষ্টির গতিও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সেনার আস্তাবলের পিছন দিক দিয়ে তীব্রবেগে জল ঢুকছে, এমন খবরও আসতে শুরু করেছে।

    ****

    (...ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১০:৩৫369957
  • #যবনিকা

    পর্ব ১৩

    ****
    মহারানী অলিম্পিয়াসের প্রসব বেদনা ওঠার মুহূর্তে রানীর অন্তঃপুরে উপস্থিত ছিলেন রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাস,রাজ-পুরোহিত এরিস্ট্যান্ডার এবং বিশ্বস্ত ধাত্রী ল্যানিকে। প্রথম সন্তান প্রসব করতে চলেছেন অলিম্পিয়াস। কিন্তু তাঁর অবস্থা এখনও প্রায় অচেতন। কিন্তু এই অচৈতন্য অবস্থাতেও তিনি মাঝেমধ্যে প্রলাপ বকছেন। অলিম্পিয়াসের মনে হতে লাগল যেন সমগ্র পৃথিবীর সকল দুর্যোগ একযোগে তাঁর গর্ভে ঘটে চলেছে। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ক্ষরা, বন্যা, ধ্বস, বিনাশের সকল চিত্রই তার অবচেতন মনে একবার একবার করে এসে রেখাপাত করতে লাগল। পুত্র সন্তান না কন্যা সন্তান, কার আগমনে এরকম অবস্থা হচ্ছে, তাঁর জানা নেই। কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে যে হয়তো মানুষ নয় কোনও এক ভয়ানক আদিম দৈত্য টাইটানের জন্ম হতে চলেছে তার পেট থেকে। অলিম্পিয়াস এই সন্তানের পথ চেয়ে বসে আছেন। হয়তো ম্যাসেডনের রাজত্বের শিখরে যাওয়ার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা একজন ম্যাসেডনীয় নারীর কাছেও অভাবনীয়, সেই আকাঙ্খায় তার মাকে পৌঁছে দেবে এই সন্তান।

    প্রসব বেদনায় কাতর অলিম্পিয়াসের ঘরে তখন নিকোম্যাকাসের কথামতো ল্যানিকে গরম জল, শুকনো কাপড় প্রভৃতি জোগাড় করে আনতে ব্যস্ত। রাজপুরোহিত এরিস্ট্যান্ডার গম্ভীর হয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছেন। নিকম্যাকাসকে ডেকে ধীর স্বরে বললেন, "লক্ষণ ভালো নয়।"
    "না না, মা বা সন্তান কেউই বিপদে আছে বলে মনে হয়না!"
    "আমি তাদের স্বাস্থ্যের কথা বলছি না। আমি দেখতে পাচ্ছি যে মহারানী পুত্রসন্তান প্রসব করতে চলেছেন। কিন্তু এই সন্তান হয় পৃথিবীতে গ্রীক জগতের নাম উজ্জ্বল করবে, নয়তো সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হবে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে। বাইরের আবহাওয়া লক্ষ্য করো, নিকোম্যাকাস। দেবরাজ জিউস বারংবার বজ্রপাতের মাধ্যমে কিন্তু মহাকালের আগমনবার্তা ঘোষণা করছেন। তিনিও ভীত। দেবতারাও কেউ চাইছে না এই সন্তানের জন্ম হোক।"
    "তা,আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি একটা নবজাতককে জন্মের পরেই হত্যা করি? এ ছাড়া তো শিশুর জন্মানো আটকানোর কোন উপায় নেই!"
    "দরকার পড়লে তাইই করো। দেশের স্বার্থে এই বলিদান প্রয়োজন!"
    "আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আমি একজন চিকিৎসক। জন্ম দেওয়া, প্রাণ বাঁচানো আমার কাজ। প্রাণ নেওয়া নয়। আর আপনি তো পুরোহিত, জ্যোতিষী। ভবিষ্যতে কি হবে সেটা দেখতে পান বলে দাবী করেন। সেই দাবি মিলিয়ে দেখবার মতো চাক্ষুষ প্রমান দিতে পারেন না? তাহলে কেবল আপনার ধারণার ওপর নির্ভর করে একটু শিশু বড় হয়ে কি হবে সেটা ভেবে এখনই তাকে শেষ করে দেওয়া আমার নৈতিক শিক্ষার পরিপন্থী। তাতে আপনি যা মনে করার করে নিন। এই সন্তানের জন্ম আমার হাতে হবেই।"
    ল্যানিকে দূরে দাঁড়িয়ে এই কথাবার্তা শুনে বলে উঠল, "দেখুন,রাজপুরোহিত। অলিম্পিয়াসের সন্তানের গায়ে একটুও আঁচ আসলে তার জন্য কিন্তু দায়ী হবেন আপনিই। আজকের পর থেকে আপনার ওপর আমার সজাগ দৃষ্টি থাকবে। কোনোরকম বেচাল দেখলেই কিন্তু অলিম্পিয়াস আপনার প্রাণদণ্ড মঞ্জুর করাতে পিছপা হবেন না। ম্যাসেডনের রাজপরিবারে আপনার মর্যাদা যাইই থাকুক না কেন, এপিরাসের রাজকুমারী কিন্তু কোনোদিনই আপনাকে গুরুত্ব দেন না। এটা মনে রাখবেন। এবার আসুন!" এতটাই দৃঢ়তার সাথে ল্যানিকে কথাগুলি বলল যে এরিস্ট্যান্ডার বাধ্য হয়ে অন্তঃপুর ত্যাগ করলেন।

    ইতিমধ্যে নিকোম্যাকাস নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঈষদুষ্ণ জল নিয়ে ক্রমাগত অলিম্পিয়াসের পেটে চাপ দিতে শুরু করেছেন। প্রসব বেদনা উঠেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই গর্ভের ভিতরে থাকা জল ভেঙে গেছে। এইমুহূর্তে ক্রমাগত নিচের দিকে চাপ দিয়ে শিশুকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করাটাই চিকিৎসকের কাজ। শিশু যেন কোনোমতেই গর্ভের মধ্যেই শ্বাসরোধ হয়ে মারা না যায়, তাই নিকোম্যাকাস ক্রমাগত অলিম্পিয়াসকে বলতে লাগলেন, "আরও জোর দিন!! নিচের দিকে ঠেলুন!! চেষ্টা করে যান!"
    অন্তত মিনিট খানেক চেষ্টা করার পর অবশেষে অলিম্পিয়াস সন্তান প্রসব করলেন। পুত্রসন্তান।
    ম্যাসেডনের রাজসিংহাসনের আরেক দ্বিতীয় দাবিদার। প্রথমজনের পৃথিবীতে আগমনের মাত্র আট মাসের মধ্যেই তার সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী আগত হলো।
    সন্তানের জন্মের মুহূর্তেই যেন একটা তীব্র ধাক্কায় ম্যাসেডনের মাটি কেঁপে উঠল। প্রাসাদের অশ্বশালায় রাখা ঘোড়ার চিৎকারে ও সৈন্যদের হৈচৈ শুনে প্রাসাদের বাইরে হঠাৎ পড়ে যাওয়া হুড়োহুড়ির আঁচ পেল ল্যানিকে।

    ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে উঠে নিকোম্যাকাসের খেয়াল হল , এ কি! বাচ্চার জন্মের পর তার কোনো হৃদস্পন্দন নেই কেন? কোনরকমের কান্নার আওয়াজও নেই! স্বাভাবিক রক্তবর্ণের বদলে এই শিশু যেন অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাশে। নিকোম্যাকাসের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। রানী অলিম্পিয়াস কি মৃত সন্তানের জন্ম দিলেন?
    ল্যানিকে কে ডেকে রাজবৈদ্য আদেশ দিলেন এই মুহুর্তেই দুটি পাত্রের একটিতে গরম আরে আরেকটিতে ঠান্ডা জল নিয়ে আসার জন্য। সদ্যোজাত শিশুকে হাতে নিয়ে একবার গরম জলে, একবার ঠান্ডা জলে বারকয়েক চুবিয়ে যতক্ষণে নিকোম্যাকাস প্রায় হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, তখনই হঠাৎ যেন শিশুর শরীরের রক্তিম আভা ফিরে আসতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষার পরে শিশু রাজপুত্রের প্রথম ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেল।
    ইতিমধ্যে শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করতে করতে নিকোম্যাকাস অলিম্পিয়াসের কথা ভুলেই গেছিলেন প্রায়। প্রসবের পরপরই অলিম্পিয়াস যেন একদম ঝিমিয়ে পড়েছেন। শিশুপুত্রের প্রথম কান্না শোনার সুযোগ তাঁর হয়নি।
    রাজপুত্রকে ল্যানিকের কোলে দিয়েই রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাস রানী অলিম্পিয়াসের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় রত হলেন।

    ল্যানিকে রাজপুত্রকে কোলে নিতেই রাজপুত্রের কান্না যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। কয়েক মাস আগেই শিশুকন্যা জন্ম দেওয়া ল্যানিকে বুঝতে পারলো যে শিশু তার প্রথম দুধের তেষ্টায় কেঁদে উঠেছে। তাই, কতক্ষণে অলিম্পিয়াস চেতনা ফিরে পাবেন এবং সন্তানকে স্তন্যপান করাবেন, তার জন্য অপেক্ষা না করে ল্যানিকে নিজেই শিশু রাজপুত্রের মুখে স্তন্য তুলে দিলেন।
    এদিকে অলিম্পিয়াসের চেতনা না ফিরলেও তিনি বিপন্মুক্ত।
    নিকোম্যাকাস মা ও সন্তানকে ল্যানিকের দায়িত্বে রেখে তার নিজের জন্য বন্দোবস্ত করে রাখা ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ল্যানিকেকে বলে গেলেন, কোনোরকম বিপদ বা অসুবিধা হলে যেন তৎক্ষনাৎ তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়।

    এদিকে ভূমিকম্পের ফলে পটিডিয়ার পরিখা এবং দেওয়াল, যা এতদিন ম্যাসেডনীয় আক্রমন প্রতিহত করে এসেছিল, হঠাৎই ভেঙে পড়ল। বৃষ্টি, দুর্যোগ মাথায় নিয়েই অসুস্থ ফিলিপ আনতিগোনাসকে আদেশ দিলেন আক্রমন করার জন্য।
    আনতিগোনাস ম্যাসেডনীয় বাহিনীর কেবল অর্ধেক সেনা নিয়েই ভাঙা পাঁচিলের বাকিটুকু মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।
    রাত পেরিয়ে ভোর হতে না হতেই ম্যাসেডনীয় সেনাবাহিনী পটিডিয়া দখল করে ফেলল। থেসালির তটভূমি এখন থেকে ম্যাসেডনের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল।

    পশ্চিমে এপিরাস থেকে পূর্বে থ্রেস, উত্তরে ড্যাসিয়া, বলকান পর্বত থেকে দক্ষিণে থেসালি অবধি ম্যাসেডনীয় সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার মধ্যেই ফিলিপের শিবিরে দূতের মাধ্যমে খবর এলো, ম্যাসেডনের রাজপুত্রের জন্ম হয়েছে। মা ও সন্তান উভয়েই এখন সম্পুর্ন সুস্থ।

    সাম্রাজ্য বিস্তারের মত এমন শুভদিনে সন্তানের জন্মের খবর পেয়ে ফিলিপ মনে মনে পুত্রের নাম স্থির করে ফেললেন: "আলেক্সান্ডার", মানবজাতির রক্ষাকর্তা!

    ৶৶৶৶৶

    (...ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৩২369958
  • #যবনিকা

    পর্ব ১৪

    ।।৪।।
    পেল্লার রাজপ্রাসাদে রাজকুমার এরিডিয়াস এবং অলেক্সান্ডারের জন্ম উপলক্ষ্যে উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। সমগ্র উত্তর ম্যাসেডন নিজের কুক্ষিগত করে ফিলিপ বেশ কিছুদিনের জন্য প্রাসাদে অবস্থান করবেন। নিজের অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করে নেওয়া এবং সেনাবাহিনীকেও কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। ম্যাসেডনীয় সেনা অনেকদিন ধরেই ক্রমাগত যুদ্ধ করে গেছে। তাদের বিশ্রাম দরকার। বসে থাকলেই যেমন তাদের মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব দেখা দেয়,তেমনই ক্রমাগত লড়াইতে ব্যস্ত থাকতে গেলে তাদের পরিবারকে সময় দেওয়াও সম্ভব হয় না। সৈন্যদেরও পরিবার আছে, তাদেরও বংশ বিস্তারের প্রয়োজন। না হলে পরবর্তীকালে ম্যাসেডনের সেনা কি করে নিজের গৌরব ধরে রাখবে? তাই, যেসব সেনাদল পটিডিয়া এবং এপিরাস-ইলিরীয় সীমান্তে লড়াই করছিল,তাদেরকে ফিলিপ ম্যাসেডনে ডেকে নিলেন এবং তার পরিবর্তে ম্যাসেডনে অবস্থানকারী অন্য দুটি সেনাদল ওই এলাকাগুলো ধরে রাখার কাজে নিযুক্ত হয়ে যাত্রা শুরু করল।
    ইতিমধ্যে পারমেনিও ফিরে এসেছেন পেল্লায়। গতবছরের বসন্তের ফসল তুলতে যখন ব্যস্ত ম্যাসেডনীয় রাজপরিবার, পারমেনিওর ঘরেও নতুন সুখের সংবাদ। আলেক্সান্ডার এর জন্মের ঠিক সাতদিন পরে পারমেনিওর ঘরেও ছেলে হয়েছে। পারমেনিও তার নাম রেখেছেন ফিলোটাস। বড় ছেলে নিকানোরের এখন প্রায় দশ বছর বয়স। তার ভাইয়ের জন্ম হওয়ায় সেও খুব খুশি। নিজের দুই ছেলের জন্ম এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি পারমেনিওর ঘরে সন্তান জন্মানো, এই দুটো উপলক্ষ্য কে স্মরণীয় করে রাখতে এবং সেনাবাহিনীর এই বিশ্রামের সময়ে কিছুটা উৎসব ও আনন্দের স্বাদ দিতেই ফিলিপ ঠিক করলেন যে এইসব সন্তানদের জন্মের উৎসব পালিত হবে।
    পেল্লা জুড়ে তাই খুশির মেজাজ।

    ম্যাসেডনের প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকার মেষপালক থেকে আরম্ভ করে থ্রেসের সীমান্তে থাকা আধা-বর্বর উপজাতি, থেসালির অশ্ব ব্যবসায়ীর দল থেকে শুরু করে এপিরাসের রাজকুমার,অলিম্পিয়াসের ছোট ভাই ও ভবিষ্যতের রাজা আলেক্সান্ডার মোলোসিস সবাইই এই উৎসবে সামিল হতে চলে এসেছেন।
    পেল্লার রাজপ্রাসাদে যাওয়ার রাস্তার দুইধারে বসানো হয়েছে পাথরের ফলক। প্রতিটা ফলকে অর্গিয়াদ রাজবংশের পূর্ববর্তী রাজাদের কৃতিত্ব ও কীর্তির কথা বর্ননা করা আছে। কোনও ফলকে আবার ইলিয়াড, অডিসি থেকে গ্রীকবীরদের বীরত্বের গাথা খোদাই করা। কোথাও আবার রাস্তার দুদিকে এক ওপরের মুখোমুখি দন্ডায়মান সিংহ। পেল্লা শহরের সব ঘোড়ার গাড়ি এবং ঘোড়াগুলিকে সাজানো হয়েছে জলপাইয়ের পাতা দিয়ে। এমনকি অশ্বারোহী বাহিনী এবং গাড়িচালকের জন্য রয়েছে বিশেষ জলপাই পাতার মুকুট। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হলেও ফিলিপ তিন মাসের জন্য কৃষকদের কর মকুব করে দিয়েছেন। মোটামুটিভাবে বলাই যায় যে গ্রীসের উত্তরে এখন আনন্দের,উৎসবের আমেজ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে গেছে। বসন্তের হাওয়া আবার বইছে। মাঠের ফসল খামারে উঠে গেছে। সবমিলিয়ে প্রকৃতিও যেন ম্যাসেডনকে ঢেলে সমৃদ্ধি দান করছেন।

    প্রাসাদের বাগানে বারোজন গ্রীক দেবদেবীর মূর্তি বসানো হয়েছে। সেনাবাহিনী আজকে তাদের উৎসবের জন্য রাখা বিশেষ বর্ম ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পারস্যের গালিচা বিছানো বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে।

    পেল্লার স্টেডিয়ামের কাজ কিছুদিন আগেই সম্পন্ন হয়েছে। ফিলিপ তাঁর পুত্রদ্বয়ের জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে আজ সেই স্টেডিয়ামেই দেখা দেবেন। সাধারণ মানুষ বসে আছে গ্যালারিতে। স্টেডিয়ামের পথের দুধারে সেনাবাহিনীর প্রহরা। একে একে দু চাকার র্থে চেপে আগমন ঘটল ম্যাসেডনের রাজপ্রাসাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের। একে একে ঢুকলেন রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাস, রাজপুরোহিত এরিস্ট্যান্ডার, মুখ্যমন্ত্রী এন্টিপ্যাটার, সেনাপতি আনতিগোনাস এলেন সঙ্গে ছোট্ট নিয়ার্কাসকে কোলে নিয়ে। ল্যাগাসের সাথে এলো তার ছেলে টলেমি, আমিন্টোর এর সাথে পুত্র হেফায়শ্চিয়ন।

    শোভাযাত্রার শেষ অংশে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন সপরিবার পারমেনিও, তাঁর পিছনের রথে এলো ধাত্রী ল্যানিকে,তার ছোট ভাই ক্লাইটাস, এবং পরবর্তী রথগুলিতে এলেন মোলোসিস বংশের রাজপুত্র,রাজশ্যালক আলেক্সান্ডার। সবার শেষ রথটি আকারে বেশ বড়। চারটে চাকা, এবং চার চাকাওয়ালা। তাতে বসে আছেন ফিলিপ এবং তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছেন দুই রানী ফিলিনা এবং অলিম্পিয়াস। ফিলিনার কোলে এরিডিয়াস। তার বয়স আট মাস হলেও আকারে এখনও বেশ ছোট। সেই তুলনায় অলিম্পিয়াসের কোলে থাকা ছোট্ট আলেক্সান্ডার অনেকটাই চনমনে। মাঝেমধ্যে মায়ের কোলে বসে তার দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে হাসির আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
    তাদের রথের পিছনেই সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে এলো ষোলো থেকে আঠারো ফিট লম্বা বর্শাধারী ম্যাসেডনের গর্বের সম্পদ আর শত্রুর বিভীষিকা, ফ্যাল্যাংক্স।
    একে একে সবাই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার পরে শুরু হল অনুষ্ঠান।

    ফিলিপ সবার মাঝখানে এলেন, দুই হাতে পাঁজাকোলা করে ধরে রাখা এরিডিয়াস আর আলেক্সান্ডার। জনগনের উল্লাস,চিৎকারের মধ্যেই জনগনের দেখার সুবিধার্থে দুই পুত্রকেই এক এক হাতে উপরে তুলে ধরলেন। প্রজাদের উল্লাস যেন বাঁধ ভাঙলো। শুরু হলো সঙ্গীত বাদকদের বাজনা। কেউ কেউ নানান রকমের তারের যন্ত্র বাজাতে লাগল, কেউ বাজালো দুমুখো বাঁশি, কেউ বা হাতে রাখা ছোট ছোট চামড়ার ড্রাম বাজিয়ে সঙ্গত দিল। ম্যাসেডনের নর্তকীদের দলের নাচ চলাকালীন ফিলিপ তার সমবয়স্ক বন্ধুদের সাথে স্টেডিয়াম ছেড়ে নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন।
    প্রাসাদে আজ মদের ফোয়ারা ছুটবে। ম্যাসেডনীয়রা গ্রীকদের মধ্যে যেমন সর্বোৎকৃষ্ট মদ বানায়,তেমনই জল না মিশিয়েই কয়েক পিপে মদ খেতে তারা সিদ্ধহস্ত।

    ফিলিপ,আনতিগোনাস প্রমুখরা আজকে সব চিন্তা ভুলে নিজেদের মদের সাগরে ডুবিয়ে দেবেন। তাদের সঙ্গত দিতে এসে গেছে গ্রীক দেহপসারিনীদের দল। আজ সারারাত মদের ফোয়ারার পাশে রূপ আর অবাধ যৌনাচারের ঢেউ আছড়ে পড়বে পেল্লার রাজপ্রাসাদে।

    আজ উৎসবের দিন। উৎসবের রাত।
    কালকের সমস্যা কালকেই সমাধান করা যাবে।
    এটাই গ্রীক জীবন।

    ****

    (...ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৩৭369959
  • #যবনিকা

    পর্ব ১৫

    ****
    শীত আসতে আসতে মহারানী অলিম্পিয়াস বুঝতে পারলেন যে এরিডিয়াসের সম্পর্কে তাঁর অনুমান সম্পুর্ন ঠিক নয়।
    গ্রীষ্মের শেষদিকে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে বড় রাজপুত্র এরিডিয়াস। রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাসও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। রানী ফিলিনা তার প্রথম পুত্রকে প্রায় হারাতে বসেছিলেন, ঠিক সেইসময়েই অপ্রত্যাশিত সাহায্যের হাত বাড়ালেন মহারানী অলিম্পিয়াস।
    অলিম্পিয়াসকে কোনোদিন কেউই প্রাসাদে ঘুরে বেড়াতে দেখেননি। সারাবছরই প্রায় নিজের অন্তঃপুরে সাপের মধ্যে থাকাটাই তাঁর স্বভাব। এইভাবে নিজেকে আলাদা করে রাখার কারণেই অলিম্পিয়াস ম্যাসেডনের প্রাসাদে একরকমের রহস্যময়ী জাদুকরীর ধারণা জন্ম দিয়েছেন। ল্যানিকে ছাড়া আর কাউকে তিনি ভরসা করেন না। আর কেউই অলিম্পিয়াসের সামনে পড়তে চায় না। মহারানীর মেজাজ ঠিক কিরকম সেটাই প্রাসাদের কর্মচারীরা জানে না। তাই এরকম হঠাৎ করে ফিলিনার ঘরে এসে মহারানী দেখা দেবেন,এটা কেউই ভাবেনি।

    যা হোক, অলিম্পিয়াস এলেন, তাঁর পিছনেই ল্যানিকে কোলে শিশু আলেক্সান্ডারকে নিয়ে দাঁড়াল। রাজবৈদ্য নিকোম্যাকাসও অলিম্পিয়াসকে আলেক্সান্ডারের জন্মের উৎসবের পরে এই দ্বিতীয়বার জনসমক্ষে দেখলেন। তিনিও খানিকটা আশ্চর্য হয়েছেন। অলিম্পিয়াস ফিলিনার ঘরে ঢুকতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। দুই রানীর কথোপকথনের মাঝে থাকা তাঁর কাছে শোভনীয় নয়।
    রানী এসে শিশু এরিডিয়াসের বিছানার পাশে বসলেন। ফিলিনাকে ডেকে বললেন, "তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট, তাই কোনরকম রাজকীয় সম্মান না দেখিয়েই তোমায় বলছি। যদি নিজের ছেলেকে বাঁচাতে চাও,তাহলে আমি যেমন যেমন বলব,তেমন তেমন কাজ করতে হবে।"
    নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া ফিলিনা বলল, "মহারানী,আপনি যদি সত্যিই আমার ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেন,তাহলে আজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকব।"
    "বাজে কথা বলে সময় নষ্ট না করে ছেলেকে আমার হাতে দাও।"

    ফিলিনা অনন্যোপায় হয়ে অলিম্পিয়াসের হাতে মৃতপ্রায় সন্তানকে তুলে দিলেন। অলিম্পিয়াস এরিডিয়াসের শিথিল হয়ে আসা ছোট্ট দেহটাকে তুলে নিলেন এবং নিজের ঘরে এসে যথারীতি দরজা বন্ধ করে দিলেন। দরজা বন্ধ করার আগে ল্যানিকেকে বলে গেলেন, "কেউ যেন এদিকে না আসে। ফিলিনাও নয়। খেয়াল থাকে যেন!"
    নিজের বিছানা থেকে সাপগুলোকে সরিয়ে দিয়ে অলিম্পিয়াস এরিডিয়াসকে একটা বালিশে মাথা দিয়ে শোয়ালেন।
    ঘরের অন্যদিকে রাখা একটা বেশ বড় মাপের পিপের কাছে গিয়ে পিপের ঢাকনা খুলে অলিম্পিয়াস তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে খব স্বচ্ছন্দ্যে বের করে আনলেন একটা কালকেউটে।
    একটা ছোট বাটির কানায় সাপের মুখটা লাগিয়ে হালকা চাপ দতেই তার মুখটা খুলে গেল। দুই দাঁতের পিছনে থাকা বিষের থলি থেকে মাপা হাতে কেবল এক ফোঁটা করে বিষ ঢেলে নিলেন অলিম্পিয়াস সেই বাটিতে থাকা দুধে। হালকা সোনালী রঙের বিষ বাটির সাদা দুধে মিশে গেলে ঝিনুক বাটিতে করে ধীরে ধীরে কয়েকবার ওই দুধ অলিম্পিয়াস তুলে দিলেন ছোট্ট এরিডিয়াসের মুখে। অসুস্থ,ঝিমিয়ে পড়া এরিডিয়াস ওই দুধ ধীরে ধীরে ছোট্ট জিভ বের করে খেয়ে নিতে লাগল।
    ঘন্টা খানেক শুইয়ে রাখার পরে যেন এরিডিয়াসের ঝিমিয়ে পড়া শরীরে একটু একটু করে প্রানের সঞ্চার হতে লাগল। যেই মুহূর্তে অলিম্পিয়াস বুঝতে পারলেন যে এরিডিয়াস এখন বিপদসীমার বাইরে এসে গেছে,তিনি ল্যানিকের কোলে এরিডিয়াসকে তার মায়ের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
    "রানীমা বলে পাঠিয়েছেন যে আপনার ছেলে এখনো সম্পুর্ন সুস্থ হয়নি। আপাতত তাকে বাঁচিয়ে রাখার মত ওষুধের বন্দোবস্ত উনি করে দিয়েছেন। রানীমা এটাও জানিয়ে দিতে বলেছেন যে আপনার ছেলেকে এখন থেকে অন্তত আগামী এক মাস এই ওষুধ খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন সকালবেলা এরিডিয়াসকে আমি এসে রানীর ঘরে নিয়ে যাবো,আর ওষুধের প্রভাব চালু হলে আপনার কাছে ফেরত দিয়ে যাব।" অলিম্পিয়াসের আদেশমত ল্যানিকে ফিলিনাকে কথাগুলো জানিয়ে দিলো।

    ফিলিনা ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পেয়ে অলিম্পিয়াসের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো। তার ধারণা ছিলো, রানী অলিম্পিয়াস অত্যন্ত নিষ্ঠুর একজন মহিলা,যিনি হয়তো মাস খানেকের ছোট্ট শিশুকেও হত্যা করতে পিছপা হবেন না। তার ওপর রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলেও নোংরা রাজনীতি চলে। নিজের ছেলেকে রাজসিংহাসনের দাবীদার প্রতিপন্ন করতে এরিডিয়াসকে সরিয়ে দেওয়াটাই অলিম্পিয়াসের কাছে খুব যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তিনি তা না করে রাজবারোর জ্যেষ্ঠ রাজকুমারকে বাঁচিয়ে তুললেন,এটা ভেবেই সরল মনে ফিলিনা অলিম্পিয়াসের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল।

    এদিকে দিনের পর দিন এভাবে ওষুধের অছিলায় এরিডিয়াসকে দুধের মধ্যে বিভিন্ন সাপের বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো অভ্যাসে পরিণত করলেন। ধীরে ধীরে এরিডিয়াস আর আলেক্সান্ডার প্রায় সমান্তরাল ভাবে বড় হতে লাগল। কিন্তু আলেক্সান্ডারের এক বছর বয়স হতে হতেই দেখা গেল তার তুলনায় এরিডিয়াস অনেকটাই আকারে এবং অভিব্যক্তি প্রকাশে বেশ পিছিয়ে। এরিডিয়াস যতক্ষণে হাঁটতে শিখল,ততক্ষনে ছোট্ট আলেক্সান্ডারের মুখে বুলি ফুটে গেছে। সে এখন তার মা আর ধাত্রী ল্যানিকেকে ডাকতেও পারে।
    তবে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় দেখা গেল,সেটা হচ্ছে এদিকে যেমন এরিডিয়াস ক্রমাগত মাসের পর মাস অলিম্পিয়াসের দেওয়া সাপের বিষ মেশানো ওষুধ খেয়ে তার ওপর ভয়ানক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তেমনিই আলেক্সান্ডার তার মায়ের ঘরে থেকে ভয়ানক বিষধর সাপ হাতে নিতে ভয় পায় না। এবং যেন কোন এক মন্ত্রবলে অলিম্পিয়াসের পোষ্য সাপগুলোও আলেক্সান্ডারের সামনে একদম নির্জীব,নিরীহ প্রাণীর মত পড়ে থাকে। একদিকে যেমন এরিডিয়াস দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ না পেলে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, অন্যদিকে আলেক্সান্ডার তার মায়ের কোলে সাপের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমায়।

    দুই রাজপুত্র দুইরকম চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগল এবং এই সময়ের মধ্যে একবারও ফিলিপ তাদের সেভাবে কাছে থেকে দেখবার সুযোগ পাননি। ইতিমধ্যেই ফিলিপ থ্রেস রাজ্যকে মিজের পদানত করে স্থানীয় রাজকন্যা মেডা কে বিয়ে করলেন। তাঁর রাজপ্রাসাদে এখন মোট ছয়জন রানীর অন্দরমহল তৈরি হল। যদিও অলিম্পিয়াস এই বিবাহের খবরে খুশি ছিলেন না। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে মেডা কে বিয়ে করে সন্তান লাভ করলেও সেই সন্তান ম্যাসেডনের রাজপুত্র হতে পারবে না, কারন ফিলিপ আগে থেকেই থ্রেসের রাজার কাছে প্ৰতশ্রুতিবদ্ধ যে মেডার পুত্রসন্তান থ্রেসের সিংহাসনের অধিকারী হবে যেহেতু থ্রেসীয় রাজবংশে এই প্রজন্মের কোন ছেলে নেই।

    মেডার সাথে বিবাহ সম্পন্ন করে অন্তত এক বছর পর ফিলিপ অলিম্পিয়াসের ঘরে এলেন।
    ঘরে ঢুকে নিজের ছেলে আলেক্সান্ডারকে সাপের মাঝখানে বেষ্টিত হয়ে থাকতে দেখে প্রথমেই ঘাবড়ে গেলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ফিলিপ। একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা ছেলেকে কি করে তার মা এরকম ভয়ানক বিষাক্ত সাপের মাঝখানে রাখতে পারে? নিজেকে ধাতস্থ করেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন মহারানী অলিম্পিয়াসকে লক্ষ্য করে।
    "তোমার কি সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান নেই? আমার ছেলেকে তুমি সাপের মাঝখানে রেখেছ কেন?" অলিম্পিয়াসকে নিস্পৃহ থাকতে দেখে তিনি চেষ্টা করলেন আলেক্সান্ডারকে ওই সাপের মধ্যে থেকে বের করে আনতে,কিন্তু মেঝেতে পড়ে থাকা সাপগুলোকে দেখে তাঁর সর্প-ভীতি আবার ফিরে এলো। তিনি পিছিয়ে এলেন কয়েক পা।
    "এইজন্যই! ঠিক এইজন্যই আমার ছেলেকে আমি এখন থেকেই সাপের মাঝখানে থাকার শিক্ষা দিচ্ছি। তুমি নিজেকে বিরাট বড় বীর মনে করতেই পারো,ফিলিপ। কিন্তু এই একটা ভীতি তোমাকে কোনোদিনই শ্রেষ্ঠ হতে দেবে না। আর দেখো,আমার ছেলেকে, সে একদিন বিশ্বজয় করবে। সে তোমার থেকেও বড় বিজয়ী হবে। আর একজন বিজয়ী বীরের কোনো বিষয়ে ভীতি থাকাটাই লজ্জার। আমার ছেলেকে আমি দুঃসাহসী হিসেবে গড়ে তুলব। তার শরীরে ভয়,ভীতি বলে কোনকিছু থাকবে না।"
    "তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ,অলিম্পিয়াস!!! একটা দেড় বছরের বাচ্চাকে বিষধর সাপের মাঝখানে রেখে তুমি তাকে বিশ্বজয়ী বীর বানাতে চাও? এভাবে তার ভীতি কাটবে? অলিম্পিয়াস, তোমার পোষ্যগুলো কুকুর,বিড়াল নয় যে সামান্য আঁচড়ে বা কামড়ে দেবে। এগুলো সাপ। যেকোন সময় ওকে ছোবল দিতে পারে,অথবা পেঁচিয়ে মেরে ফেলতে পারে। তুমি ঠিক কি চাইছো, বলো? এইসব পাগলামি থামাও,রানী! নইলে আমি বাধ্য হব আমার ছেলেকে তোমার কাছ থেকে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ যার করতে। তুমি চাও সেটা হোক?"
    "ফিলিপ, ভুলে যেও না ও আমারও সন্তান। ওর ধমনীতে আমার রক্তও বইছে। আর আমার রক্তে সাপের বিষ রয়েছে। আমার ছেলের সামনে অতি বিষধর সাপও মাথা নত করে থাকবে। আর যেদিন তুমি আমার কাছ থেকে আমার ছেলেকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করবে, সেদিন তোমার জীবন থেকে আমিও নিজেকে চিরকালের মত সরিয়ে নেব। সেদিন তোমার কাছে কেবল সাম্রাজ্য থাকবে, সম্মান, ভালোবাসা থাকবে না।"
    অলিম্পিয়াসের সাথে কথা না বাড়িয়ে ফিলিপ নিজেকে চুপ রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু,আলেক্সান্ডারকে সাপের মাঝখান থেকে সরাতে না পেরে এবং নিজের ব্যস্ত সময়ের থেকে কিছুক্ষনের জন্য অলিম্পিয়াসের ঘরে একফোঁটা শান্তির খোঁজে এসেও শান্তি অধরা রেখেই ফিলিপ ফিরে গেলেন নিজের ঘরে।
    আজ আর রাতে তাঁর ঘুম আসবে না।
    ****
    (...ক্রমশ)
  • Ankur Chakraborty | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:৪৮369960
  • #যবনিকা

    পর্ব ১৬

    প্রায় একবছরের মত সময় লেগে গেল ফিলিপের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে। রাজপ্রাসাদের ভিতরের রাজনীতি অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রের আর কূটনীতির রাজনীতিই শ্রেয় মনে করে ফিলিপ আবার নতুন করে নিজের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় মেথোনী শহর আক্ৰমনের সিদ্ধান্ত নিলেন।

    মেথোনী মূলতঃ এথেনীয় উপনিবেশ। থেসালি এবং ম্যাসেডনের সীমান্তে অবস্থিত বন্দর শহর হওয়ায় ম্যাসেডনের কাছে এটাই দখল করবার মত শেষ এথেনীয় বন্দর। যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই খবর আসছিল আনতিগোনাসের সেনাবাহিনীকে অনেকটাই করা চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁত করিয়ে দিয়েছিল শহরে অবস্থানকারী হাজার পাঁচেক এথেনীয় সৈন্য। খুব সম্প্রতি গ্রীসের সমুদ্র এলাকায় একের পর এক এথেন্সের নৌবাহিনীর পরাজয়ের খবরের মধ্যে এটাই একমাত্র ভালো খবর ছিল যে মেথোনী সামান্য কিছু সৈন্যশক্তি নিয়েও ম্যাসেডনের ভয়ানক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মুখে লড়াই করে যাচ্ছিল। কিন্তু পটিডিয়ার মত এখানেও এথেনীয় রাজনীতিবিদগন অবিবেচকের মত কাজ করলেন। যখন কোন প্রভাবশালী সেনাপতির নেতৃত্বে একটা পদাতিক বা নৌবাহিনী পাঠালেও আনতিগোনাসকে চাপে রাখা যেতে পারতো, তখন তা না করে এথেনীয় নেতৃবর্গ ইতালির সাইরাকিউজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ফয়সালা নিয়ে বিচার বিবেচনা করতে মশগুল। সাইরাকিউজে প্লেটোর এক প্রাক্তন ছাত্র ডিওন অত্যাচারী শাসক হয়ে ওঠার ফলে তারই এক সহপাঠী ক্যালিপ্পাস তাকে কিছু গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে সপরিবার হত্যা করে। যেহেতু ক্যালিপ্পাস ও ডিওন দুজনেই এথেনীয় বংশোদ্ভূত, তাই এই বিষয়ে এথেন্সের কি অবস্থান হতে পারে, এই নিয়ে আলাপচারিতা চালাতে থাকে এথেনীয় নেতৃবর্গ।
    এই ঘটনা আসলে ফিলিপের পক্ষেই কালের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে দেয়। ফিলিপ যেই মুহূর্তে বুঝতে পারলেন যে এক আনতিগোনাসের পক্ষে এথেনীয় আক্রমন প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না,তিনি নিজেই রাশ হাতে তুলে নিলেন এবং মেথোনী আক্রমন করে বসলেন। দুদিক থেকে দুই দল ম্যাসেডনীয় সেনার সাথে লড়তে হতে পারে, এথেন্সের সেনাবাহিনী দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি এবং তার ফলস্বরূপ মাত্র দিন তিনেকের মত প্রতিরোধ তুলতে সক্ষম হলেও চতুর্থ দিন প্রথম বেলাতেই এথেনীয় সেনাবাহিনীর শেষ প্রতিরোধটুকুও তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। এতদিন ফিলিপ এথেন্সের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও তাদের এলাকাগুলো হয় নিজের কুক্ষিগত করেছিলেন অথবা এথেন্সকে সেখান থেকে ফিলিপকে কর দিতে বাধ্য করেছিলেন। এই প্রথমবার, সমগ্র ম্যাসেডন নিজের পদানত করার গর্বেই হোক, বা এথেন্সের কাছে নিজের ভয়ানক ভাবমূর্তি তুলে তাদের শহরবাসী এবং নেতৃবর্গের কাছে বার্তা পাঠাতেই হোক, ফিলিপ আদেশ দিলেন সমগ্র মেথোনী শহর এবং বন্দরকে জ্বালিয়ে দিতে। সকালের পরাজয়ের পরেও এথেনীয় বাহিনী ভাবতে পারেনি যে এভাবে ফিলিপ তাদের গোটা শহর ও বন্দর ধ্বংসের আদেশ দেবেন। এথেনীয় সৈন্য ও তাদের পরিবারের তীব্র আর্তনাদ ও হাহাকারের মধ্যে দিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে মেথোনী শহর চিরতরে গ্রীসের মানচিত্র থেকে মুছে দিলেন ফিলিপ।

    জ্বলে যাওয়া,পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ কানে পৌঁছনো থেকে আটকাতে ফিলিপ নিজের তাঁবুতে পৌঁছে আকন্ঠ মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটা গোটা শহর জ্বালিয়ে দিয়ে রাজা ফিলিপ মানসিক শান্তি পেলেন কি না জানা নেই,তবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে বাস্তব জগতের রাজনীতির থেকে নিজেকে এক রাতের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে রাখলেন। ম্যাসেডন সেনাবাহিনীর সেনারা পৈশাচিক উল্লাসে মানুষের হাহাকার ঢেকে দিতে ব্যর্থ চেষ্টা করল, আনতিগোনাস সামনের টিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করলেন গত একশো বছরের বেশি সময়ে গ্রীসের মাটিতে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় সামরিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের দৃশ্য।

    মেথোনীর ইট-কাঠ-পাথরের ধোঁয়া মুছে যেতে না যেতেই এথেন্সের রাজনীতির ভিত একের পর ধাক্কায় কেঁপে উঠল।
    ডেলফির এপোলো মন্দিরের ধনসম্পত্তি লুঠ করে মধ্য গ্রীসের ফোকিস নগরীর নেতা ফিলোমেলাস নিজেকে এথেন্সের দ্বিতীয় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাহির করতে আরম্ভ করল। সুদূর উত্তরে ম্যাসেডনের ফিলিপ আর মধ্য গ্রীসে এই নতুন শত্রুর উত্থানে ডেমোসথেনিস এবং ইস্কিনেস সাময়িকভাবে হলেও জোট বাঁধলেন। এবং রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে আবেদন জানালেন ডেমাডেসকে এথেন্সে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে। জ্বালাময়ী ভাষণ এবং কূটনীতির মাধ্যমেই কেবল এথেন্সের মানুষকে তাদের রাজনৈতিক নিস্পৃহতা থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হলেন এই তিন বক্তা।

    পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠল যে দিকে দিকে এথেনীয় বাহিনীর পরাজয়ের খবরে করিন্থ, স্পার্টা কোনো গোষ্ঠীই এথেন্সের সাথে হাত মেলাতে রাজি হলো না। ডেলফির মন্দিরের এহেন অপমান প্রতিহত করতে একমাত্র ফোকিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই এথেন্স তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে ভেবে বসল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবর্গ জনগনের মতের সম্পুর্ন বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরাই ডেলফির লুন্ঠিত সম্পদের সিংহভাগ লাভের আশায় যে ফোকিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা ভেবেছিলেন, কেবলমাত্র ম্যাসেডনের সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে খন্ডন করতে সেই ফোকিসের সাথেই জোট বেঁধে ফেলল। এথেনীয় সেনাপতি ওনোমার্কাস ইস্কিনেসের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন এবং ম্যাসেডনের বিরুদ্ধে লড়তে হলে এবং আরও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে হলে ডেলফির সম্পদ কতটা দরকার সেটা বাকি নেতৃবর্গকে বোঝাতে সফল হলেন। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন ডেমোসথেনিস। তিনিও নিজের অবস্থান বদলে সেনাপতি ওনোমার্কাসকে সমর্থন করলেন এবং এথেনীয়রা তাদের চিরশত্রু স্পার্টাকেও এই সংগ্রামে নিজেদের দলে টেনে নিতে সক্ষম হল। ফোকিস,এথেন্স,স্পার্টা এবং ফেরাই, এই চারটি নগর-রাষ্ট্র নিজেদের সাময়িকভাবে একজোট করতে সমর্থ হলে ফিলিপ বুঝতে পারলেন যে তাঁর সমগ্র গ্রীস জয়ের আশা বিনা বাধায় বাস্তবায়িত হবে না। ইতিমধ্যেই ফিলিপের আগ্রাসী নীতির কারনে ম্যাসেডনের বিরুদ্ধে চারটি নগর-রাষ্ট্র জোট বেঁধেছে, হয়তো এরকম উগ্রতা দেখাতে থাকলে বাকি গ্রীক শহরগুলিও তাঁর বিরুদ্ধে চলে যাবে।
    যে গ্রীসের নাগরিকত্ব ও স্বীকৃতি পেতে ফিলিপের পূর্বপুরুষ আলেক্সান্ডার ফিলহেলেনকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে,সেই গ্রীসেই না ফিলিপ ব্রাত্য হয়ে যান।

    এমনিতেই গ্রীক রাজনীতি কেবলমাত্র বাকচাতুর্যে ভরা। এক দল আরেক দলকে নিজের কাছে টানতে কিছু প্রতিশ্রুতি দেবে আর ব্যাস! নতুন জোট গঠন হয়ে যাবে। তাই ফিলিপ সময়ের চাহিদা অনুধাবন করলেন। বুঝলেন যে এই জোটের বিরুদ্ধে আরেকটা জোট না বাঁধলে তিনি যে গ্রীসের ঐক্যের রক্ষক,সেই বিষয়ে কাউকে বোঝানো যাবে না।

    ফিলিপ স্বয়ং কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে একের পর এক থেসালি,লোকরিস, ডোরিস এবং থিবস নগরীকে নিজের সাথে জোটবদ্ধ হতে রাজী করালেন।
    "ডেলফির অপমান অর্থাৎ সমগ্র গ্রীসের সার্বভৌমত্বের অপমান। ডেলফির মন্দিরের সম্পদ সমগ্র গ্রীসের মানুষের পরিশ্রমের ফল। ফোকিস যেমন সেই সম্পদ লুঠ করে নিজেদের সমগ্র গ্রীসের নজরে দেশদ্রোহী বলে প্রমাণ করেছে, তেমনই এথেন্স আর স্পার্টাও এই কাজকে সমর্থন করে নিজেদের ওই অপরাধের অংশীদার প্রমান করেছে। এই জোটের অনেকেই আমাকে,অর্থাৎ ফিলিপকে কেবলমাত্র ম্যাসেডনীয় হওয়ার কারনে বর্বর, বিজাতীয়, এমনকি বিদেশী বলেও অভিহিত করেছে। অথচ গ্রীসের প্রতি ভালোবাসা আমার তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের তুলনায় কোন অংশেই কম নয়, বরং বেশিই। তাই, মাননীয় প্রতিবেশী নগর-রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আবেদন জানাচ্ছি যে আপনারা আমার এই দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপে সামিল হোন। আপনাদের সম্মতি থাকলে আমি আপনাদের নেতৃত্ব দিতে রাজি আছি এবং ম্যাসেডনের সেনাবাহিনীর ত্রিশ শতাংশ আমি এই সংগ্রামে নিয়োগ করবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এই সংগ্রাম কেবলমাত্র এদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার সংগ্রাম নয়, গ্রীসের চোখে ম্যাসেডনের অপরিহার্যতা বুঝিয়ে দেওয়ার সংগ্রামও বটে।
    মাননীয় বন্ধুগন ও নেতৃবর্গ, আপনারা আমার সাথে থাকুন, তবেই আমরা গ্রীসের ঐক্যকে ধরে রাখতে সক্ষম হব। বলুন, আমি কি আপনাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পেতে পারি?" বলে ফিলিপ নিজের কথা শেষ করতেই সম্মিলিত সৈন্যদল তাদের ঢালের ওপর বর্শা দিয়ে আঘাত করে ফিলিপের প্রতি তাদের পূর্ন আস্থা জাহির করল। ফিলিপ জানতেন যে এখানে উপস্থিত শক্তিবর্গের কেউই ম্যাসেডনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিপদে ফেলতে চাইবে না। সুতরাং যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ফিলিপ একটা নৈতিক জয় পেয়ে গেলেন।

    ডেলফির মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে ফিলিপ প্রায় অর্ধেক গ্রীসের সেনাপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেন অদূর ভবিষ্যতে সমাগত পবিত্র যুদ্ধের জন্য।
    গ্রীক ইতিহাসের ধারা বদলে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ নিলেন ফিলিপ, তৃতীয় পবিত্র যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে। আগামী নয়-দশ বছর ব্যাপী এই যুদ্ধ ভবিষ্যতে গ্রীসের মাটিতে ম্যাসেডনের আধিপত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে। এবং ফিলিপকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রীসের ভাগ্যবিধাতা রূপে তুলে ধরবে জনমানসে।
    ****

    (...ক্রমশ)
  • Du | 7845.184.1256.215 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:১৭369961
  • কোথায় চলে গেলেন ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন