ষোলোশো আঠাশের দোসরা ফেবুয়ারি, শহর লাহোরের থেকে কিছু দূরে কেল্লায় এক ঘুপচিতে বেতখত হয়ে যাওয়া বাদশাহ দাওয়ার বক্স দাবা খেলছিলেন ভাই গার্শপের সঙ্গে। সময়? এই তো মুশকিল, সময় নিয়ে কে ভেবেছে সে দিন! গার্শপ কথাটার মানে দানবহন্তা কিন্তু হিন্দুস্থানী প্রথায় দাবাতে রাক্ষস খোক্কস মারার গল্প নেই। দাওয়ার বক্স বাবা শাহাজাদা খুসরুকে প্রায়ান্ধ দেখেছেন বরাব্বর, গার্শপও। তারপর বাবা পেটের ব্যথায় ছটফট করতে করতে মারা যান বুরহানপুরের কেল্লায় সেও দেখেছেন দুই ভাই। সেটা বিষ দিয়ে সবাই জানে, তারপর থেকে এই দুই ভাই অনবরত বিষেরই অপেক্ষা করে থাকেন। কোথাও কি আর্তনাদ শোনো গেল? খুব তাড়াতাড়ি, খুব ধারালো উঁচুমানের ইস্পাত দিয়ে বানানো ছুরি দিয়ে নলি কাটলে একরকমের হাওয়া বিদারী আওয়াজ হয়। আসলে সেটা আওয়াজ কিনা সন্দেহ আছে, শব্দের ধাতবতা তাতে নেই শুধু হওয়াতে হাওয়া মেশে না হলে যুদ্ধের এতো আর্তনাদ সব কানে সারাক্ষণ বেজেই চলতো। তাই ওই সামান্য আওয়াজে দিমাগ খারাপ হল না দুই শাহজাদার। কখন যে রাজা বাহাদুর তাঁর বিশ্বস্ত গোটা কয় চেলাকে নিয়ে হাজির হয়েছেন টেরটাও পেলো না তারা। ফলে বাধ্য হয়েই রাজা বাহাদুরকে শাহাজাদাদের খেলা থামানোর জন্য গলা খাঁকারি দিতে হচ্ছে। এ দুজনের যেন মৃত্যু মুখে কোন উত্তাপ নেই। রাজা বাহাদুর বললেন, ''হুজুর"। দাওয়ার বক্স এই লোকটাকে বাবার ঘর থেকে বার হয়ে যেতে দেখেছিলেন বুরহানপুরের কেল্লায়। তারপরই তার বাবা শাহাজাদা খুসরু মারা যান কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছটফট করতে করতে। এ আসার মানেটা কী তিনি বুঝতে পারলেন। এমনিতেই দাওয়ার বক্স অচঞ্চল, বিশেষত কিছুদিন বাদশাহ হবার পর কারুর দিকে না না তাকিয়ে আদেশ করতে শিখেছেন, তাই দাবার টেবিল থেকে মাথা না তুলে বললেন, ''আর একটু খেলব।''
----- না হুজুর।
----- কেন ?
----- হুকুম হুজুর।
----- কার?
----- শাহেনশার হুজুর।
----- কবে থেকে?
----- কালই বাদশাহ শাজাহানের নাম খুতবা পড়া হয়েছে হুজুর। বান্দা হুকুম তামিল করতে এয়েচে।
দাওয়ার বক্স বোঝেন। রাজা লোকটা যখনি আসবে মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকে। সে মৃত্যুর খুবই তাড়া তাই যা করার রাজাকে তাড়াতাড়ি করতেই হয় আরকি। কিন্তু গার্শপ না বেয়াদবি করে! ভয়ে চিৎকার না করে ওঠে! তাই অত্যন্ত শান্ত চোখে ভায়ের দিকে চেয়ে বিদ্রুপ করে ওঠেন দাওয়ার বক্স, ''ওরে এ মালটা দিলদার রাজা নয়, বদ নসিব কাজা-নিয়তি"। এর পরপরই দুই শাহজাদাকে পরপর বা একসঙ্গে গলার নলি কেটে দিলে আরো কিছু হাওয়া ফিসফিসিয়ে বেরিয়ে গেল, কোন আর্তনাদ হয়নি। দাওয়ার বক্সের টিটকিরির গল্পটা পাক খেয়ে ঘুরে ফিরে গোটা হিন্দুস্থানে শাহী গুমরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে রয়ে যায় দেড়শো বছর। গোপনে উচ্চারিত সে কিস্সা সরব হচ্ছে, শানাওয়াজ খান আর তাঁর ছেলে আব্দুল হাই লিখে রাখছেন মসির-উল-উমারা বইতে।
লাহোরওয়ালাকে এইসব তারিখ বেত্তান্ত জিজ্ঞাসা করাতে উনি লাহোরের গলিঘুঁজি দিয়ে হাঁটতে বললেন যেন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় তারিখের অন্দরে। একবার হাঁটতে শুরু করলে কি থামা যায়? হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাচ্ছেন দাতা দরবার থেকে ভাট্টি গেট। সেখানে বড় বড় মাটির তন্দুর তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে বাহারি হুঁকো আর গড়গড়া। গজনীর মামুদের কাছে পেশাওয়ারের যুদ্ধে সাতাশে নভেম্বর একহাজার একে হেরে রাজা জয়পাল জহর ব্রতের আগুনে আত্মাহুতি দিলেন মরি গেটের একদম পাশের একটা জায়গায়। সেখানে থেমে যাচ্ছেন লাহোরওয়ালা আর লিখে রাখা এক ফলক দেখিয়ে লাহোরের এই বীর সন্তানের কথা বলতে থাকেন, বলতেই থাকছেন তিনি। দাওয়ার বক্সের টিটকিরির গল্পটা শুনেছেন কিনা জানতে চাইলে কয়েক পংক্তি আউড়ে দিলেন উনি আর তাতে আর যাই হোক লাহোর আর যত লাহোরির সম্পর্কে একটা ধারণা তো পাওয়া গেল। জনাবের পেশ করা শায়েরি শাহী লড়াইয়ের বাইরে অনেক চওড়া দিল ইতিহাস চিনিয়ে দেয়। সেখান থেকে আস্তে আস্তে মাজারের ধূপের ধোঁয়া হয়ে দম পখত খুশবু ফেনিয়ে দিচ্ছে মাথা ও দিল। জনাব যেন মেহফিল বসিয়েছেন -
উঁচ্চে বুরজ লহোরদে যিথে
বুলদে চার মিশাল
এথে মিঁয়া মিরদে বস্তি
এথে শা জামাল
এক পাশে দা দাতা মালক
এক থা মাধো লাল।
উঁচু ওই লাহোরের বুরুজের
হল চার বাতিঘর
এখানে থাকেন পির মিঁয়া মির
আর পির শা জামাল
এদিকের মালিক হলেন পির দাতা
অন্য দিক পির মাধোলালের
লাহোরওয়ালার গমগমে অথচ ফিসফাস উচ্চারণ কেলেহ এ লাহোরের দেওয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে। মুছে দেবে কালচে হয়ে আসা রক্তের দাগ।
উপল মুখোপাধ্যায়ের আলমগীর উপন্যাসের অংশ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।