এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বার্লিন! তিন দশকের স্মৃতি

    হীরেন সিংহরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৫৩৯ বার পঠিত | রেটিং ৪.৮ (৪ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    বার্লিন !

    তিন দশকের স্মৃতি

    গোড়ার কথা

    উলানড স্ত্রাসে যেখানে এসে কুরফুরস্টেনডামের সঙ্গে মিশেছে সেখানে হিন্দুস্তান  হৌস নামে একটি কফি হাউস ছিল।

    মনে মনে হোক আর চাক্ষুষ হোক, আমাদের প্রজন্মের বহু বাঙালির  বার্লিন, জার্মানি তথা ইউরোপ দর্শনের সূচনা হয় চাচা কাহিনীর প্রথম পাতায়। পঞ্চাশ বছর পরে হিন্দুস্তান হৌস থাকতে পারে না জেনেও বার্লিনে গিয়ে কিংবদন্তীর খোঁজ করেছি। হিন্দুস্তান হৌস , চাচা কাহিনী আমার মনের ভেতরে থেকে যাবে , যতদিন আছি।  

    ইউরোপে এসেই  ট্রেনিঙ  সূত্রে অল্প দিনের জন্যে কাজ  করার সুযোগ জুটেছিল বার্লিনে।  আমার জার্মানি বইতে সেই চোখে দেখা,  ছুঁয়ে নেওয়া বার্লিনের গল্প বলেছি ,  তাহলে আজ আবার কেন?

    সেই বইতে লিখেছি  টাইম মেশিনে চড়ে এই পৃথিবীর কোন শহরে ফিরে যেতে পারি, যাবো বার্লিনে । ঝরিয়া, পাইকপাড়ার বাড়িতে বসে বাল্য,  যুবা কাল থেকে গত শতাব্দীর ইতিহাসের যে পর্ব এবং স্থানটি  আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে সেটি  তিন দশকের বার্লিন। এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে পতন ও অভ্যুদয়ের  ঘনঘটা আর কোথাও চোখে পড়ে নি । ওয়ান্স আপন এ টাইম নয়, এই সময়কালকে যেন ধরা ছোঁয়া যায় , এই তো সেদিনকার কথা!  নিতান্ত ভাগ্যক্রমে ইতিহাসের এই ঘুরন্ত রঙ্গমঞ্চের সেট,  উইংস,তার পিছনের  দৃশ্য পট  শুধু  চোখে দেখি নি , মঞ্চের মাঝখান দিয়ে হেঁটেছি –কথা বলে ইতিহাস ,  ভিলহেলমস্ত্রাসেতে বিসমার্কের অফিস যেখানে বসে তিনি আফ্রিকা খণ্ড খণ্ড করছেন, হিটলার ওই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মশাল যাত্রা দেখছেন ,  তিরিশে জানুয়ারি ১৯৩৩, এক নম্বর ঊনটার ডেন  লিনডেনে আডলন হোটেল , পারিসার প্লাতস, গ্রুনেভালডের  পথ যেখানে রাথেনাউ প্রাণ হারালেন, ফ্রিডরিখস্ত্রাসে স্টেশন, আপোলো থিয়েটার, আলেক্সান্দার প্লাতস , কুডামে সুবেশ নরনারী : বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়াম এখনও দাঁড়িয়ে , এই তো আজকের সন্ধ্যায় বিসমার্ক আলেতে জ্বলবে আলবার্ট স্পেয়ারের ডিজাইন করা পথবাতি।

    প্রথম পর্ব : অন্ধের নগরী ,   চৌপট রাজা

    আগস্ট ১৯১৮ থেকে ব্রিটিশ,  আমেরিকান , ফরাসি , বেলজিয়ান আক্রমণ ক্রমশ এগিয়ে এসেছে জার্মান সাম্রাজ্য সীমান্তের দিকে –রণক্লান্ত , ক্ষুধার্ত জার্মান সেনাবাহিনী  ক্রমশ পিছিয়ে আসে।  জেনারেলরা সম্রাট ভিলহেলমকে জানান এ যুদ্ধ চালানো অর্থহীন;  কেউ চাইলেন  আমেরিকান বা ফরাসিদের সঙ্গে স্বতন্ত্র সন্ধি চুক্তি । তাতে প্রতিপক্ষ রাজি নন, তাঁরা চান বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ , যুদ্ধ বাধানোর অপরাধে সম্রাটের নিধন। সেনা বাহিনীর শীর্ষে সম্রাট আছেন বেলজিয়ামের  স্পা নগরীতে – নতুন  চ্যান্সেলর মাক্স ফন বাদেন ফোনে অনুরোধ করলেন, আপনি সিংহাসন ত্যাগ করুন।  ভিলহেলম জানালেন আমার দুটো মুকুট , আমি প্রাশিয়ার রাজা এবং জার্মানির সম্রাট , দ্বিতীয়টি ছেড়ে দিতে রাজি আছি কিন্তু  পাঁচশ বছরের হোহেনজলারন রাজবংশের কুলতিলক আমি,  প্রাশিয়ান রাজ মুকুটটি  ছাড়তে রাজি নই ।

    নৌ বিদ্রোহ বন্দরে বন্দরে , কীল , হামবুর্গ থেকে নৌসেনা হাঁটছেন বার্লিনের দিকে ,  মিউনিক এমনকি  বার্লিনের নয় কোয়লন নিজেদের স্বাধীন রিপাবলিক বলে ঘোষণা করেছে -  পার্লামেন্টের  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব তাদের দাবিতে অনড় , সম্রাটের পদত্যাগ চাই ;  প্রাশিয়ান রাজত্ব জার্মান সাম্রাজ্যে মিশে গেছে একটা মুকুট রেখে অন্যটা বিসর্জন দেওয়া যায় না।  সেনাধ্যক্ষ  হিনডেনবুরগের নিজের হিম্মত হল না , অধস্তন অফিসার গ্রোয়নারকে  শিখণ্ডী  করে সম্রাটের কাছে পাঠালেন- প্রভু আপনি দুই মুকুট মাটিতে নামিয়ে রাখুন। 

     আমি এতদ্বারা প্রাশিয়ান রাজমুকুট ও তৎ সংশ্লিষ্ট জার্মান কাইজারের সকল অধিকার পরিত্যাগ করিলাম 

     ভিলহেলম - শেষ রাজ স্বাক্ষর 
     
    ৯ নভেম্বর ১৯১৮ সকাল এগারোটায় স্পা থেকে টেলিফোন বার্তায়  সম্রাট ভিলহেলম তাঁর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে ট্রেনে চড়ে  নিরপেক্ষ হল্যান্ডের ডুরণ রওয়ানা হলেন (আর কোন দিন জার্মানিতে পা দেবেন না , বত্রিশ বছর বাদে ভগ্ন মনোরথ সম্রাট সেখানই চির বিদায় নেবেন)।

    এগারোই নভেম্বর এগারোটা বেজে এগারো মিনিটে প্যারিসের সত্তর মাইল উত্তর পূর্বে কম্পিয়েনে এক নির্জন বনের মাঝে টেনে আনা মার্শাল ফখের নিজস্ব ট্রেনের বগিতে জার্মানি  স্বাক্ষর করলো  সন্ধিচুক্তি-  পশ্চিম রণাঙ্গন হলো নিশ্চুপ।  

    বার্লিন এক অন্ধের  নগরী  ।


    ফিলিপ শাইডেমান রিপাবলিকের ঘোষণা করছেন রাইখসটাগের ব্যালকনি থেকে 
    ৯ নভেম্বর ১৯১৮
     
    পার্লামেন্টের সামনে সমবেত জনতা উত্তাল- এবার তাহলে কি ? পার্লামেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট মন্ত্রী ফিলিপ শাইডেমান সমবেত জনতাকে বললেন

    “ হোহেনজোলারন সম্রাট পদত্যাগ করেছেন । এই দিনটি জার্মান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে । জার্মান প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক ।“

    বিকেলবেলা বার্লিন কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে  কমিউনিস্ট নেতা কার্ল লিবকনেখট একই ঘোষণা করলেন।

    আট ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার বছরের রাজতন্ত্র ধূলিসাৎ হলো ।  রেডিও আসতে চার বছর বাকি, পার্লামেন্টের জানলায় দাঁড়িয়ে একজন বলে দিলেন, জার্মানি এখন এক প্রজাতন্ত্র !

    কেউ একজন বলে দিলেই হয়ে যাবে ?  কী চেহারা নেবে  সেই প্রজাতন্ত্র ? ভোট দেওয়া দূরের কথা , এ দেশের আম জনতা কখনো ভোটের বাকসোই চোখে দেখেনি ? সংবিধান  লেখা হবে নাকি ?

    জুলিয়াস সিজারের শবদেহের সামনে দাঁড়িয়ে , তাঁর  প্রতি  সম্মান জানিয়ে বক্তৃতার শেষে মার্ক অ্যান্টনি, জনান্তিকে  বলেছিলেন, মিসচিফ দাউ আর্ট অ্যাফুট!  

    বার্লিন এক অরাজক শহর । ওপেন সিটি ।


    লড়াই - ফ্রন্টে নয় আপন শহরে 
     
    প্রাশিয়ান রাজতন্ত্রের সাদা কালো লাল,  নতুন জার্মান প্রজাতন্ত্রের লাল কালো হলুদ, কমিউনিস্টদের কাস্তে হাতুড়ি মার্কা বহুবিধ পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামলেন যুযুধান পক্ষ , নৌ বিদ্রোহীরা বার্লিন পৌঁছুলেন,  তাঁদের হেলমেটে  স্বস্তিকা ( হিটলার তখনও নাৎসি পার্টিতে যোগ দেন নি )  , চতুর্দিকে শুরু হলো স্ট্রাইক, যুদ্ধ ফেরত ছিন্ন বস্ত্রধারী  সৈনিক দুটো রুটির জন্যে  বিক্রি করে তার অস্ত্র ,  কমিউনিস্টরা গড়ে তোলে সোভিয়েত, তাঁদের সঙ্গে  স্বেচ্ছা সৈনিকদের ( ফ্রাই করপ্স) খণ্ডযুদ্ধ চলে, দেশের চ্যান্সেলর  বদলায় মাসে মাসে, নভেম্বরের পথ বিপ্লব, অকল্পনীয় দারিদ্র্য , রুটির জন্য সম্মান বিকোয় ঘরে ঘরে , কোটি মূল্যের মার্কের নোট দিয়ে পাঁচশ গ্রাম আলু মেলে, ঠেলা গাড়ি করে আসে বস্তা বস্তা নোট যার মাত্র একদিকে ছাপা অন্য পৃষ্ঠায় হাতের লেখা করা যায় , জার্মানি হারিয়েছে সকল কলোনি – এখন আওয়াজ ওঠে আমাদের যেতে হবে পুব  দিকে, দখল করতে হবে স্লাভিক দেশগুলিকে  তাই তো বিজয় স্তম্ভের স্ট্যাচু , ব্রানডেনবুরগ ফটকের ঘোড়া চেয়ে আছে সেদিকে , পুবের পানে ধাও,  দ্রাং নাখ অস্টেন ( নাৎসিদের রাজ্য দখলের চোদ্দ  বছর বাকি ),   রাশিয়াতে কমিউনিস্ট  বিপ্লব থেকে পলাতক ধনী এমিগ্রেরা আয়েসে বসবাস করেন গ্রুনেভালডের ভিলাতে সেখানে ছোটে শ্যম্পেনের ফোয়ারা, এক ডজন রাশিয়ান পত্রিকা বেরোয় রোজ , তার একটির নাম  আহ্বান (প্রিজভ )  ; সেখানে সম্পাদক ফিওদোর ফিনবেরগ  লিখলেন ইহুদিরা আমাদের সমস্যা , একমাত্র সমাধান তাঁদের ঝাড়ে বংশে হত্যা করা ( হিটলার সবে  সাত নম্বর সদস্য হিসেবে জার্মান শ্রমিক  পার্টির খাতায়  নাম লিখিয়েছেন), ,  ইনফ্লেশন-  আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি-  বহু হাজার বছরের পুরনো বারটার প্রথা ফিরে এলো , ট্রামের ভাড়া বাড়ে দিনে তিনবার ।  তারই মাঝে আরেক বার্লিন,  বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তার মুক্ত প্রকাশ , সহিষ্ণুতা,  অসহিষ্ণুতা-  লম্বা ছুরির রাত , মারামারি কাটাকাটি লেগে আছে, গ্যাং ওয়ার খুন নিত্যি দিনের ঘটনা , খবরের কাগজে হেড লাইন পায় না ।

    তিন চতুর্থাংশ প্রটেস্টান্ট , বিদেশ মন্ত্রী , পুলিশের সহকারি কমিশনার ইহুদি। 

    সারা  বার্লিনে বয়ে যায়  শিল্প , চিত্রকলার,  সঙ্গীতের সুরধুনী,  মঞ্চে নগ্নতা, পোশাকে আশাকে বা  তার অভাবে কোন সীমারেখা নেই, বার্লিনের স্টেজে যৌনতার , আদি রিপুর সকল প্রকাশ – পুলিশ প্রেসিডেন্ট নগ্ন নৃত্য বন্ধ করতে চাইলেন,  আফিং কোকেনের সেবন হয় ডজন ডজন ক্লাবে , অবক্ষয় শব্দ তার মূল্য হারিয়েছে অনেক দিন , সাহিত্যে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন হাইনরিখ মান ( কাইজার ট্রিলজি ), কার্ল জুকমায়ার ( কপেনিকের পুলিশ প্রধান )  এরিখ কেসটনার ( ফাবিয়ান, এমিল দি ডিটেকটিভ),  মার্ক শাগাল , মাক্স লিবারমান এঁকে চলেছেন মাষ্টারপিস,  ফুরটভাংলার কন্ডাক্ট করেন সিম্ফনি , একদিন হাফ প্যান্ট  পরে মোটা মতন একটি ছেলে স্টেজে উঠলে তিনি অবাক হলেন, কিঞ্চিৎ বাদে অভিভূত হলেন ইহুদি মেনুহিনের বেহালা বাদন শুনে, প্রথম সবাক চলচিত্রের আবির্ভাব, ক্যাবিনেট অফ ডক্টর ক্যালিগারি , ভিক্টর /ভিক্টোরিয়া ( আপনারা ইংরেজি ভার্শনে জুলি অ্যানদ্রুজকে দেখেছেন),  সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গড়ে উঠেছে হলিউডের পরে বিশ্বের বৃহত্তম সিনেমার স্বর্গভূমি, আইনস্টাইনের ( ১৯১৪-১৯৩৩ )  পাশাপাশি ফ্রিতস লাঙ্গ , এরনস্ট লুবিচ , মাক্স রাইনহারড, বিলি ওয়াইলডার , আলেক্সান্দার করডা, এমিল ইয়ানিংস, সেরগেই আইজেনস্টাইন, মারলেনে দিয়েত্রিশ - অবিস্মরণীয় ব্লু অ্যানজেল।

    তাঁদের অনেকে বিখ্যাত হবেন হলিউডে - লুবিচ পরিচালনা করেন হেভেন ক্যান ওয়েটের মতো ছবি , তিনবার শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জন্য মনোনীত হবেন, ফ্রিতস লাঙ্গ দেবেন স্কারলেট , উওমান ইন দি উইন্ডো ; বিলি ওয়াইলডার দেবেন  ডাবল ইনডেমনিটি, সেভেন ইয়ার ইচ ,সানসেট বুলেভারড ,সাম লাইক ইট হট ; এমিল ইয়ানিংস , আজ অবধি একমাত্র জার্মান যিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার  অস্কার পেয়েছেন, উইটনেস ফর প্রসিকিউশন , জাজমেনট অ্যাট নুরেমবেরগ ছবির জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মারলেনে দিয়েত্রিশ ।  

    বার্লিন রাইনিকেনডরফের খোলা মাঠে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে রকেট ওড়ানোর প্র্যাকটিস করছে  সতেরো বছরের একটি ছাত্র।  তার নাম ভেরনহার ফন ব্রাউন - পরবর্তী কালে ভি ওয়ান ভি টু এবং নাসার স্যাটার্ন রকেটের পিতা ।

    অফেনবাখের রোজেমারি ময়জা আমাকে বলেছিল, আরেকটু সময় পেলে আমরাও...

    এই তিরিশ বছরে  তেইশ জন বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেলেন  যারা বার্লিনে কাজ করেছেন।  

    থিয়েটারের বাইরে গুলির  শব্দ , আন্তন কু বলেন, নাটক দেখো মন দিয়ে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছেন  এক যুবক - এমন দুর্বল সে পাঠ, দর্শকরা হাতের কাছে যা পান তাই ছোঁড়েন মঞ্চের উদ্দেশ্যে ।  পরিচালক এগিয়ে এসে বললেন পৃথিবী আপনাদের এই অভদ্রতা  দুদিন বাদে  ভুলে যাবে , মনে রাখবে বেরটোলট ব্রেখটকে ।  মাত্র তেইশ বছর বয়েসে তিনি  পেলেন জার্মান নাট্য জগতের শ্রেষ্ঠ সম্মান, ক্লাইসট পুরস্কার , যার তিন পয়সার পালা জমজমাট , হাউস ফুল প্রত্যহ ;  নয়ে প্রয়শিশে পত্রিকার নাৎসি সমালোচক লিখলেন, কেবলমাত্র  নিয়মিত নিদ্রাহীনদের জন্যে এ নাটকের সুপারিশ করতে পারি।  

    ব্রিটেন ফ্রান্স সুইডেন ইতালি থেকে অনেক প্রতিভা এসে আলোকিত করেন অনেক মঞ্চ । সমকালীন শাসক গোষ্ঠী,  রাজনীতিকে কঠোর ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছে ক্যাবারে - তাকে  নতুন জন্ম দিয়েছে বিশের দশকের  বার্লিন  সম্পূর্ণ নির্ভীক সেই ক্যাবারে একদিন নাৎসিদেরও রেয়াত করে নি ।

    তারই পাশাপাশি ইঙ্গিত পাই বার্লিনের আসন্ন পালা  বদলের -ঈশারউডের গুডবাই টু বার্লিন ,  লিজা মিনেলির ক্যাবারে ছবিতে , টুমরো বিলংস টু মি  গানে !

    দ্বিতীয় পর্ব

    ওই  উজ্জ্বল দিন , ডাকে  স্বপ্ন রঙ্গিন

    নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে অবতীর্ণ হলেন এক যুগ পুরুষ যার পথের দিকে চেয়ে ছিল দেশ -

    আমরা এক ফুয়েরারের প্রতীক্ষায় আছি , যিনি মধ্য ইউরোপকে একত্র করে এক বৃহৎ জার্মানি গড়বেন ( এরনসট  হাসে, প্রেসিডেন্ট , প্যান জার্মান লিগ , ১৯১৩ )

    তাঁর লক্ষ্য ?  গ্রেগর স্ত্রাসারকে হিটলার বললেন, আগে ক্ষমতা দখল করি, , তারপরে দেখা যাবে ।

    আমরা কি চাই ?রুটি নয়, চাই জাতির  সম্মান / তার জন্য  মেনে নেবো বীরের মৃত্যু ।

    রুটিও  যোগালেন , দেশ গঠন করলেন, বিভ্রান্ত এক জাতিকে ফিরিয়ে দিলেন সম্মান , লক্ষ মানুষের  ডান হাত উঠে যায় তাঁর বন্দনায় , উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মার্চ করেন  হাজার হাজার তরুণ তরুণী , তাঁদের পাশে লাঠি  সোঁটা হাতে শাসক পুলিশ, বই পোড়ানোর উৎসব, আবার এক ৯ই নভেম্বর সিনাগগ জ্বালানোর দেওয়ালি , বার্লিন স্পোর্ট পালাসটে মন্ত্রমুগ্ধ জনতা শোনেন মুক্তিদাতার বাণী, স্বস্তিকায় ছেয়ে গেছে সকল প্রাচীর, কিছুই অসম্ভব নয় আর, মৈত্রীর বাণী বহন করে আশিটি  দেশ যোগ দেয়  বার্লিন অলিম্পিকে।  

    তৃতীয় পর্ব

    আজ জার্মানি , আগামীকাল সারা দুনিয়া

    বিশ্ববিজয়ের স্বপ্ন পূরণের সূচনা , আজ পোল্যান্ড , কাল নরওয়ে , চল্লিশ দিনে ফ্রান্স – ঠিক বাইশ বছর পরে পরাজিত ফ্রান্স নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে  কম্পিয়েনের সেই রেলের ডিব্বায় যেখানে জার্মানি একদিন শান্তি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছিল। বীরের সম্বর্ধনায় বার্লিন লোকে লোকারণ্য,  উত্তাল- উত্তর সাগর থেকে ভূমধ্য সাগরের তটে ওড়ে স্বস্তিকা , আমরা  জগত জয় করবো, বাঁচবার জন্যে বাসভূমি চাই, তাই যেতে হবে পূর্বে , রাশিয়ান অভিযান,  তারপর একদিন প্রথম বোমা পড়ে শহরের মাঝে , একদিন সোভিয়েত সৈন্য লাল পতাকা তোলে রাইখস্টাগের চুড়োয় – বার্লিনে আবার চূড়ান্ত অরাজকতা , সোভিয়েত বাহিনির নগ্ন নির্মম প্রতিশোধ । আবার ট্রামের ভাড়া তিনবার বাড়ে  এক দিনে, আবার রুটির জন্যে মানুষ বেচে  সম্মান, আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি,  আমেরিকান সৈন্যের ফেলে দেওয়া সিগারেট কুড়িয়ে নিলো মানুষ,   একটি বাড়িও দাঁড়িয়ে নেই – আমেরিকান সংবাদদাতা সে ছবি দেখিয়ে বললেন এ শহরে আর কোনদিন কোন মানুষ বসবাস করবে না । শহর দু ভাগে ভাগ হলো , একটি দ্বীপের মতো জেগে রইল পশ্চিম বার্লিন- কমিউনিস্ট পূর্ব বার্লিন হঠাৎ একদিন সেই দ্বীপে আসা  যাওয়ার সকল বন্দরের দ্বার রুদ্ধ করে দিলো , সেই প্রতিরোধের জবাব বার্লিনে  হাওয়াই জাহাজে উড়ে এলো জীবনের সামান্যতম প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

    তবু বার্লিন বাঁচে , তার হাওয়ায় উদ্ধত উল্লসিত কৌতুক । এতো বার এতো ভাবে ভঙ্গ বার্লিন, তবু রঙ্গে  ভরা , বার্লিনের রুক্ষ হাওয়ায় ভাসে গান, অনন্য হাসির  ফোয়ারা , বারলিনার ভিতস ! 
     
    হাস্যমুখে অদৃষ্টকে পরিহাস করে বার্লিন।    

    সশরীরে বার্লিন পৌঁছুব এ  ছিল ধারণার অতীত । ভাগ্যক্রমে স্বচক্ষে দেখেছি তাকে  : এবার যাবো এক স্বপ্নের , কল্পনার ভ্রমণে , অতীতের মুখোমুখি  হতে ; পথ দেখাবে সেই সময়ের অজস্র দলিল, ছবি, অনেক বই, জার্মান ও ইংরেজি, সেই সময়ের  কিছু গালগল্প ।

    ফিরে যেতেই হবে , কারণ

    বার্লিনে এখনও আমার একটা বাকসো রাখা আছে
    তাই আমাকে সেখানে আবার যেতে হবে

    ইখ হাব নখ আইনেন কফার ইন বেরলিন
    ডেসভেগেন মুস ইখ নেকসটেনস উইডার হিন

    মারলেনে দিয়েত্রিশ  
    কথা /সুর – রালফ মারিয়া জিগেল / আলদো পিনেলি
     

    মারলেনে দিয়েত্রিশ

     
    • জার্মানরা বলেন বেরলিন। আমার মৌলা , আমার গুরু আলি সাহেব বাঙালিকে পরিচয় করিয়েছেন বার্লিনের সঙ্গে,  তাঁর জুতোর সুকতলার অধম চেলা আমি । এই শহর আমারও বার্লিন ।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • ব্লগ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৫৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কুণাল চট্টোপাধ্যায় | 2409:4060:2d40:926a::9b88:fc08 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:১৮528712
  • আলি সাহেবের পর আবার হীরেনদার চোখ দিয়ে বার্লিনকে দেখলাম।
  • অসিতবরণ বিশ্বাস | 2409:4061:414:9864::28e:70b1 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:২৬528713
  • ব্রেভো, ব্রেভো।
  • Nikhil Baran Biswas | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:৫৮528721
  • হীরেন দা, আপনার এই লেখা পড়ে ধন্য হলাম। প্রণম্য মুজতবা আলীর লেখা বার্লিন তথা জার্মানিতে দীর্ঘকাল মনে মনে পড়ে ছিলাম। এই লেখা পূর্বাপর উন্মোচিত ও উদ্ভাসিত। অসাধারণ লাগলো।
  • Amit | 220.245.202.216 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০২:০৬528734
  • অসাধারন হীরেন দা। একটা পুরো পিরিয়ড ডকুমেন্টারী যেন চোখের সামনে ফুটে উঠলো। 
  • Kishore Ghosal | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:১৮528749
  • বার্লিনের পালাবদলের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরলেন, ঠিক যেন ছবির মতো।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন