এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কল্যাণী কাজী - বঙ্গ সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতিভূ

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ মে ২০২৩ | ৪৩৬ বার পঠিত
  • শুধু গান দিয়ে বিচার করলে খুব ভুল হবে, মাননীয়া কল্যাণী কাজী ছিলেন বঙ্গ সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিভূ। শ্বশুরমশাই ছিলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক আকাশের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, রবি ঠাকুরের তীব্র আলোর পাশাপাশি সম্পূর্ণরূপে রবি প্রভাবমুক্ত নিজস্ব আলোয় আলোকিত এক ধ্রুবতারা, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা বাঙালিরা সেইভাবে পায়নি কারণ ইংরেজদের অত্যাচার। তিনি জীবনের একটি বিরাট অংশে নিশ্চল হয়েছিলেন সেই পাশবিক অত্যাচারের কারণে। বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সংস্কৃতি বঞ্চিত হয়েছে সেই কারণে। কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাধারায় কয়েকশো যোজন এগিয়ে ছিলেন। তিনি প্রথমে বিবাহ করেছিলেন নার্গিস আসার খানমের সাথে, কিন্তু সেই বিবাহ বাসর ঘর অব্দি পৌঁছতে পারেনি। ঘর জামাই থাকার প্রস্তাব কবি নজরুল অস্বীকার করে সেখান থেকে পালিয়ে যান। এরপরে তিনি শ্রীমতী প্রমীলা বা আশালতা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। এই প্রমীলা দেবীর গর্ভে চার সন্তান হয়, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী  এবং কাজী অনিরুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের মতোই নজরুলকেও জীবদ্দশাতেই সন্তানদের মৃত্যুর মত অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। প্রথম দুই সন্তান জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। কাজী সব্যসাচী ছিলেন একজন বিখ্যাত আবৃত্তিকার। আর কাজী অনিরুদ্ধ ছিলেন বিখ্যাত গিটার বাদক। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কাজী অনিরুদ্ধ ১৯৭৪ সালে মারা যান, তখনও কবি জীবিত। 

    কাজী অনিরুদ্ধ বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন কল্যাণী কাজীর সাথে ১৯৫২ সালে। ১৯৭৪ সাল অব্দি যে বন্ধন অটুট ছিল। শ্বাশুড়ী প্রমীলা দেবীর মত কল্যাণী দেবীও হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। আবার কল্যাণী দেবীর সন্তানেরাও হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছেলেমেয়েদেরকেই বিবাহ করেছেন। বাস্তবে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারে এই ধারা চলে আসছে কবির প্রমীলা দেবীকে বিবাহ করার সময় থেকেই অর্থাৎ ১৯২৪ সালের ২৫ শে এপ্রিল থেকে। আবার বিগত একশো বছর ধরে কবির পরিবারে যে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সন্তানেরা বিবাহসূত্রে আত্মীয়ে পরিণত হয়েছে তাদের কাউকেই ধর্ম পরিবর্তন করতে হয়নি। যে যার নিজের ধর্ম পালন করেছে, তাতে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি।

    কাজী অনিরুদ্ধকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে। কিন্তু বাইশ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি হয় ১৯৭৪ সালে। এরপরে কাজী অনিরুদ্ধের সন্তানদের আগলে রেখেছেন বুকে করে, মানুষ করে তুলেছেন। প্রথম সন্তান কাজী অনির্বাণ পশ্চিমবঙ্গের একজন গুণী অঙ্কন শিল্পী, দ্বিতীয় সন্তান কাজী অরিন্দম পিতার মতোই একজন উচ্চস্তরের গিটার বাদক। আর ছোট মেয়ে কাজী অনিন্দিতা একাধারে নজরুলগীতি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আবার জনপ্রিয় টিভি সঞ্চালিকা। কাজী অনিরুদ্ধ যেমন তাঁর কবি পিতার সৃষ্ট অমর সুর সম্পদ সংরক্ষণের কাজে লিপ্ত ছিলেন, নজরুলের দুষ্প্রাপ্য লুপ্ত, অর্ধলুপ্ত গানের সুর উদ্ধার, স্বরলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশের মাধ্যমে কবির সৃষ্টিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন সারাজীবন। তেমনি কাজী অনিরুদ্ধের মৃত্যুর পরে সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। অবশ্য এই কাজে কবির আর এক পুত্র ও পুত্রবধূ কাজী সব্যসাচী এবং কাজী উমাও সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তবে কাজী সব্যসাচী এবং কাজী উমা দুজনেই ১৯৭৯ সালে মারা যান, ফলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ মূলতঃ এগিয়ে নিয়ে যান কল্যাণী কাজী এবং কবির দুই পুত্রের বংশধরেরা। কবির অনেক অগ্রন্থিত কাহিনীর সাথে বাঙালীর পরিচয় করিয়েছিলেন কল্যাণী কাজী। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাকাডেমীর উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য। সারাজীবন নজরুলগীতি আর কবির বিভিন্ন সৃষ্টির সংরক্ষণের কাজ করে গেছেন। একজন অতি উচ্চ মানের গায়িকা ছিলেন তিনি।

    ধর্মের ওপরে উঠে মানবতার জয়গানের যে যাত্রা বিদ্রোহী কবি শুরু করেছিলেন সেই যাত্রার একজন সফল ধারক এবং বাহক ছিলেন কল্যাণী কাজী। কবি পত্নী যেমন ধর্ম পরিবর্তন না করেও শেষ ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন কবরে শায়িত হওয়ার এবং কবির জন্ম ভিটেতে শায়িত আছেন তিনি। তেমনি কল্যাণী কাজীও সারাজীবন পিতৃধর্ম পালন করে স্বইচ্ছায় কবরে শায়িত হবেন। আজ আমরা প্রকৃত বঙ্গ সংস্কৃতির একজন ধারক ও বাহককে হারালাম।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • M. Emad | 2a02:c7c:d580:9900:b88e:6b91:82d3:d99 | ১৩ মে ২০২৩ ১৯:২৫519766
  • . . .  'আমরা প্রকৃত বঙ্গ সংস্কৃতির একজন ধারক ও বাহককে হারালাম।' 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন