এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আজও রহস্য (গল্প)

    অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ জুন ২০২৩ | ৩৪৬ বার পঠিত
  • আমার নাম অরুণ কুমার চক্রবর্তী। বয়স পঞ্চাশর একটু বেশি। আমি বর্তমানে থাকি বালিগঞ্জে। আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
    আজ আপনাদের যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি তা আদৌ ভৌতিক না অলৌকিক তা আপনারা বলবেন। আমার কাছে তা আজও রহস্য হয়েই আছে।
    শুনুন তাহলে।
    আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা।
    আমার জন্ম মাতলা নদীর তীরে এক অখ্যাত গ্রাম আসানপুরে। তখনকার সময়ে এই গ্রামের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। গ্ৰামের বাড়িগুলো দূরে দূরে অবস্থান করত। এখন অবশ্য কিছু কিছু পাকা বাড়ি দেখা যায় এদিক-ওদিক, জনবসতি আগের তুলনায় একটু বেড়েছে। তখন একটাও স্কুল ছিল না আমাদের গ্ৰামে। পাশের গ্ৰামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। সেখানেই পড়াশোনা হতো। একটি ছোট স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিল। এখন আর সেটা নেই। বদলে একটা গ্ৰামীণ হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আর একটি হাট যা বসত সপ্তাহে একবার গ্রামের পাশে বয়ে চলা নদীর তীরে। এখন বসে সপ্তাহে দুইবার।শহরের বড় রাস্তা আমাদের গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে। বর্তমানে আমাদের গ্ৰামে একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি ডাকঘর হয়েছে।
    আমাদের গ্রামের মোড়ল মশাইয়ের নাম ছিল বিমল ভট্টাচার্য। একমাত্র সারা গ্রামের মধ্যে তাঁর বাড়িটি হলো দুইতলা। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। গ্রামের সকলের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতেন। তিনি সকল সমস্যার হাসিমুখে সমাধান করতেন। গ্ৰামের মানুষেরা তাঁকে খুব ভালোবাসত। এতটাই শ্রদ্ধা ভক্তি করত যেন তিনি গ্রামের সকলের কাছে ভগবানের সমান। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম অসিত ভট্টাচার্য আর ছোটোটির নাম ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য। দুজনেই কলকাতায় চাকরি করত। এখন তাদের কী অবস্থা আমার জানা নেই। এই কাহিনি যখনকার তখন বিমল ভট্টাচার্য'র বয়স পঁচাত্তর।
    সেদিনটা ছিল শ্রাবণ মাসের কোন একদিন। দীর্ঘ চার মাস ধরে ভট্টাচার্য মশাই কি এক পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন। আমাদের গ্ৰাম ও পাশের গ্ৰাম থেকে অনেক ডাক্তার কবিরাজ শত চেষ্টা করেও যখন রোগ সারাতে পারল না তখন কলকাতায় খবর দেওয়া হলো। সেই মতো চিকিৎসা শুরু হলো। এইরকম ভাবে চলতে চলতে এক শনিবার সকালে তিনি দেহ রাখলেন। এমন ঈশ্বরতুল্য মানুষের মৃত্যুতে সারা গ্ৰামের লোক জড়ো হলো তাঁর বাড়ির সামনে। খবর পাঠানো হলো কলকাতায় ছেলেদের কাছে।
    বড় আর ছোটো ছেলের ফিরতে রাত হয়ে গেল। অফিস করে এত দূর গ্ৰামে আসতে সময় তো লাগবেই আর তাছাড়া তখন এই সব গ্ৰামের দিকে এত যানবাহনও ছিল না।
    শবদেহ নিয়ে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল যদিও সেই সময় কিছুটা ধরেছিল। ঠিক হলো গ্ৰামের জনা দশেক ছেলে যাবে আর মোড়ল মশাইয়ের বাড়ির দশজন লোক যাবে শ্মশানে। মোট কুড়ি জন। আমিও সেই জনা দশেকের মধ্যে একজন।
    একে শ্রাবণ মাস তায়ে গ্ৰামের মেঠো রাস্তা কাদায় একাকার। ঠিকমতো পা ফেলা কঠিন। তাও আমরা অনেক হ্যারিকেন আর মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে চললাম "বল হরি হরিবোল" বলতে বলতে শ্মশানের উদ্দেশ্যে। যেখানে নদীর ধারে হাট বসত তার থেকে পাঁচ কিমি উত্তরে শ্মশান। এই শ্মশান গ্ৰামের বাইরে অবস্থিত। যখন পৌঁছানো হলো তখন শ্মশান একেবারে শান্ত। এতটাই নিস্তব্ধ যেন এ পরিবেশ পৃথিবীতে নয় বরং তার বাইরে অবস্থিত। চারিদিকে মরার মাথার খুলি শবের গায়ে জড়ানো গামছা চাদর ভাঙা লাঠি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। গ্ৰামের শ্মশানে এমনিতেই বেশি লোক থাকে না। তার উপর এই বাদলার রাতে খুব একটা প্রয়োজন না হলে কে আসবে এই মরার দেশে?
    আমরা কয়েকজন মিলে কাঠ জোগাড় করে চুল্লি সাজালাম। কাঠ ভিজে ছিল বলে ভালো করে আগুনও ধরতে চাইছিল না। তাও আগুন ধরানো হলো কোনরকমে। বড়ছেলে মুখে আগুন দিল।
    প্রায় মিনিট পনেরো পরে আবার শুরু হলো বৃষ্টি। মৃতদেহ সম্পূর্ণ দাহ হয়নি তখন। আগুনের উপর বৃষ্টির জল পড়াতে আগুন ক্রমশ নিভে আসছিল।শ্মশানে একটাও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না শবযাত্রীদের জন্য। আমরা বাধ্য হয়েই গ্ৰামের মুখ ধরলাম। কী করব এই ফাঁকা শ্মশানে বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক? আর যখনই বৃষ্টি হচ্ছে একেবারে ঝমঝমিয়ে।
    আমরা কিছুটা এগিয়ে এসেছিলাম। হঠাৎ অসিত চিৎকার করে বলে উঠল,"একী ও কে?"
    আমরা সেই মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকালাম। অত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না কিছুই তার উপর বৃষ্টি। মাঝেমাঝে আকাশ রাঙিয়ে একটা দুটো বিদ্যুতের রেখা ঝলসে উঠছিল। সেই আলোয় দেখলাম একটা রোগা শীর্ণ মতো লোক ভট্টাচার্য মশাইয়ের শবদেহের উপর ঝুঁকে কি যেন করছে।
    ঠিক যেন একটা ছায়ার গায়ে কেউ মাংস বসিয়েছে এমনই দেখতে লাগছিল লোকটাকে। ততক্ষণে আগুন প্রায় নিভে এসেছে। অর্থাৎ মৃতদেহ সম্পূর্ণ দাহ হয়নি। আমরা সবাই অবাক এই দৃশ্য দেখে!ইন্দ্রজিৎ চিৎকার বলে উঠল, "এই কে রে? কী করছিস ওখানে?"
    সেই চিৎকার শুনে মৃতদেহ থেকে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকালো লোকটা। আবার আকাশে কড়কড় করে উঠল একটা বিদ্যুতের রেখা। দেখলাম ওই রোগা শীর্ণ লোকটার দুই চোখ আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। ওই বৃষ্টির মধ্যে ভিজে জানি না অন্য কার কী অবস্থা হয়েছিল অন্তত আমার সারা শরীরের ভেতর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা হিম স্রোত বয়ে গেল! এই দৃশ্য দেখে আমরা কেউ সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকিনি। দৌড় দিয়েছিলাম গ্ৰামের উদ্দেশ্যে।
    এরপর কেটে গেছে বহুবছর। আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। কলকাতার কলেজে ভর্তি হলাম। পরে একটা চাকরি জোটালাম। এখনও মাঝেমধ্যেই ঐ দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন ভাবি এই ইঁট কাঠ পাথরের কলকাতায় ঐ ঘটনা কিছুই নয়। সম্পূর্ণ অবাস্তব। কিন্তু মন তখন জানান দেয় গ্ৰামের ঐরকম পরিবেশে অনেক সময় এইসব অবাস্তব ঘটনাও বাস্তব হয়।
    আমি আজও বুঝতে পারিনি ঐ রোগা শীর্ণ লোকটা কে ছিল?

    ২৮/০৬/২০২৩
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:502:e060:328:831:813e:800f | ২৮ জুন ২০২৩ ২১:৪৮520797
  • ও তো ভুত, ভুত। অলৌকিক টলৌকিক অন্য কোনো রহস্য নেই। ওরকম আগুনের ভাঁটার মত চোখ ওয়ালা, রোগা আর শীর্ণ, এসব ভুতরাই হয়। হয়তো ভটচাজ মশাইয়ের কাছে পুরীর মহাপ্রসাদ খুঁজতে এসেছিলো। একটু খাইয়ে দিলেই দেখতেন মুক্তি পেয়ে চলে যেতো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন