এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Eman Bhasha | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:২৯528155
  • আজই তো ১৯ মাঘ।
    ১৯১০ সাধারণ অব্দ থেকে হয়ে আসছে কলেরা ঠেকাতে ওলাইচণ্ডী পূজা। হিন্দু মুসলমানের মিলিত পূজা। আমাদের পূর্ব পুরুষ হেকিম সাহেব, ফতে চৌধুরী, সরকার, চক্রবর্তী ও মজুমদার পরিবার মিলে যুক্তি করে প্রবর্তন করেন এই পূজার । কলেরা ঠেকাতে। নিয়ম হয় গ্রামের সাত পুকুরের জল নিয়ে হবে পূজা। বিয়ে শাদিতে হিন্দু মুসলমান ব্যবহার করবে সাতপুকুরের পানি।
    অর্থাৎ মা ওলাইচণ্ডীর পুকুর বলে তাকে লোকে পবিত্র ভেবে গোরু মোষ ধোওয়াবে না, শৌচকর্ম ইত্যাদি করবে না।।
    এরপর ১৯২০ থেকে শুরু হয় যাত্রার আসর। তার দুবছর পর ১২২ থেকে যাত্রাকে  ঘিরে মেলা।  
    ছবিতে আমাদের গ্রামের মাটির দোতলা বাড়ি। বারান্দাটা ইটের।
    সেই নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ আবার পড়তেও পারেন।

    ওলাইচণ্ডী পূজা ও এক আশ্চয্য মেলার ভোরের গপ্পো

    দেখতে পাচ্ছে দেখতে পাচ্ছে সেই আশ্চয্য ভোরকে। অন্যদিন লেপ কাঁথা ছাড়তেই চায় না। আজ টলটল করা পায়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করছে দু বছর এক  মাসের ছেলেটা। সবাই জেগে গেছে। কেন? একটা বছর এলে একটু  বয়স বেড়ে যায়। 

    ছেলেটা জেনে গেছে আজ মেলা। ফুফু এসে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সবাই গাদাগাদি করে শুয়েছে। কাল রাতে এতোল বেতোল গপ্প জুড়েছিল ননদ ভাজে।

     বলে আর খিলখিল করে হাসে। কী ভাব কী ভাব! 

     ফুফু বলছিল, যাই মায়ের ঘরে শুই।
    থাক না, এখানেই।

    শুনে তার কী আনন্দ। তার থেকেও ছোটো একটা ভাই আছে। সে শুয়েছে ওপাশে। মাঝে বড়দি।
    এখন মা বড়দি মেজদি কেউ নাই। তার চেয়ে এক বছরের বড় রিজিও নাই। সে বলে, লিজি। 

    কোথায় গেল?
    উঠতে যায়।
     লেপের ভার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
    ঠেলে ওঠে, কারণ নাকে আসছে বিচিত্র সব গন্ধ।
    ধনে জিরা লঙ্কা হলুদ সব গরম খোলায় ভাজছে। সে ওসব নাম জেনেছে পরে।
    ওগুলো হামানদিস্তায় পেষাই হয়ে মিশবে আলু সেদ্ধর সঙ্গে। পেঁয়াজ ভাজছে পিসি। দিদি বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। বাদামের কুচি আর কুসুম বীজের আলতো ছোঁয়া-- কী ভালো যে লাগে চপে। 
    সে গিয়ে হাত পাতে, গরম গরম বাদাম ভাজা, ভারি মজা।
    হাত পুড়ে যাবে রে কাল্টা।
    তবু সে হাত সরায় না।
    আগে মুখ ধো। তারপর।
    মুখ ধোবে?
    লাভা মাজন দিয়ে। সেটা তো সে খেয়েই ফেলবে। ঝাল ঝাল। এর চেয়ে তেল নুন ভালো।
    তে  লুন।
    আধো আধো স্বরে বলে সে।
    এমন সময় মেজবু ঢোকে, দোকান বসছে বসছে। মুখে তার হাসি। একা একাই ছুটেছে মেলাতলায়।
    এই রুবি শোন শোন। মা ডাকে।
    রুবি ইশারা করে, রিজি হাত ধরে টান দেয়। তিনজন মিলে দৌড় দেয়।
    সে পারে না, পড়ে যায়।
    কোলে করে ধরে মেজবু।
    না আমি হেঁটে।
    বাবুর সম্মানে লাগে। সে কোলে চাপবে না। কিন্তু পারেও না। একটু গিয়ে  হোঁচট খায়। আবার উঠে হাঁটে।
    কাল্টা রে, তোর জন্য মেলা শুরু দেখা হবে না।
    কী দেখবে দিদি এই সকালে? 
    মেলা তো জমবে নি। ভাবে ছোটো বোন রিজি।
    শুরু দেখাই তো আসল মজা। জমা মেলাই তো সবাই দেখে।
     

    মোতিদাদু চায়ের দোকান খুলেছে। ধোঁয়া উড়ছে। চপ বেগুনি পাঁপড় ভাজার প্রস্তুতি চলছে। ওপাশে একটা লাল রঙের কী যেন ভাজছে। পরে কাল্টা জেনেছে, ওর নাম জিলিপি। সে বলতো, জিলিবি।
    এর মাঝেই নামছে মাথা থেকে বড় বড় কাচের বাক্স। চট পাতছে।   তার আগে কমিটির লোকজন কঞ্চি পুঁতে দিচ্ছে। এই তোমার সীমানা। 
    কেউ মাথায় চট দেবে।‌ বেশিরভাগ দেবে না।
    একদিনের তো মেলা।
    বাক্সের দিকে নজর যায় তার। আংটি আর আংটি।
    ওমা ওদিকে বাঁশি আর কটকটির দোকান।  কটকট করে আওয়াজ হবে।
    তার এক্ষুনি একটা বাঁশি পেতে ইচ্ছে করে। বাঁশিওয়ালার ছেলে এয়েছে সঙ্গে। সেই বাজাচ্ছে।
    মেজবু বলে এখন না, পরে, যাই ঠাকুর দেখে আসি।
    তারা যেতে না যেতেই ঢাক বেজে ওঠে। ঘট আসছে পুকুরের জল নিয়ে।
    ঢাক বাজছে।
    ওমা কী সুন্দর ঠাকুর। বইয়ের ছবির থেকেও ভালো।
    কাল্টার চোখ সরে না।
    ও রুবি এটি তোর ছোট ভাই?
    হ্যাঁ গো। পিসি।
    একদম তোর বাপের মতো হয়েছে, তবে তোদের মতো রঙ পায় নি।
    মেজবুর ফরসা গা।
    তার রঙ কালো।  বলার কী আছে!
    তার সজল চোখ দেখে একজন চিবুক নেড়ে দেন।
    পরে জেনেছে কাল্টা, উনি রাম মামার মা। অন্নপূর্ণা দিদিমা।
    ৯০ বছরেও এখনো  সমান সজাগ। তখন দিদিমা কতো বয়স ৩৫ বড় জোর। 
    দিদিমা বলেন, ছেলের চোখ দুটো দেখেছো, ভারি সুন্দর। কালো বলিস কেন বৌ, কালো জগতের আলো।
    দিদিমাকে সেই ভালোবাসার শুরু।
    আজ ৫৫ বছর পরেও অমলিন।
    পূজা শুরু হয়।
    নাকে লেগে যায় ধুনোর অপূর্ব গন্ধ।
    যে গন্ধে সে আজো আমোদিত উদ্বোধিত।
    ধূপ আর ধুনোর গন্ধই তাকে ১০ বছর পর প্রথমে সরস্বতী পুজো তারপর দুর্গাপূজোর পাণ্ডা করে তুলবে।
    মেজবু বলে, চল চল। বাড়িতে বকবে।  
    তার ইচ্ছে আরেকটু থাকি।
    শোন তোকে আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাবো।
    কোথায়?
    মামাদের ঘর।
    লাফিয়ে ওঠে সে একটা ছোটো ভাই আছে।
    আজম নাম। সে বলে জম।
    আজম বলতে পারে না।
    তম আর জম-- দুই হরিহর আত্মা বন্ধু পরে পরস্পরকে ডাকবে।
    মেজবু গিয়েই জমকে কোলে তুলে নেয়।
    নানি চেঁচায় পড়ে যাবে পড়ে যাবে।
    ইসস আমি পারবো না!
    মেজবু বলে।
    কতো আদর করে।
    বোস রুবি।
    বসলে হবে, তোমার মেয়ে খেয়ে ফেলবে ন্না। এতেই পাড়াবেরুনি বলে কত বদনাম।
    ছুটে বের হয়ে আসে।
    এর মধ্যে আট দশটা দোকান বসে গেছে গোলামহলে।
    তারা মুন্সিদের ঘর দিয়ে শর্ট কাট করে।
    মুন্সি বাড়ির বড় মেয়ে সাত বছরে বেলা ফুফু বলে, রুবি তুই একা একা গেলি।
    একা একা কই?
    এই তো ওরা আছে?
    ওরাই সব, আমি কেউ নই?
    বেলা গাল ফুলোয়।
    চ তো এখন?
    না যাবো না!
    হিড়হিড় করে টানে।

    ও দাদি তোমার মেয়ে, তোমার মেয়েকে নিয়ে চল্লুম।
    একটা ছয় একটা সাত বছরকে নিয়ে যায়।
    ঘরে তখন দক্ষযজ্ঞ।
    চপ বেগুনি পাঁপড় ভাজা রেডি।
    হাজির সেখানে?
    কাল্টা মুখ ধুয়েছিস?
    দেখো।
    হাঁ করি আমি‌।
    হেসে ফেলে নয়  বছরের বড়বুবু।
    দাদি বলেন, কাল্টা খেতে ভালো বাসে। ওকে নিয়ে কোথায় গেছিলি বলদিনি।
    আমার মেয়ে আমার স্বভাব পেয়েছে, ঘরে মন টেকে না। বলে বাবা।
    আয় মা, মা আমার।
    দিদিকে ডাকে।
    আমাকে দাদি কোলে নিয়ে খাইয়ে দিতে যায় চপ।
    আমি বাধা দিই।
    আমি কি ছোটো আছি?  দু বছর এক মাস বয়েস।
    না হয় বেশি হাঁটতে পারি না। কোলে উঠতে হয়।
    তা বলে, নিজে খেতে পারবো না!

    খাই বটে কিন্তু মন টেকে না, ওদিকে কে একজন বাঁশি বাজিয়ে ফিরছে। টলটল করে উঠে দেখি কে?
    পাঁচিল ভেদ করে কি চোখ যায়।
    নিগ্ঘাৎ গেঁড়া।
    চপ বিস্বাদ লাগে, বাঁশি ছাড়া।
    মেজবু ছুটে বেরিয়ে যায়।
    একটু পর ফেরে।
    বলে, কাল্টা চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ।
    চোখ বন্ধ করি‌।
    মুখে দেখি, বাঁশি।

    সেই বাঁশি আজো বাজিয়ে চলেছি প্রতি উনিশে মাঘে।
    মেজবু বড়বু দাদি আব্বা মা তোমরা কি শুনতে পাচ্ছো?

    মেলা তলা দেখতে পাচ্ছো।

    ওলাইচণ্ডী ঠাকুর।
    রাম মামার মা কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
    ভোলা সরকার আর সরকার গিন্নি আকাশ থেকে দেখছেন, ১৯১০ কেমন করে বাঁচে ২০২২ -এ।

    পাশে কাল্টার বাবা এনাম দাউদ খাঁ র পার্ট আওড়াচ্ছে!
    বাংলা মাথা নত করতে শেখে নি!
  • বকলমে | 172.58.223.47 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০১:৪৬528159
  •  
     
  • তৌহিদ হোসেন | 42.110.138.71 | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:০০528257
  • অনবদ্য❤
  • শিবাংশু | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৪১528263
  • ছোটোবেলা জ্বর হলে গায়ে মায়ের হাতের ছোঁয়া যেমন লাগতো, শীতল, অথচ উষ্ণতায় মুখর , 
     
    তেমন লাগলো লেখাটি , 
  • Eman Bhasha | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:০০528272
  • ধন্যবাদ শিবাংশু
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন