এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন

    ইমানুল হক
    ধারাবাহিক | সমাজ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৪৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হ

    কথা - ৪



    প্রথম রাত কাটল মেঝেতে। প্রথম রাত কেন পরের প্রতিটা রাতই।
    কে চৌকি কেনে? তখন চৌকির দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা।
    অকারণ এতগুলো টাকা খরচ করা!
    আমি মেঝেতেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডার ধাত, তাই মাথার দিকে একটা কাঁথা দিয়ে রাখলাম। গ্রামে তো সারারাত হ্যারিকেন/ লন্ঠন নিভু নিভু আলোয় জ্বালিয়ে রাখার চল ছিল। আমি হ্যারিকেন অল্প করে জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলাম। বিদ্যুৎ আছে শহরে। কিন্তু তখন তো লোডশেডিংয়ের যুগ। মাথার গোড়ায় একটা টর্চও রইল।

    গ্রামে থাকতে ভোর তিনটের সময় উঠে সাড়ে তিনটায় বেরিয়ে চারটে পনের মিনিটে ফার্স্ট বাস ধরে বর্ধমানে টিউশন পড়ে স্কুলে যাওয়ার চল ছিল। আজ তো এত তাড়া নেই। ঘুম হল জব্বর। পাঁচটায় উঠে রান্না চাপিয়ে দিলাম। জনতা কেরোসিন স্টোভে রান্না। স্টোভটা নেভানোর সময় একটা সাঙ্ঘাতিক গন্ধ হতো। প্রাণান্তকর। কিন্তু অভ্যাস ছিল এই স্টোভে রান্নার। স্টোভের দাম তখন কত ছিল? পঁচিশ না ত্রিশ মনে পড়ছে না। (কাল শিয়ালদহ বৈঠকখানায় জিজ্ঞেস করে জানলাম, ২৫০-৩৫০ টাকা। তবে নাম জনতা স্টোভ, কিন্তু জনতা কোম্পানির নেই)। মুড়ি খেয়ে সাইকেল চেপে চলে গেলাম বাবুরবাগ অঞ্জনদার বাড়ি। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন আর অঙ্ক পড়াতেন অঞ্জনদা।
    অঙ্কে তুখোড়।

    ওখানে তখন বেশ কয়েকজন গুণী ছেলে পড়তেন। ইন্দ্রজিৎ যশ, অরিন্দম তাঁদের অন্যতম। ইন্দ্রজিৎদা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তেন।‌ তখন জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্ততি চলছে। অরিন্দম অল্প বিস্তর নকশাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে আমেরিকায় চলে যায়। ইন্দ্রজিৎদা ধনী পরিবারের ছেলে। প্রচুর ভালো ভালো বাংলা বই কিনতেন। খানিকটা অঞ্জনদার প্রণোদনায়। তখন বিশ্বসাহিত্যের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বইগুলোর অনুবাদ চলছিল বিষ্ণু বসুদের উদ্যোগে। (বর্তমান উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ও প্রখ্যাত নাট্যকার ব্রাত্য বসু তাঁর সন্তান)। পঁচিশ টাকা প্রতিটি খণ্ড। গ্রাহক করে বের হচ্ছিল। ইন্দ্রজিৎদা গ্রাহক। সবকটি খণ্ড পড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। গোগ্রাসে গিলতাম। অঙ্ক বিজ্ঞান পড়ার চেয়েও ওই উপন্যাসগুলো পড়ার দিকে বেশি ঝোঁক। এতদিন রাশিয়ান সব উপন্যাস পড়েছি। শেক্সপিয়ার, মম, ডিকেন্স, এমিল জোলা আগে পড়েছি। কিন্তু এটা আরেক দিগন্ত। এক একজন অজানা লেখক। অজানা দেশ, অভাবিত জীবন --বুঁদ হয়ে গেলাম। মনে হতো, কখন সময় পাবো। এদিকে স্কুলে খুব বেশি ক্লাস হতো না। আগে খুব মন খারাপ হতো। সারাদিন বসে রইলাম, দুটো কি বড়জোর তিনটে ক্লাস হতো। হওয়ার কথা ছটা বা সাতটা। হয় না।

    কয়েকজন শিক্ষক কামাই করতেন না। বিশেষ করে অমিতজ্যোতি সামন্ত এবং সোমনাথ বাবু।
    অসাধারণ পড়াতেন মিহির সাঁই। কিন্তু তাঁর তখন ব্যবসায় মন। পদার্থ বিজ্ঞান বিশেষ করে আলোর অংশটা এত ভালো পড়াতেন কহতব্য নয়। পরে মিহিরবাবু পড়ানো ছেড়েই দিলেন।‌পুরোপুরি বিস্কুটের ব্যবসায় মন দিলেন।
    সাঁই বিস্ক ছিল সংস্থার নাম।
    আমরা যখন 'ভাবীকাল' পত্রিকা প্রকাশ করলাম নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিতেন। বামপন্থী মানুষ।
    অন্য শিক্ষকদের কথাও বলা দরকার।
    প্রথমদিকে ভালো ক্লাস হতো না।
    পরে ঠিক হয়ে যায় অনেকটাই।
    আমরা আন্দোলনও করি এই নিয়ে।
    কিন্তু নিজেই আর ক্লাসে তত মনোযোগী থাকতে পারছিলাম না। বাইরের নানা ডাক এসে পৌঁছেছে মনে।

    আমরা যখন ভর্তি হই তখন পরিচালন সমিতি সিপিএমের।‌ অধ্যাপক কল্যাণ ভট্টাচার্য সম্পাদক। তখন বিদ্যালয়ে প্রায় ৫৫ জন শিক্ষক। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের সদস্য নন। সিপিএমের ১৩ জন শিক্ষক এবিটিএ করতেন। তাঁরা স্টাফ রুমে না বসে পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবের ঘরে বসতেন। স্টাফরুমে তখন আর এস এস করা জগজ্জ্যোতিবাবুর দাপট। জগজ্জ্যোতিবাবুর সমর্থরা প্রাপ্য সিএল ইত্যাদি নিতে শুরু করলেন। মাধ্যমিক স্তরে তত প্রভাব না পড়লেও উচ্চ মাধ্যমিক খুব ক্ষতিগ্রস্ত হল। অনেকেই এই স্কুল ছেড়ে ছেলেদের পাশের সিএমএস স্কুলে নিয়ে যেতে আরম্ভ করেছেন। এই অভিভাবকরা মজার বিষয় অধিকাংশই বামপন্থী। এমনকী তখনকার সাংসদের ছেলেও এই স্কুল ছেড়ে চলে গেল সিএমএস স্কুলে। সেখানকার প্রধান শিক্ষক তখন একজন নামকরা কংগ্রেসি নেতা। সুধীর দাঁ। সত্তর দশকে নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের দাদা হরিপ্রসাদ সেনগুপ্তকে সরিয়ে দিয়ে নিজে প্রধান শিক্ষক হন।
    ফলে বামপন্থী মহলে তাঁর খুব বদনাম। গ্রামে থাকতেই শুনেছি। কিন্তু পরে আলাপ হতে দেখলাম, দারুণ প্রশাসক। বিজ্ঞান ক্লাব করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করছেন এবং ভরসা করছেন।‌ সুধীর দাঁ সিএমএস স্কুলে একদম পড়াশোনা হয় না, এই বদনাম ঘুচিয়ে স্কুলকে খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তুললেন। শিক্ষক হিসেবে খুব সুনাম ছিল না, কিন্তু প্রশাসক হিসেবে অসাধারণ হিসেবে ১৯৮২-তে দেখা দিলেন সুধীর দাঁ। স্কুলের বামপন্থী শিক্ষকদের ডেকে বললেন, আমাদের রাজনৈতিক মত আলাদা কিন্তু স্কুলে কোনও রাজনীতি নয়। স্কুলের উন্নয়নই আসল। সিএমএস স্কুল তখন লোকে কানাকানি করতো আলু পটল বেচনেওয়ালেদের ছেলেরা পড়ে। ওমা, সুধীরবাবুর দক্ষ পরিচালনায় শহরের দুই সেরা স্কুল মিউনিসিপ্যাল স্কুল এবং টাউন স্কুলকে ছাপিয়ে উঠল। ১৯৮৪-তে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আজিজুল হক চতুর্থ স্থান পেলেন। হইহই পড়ে গেল শহরে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে যাওয়ার ঢল নেমে গেল। যদিও সিএমএসের সহকারী প্রধান শিক্ষক দেবাশিস দাশগুপ্ত, বাণিজ্য বিভাগের সিরাজবাবু আর দু একজন ছাড়া শহরের নামী শিক্ষক বলে পরিচিত তেমন কেউ সিএমএস স্কুলে ছিলেন না।
    মিউনিসিপ্যাল স্কুলে নামী শিক্ষকের ছড়াছড়ি।

    ইংরেজির কালীবাবু (তখন অবসরপ্রাপ্ত) , রাজেন নাগ, কামাখ্যাবাবু, পদার্থবিজ্ঞানে মিহির রক্ষিত, রসায়নেও মিহিরবাবু জীবনবিজ্ঞানে বলরামবাবু, বাংলায় পাঁচুগোপাল রায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী, নিত্যানন্দ মিত্র, রাধারমণ মণ্ডল, অঙ্কে মৃত্যুঞ্জয় খান, অনিলবাবু ছাড়াও শক্তিবাবুসহ বহু শিক্ষকের খুব সুনাম।
    কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলি আর কড়া প্রশাসনের অভাবে স্কুলে সমস্যা দেখা দিল।
    প্রধান শিক্ষক শিক্ষক হিসেবে কিংবদন্তি কিন্তু প্রশাসক হিসেবে কড়া হতে পারলেন না।
    ফল ভুগতে হল, ছাত্রদের। অনিয়মিত ক্লাস। বিশেষত, উচ্চমাধ্যমিকে।
    আমরা গ্রাম থেকে আসা ছেলেরা মূলত স্কুল নির্ভর। তাঁরা পড়লাম সমস্যায়।
    এই সময় লায়ন্স ক্লাব ও নিউটন সায়েন্স ক্লাবের দুটো বড় সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা হল।
    এই প্রতিযোগিতা বিদ্যালয় ও আমার জীবনে এক নতুন আলো নিয়ে এল।


    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন